হেনরি ডেভিড থরো II হোমেন বরগোহাঞিII অসমিয়া থেকে অনুবাদ : বাসুদেব দাস

১৮৪৫ সনে ডেভিড থরো ‘ওয়ালডেনে’ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দু’বছরের বনবাস আরম্ভ করার সময় একদিনের জন্য তাকে জেলের ভাত খেতে হয়। সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করাটাই ছিল তাঁর অপরাধ। করের টাকা ছিল খুবই সামান্য, কিন্তু সেই সামান্য টাকাকেই তিনি এই যুক্তিতে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন যে, যে সরকার দাস প্রথা এবং সমরসজ্জা সমর্থন করে সেই সরকারকে কর দিতে তিনি নৈতিকভাবে বাধ্য নন। এই অপরাধের জন্য তাঁর একদিনের কারাবাস হল। জেল থেকে রেরিয়ে এসেই থরো তাঁর সামাজিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারা লিপিবদ্ধ করে একটা ছোটো বই লিখলেন। নাম ‘Civil Disobedience’ সরকারকে কর না দেওয়ার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে থরো তাতে লিখলেন: ‘যে সরকার দাসদেরও সরকার, সেই সরকারকে এক মুহুর্তের জন্যও আমি আমারও সরকার বলে মেনে নিতে পরি না।’ কর না দেওয়াটা সোজাসুজি একটা আইন বিরোধী কার্য। আইনের বিরোধিতা করার নৈতিক যুক্তি দেখিয়ে তিনি লিখলেন:‘অনেক আইন আছে যা ন্যায় ও আদর্শের পরিপন্থী। সেই সমস্ত আইন আমরা মেনে চলব, না কি মুহুর্তের মধ্যে সেই সমস্তকে উলঙ্ঘ করব? আইনের প্রতি অবাধ্যতাই হলো সেই সমস্ত অন্যায় আইনের বিরোধিতা করার এবং তা সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায়।’ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সমস্ত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশে তিনি পুনরায় লিখলেন: ‘যে সরকার অন্যায়ভাবে একজন মাত্র মানুষকেও জেলে ভরে সেরকম সরকারের অধীনে প্রতিটি ন্যায়পরায়ণ মানুষের জন্য জেলই হলো একমাত্র যোগ্য বাসস্থান।’
হেনরি ডেভিড থরো একথা লেখার পর প্রায় ৭৫ বছর পরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামে একজন প্রৌঢ় ভারতীয় যখন বিদেশী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য উপযুক্ত অস্ত্রের সন্ধান করছিলেন সেই অস্ত্র তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন থরোর ‘Civil Disobedience’ নামের সেই ক্ষুদ্র গ্রন্থটির মধ্যে। গান্ধীজির যুগান্তকারী আইন-অমান্য বা অসহযোগ আন্দোলনের প্রেরণার উৎস ছিল হেনরি ডেভিড থরো, সেকথা গান্ধীজি নিজে মুক্তকন্ঠে এবং কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করে গেছেন।
আমেরিকান সমাজবাদী নেতা ইউজিন দেবস নিজের বিবেকের দোহাই দিয়ে ১৯১৮ সনে সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি আদালতে বিচারের সম্মুখীন হলেন। হেনরি ডেভিড থরোর তেজোদ্বীপ্ত অমর ঘোষণার প্রতিধ্বনি করে সেদিন ইউজিন দেবস দৃপ্তকন্ঠে বিচারককে বলেছিলেন- ‘অনেক বছর আগেই সমস্ত জীবিত প্রাণীর সঙ্গে আমি আমার আত্মীয়তা স্বীকার করে নিয়েছিলাম। তখনই আমি এ কথা স্থির করে নিয়েছিলাম যে পৃথিবীর নীচতম প্রাণীর চেয়েও আমি কোনো গুণে উৎকৃষ্ট নই। তখন আমি যে কথা বলেছিলাম সেকথা আজও বলছি: পৃথিবীতে যতদিন পর্যন্ত একটা নীচ শ্রেণি থাকবে, তার মধ্যে আমিও থাকব, যতদিন পর্যন্ত একটা অপরাধী শ্রেণি থাকবে, আমিও তার অংশ হয়ে থাকব, যতদিন পর্যন্ত একটি মাত্র মানুষও কারাগারে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমিও মুক্ত মানুষ নই।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নুরেমবার্গে যখন যুদ্ধ- অপরাধীদের বিচার আরম্ভ হল, তখন নাজি অফিসাররা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য এই যুক্তি দেখিয়েছিল যে রাষ্ট্রের শত্রুদের হত্যা করে তারা আইনের নির্দেশ পালন করেছিল। মিত্র-পক্ষের উকিলরা তখন তাদের মূখ বন্ধ করেছিল থরোর ‘Civil Disobedience’ গ্রন্থ থেকে একটা উদ্ধৃতি দিয়ে:’যদি অন্যায় আইনের নির্দেশ তোমাকে অন্য একজন মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করতে বাধ্য করে, তাহলে সেক্ষেত্রে তোমার উচিত হবে সেই ধরনের আইন অমান্য করা।’

