নিশূন্য অঞ্চল ।।শহিদুল হক শ্যানন

নিশূন্য অঞ্চল ।।শহিদুল হক শ্যানন

একটি ব্যস্ত নগরীর দৈনন্দিন সড়ক শব্দমালা শোনা যায়। হাসতে হাসতে একজন মাঝ বয়স্ক ভদ্রলোক মঞ্চে প্রবেশ করেন।

জাস্টিশিয়া। দেখে এলাম। আরে ঐ আইনের মেয়েটা যার এক হাতে তরবারি, আরেক হাতে নিক্তি, চোখটা মোটা কাপড়ে বেশ করে বাঁধা..। দেখে এলাম ওর চোখের বাঁধন খোলা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ড্যাবড্যাব করে সব দেখছে। তার মানে আসলে সে কিছুই দেখছে না। আর পরের জন, মানে লাইনের মেয়েটা, ওকে দেখলাম চোখ বন্ধ করে আছে যাতে কিছুই দেখতে না হয়। কিন্তু আসলে সে…। হা হা হা।

আমিও কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চশমাটা যে কোথায় হারায় থেকে থেকে। অ এইযে। গলায় ঝোলানোই আছে। বাক্সটা কোথায় গেল? বাক্স.. বাক্স.. শো ইওরসেল্ফ, নটি বক্স। নাহ…। ভারি মুশকিল তো বাক্সটা দেখেও রাখতে পারছি না ঠিকমত, আবার ছেড়ে চলেও যেতে পারছি না..। আপনারা কেউ দেখেছেন নাকি?

দেখার অবশ্য কথাও না। আজকাল কি আর কারও দেখার চোখ আছে! আমরা কেউ কিছুই দেখি না! যা দেখি তাও কতটুকুই বা দেখি! সারাটা সময়তো নজর ভার্চুয়ালে। একচুয়াল তাই দেখতেই পাই না। বা দেখি না। ওইযে একজন মহাপুরুষ বলেছেন না… আলু-পটল যা খুশি বেঁচো, (সুরে) বেঁচো না বেঁচো না বন্ধু তোমার চোখের মনি..। আমরা কি আর ততটা বোধের মানুষ! আমরা হলাম পাবলিক। তাই উল্টোটাই বরং করি-। আমাদের ব্যবসাইতো আলু-পটলের। ওগুলোই ছোট-বড় নানান গোডাউনে গোপনে স্টক করি, যতটা পারি। পরে দাম বাড়লে বাজারে ছাড়ি। আপাতদৃষ্টিতে সব চেয়ে যেটা অপ্রয়োজনীয়, সেই চোখের মনিটা শুরুতেই বিক্রি করে দেই। ভাল দাম পাইযে! তাছাড়া আরেকটা লাভও আছে – চোখ বেঁচে দিলে চোখের পর্দা, মানে লজ্জাও থাকে না, লজ্জা বেঁচে দেয়া আর কি। তখন যা খুশি দেখা যায়, করা যায়, কোন সমস্যা হয় না।

আজকালতো আবার বিক্রিরই মোক্ষম সময়। দেদারসে সব বিক্রি হয় এখানে। কারো কোন কিছু গোপন বা নিজস্ব নেই। যে যা খুশী, যেমন খুশী দেখছে এবং কিনছে। জামাকাপড় থেকে শুরু করে মান-সম্মান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অধিকার-মূল্যবোধ, সব। মজার ব্যাপার হল- মূল্যবোধের মূল্যটাই সবচেয়ে কম। আর এই মূল্য ঠিক করে কারা জানেন? যারা কিনেন তারা। তারা নেটে কিনেন, ঘেটে কিনেন, বাইরে কিনেন কিংবা ঘরে। শান্তিতে বসবাসের ঘর কোথাও নেই, পুরোটাই বাজার। হা হা হা…।

ভাল কথা। আমি আসলে একটা হাতল খুঁজছি। বাক্সের হাতল। চামড়া, রেক্সিন, প্লাস্টিক, লোহা -একটা হলেই হল। আমার বাক্স’র হাতলটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তারপর থেকে বাক্সটা বহন করা একটা বেশ বিপদের ব্যাপার হয়েছে। মানে বুঝছেন তো? হাতল ছাড়া একটা বাক্স নিয়ন্ত্রণ করব কি করে? তাই একটা হাতল খুঁজছি। কিনবো। আমার পয়সা নেই ভাববেন না। এইযে কার্ড। প্লাস্টিক মানি। ভাল দাম পাবেন। কেউ বেঁচবেন?

