একগুচ্ছ অসমিয়া কবিতা II মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

সাইকেল: নীলিম কুমার

সেদিন গ্রামের বাড়িতে যাবার সময়
অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা ঘরটির
মাকড়সার জালের মধ্যে দেখেছিলাম
৪০ বছর আগে ফেলে আসা আমার সাইকেলটা।
চোখে চোখ পড়ায় চিনতে পেরেছিলাম দুজন দুজনকে
এত কাতর দৃষ্টিতে সাইকেলটা আমাকে দেখছিল-
যেন আমাকে বলার জন্য বুকভরা কথা ছিল সাইকেলটার।
মাকড়সার জাল থেকে বের করে এনে সাইকেলটার
গায়ের ধুলোবালি মুছে দিয়েছিলাম।
দেখেছিলাম-ক্যারিয়ার নেই,ব্রেক নেই
নেই দুই চাকায় বিন্দুমাত্র বাতাস
আমার মতোই ভগ্ন,রুগ্ন একটা সাইকেল।
ঘন্টাটি ও নেই। সেই ঘন্টা-
যা বাজাতে বাজাতে ইতিহাসের নোট খাতা দিতে গিয়েছিলাম
স্কুলের বান্ধবীকে।
বকুল গাছের নিচে পরম বন্ধুর মতো আমরা তিনজন
কথা বলতাম-আমি বান্ধবী আর সাইকেল
সেই সাইকেলটাকে বাসের ওপর তুলে
আমি নিয়ে এলাম আজ
আমার থাকা মহানগরে (আমি কোথায় থাকি?)
এই মহানগরের গাড়ি মোটরের মধ্যে
হর্ণের চিৎকার এবং কোলাহলের মধ্যে
রাস্তার পাশে পাশে হ্যান্ডেল ধরে সাইকেলটার সঙ্গে
আমি এখন পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াই
জেলা গ্রন্থাগার, রবীন্দ্রভবন,প্রেস ক্লাব
এবং আর্ট গ্যালারি,দীঘলিপুখুরির সঙ্গে পরিচয় করে
দিয়েছি আমার সাইকেলের।
সাইকেল লজ্জা পায় নি ভাঙ্গা,ছেঁড়া পুরোনো হয়েও।
পায়ে হেঁটে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে ঘাম মুছে
এমনকি মহানগরের ওভারব্রিজগুলিও আমরা
কখনও পার হয়ে গিয়েছি
গলায় গলায় দুই বন্ধুর মতো
সাইকেল এবং আমি
ঘুরে বেড়াই পায়ে হেঁটে জীবনের বাস্তবতায়।
এভাবে দুজনেই দুজনের অসুখের কথা জানি
দুজনে দুজনের ভগ্নতার কথা জানি
ভবিষ্যতের কথা আমরা বলিই না।
আমরা দুজনেই বেঁচে থাকি পৃথিবীর ভীষণ কোলাহলে।
এই বাস্তবতাই এখন আমাদের এখন প্রিয়
এই দুই পা দুই চাকার ভ্রমণই এখন আমাদের উদযাপন
কাউকে দেবার জন্য এখন আমাদের ইতিহাসের নোটখাতা নেই
এখন যেন আমার অবিহনে সাইকেল নেই
সাইকেলের অবিহনে আমি নেই
কোলাহলের মধ্য দিয়ে পথ কেটে কেটে
এই মহানগরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াই আমরা
আমি আর সাইকেল পায়ে হেঁটে হেঁটে
কারোকে বলেনা নগরটি যে—
আমাদের দেখে নগরটি হয় ভীষণ সুখী।

 

কবিতা:  প্রাণজিৎ বরা

ইচ্ছেমতো কিছুই পরিবর্তিত করতে না পারার বিষম দুঃখে
প্রথমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আমাদের সন্ধেগুলি।রিক্ত হয়ে গিয়েছিল
আমাদের ঈশ্বর।আর ও  কোনো ক্লান্ত বিবশ উপমার মতো
শূন্য হয়ে পড়েছিল ধুনোর সুবাস।
তারপরে আড্ডার পুরোনো টেবিলে আঘাত করে আমরা
বলতে পারছিলাম না জীবনের কথাগুলি ।তারপরে
হঠাৎ মাঝখানে পাক খেয়ে থেমে গিয়েছিল ভীমসেন যোশী।
তারপর নৌকাগুলি ঘাট হারিয়েছিল
রাত হারিয়েছিল সেই বাতাস
যার জন্য অধীর হয়েছিল গাছগুলি নৌকাগুলি পাহাড়গুলি
যার জন্য ব্যগ্র ছিল লুইতের বাঁশি আর কমলের কবিতাগুলি
একদিন নব এসেছিল। বহুদিন বইয়ের মধ্যে বন্দি
একটি পোকার মতো দুঃখগুলি বমি করার দীর্ঘ ইতিহাস
শুনিয়েছিল সে। বাঁকগুলিতে আমরা স্থির হয়ে শুনেছিলাম
তার পিতার ভাঁড়ারের ধানগুলির ফুঁপিয়ে কান্না। ঘর হারানো
একটি টুনি চড়ুইয়ের অন্তহীন কান্নার সাক্ষী ছিলাম আমরা বহুরাত।
ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়েছিল আমাদের ইচ্ছেগুলি।এখন আমাদের
ইচ্ছাই আমাদের গতি দান করে –সেই ইচ্ছায় নীরব কবিতা,
লুইতের বাঁশি,কমলের স্বপ্ন এবং আড্ডা আরও কত কি।

