গারো লোকগল্প ।। ম্যাগডিলিনা মৃ

বুলবুলি
একবার এক বুলবুলি পাখি পাতাল ভ্রমণে গিয়েছিল। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে পৃথিবীতে ফিরে এসে খুব ক্ষুধা পেয়েছিলো বুলবুলিটার। খাবার খুঁজতে খুঁজতে এক বুনো কলাবাগানের খোঁজ পেয়ে গেল সে। সেখানে প্রায় প্রতিটি গাছে পাকা কলা দেখে লোভ সামলাতে পারলো না বুলবুলিটা। প্রচুর পাকা কলা খেয়ে মনের আনন্দে আকাশে উড়তে লাগলো সে। উড়তে উড়তে হঠাৎ করেই বুলবুলির পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। প্রচুর কলা খাওয়ার ফলে আমাশয় শুরু হয় বুলবুলির। পেট ব্যথা ও আমাশয়ের কারণে যত্রতত্র মলত্যাগ করতে শুরু করে । বলা হয়ে থাকে বুলবুলির মল থেকেই কলাগাছের বিস্তার পাহাড়, উপত্যকাসহ পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল আর ঘন ঘন মলত্যাগ করে বুলবুলির মলদ্বারের চারপাশে রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে বুলবুলি পাখির পশ্চাদ্দেশে লাল রঙ আজও দেখা যায়।
উৎসঃ কিমচেং সাংমা আগিতক, গ্রামঃ সোহরাগিরি, গারো পাহাড়,মেঘালয়

বাঘ এবং বনরুই
এক সময় বনের রাজা বাঘ ছোট্ট প্রাণি বনরুই শিকার করতে জানতো না। যখনি বনরুই দেখতে পেত বাঘ তাকে শিকার করার জন্য আসছে অমনি সে গুটি পাকিয়ে বলের মত হয়ে থাকত। বনরুই এর চামড়া মোটা, শক্ত এবং আঁশযুক্ত হওয়ার কারণে বাঘ কখনোই বনরুই শিকারের চেষ্টা করেনি। একদিন বনরুই বাঘকে পরিহাস করে বললো, ‘বনের সব প্রাণিরাই আমাদের শিকার করতে জানে একমাত্র তুমি বোকা বাঘই আমাদের শিকার করতে জান না।’ বনরুইয়ের দাম্ভিক মনোভাব এবং পরিহাস দেখে বাঘ নিজে নিজে শপথ করে নিলো এবং বনরুইকে বললো, ‘আমিও পরবর্তীতে দেখে নিব তুমি কতটা চালাক আর আমি কতটা বোকা।’
পরদিনই বাঘ বনরুইকে আক্রমণ করলো। বাঘকে দেখে বনরুই গুটি পাকিয়ে গোল হওয়ার আগেই বাঘ বনরুইকে কামড় দিয়ে ধরে ফেললো। বলা হয়ে থাকে বনরুইয়ের দম্ভোক্তি এবং উপহাসের কারণে সেদিন থেকেই বাঘ সেটিকে শিকার করার কৌশল শিখেছিলো।
উৎসঃ রিমজেং সাংমা রংমুথু, গ্রামঃ রুগাপাড়া, গারো পাহাড়, মেঘালয়

চু এর উৎপত্তি
অনেক অনেক আগে গারোরা চু পান করা জানত না কেননা চু তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পর্কে গারোরা জানতো না। সর্বপ্রথম তিয়েবাংশি মিসি নোয়েবাল চু তৈরি করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে চু তৈরির এই প্রক্রিয়াটি তিয়েবাংশি মিসি থেকে পর্যায়ক্রমে তিরাননি র্র্যাংসিলচি থেকে সোয়েংমা টোটেংমা শিখে নিয়েছিলো। সর্বশেষ সোয়েংমা টোটেংমা থেকে শিখেছিলো ‘অ্যাহনিং বোকজারে চিনিং দিমজারে নরে চিরে’। দিমজারের অনেকগুলো ঘর ছিলো। একদিন দিমজারে চু তৈরির জন্য খামি মিশ্রিত ভাতের মটকাটিকে কিছু লতাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে একটি ঘরের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিল। ‘খরেংপা খবিনপা গ্যাংগিপক চিদুয়াল’ চু’র মটকাটিকে চুরি করে নিয়ে একটি উঁচু শিমুল গাছের উপরে বেঁধে রাখে। সেই শিমুল গাছের পাশেই বসবাস করতেন এলঙ্গাএলঙ্গি যিনি গারো মাতৃতন্ত্রের প্রথম নারী, মেঘাম নংস্টিং এর মা। এলঙ্গাএলঙ্গি সুযোগ বুঝে সেই মটকাটিকে গাছ থেকে পেড়ে আনে এবং চু পান করে। বলা হয়ে থাকে এলঙ্গাএলঙ্গিই সর্বপ্রথম গারোদের মধ্যে চু তৈরির প্রচলন শুরু করে। পরবর্তীতে গাঁজন প্রক্রিয়ায় চু তৈরির জন্য গম, যবসহ নানারকম শস্য, ফল এবং শিকডের ব্যবহার করার পদ্ধতিও গারোরা আবিষ্কার করেছে।
উৎসঃ জরাং সাংমা স্নাল, গ্রামঃ আওয়াঙ্গা, গারো পাহাড়, মেঘালয়