পুকুরের জলে একটা পাথর ছুঁড়ে দিলে তার ফলে সৃষ্টি হওয়া ঢেউয়ের আলোড়ন যেভাবে চক্রাকারে ছোট থেকে ক্রমে বড় হয়ে অবশেষে সমগ্র পুকুরটাতেই ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনই আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে একজন সন্ন্যাসী প্রকৃতির আমেরিকান যুবক ওয়ালডেনের পুকুরপাড়ে বসে মানুষের চিন্তা সমুদ্রে ছুঁড়ে দেওয়া কয়েকটি উক্তিও একই রকম আলোড়নের সৃষ্টি করেছে এবং বছর অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আলোড়নও ক্রমশ বিশাল আকার ধারণ করে এখন প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পোলান্ডের শ্রমিকবিপ্লব, বিংশ শতকের এ রকম অনেক মহৎ ঘটনার ওপর বিপুল প্রভাব পড়েছে- এই সংসারবিমুখ নিঃসঙ্গতা-প্রেমী যুবকটির। আধুনিক সভ্যতা মানুষের জন্য যে সমস্ত নিত্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে, তার দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে পারা যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে মানব-সমাজ এই মানুষটির জীবন এবং বাণীর প্রতি গভীরতর মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে।

প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের জীবনে এ রকম একটি মুহূর্ত আসে – যখন সে জীবন পথে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরে তাকায়, অতীতের হিসাব নেয় এবং পরবর্তী পদক্ষেপটা কীভাবে ফেলবে সেকথা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখে। হেনরি ডেভিড থরোর জীবনে সে মুহূর্ত এসেছিল ১৮৪৫ সনে, যখন তিনি ২৮ বছরে পা রাখলেন। থরো অনুভব করলেন যে তিনি নিজের জন্য কোন্ ধরনের জীবন বেছে নেবেন সেটা ঠিক করার সময় এসেছে। অবশ্য সেটা করতে গিয়ে তাকে যে কয়েক দিন রাত চিন্তা করতে হয়েছিল তা নয়। আসলে তিনি এই মুহূর্তে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তার জন্য তাঁর সমগ্র জীবনটাই ছিল একটি নীরব প্রস্তুতি মাত্র। অভাবও নেই, প্রাচুর্যও নেই -কনকর্ড গ্রামের এমন একটি পরিবারে ১৮১৭ সনে থরোর জন্ম হয়েছিল। পিতা জন থরো পেন্সিল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। থরো নিজে লিখে যাবার মতই তাঁর বাল্যকাল ছিল পরম আনন্দময়। স্নেহময় পরিবেশ, ভালো বই এবং ভালো চিন্তা চর্চার মধ্যে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল। স্কুল জীবনে কোন বিষয়েই তাঁর বিশেষ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় না কিন্তু শৈশব থেকেই তার মধ্যে দেখা গিয়েছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর এবং ব্যাকুল প্রেম। প্রকৃতির নানা রূপ সবসময়ই তাঁকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ যে সমস্ত জিনিসে আনন্দ লাভ করে সেদিকে চোখ দেবার মতো তাঁর অবসরই ছিল না। ফলে বিলাস-বৈভব এবং আরাম স্বাচ্ছন্দের প্রতি জীবনের প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন উদাসীন।