 

সময়ের নতুন পাঠ:  প্রণব শর্মা

ঘন্টায় কত কিলোমিটার
পঞ্চাশ আশি না একশো
কত বেগে দৌড়ায় সময়
মাপার জন্য আমার হাতে ঘড়ি নেই

সময়কে একমাত্র
আমি পদুলিতে বাঁধতে পারি নি
আর বুঝতে পারিনি জীবনকে
কত নতুন পাঠ শিখলাম আমি
জীবন থেকে
অথচ একটি জটিল সমীকরণের মতো
বুঝতে পারিনি জীবনকে
যেভাবে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি
অনন্ত আকাশের অসীম রহস্য
সূর্য উঠে এলেই প্রতিদিন
প্রতিদিন শিখি এক একটি নতুন পাঠ
সত্যি
কী যে বিচিত্র এই জীবন!

 

প্রেমের কবিতা: কমল কুমার মেধি

তুমি যখন আমার নিন্দা কর
আমার মনে হয়
যেন আমি কেবল করি
নিন্দনীয় কাজ
যখন আমার প্রশংসা কর
আমার মনে হয়
এই সমস্ত কিছুর মূলে তুমি

আর যখন মনে মনে থাক
আমার মনে হয়
মনে হয় যেন
আমি কারোকে ভালোবাসতে পারলাম না।

 

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বার্তালাপ:  রমেন কলিতা

দুঃখ এবং যন্ত্রণা
আমাদের ঈশ্বরের দেওয়া
এক ভয়াবহ অনন্য উপহার
জীবনের পরম সত্য
দুঃখের দর্শন আত্ম মন্থন
যার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব
আত্মার সংযোগ ঘটিয়ে
সৃষ্টির আকাঙ্খা জাগিয়ে
যন্ত্রণা এবং সৃষ্টির মধ্যে
চিরন্তন চিরন্তন সম্পর্ক
প্রতি ফোঁটা রক্ত,ঘাম এবং
চোখের জলে লুকিয়ে থাকে
ঈশ্বরের অভিনব দান
দুঃখ এবং যন্ত্রণা
অনন্য সাগরের প্রলয়ঙ্করী তুফান
একটি নির্জন দ্বীপে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া
মনের মধ্যে
দুঃখ যন্ত্রণা চিৎকার এবং আর্তনাদ
যেখানে ভেসে থাকে
ভগ্ন প্রতিবিম্ব
ভগ্ন বার্তালাপ
ভগ্ন হৃদয়ের
ভগ্ন শিলালিপি
ভগ্ন চিত্রগুলি
কাঁপতে থাকে
কেবল কাঁপতে থাকে
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে…

 

গাছের নিচে মানুষ:  জীবন নরহ

পৃথিবীকে ছায়া দেওয়া প্রতিটি গাছই কালো হয়ে গেছে
আর গাছগুলি নিজের ছায়া হারিয়ে শিকড় মেলে দিয়েছে
এখন গাছের ডাল-পাতায় অন্ধকার
মানুষগুলি মানুষের ছায়ার খোঁজে
একে অপরের কাছে ছোট হতে হতে ক্রমশ কুঁজো হয়ে গেছে
আর পৃ্থিবীর সবচেয়ে উঁচু গাছটিতে একটা শকুন বসেছে
সেই শকুনের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে পৃথিবীর একদল মানুষ
অথচ মানুষগুলি জানে না যে
গাছগুলি নিজের ছায়া হারিয়ে খুলে দিয়েছে মাটির নিচ পর্যন্ত কালো শিকড়।

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ -বাসুদেব দাস

 

⇒ নীলিম কুমার-১৯৬১ সনে জন্ম। পেশায় চিকিৎসক। প্রকাশিত কাব্য সংকলন আটটি।ভারতের প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই কবিতা অনূদিত হয়েছে।বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত।

⇒ জীবন নরহ-১৯৭০ সনে জন্ম।নগাঁও এডিপি কলেজের অসমিয়া ভাষার অধ্যাক। বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা।

⇒ প্রাণজিৎ বরা-১৯৭৬ সনে নগাঁও জেলায় জন্ম। ডিবরুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘পাণবজার আরু অন্যান্য কবিতা।

Facebook Comments

comments

২ Replies to “একগুচ্ছ অসমিয়া কবিতা II মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস”

  1. Shuvo বলেছেন:

    একসাথে অনেকগুলো সাবলীল ও উপভোগ্য কবিতা পড়লাম ।

  2. মননশীল উদ্যোগকে স্বগক জানা্ি!ি

সয়স তালুকদার শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top