গারোরা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় ও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোণা অঞ্চলের গারো পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চল, মধুপুর ও সিলেটে বসবাসকারী আদিবাসী। এরা মোঙ্গলীয় জাতিসত্তার তিব্বতী-বর্মণ জাতিগোষ্ঠীর বোড়ো শাখাভুক্ত। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মত গারোদের সামাজিক বিবাহের রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রথা। তবে ভারতের গারো এবং বাংলাদেশের গারোদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। বাংলাদেশের গারোদের বেশিরভাগই খ্রিষ্টান। তবে বেশিরভাগ গারোর মধ্যে এখনো রয়েছে তাদের প্রাচীন গোষ্ঠীপ্রথায় প্রচলিত বেশ কয়েকটি বিবাহরীতি।
দোন্দকা বা দোবুক নিয়া
দোন্দকা বা দোবুক নিয়া মূলত আনুষ্ঠানিক বিবাহরীতি। এটিই গারোদের প্রথম স্থানীয় বিবাহ অনুষ্ঠান। আদি গারো উপগোষ্ঠীর সকলেই দোন্দকা রীতি পালন করে থাকে। এই বিয়েতে প্রয়োজন হয় চু, দোরাসং বা একটা বড় মোরগ এবং মুরগী। বড় মোরগটি কেবল পাত্রপাত্রীর অনাত্মীয়রাই খেতে পারে। তবে অন্যান্য মোরগ ও মুরগী আগুনে পুড়িয়ে দেবতার জন্য উৎসর্গ করে, তারপর সকলে খায়। নবদম্পতির ভবিষ্যৎ শুভ কি অশুভ তা জানার জন্য কর্মকারী পুরোহিত মোরগ-মুরগীর অন্ত্র পরীক্ষা করেন। অন্ত্রগুলোর বড়শি আকৃতির অংশের আকার ও আয়তন সমান হলে ধরে নেয়া হয় নব-দম্পতির ভবিষ্যত শুভ। অতঃপর পুরোহিত বর ও কনের পিঠে বন্ধ মুষ্টির তিন আঘাত করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন।
টু-নাপা
টু-নাপা হলো বাসর বিয়ে। এই রীতিটি আদি গারো সম্প্রদায় এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারোদের মধ্যে এখনো প্রচলিত রয়েছে। বিয়ে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী তাদের নিজ ইচ্ছায় একই বিছানায় শয়ন করে। সাধারণত অভিভাবকদের অনুমতিতেই তা হয়ে থাকে, কিন্তু কখনো কখনো অভিভাবকদের অজান্তে প্রেমের সম্পর্ক হলে পাত্র-পাত্রী এই রীতিতে নিজেরা বিয়ে করে এবং অবশ্যই উভয়ের মধ্যে যৌন সংসর্গ হয়ে থাকে। যৌন সংসর্গ না হলে প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য বলে বিবেচিত হয়। ছেলে অথবা মেয়ে কেউ যদি জোর করে টু-নাপা করে তাহলে তাকে জরিমানা দিতে হয়।
দক-চাপা বা অনচাপা বা অননা-চাপা
দক-চাপা বা অনচাপা বা অননা-চাপা হল সপত্নী গ্রহণ। এই প্রথা অনুযায়ী একজন পুরুষ একজন বৃদ্ধা ও একজন যুবতীকে একত্র বিয়ে করতে পারে। প্রায় ক্ষেত্রে বৃদ্ধাটি যুবতীর মাতা হয়। কিন্তু যৌন সংসর্গে মাতা ও কন্যা উভয়েরই সমান অধিকার থাকে। পরিবারের মধ্যে অবশ্য বৃদ্ধা পত্নীরই কর্তৃত্ব থাকে এবং সেই সম্পত্তির অধিকারিণী হয়। তার মৃত্যুর পর উক্ত সম্পত্তি কন্যা সপত্নীর অধিকারগত হয়।
আর একটি সপত্নী গ্রহণ প্রথা আছে। সেটিকে ‘নকমা-রা’ বলা হয়। এই প্রথায় বৃদ্ধা পত্নী নিঃসন্তান হলে স্বামী একজন যুবতী পত্নী গ্রহণ করে । বৃদ্ধার মৃত্যুর পর যুবতী পত্নী সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়। কিন্তু বৃদ্ধার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত যুবতী পত্নী রান্নাবান্না ও জমির কাজকর্মাদি করে থাকে যা বৃদ্ধা আর করতে পারে না। যদি উভয় পত্নীরই মৃত্যু হয়, তবে তাদের সগোত্র আত্মীয়বর্গ বিপত্নীককে আর একটি পত্নী দিতে বাধ্য থাকে।
শেক্কা
শেক্কা বিয়ে বলতে বোঝায় নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একে অপরকে নিজ ইচ্ছায় গ্রহণ করে বসবাসের জন্য অন্য কোথাও চলে যাওয়া। যদি অবিবাহিতদের মধ্যে শেক্কা বিয়ে ঘটে তবে আ’খিম বা মিমাংসার বাধ্যবাধ্যকতা থাকে না। তখন সাধারণত কোনো জরিমানা করা হয় না এবং তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করতে দেওয়া হয়। কিন্তু কখনো কখনো নারী-পুরুষ উভয়কে জোরপূর্বক পৃথক করা হয় এবং তাদেরকে প্রহার করা হয়।
যদি একপক্ষ বিবাহিত ও অন্যপক্ষ অবিবাহিত হয়, বিবাহিত পক্ষের আত্মীয়বর্গ অবিবাহিত পক্ষের আত্মীয়বর্গের কাছ থেকে জরিমানা আদায় ও ভোগ করে। যদি উভয় পক্ষ বিবাহিত হয়, তবে উভয় পক্ষেরই আত্মীয়বর্গ জরিমানা দিতে বাধ্য।