তাই কুড়ি বছর বয়সে হাভার্ড থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে বেরিয়ে ডাক্তার-উকিল কোন কিছু হওয়ার চেষ্টা না করে তিনি নিজের গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু গ্রামের মানুষের চোখে তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য ধরনের শিক্ষক। যে শিক্ষক ছাত্রের পিঠে বেত মারতে চায় না, সে আর ছাত্রকে কী শিক্ষা দান করবেন? বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষা দান সম্পর্কীয় নানা বিষয়ে মতানৈক্য হওয়ার ফলে তিনি ভাইয়ের সঙ্গে মিলিতভাবে নিজেই একটি বিদ্যালয় খুললেন। গান্ধীজির বুনিয়াদি শিক্ষানীতিরও প্রথম প্রবর্তন থরো করেছিলেন বলা উচিত, কারণ ছাত্র কেবল বইয়ের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করার মধ্যেই থরোর বিদ্যালয়ের আদর্শ ছিল। বিদ্যালয় ভালোই চলছিল, কিন্তু থরোর প্রধান সারথি ভাইয়ের হঠাৎ একদিন অকাল মৃত্যু হওয়ায় শোকাভিভূত থরো বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেন।

থরোর বয়স যখন চব্বিশ বছর, সেই সময়ে তাঁর জীবনের প্রথম বড় ঘটনাটি ঘটে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি রালফ ওয়াল্ডো এমারসনের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন। এমারসন থরোকে তাঁর বাড়িতে কিছুদিন অতিথি হিসেবে বসবাস করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এমারসন থরোকে এই চিঠি লেখার সময় তাঁর নিজেন বয়স মাত্র ৩৮ বছর। কিন্তু সেই তরুণ বয়সে তিনি’The most shining intellectual glory and the most potent intellectual force of a continent’ হিসেবে সকলের দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। তার Nature এবং The American Scholar নামের গ্রন্থ দুটি নতুন প্রজন্মের আমেরিকানদের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। থরো হাভার্ডে ছাত্র থাকাকালীন এমারসনের Nature নামে গ্রন্থটি পড়ার সুযোগ লাভ করে। এমারসনের চিন্তাধারা থরোর উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে নিজের চিন্তার কণিকাগুলো টুকে রাখার জন্য তিনি তখন থেকেই একটি ব্যক্তিগত জার্নালে লিখতে শুরু করেন। বস্তুত থরোর একাধিক চরিতকারের মতে প্রধানত দুটি গ্রন্থ থরোর অসামান্য জীবনকে রূপায়িত করে তুলেছিল: একটি এমারসনের Nature অপরটি ভগবৎগীতা। সে যাই হোক না কেন, থরোর জার্নালটি বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে এমারসনের হাতে এসে পড়ল। আর তা পড়ে মুগ্ধ হয়েই তিনি থরোকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন।

থরো এমারসনের পরিবারের একজন হয়ে তাঁর বাড়িতে দুই বছর রইলেন। সেই সময়ে এমারসনের বাড়ি ছিল Transcendentalist Circle নামের আমেরিকার এক নতুন বিদ্বৎসমাজের মিলনকেন্দ্র যার মধ্যমণি ছিলেন এমারসন স্বয়ং। পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা এমারসন এবং থরো দুজনকেই Transcendentalist Circle এর দুটি প্রধান অবলম্বন বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু থরোর অধিক নির্ভরযোগ্য চরিতগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে এই জ্ঞানী-গুণী লোকদের আলোচনায় থরো কখনও বিশেষভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি বা তিনি নিজেকে তাদের সঙ্গের একজন বলে ভাবতেনও না। থরো সর্বদাই তাঁর নিজের চিন্তার মধ্যে মগ্ন থাকতেন। কিন্তু তবুও একথা বলা যায় না যে, দুই বছর ধরে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণী-জ্ঞানী মানুষের ঘনিষ্ঠ সংসর্গ তাঁর ওপরে কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। এই মানুষগুলোর গভীর আদর্শবাদ এবং সত্যানুরাগ থরোর ব্যক্তিত্ব বিকাশে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

দুই বছর এমারসনের বাড়িতে বসবাস করার পর একদিন থরো সেখান থেকে চলে এলেন । তার কিছুদিন পরেই ২৮ বছরে পা রেখে থরো একদিন নিজেকে প্রশ্ন করলেন : ‘কিছু না করেই জীবনের ২৮টি বছর পার হয়ে গেল। এখনও কিছু একটা করার সময় হয়নি কি?’