(দর্শকদের) এই যে…. আপনি বিক্রি করবেন? আপনার কাছে আছে? আপনি…? এই যে হ্যালো আপনি?

আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে যে, আপনাদের বাক্সেরও হাতল হারিয়ে গেছে আর আপনারও আমারই মত হাতল কিনতে বেরিয়েছেন। তারপর কারো অনুরোধে, অথবা কিছুটা সময় পেয়েছেন বলে, বা ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে এখানে ঢুকে পড়েছেন। পরে আবার হাতল খুঁজবেন। কি ঠিক বলেছি? অবশ্য আমার ধারনা ঠিক নাও হতে পারে। আপনাদের মধ্যে কেউ আবার আলু পটলের মত বাক্সের হাতল স্টক করছেন না তো? যে আর একটু দাম বাড়ুক, চাহিদা বাড়ুক আর তার পরেই… কি জানি তার বিশ্বাস কি! হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু বাক্সটা আমার কোথায় গেল বলুন তো…? ভারি মুশকিল.. বাক্স..বেবী..হোয়্যার আর ইউ?

নেপথ্যে হাসির শব্দ শোনা যায়। ভদ্রলোক দর্শকদের ফিসফিস করে বলেন-

সেই মেয়েটা। হাসছে-

নেপথ্যে কান্নার শব্দ পাওয়া যায়। উইংস’র দিকে তাকিয়ে দর্শকদের দিকে ফিসফিস করে বলেন-

ওই যে আইনের মেয়েটা। কাঁদছে! অদ্ভুত তো! বাক্সটা যে ওদের মাঝখানে..। ও মাই গড! বাক্সটাকে তো ওরা দুইজন দুইদিকে টানছে… বাক্সটা উদ্ধার করতে হবে। কি করে তাড়াই ওদের? কি করে বাক্সটা উদ্ধার করি ওদের হাত থেকে?

হঠাৎ চিৎকার করে তেড়ে যায়-

যাক চলে গেছে। আর পারি না। ওরা অবশ্য বলেছিল, যে করেই হোক বাক্সটা উল্টে পাল্টে দেখবে যে ওটাই সেই বাক্স কি না যেটা ওরা খুঁজছে। তা সেই চেষ্টা ওরা বহুবার করেওছে। যখন যেখানে পেরেছে সেখানে। নূহের জাহাজে, ট্রয়ের প্রাসাদে, মরুদ্যানে অলস বিহারে, হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোয়… যেখানে যেখানে আমি ছিলাম সবখানে ওরা আমাকে অনুসরণ করেছে। এবং চেষ্টা করেছে বাক্সটার দখল নিতে, ওটা খুলে দেখতে। (ফিসফিস করে) কাউকে বলবেন না। যে বাক্সটা ওরা খুঁজছে এটা সেটা নয়। ওরা এটা জেনে গেলে ওদের বাঁচার আগ্রহটাই নষ্ট হয়ে যাবে বুঝলেন? যেমন জীবনে আর কিছু হবে না এটা জানলে কি আর বেঁচে থেকে ব্যক্তিগত যুদ্ধটা চালিয়ে যাবার আগ্রহ আমাদের থাকবে? এটুকু ছল ওদের জন্য আমি করতেই পারি। তাছাড়া যতটুকু বুঝেছি – ছলতো এ সময়ের সবচেয়ে বড় শিল্প।

আচ্ছা বাক্সটা ওখানে এভাবে পড়ে আছে.. ওরা যদি আবার…. নিয়েই আসি বরং……

টেনে হিঁচড়ে বাক্সটা নিয়ে আসবে। চশমা খুলে

আর পারি না। চোখটা কেমন জ্বালা করছে। একটু ওষুধটা দিয়ে নেই। মাঝে মাঝে কড়কড় করে।

বাক্সটা খুলে দ্রুত বন্ধ করে দিবে

কিছু কি দেখলেন?