বিশ্বাসী কুকুর এবং চালাক শূকর
অনেক আগে আচিক আসং গ্রামে এক নিঃসন্তান দম্পতি ছিল। পাহাড়ের ঢালে তাদের বসবাস । পুরুষটি বনের মধ্যে তীর-ধনুক দিয়ে যা শিকার করে আনতো তাই দিয়ে তাদের খাবার ব্যবস্থা হতো। ধীরে ধীরে তাদের বয়স বাড়তে লাগলো । নিজেদের একাকিত্ব দূর করার জন্য তারা একটি শূকর এবং একটি কুকুর পালতে শুরু করলো। বয়স বাড়ার সংগে সংগে পুরুষটির বনে গিয়ে শিকার করার শক্তি কমতে লাগলো। বাড়ির পেছনে যেটুকো আঙ্গিনা ছিলো সেটিতে ধান আর অন্যান্য ফসল ফলিয়েই তাদের দুবেলা খাবার জুটতো। ধীরে ধীরে সেই জমিতে ধান চাষ করার মতো শক্তিও সেই বৃদ্ধ দম্পতির কমতে লাগলো। এদিকে জুম চাষের সময় হয়ে এসেছে প্রখর রোদে মাটি প্রস্তুত করে ধান রোপন করতে হবে কিন্তু কোনোভাবেই দম্পতিদের মাঠে কাজ করার সামর্থ নেই। তাদের পোষা শূকর উইলি আর কুকুর মিলিরও খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
একদিন বৃদ্ধ স্ত্রী কিছুটা রাগ হয়ে উইলি-মিলিকে হুকুম দিল, ‘যদি তোমরা সুস্বাদু ভাত খেতে চাও তাহলে এক্ষুনি মাঠে যাও। দুজনে মিলে ধান রোপনের জন্য মাটি প্রস্তুত কর।’ বৃদ্ধার কথা শুনে উইলি-মিলি মাঠে চলে গেল মাটি প্রস্তুত করার জন্য। কেননা দুজনেই ভাত খুব পছন্দ করে। যদি মাটি প্রস্তুত করতে পারে তাহলে আরো বেশি ধান হবে এবং উইলি-মিলি পেট ভরে খেতে পারবে। কিন্তু সূর্যের তাপ এতই প্রখর ছিলো যে রোদে পুড়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল কিন্তু মিলি তা সহ্য করে পরদিন সকাল পর্যন্ত একটানা মাঠে কাজ করলো। উইলি খুব অলস ছিলো। মিলি যখন কাজ করছিলো উইলি তখন গাছের ছায়ায় নাক ডেকে ঘুমিয়েছিল। সকালবেলা যখন মিলি বাড়িতে ফিরছে, সুযোগ বুঝে উইলি পুরো মাঠের নানা জায়গায় নিজের পায়ের ছাপ দিয়ে দিল যেন বৃদ্ধা বুঝতে পারে উইলিও মাঠে কাজ করেছে। বাড়িতে ফিরে মিলি যখন জোর গলায় বৃদ্ধাকে বললো, ‘আমি সারা দিন এবং সারা রাত ধরে মাঠে কাজ করেছি আর উইলি মনের সুখে ঘুমিয়েছিল। আমি এখন খুব ক্ষুধার্ত আমাকে খেতে দাও।’ তৎক্ষণাৎ উইলি এসে বৃদ্ধার কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘মিলি মিথ্যে কথা বলেছে। সে একটা মিথ্যুক। আমি সারা দিন সারা রাত কাজ করেছি আর মিলি আরামে ঘুমিয়েছিল। তুমি যদি বিশ্বাস না কর তাহলে মাঠে গিয়ে দেখে আসো কার পায়ের ছাপ দেখা যায়।’
উইলি-মিলির কথা শুনে বৃদ্ধা কিছুতেই বুঝতে পারল না কে সত্য কথা বলেছে। শেষমেষ বৃদ্ধা মাঠে গিয়ে দেখতে পেল মাঠ জুড়ে মিলির পায়ের ছাপ পড়ে আছে আর মাঝে মাঝে এদিক সেদিক উইলির পায়ের ছাপ বোঝা যাচ্ছে। বৃদ্ধা বুঝতে পারল উইলি মিথ্যে কথা বলেছে তাই তাকে ভাতের মাড় এবং মিলির প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ভাত খেতে দিল। উইলি ভাতের মাড় খেয়ে রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে লাগলো আর মিলি ভাত খেয়ে লেজ নাড়িয়ে সেই বৃদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। সেই থেকে দেখা যায় বিশ্বস্ততা রক্ষার করার জন্য প্রতিটি গৃহস্থই কুকুরকে গৃহপালিত পশু হিসেবে কাছে ঘেঁষতে দেয় এবং ভাত খেতে দেয় আর শাস্তি স্বরূপ শূকরকে দূরে দূরে রাখে এবং ভাতের মাড় খেতে দেয়।
উৎসঃদিংজেং সাংমা রংমুথু, গ্রামঃ দিংগ্রেং, গারো পাহাড়, মেঘালয়

*গল্প সূত্রঃ দ্যা ফোক টেলস অব দ্যা গারোস II ইংরেজী সংকলনঃ দেওয়ান সিং রংমুথু

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top