১৯৭০ সালের উত্তাল কলকাতা। চারপাশে মানুষের মনে ক্ষোভ। বিক্ষোভ করছে সাধারণ মানুষ। নকশালদের সাথে প্রতিপক্ষের লড়াই হচ্ছে, বোমা ফাটছে শহরে। এর মাঝেও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত আছে। মানুষ বাজারে যাচ্ছে, লন্ড্রিতে কাপড় দিচ্ছে, চুল কাটাচ্ছে, সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, চাকরি খুঁজছে। এমন এক পরিস্থিতিতে তরুণ রনজিৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে তার মা বোনের সাথে নতুন চাকরির ইন্টারভিওটা নিয়ে কথা বলে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রনজিৎ তার মা ও বোনকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। রনজিতের ধারনা শেখর কাকা পুরো ব্যাপারটা ভেতর ভেতর ঠিক করে ফেলেছে। চাকরি হবেই, ইন্টারভিওটা এখন জাস্ট আ ম্যাটার অব ফর্মালিটি। নতুন চাকরিতে বেতন বোনাস সব মিলে যা পাবে তার পরিমাণ রনজিতের ভাষায় হিউজ। এই হিউজ শব্দটা দিয়ে পরিচালক মৃণাল সেন রনজিতের মতো আপাত নিরীহ তরুণদের উদাসী জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যদিও পরের দৃশ্যেই জাম্পকাটের মাধ্যমে বিশাল এক মাছের মুন্ডু ঘ্যাচাং করে কাটার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বুঝানো হয় আশায় গুড়েবালি। রনজিতের বয়সী নকশাল তরুণরা যখন অধিকার আদায়ে বন্দুকের নলের সামনে নিজের জীবন দিচ্ছে, তখন রনজিত বিদেশী কোম্পানিতে চাকরির আশায় বুক বাধে। তার এই আশা কি শুধুই উদাসীনতা? হয়তো না। কারণ তার পরিবার আছে, মা আছে, বোন আছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে সে সমাজের সমস্যা প্রতি উদাসীন থেকে নিজের জীবন গুছাতে চায়।
সিনেমার ক্লাইমেক্স শুরু হয় একটি স্যুটকে কেন্দ্র করে। স্কটিশ কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিও দেওয়ার জন্য রনজিতের একটি স্যুটের দরকার হয়। কারণ শেখর কাকা বলেছেন তাকে স্যুট পরে ইন্টারভিওতে যেতে। স্যুট রনজিতের নিজেরই আছে। ইন্টারভিওয়ের দিন সকালে রনজিত তার পুরোনো সুগুলো বের করে পালিশ করে, কাগজপত্রের স্তুপ থেকে রিসিট বের করে লন্ড্রিতে যায় স্যুটটা নিয়ে আসতে। কিন্তু সেদিন লন্ড্রি শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে লন্ড্রি বন্ধ থাকে। এখানেও কিন্তু একটু অস্থিরতার আভাস মেলে। তারপরও এসব রনজিতকে আকর্ষণ করে না। তার মাথায় শুধু স্যুট জোগাড়ের চিন্তা। তারপর থেকে পুরো সিনেমা জুড়েই একটা টান টান উত্তেজনা। স্যুট কি জোগাড় হবে? রনজিত কি পারবে স্যুট পরে পরিপাটি হয়ে ইন্টারভিও দিতে। ম্যাটার অব ফরমালিটি এখন ঝুলে আছে স্যুট জোগাড় হবে কি না তার উপর। এই টানটান উত্তেজনার মাঝেই পরিচালক মৃণাল সেন সেই সময়ের কলকাতাকে তুলে ধরেন ছোট ছোট বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে। রনজিত স্যুট জোগাড় করার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুদের বাসায় ধর্ণা দেয় স্যুটের জন্য। সেই সময়ে বিভিন্ন দৃশ্যে কলকাতা শহরের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মানুষের মিছিলের বাস্তব দৃশ্য, বোমা ফাটার শব্দ। স্থিরচিত্রে দেখানো হয় ভিয়েতনামের নারী গেরিলাদের। স্যুট খোঁজার মাঝে রনজিতের সাথে দেখা