এতদিন কোনো কাজ না করলেও অন্তত একটি কাজ থরো খুব ভালোভাবে করেছিলেন: জীবনের আদর্শ কী হওয়া উচিত সেই বিষয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করে কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তাঁর মতে জীবন সম্ভোগের পথে প্রধান বাধা হল অর্থের লালসা এবং জীবিকার জন্য অবিরাম পরিশ্রমের দাসত্ব। জীবনের সময়গুলো এত অমূল্য যে অর্থোপার্জনের মতো তুচ্ছ কাজে কখনও তার অপচয় করা উচিত নয়। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে হলে অর্থোপার্জনের জন্য করা পরিশ্রমের দাসত্ব থেকে মানুষকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে হবে। আর তা করতে হলে জীবন ধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকুর বাইরে অন্য সমস্ত প্রয়োজনকে বিসর্জন দিতে হবে। আদর্শ জীবন হলো প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কাটানো একটি সরল, অনাড়ম্বর, স্বাধীন জীবন – যে জীবনে ধ্যান এবং অধ্যয়নের জন্য প্রচুর অবসর থাকে এবং কোন প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম বা চিন্তাচর্চা আমাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে না। মানুষকে নিজের প্রয়োজনগুলো এত বেশি সরল করে নিতে হবে -যাতে বছরে মাত্র দুই সপ্তাহ পরিশ্রম করেই বাকি সারা বছরের জন্য সে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে নিতে পারে। মানুষ এখন সপ্তাহের ছয়টি দিন পরিশ্রম করে মাত্র একটি দিন -রবিবারটা বিশ্রামের জন্য রাখে। কিন্তু জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ পেতে হলে মানুষকে আসলে সপ্তাহে একদিন মাত্র পরিশ্রম করে বাকি ছয়টি দিনই বিশ্রামের জন্য রাখা উচিত। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা হলো প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন সম্পত্তির মালিক হওয়ার লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। প্রাচীন মেক্সিকানরা নাকি প্রতি পঞ্চাশ বছর পর পর নিজের সমস্ত সম্পত্তি পুড়িয়ে ফেলতেন। উদ্দেশ্য ছিল সম্পত্তির দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং বারবার নিজের যোগ্যতার পরিমাপ করা। এই আদর্শ থরোর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

কিন্তু যে কোন শিক্ষা বা আদর্শকে মনের মধ্যে পালন করেই ক্ষান্ত থাকার মতো মানুষ ছিলেন না থরো। তিনি নিজেই লিখে রেখে গেছেন : ‘A truly good book teaches me better than to read it. I must soon lay it down and commence living on its hint. It is slipping out of my fingers while I read….So I can not stay to hear a good sermon and applaud at the conclusion, but shall be half-way to Thermoppylae before that.’

তাই জীবনের ২৮ বছরে পা রেখে থরো নিজের আদর্শকে বাস্তবায়িত করার সঙ্কল্প করেন এবং নিজের গ্রামের এলকট নামে একজন মানুষের একটি কুঠার ধার নিয়ে ওয়ালডেন অরণ্যে যাত্রা করেন। (পরে ভুলে যাবার ভয়ে এখানেই উল্লেখ করে রাখা উচিত হবে যে নিজের কাজ শেষ হওয়ার পর থরো তাঁর বন্ধুকে কুঠারটা ফিরিয়ে দিতে ভুলে যাননি)। তিনি কিসের খোঁজে ওয়ালডেন অরণ্যে গিয়েছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি নিজেই ‘Walden’ গ্রন্থে লিখে রেখে গেছেন ‘ I went to woods because I wished to live deliberately,– to front only the essential facts of life, and see if I could not learn what it had to teach, when I came to die, discover that I had not lived.’

নিজের হাতে কুঠার দিয়ে কাঠ কেটে থরো যে বাড়ি তৈরি করলেন – সেই সময়ে অর্থাৎ ১৮৪৫ সনে তার খরচ পড়েছিল মাত্র সাড়ে বারো ডলার, তখনকার হিসেবে একশ টাকার চেয়েও কম। বাড়িটা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র এবং খরচের হিসেব তিনি ‘Walden’ গ্রন্থে লিখে রেখে গেছেন। অনেক দরকারি জিনিস তিনি লোকের ফেলে দেওয়া জঞ্জালের স্তূপ থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন এবং ‘I carried a good part on my back.’ …. ওয়ালডেনের এই নির্জন আশ্রমে তিনি প্রায় দুই বছর বসবাস করেছিলেন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে মনে করেননি। ‘অরণ্যের মধ্যে একটি বন্য ফুলের গাছ বা একটি ঢেঁকিয়ার পাতা যেমন নিঃসঙ্গ নয়, একটি ঝিঁঝিঁ পোকা বা ফড়িং যেমন নিঃসঙ্গ নয়, কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া ঝর্ণা বা আকাশের তারা যেমন নিঃসঙ্গ নয় বা মৃদু বাতাসের ঝাঁক বা বৈশাখের বৃষ্টির দল যেমন নিঃসঙ্গ নয় তেমনই আমিও নিঃসঙ্গ নই।’ তিনি যেন আধুনিক যুগের সেইন্ট ফ্রান্সিস অফ আছিছি। তিনি শিস দিয়ে ডাকলেই বনের পাখি এসে তাঁর কাঁধে বসত, পশুগুলো তার গায়ে গা ঘষে নাকের চুলকানি দূর করত, জলের মাছ তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যেত, বাতাস তাঁর কানে গান গেয়ে যেত আর তুফান সৃষ্টি করত বজ্র-গম্ভীর সুর সমলয়।’ এক কথায় প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন থরো।