হয় তার বন্ধু তপনের সাথে। সে রনজিতকে কথা দেয় স্যুট জোগাড় করার ব্যাপারে সাহায্য করবে। আবার যাওয়ার সময় এও বলে যে সে সাত মাস ধরে বেকার। রনজিত যাতে তার জন্য একটা চাকরি দেখে, তার টাইপিং স্পিড পঁয়তাল্লিশ। এখানেও তার মধ্যে হতাশা দেখা গেলেও সমাজ ব্যবস্থার প্রতি কোন ক্ষোভ দেখা যায় না। রনজিত ও তার মতো ছেলেরা চাচ্ছে এই অস্থির সমাজব্যবস্থার মধ্যেই মানিয়ে চলতে। অন্যদিকে নকশাল তরুণরা চাচ্ছে ঘুনেধরা সমাজকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলতে।
এই চলচ্চিত্রে মৃণাল সেন ব্রেখটিয় এলিয়েনেশন এর বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেছেন। চলচ্চিত্রের দর্শককে মগ্নতার জগত থেকে বাস্তবজগতে নিয়ে আসে এইসব কৌশল। চরিত্রগুলো বিভিন্ন সময়ে দর্শকদের সাথে সরাসরি কথা বলে। ইন্টারভিও সিনেমাতে রনজিত ট্রামে চড়ার সময় দর্শকের দিকে তাকিয়ে বলে সে একজন সাধারণ যুবক। সে যে চাকরির ইন্টারভিও দিতে যাচ্ছে সেটা সত্যি ঘটনা। পরিচালক মৃণাল সেন তাকে বলেছে তিনি সারা দিন তাকে অনুসরণ করবেন। তারপরই দেখা যায় মৃণাল সেন কাট বলে শ্যুটিং শেষ করে ট্রাম থেকে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু তখনও সিনেমা তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্যটি চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। দর্শক মগ্নতার জগত থেকে হঠাৎ বাস্তব জগতে ফিরে আসে। দর্শককে বুঝানো হয় এটি কোন ফিকশন নয়, পরিচালক মৃণাল সেনের সচেতন নির্মাণ। সমগ্র সিনেমা জুড়েই মৃণাল সেন এরকম বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড দৃশ্য, স্থির চিত্র, মন্তাজ ব্যবহার করে দর্শককে একটি রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেষ্ট করেছেন। ফলে এটি শুধু ফিকশন থাকেনি, হয়েছে সচেতন রাজনৈতিক শিল্পনির্মাণ।
চলচ্চিত্রের শেষে দেখা যায় রনজিত শেষ পর্যন্ত ধুতি পাঞ্জাবি পরেই ইন্টারভিও দিতে যায়। শেখর কাকার ভাষায় ধুতি পরে ইন্টারভিও দিতে যাওয়া ক্লাউনের মতো কাজ। এই প্রথম রনজিত প্রতিবাদ করে। সে বলে সে বেকার নয়, ছোট হলেও তার চাকরি আছে। শুধু পোষাকের কারণে চাকরির ইন্টারভিও থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার অহমে ঘা লাগে। তখনই সে বুঝে এই সমাজ একটা শোষণমূলক সমাজ। আজ যদি তার দুইটা স্যুট থাকতো অথবা কিছু অতিরিক্ত টাকা থাকতো তাহলে সে খুব সহজেই স্যুট পরে ইন্টারভিও দিতো, তার চাকরিটাও হতো। সিনেমার একেবারে শেষ দৃশ্যে দেখা যায় রনজিত রাস্তার ধারে দোকানের সামনে শোকেসে সাজানো স্যুট পরা ম্যানিকিনের উপর তার ক্রোধ ঝাড়ে। হামলে পরে ম্যানিকিনের উপর। টেনে হিছড়ে ম্যানিকিনের স্যুট খুলে নেয়। অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাওয়ায় সমাজের প্রতি তার যে ক্ষোভ জন্মে সেটাই প্রকাশ পায় তার এই আচরণে।
https://www.youtube.com/watch?v=goBT8LMYj8k
সাধারণ তথ্য: সিনেমা: ইন্টাভিউ, পরিচালনা: মৃণাল সেন, রচনা: আশিষ বর্মণ, অভিনয়: রনজিত মল্লিক, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্ণনা: রনজিত মল্লিক, সঙ্গীত: বিজয় রাঘব রাও, সিনেমাটোগ্রাফি: কে কে মহাজন, দৈর্ঘ্য: ১০১ মিনিট, ভাষা: বাংলা, রিলিজ: ১৩ নভেম্বর ১৯৭০