থরো ওয়ালডেনে প্রায় দুই বছর বসবাস করেছিলেন। তাঁর দুই বছরের বনবাসের কাহিনিই হলো আধুনিক কালের একটি অসামান্য গ্রন্থ ‘Walden’। প্রকৃতির নিবিড়তম সান্নিধ্যে সরলতম জীবনযাপন করে মানুষ কি ধরনের অনির্বচনীয় মুক্তি এবং আনন্দের স্বাদ পেতে পারে – তারই অভিজ্ঞতা থরোর এই বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থের পাতায় পাতায় ব্যক্ত করা হয়েছে। থরোর গুরু এমারসন বলেছিলেন -Who so would be a man must be a non conformist এই অর্থে থরো ছিলেন একজন বিরল-জাত অসাধারণ মানুষ – যার পরিচয় পাওয়া যায় Walden গ্রন্থের পাতায় পাতায়।

‘এই গ্রহে বসবাস করা আমার প্রায় ত্রিশ বছর হল, কিন্তু আমার চেয়েও বয়সী লোকদের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত আমি একটিও মূল্যবান উপদেশ শুনতে পাইনি।’

‘অনন্তকে আঘাত না করে কেউ সময়কে হত্যা করতে পারে?’

‘বস্তুপুঞ্জের কোনো পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তন হয় কেবল আমার।’

‘বেশিরভাগ বিলাস-বৈভব এবং তথাকথিত আরামদায়ক জিনিস জীবনের জন্য অপরিহার্য তো নয়ই, বরং মানবজাতির বিকাশের পথে সেগুলো প্রতিবন্ধক স্বরুপ।’

‘যে সমস্ত উদ্যোগ আরম্ভ করার জন্য নতুন সাজ-পোষাকের প্রয়োজন হয়, সে ধরনের উদ্যোগের বিষয়ে সতর্ক হয়ে চলবে।’

‘আমাদের জীবন তিলেতিলে ক্ষয় হয়, কারণ আমরা বহু অপ্রয়োজনীয় কথায় ব্যস্ত হয়ে থাকি। জীবনটাকে যতটুকু সম্ভব সরল করে তোল, সরল কর…।’

‘সময় একটি নদী মাত্র, আমার কাজ হল তাতে মাছধরা।’

‘নিঃসঙ্গতার চেয়ে মধুরতম সঙ্গী আমি আর কাউকে খুঁজে পাইনি।’

‘আমার ঘরে তিনটি চেয়ার আছে: একটি নির্জনতার জন্য, দ্বিতীয়টি বন্ধুত্বের জন্য, তৃতীয়টি সমাজের জন্য।’

‘একটি গাছের সঙ্গে আমার পূর্ব-নির্দিষ্ট সাক্ষাৎ রক্ষা করার জন্য আমি কখনও কখনও গভীর বরফে আবৃত আট-দশ মাইল পথ পায়ে হেঁটে যাই।’

ওয়ালডেনে দুই বছর বনবাস খাটার পরে থরো পুনরায় নিজের গ্রামে ঘুরে এলেন। তার কারণও তিনি লিখে রেখে গেছেন: ‘আমার কয়েকটি জীবন কাটানোর মতো আছে, মাত্র একটি জীবনের জন্য এর চেয়ে বেশি সময় দিতে পারি না।’ সংসারের মধ্যে ফিরে আসার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩১ বছর, সফল যুবক। কিন্তু গ্রামে ফিরে এসেও তিনি জীবিকার দাসত্বে আবদ্ধ হতে চাইলেন না। যেহেতু তাঁর প্রয়োজন ছিল খুবই সামান্য, তাই গ্রামের মানুষের এটা সেটা ফাইফরমাশ খেটে তিনি নিজের প্রয়োজনটুকু জোগাড় করে নিতে পারছিলেন। বাকি সময়টুকু তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যে ও ধ্যান করে এবং বই লিখে উপভোগ করতেন। তাছাড়া, তাকে প্রায়ই গ্রামের অলিগলিতে বা বাজারের মানুষের সঙ্গে গল্প গুজব করতে দেখা যেত-ঠিক যেন একজন আধুনিক সক্রেটিস। থরোর কোনো কোনো জীবনচরিতে তাঁর জীবনে চারজন নারী এসেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে-তারই মধ্যে একজন নাকি ছিলেন এমারসনের দ্বিতীয়া পত্নী -কিন্তু থরো আজীবন অবিবাহিতই রইলেন। খুব সম্ভব এমারসন জায়ার প্রতি থরোর অনুরাগ ছিল এক প্রকারের কামগন্ধহীন গভীর প্রেমানুভূতি। থরো তাঁর আত্ম-জৈবনিক রচনায় উক্ত ভদ্রমহিলার কথা উল্লেখ করেছেন Mother-Sister বলে।

একদিন ডিসেম্বরের হাড় কাপাঁনো শীতে থরো ভিজে মাটিতে পিঠ পেতে শুয়ে একটি উপড়ে পড়া গাছের আঙটিগুলো গুণতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রচন্ড ঠান্ডা লেগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি সমগ্র জীবন শরীরে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এইবার অসুস্থতার সুযোগে চিরসঙ্গী যক্ষ্মা তাকে ভালোভাবে আক্রমণ করে বসল। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হল। মৃত্যুর সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর। রোগশয্যায় পড়ে থাকার সময় একজন বন্ধু নাকি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ঈশ্বরের সঙ্গে তোমার বোঝাবুঝি হয়েছে কি ?’ থরো উত্তর দিলেন, ‘বোঝাবুঝি হওয়ার মতো তার সঙ্গে আমার কখনও ঝগড়াই হয়নি।’ থরো শ্বাস নিতে নিতে জবাব দিলেন ‘One world at a time!’

থরোর জীবন এবং মৃত্যু ছিল সমান সুন্দর, সমান মহিমান্বিত।

আধুনিক সভ্যতার যে সমস্ত অভিশাপের বিরুদ্ধে দেড়শো বছর আগেই সাবধান বাণী উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন, মানুষ সেই সমস্ত কথা আজ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। সমস্ত মানূষের পক্ষে থরোর জীবনধারা অনুসরণ করা সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু সমস্ত মানুষের হৃদয় এক উচ্চতর জীবন চেতনায় স্পন্দিত করে তুলতে পারে থরোর এই দৃপ্ত উচ্চারণ:‘মানুষ যদি নিজের স্বপ্নের অভিমুখে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে এবং নিজের কল্পিত জীবনটা যাপন করতে চেষ্টা করে, তাহলে গতানুগতিক জীবনে কখনও পাওয়ার আশা না করা এক ধরণের পৃথক কৃতকার্যতা তিনি লাভ করবেন না বলে কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে কি ?’

হোমেন বরগোহাঞি: ১৯৩২ সালে আসামের লক্ষ্মীপুর জেলার ডকুয়াখনায় জন্ম । ১৯৫৪ সালে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক । ‘নীলাচল’, ‘নাগরিক’, ‘অসমবাণী’ ইত্যাদি সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদনা করেন। বর্তমানে ‘আমার অসম’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান, ‘বিভিন্ননরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্যগন্ধা, ‘সাউদরপুতেকেনাও মেলিযায়’ ‘হালধীয়া চরায়ে বাও ধান খায়’তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

বাসুদেব দাস: জন্ম ১৯৫৮, আসাম। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনুবাদ গল্পের সংখ্যা তিনশোরও বেশি। ‘চিন্তাভাবনা’,‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী’ (১ম পর্ব), ‘নির্বাচিত অসমীয়া গল্প সংকলন’ (অনুবাদ) ‘সমকালীন অসমিয়াগল্প’ (অনুবাদ), ‘মৎস্যগন্ধা’, ‘জীবন সাধনা’(অনুবাদ), ‘মনোজ গোস্বামীর অসমিয়া ছোটগল্প’, ‘দুর্দিনের দস্তাবেজ’ তার প্রকাশিত গ্রন্থ।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top