চশমা চোখে পরে

মানে এটা যখন বের করি তখন কোন কিছু বাক্স থেকে.. কেউ কি..? চশমা ছাড়া চোখে ভালো দেখতে পাই না তাই মনে হলো বাক্সটা থেকে যদি.. না না ভয়ের কিছু নেই। ওরাও আমার মতই। চোখে ভালো দেখতে পায় না। তাই শুধু অন্ধের মত, এলোমেলো নড়াচড়া করে। মুশকিল হয় যখন কারো ঘাড়ে পরে। এখানে ওদেরও বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নেই, যার ঘাড়ে পড়ে তারও করার তেমন কিছু নেই। ভয় পাবেন না। অবশ্য ভয় পেলেও আপনাদের খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না। অলিম্পাসের মত আপনাদের এখানে তেমন একটা শান্তি নেই তা এ কয়দিনে বেশ বুঝতে পেরেছি।

ঠিক ধরেছেন আমি এখানকার কেউ নই। মানুষ হলেও আমার নিবাস অলিম্পাসে। শৈশবে ছিলাম দেবরাজ জিউসের খাস কামরায়। সব কাজ কি ওনারা করতে পারেন? নাকি করেন? তাই ফুটফরমাস খাটার জন্য, আজেবাজে কাজের জন্য দেবশিল্পী এপিম্যাথিউস মানুষ হিসেবে আমাকে বানালেন। পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য ততদিনে তিনি অবশ্য সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, গিরগিটির সাথে কিছু মানুষও বানিয়ে ফেলেছেন।

ওরা সবাই তখন পৃথিবীতে। কেবল আমিই দেবতাদের ফুটফরমাস খাটার জন্য অলিম্পাসে। এমন সময় দেবতা এপিম্যাথিউসের ভাই, আরেক দেবতা দয়ালু প্রমেথিউস… কে.. কে.. ওখানে?

ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ধরে ফেলে

ঠিক বুঝেছিলাম কিছু একটা বেরিয়েছে বাক্স থেকে।

আবার বাক্সে রেখে

তেমন ভয়ংকর কিছু নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস। আটকে ফেলেছি।

যা বলছিলাম। মানুষের জন্য মমতায় দয়ালু প্রমেথিউস অলিম্পাসের গোপন কুঠুরি থেকে আগুন চুরি করে পৃথিবীতে মানুষের হাতে তুলে দিলেন। মানুষের সভ্যতার প্রথম ধাপ শুরু হল। আগুন পাওয়ায় বিপদ, ঠান্ডা আর অন্ধকার থেকে মুক্তি পেল তারা। কিন্তু দেবরাজ জিউস গেলেন ক্ষেপে! বিনা অনুমতিতে আগুন নিয়ে মানুষকে দিয়ে দেয়ার জন্য তার সকল পরিকল্পনা উলট-পালট হয়ে গেল। তাই তিনি রেগে প্রমেথিউসকে পাহাড়ের নির্জনে চিৎ করে বেঁধে ফেলে রেখে দিলেন। মানুষের অগ্রযাত্রায় প্রথম শাস্তি পেল এক দেবতা।

জিউস বললেন সারাদিন অতিকায় এক ঈগল পাখি ঠুকরে খাবে প্রমেথিউসকে, যন্ত্রনায় রক্তাক্ত হবে সে, কিন্তু মুক্তি পাবে না। রাত হলে পাখিটা বিশ্রাম নেবে আর প্রমিথিউসের সমস্ত ক্ষত তখন শুকাবে। পরদিন আবার আলো ফোঁটার সাথে সাথে শুরু হবে শাস্তি। এভাবে আমৃত্যু।

দেবতা যেহেতু অমর তাই প্রমেথিউসের মৃত্যু যন্ত্রনাও থামবে না কোনদিন।

এতেও কিন্তু রাগ কমলো না দেবপ্রধানের। জিউস এবার মাটি ছেনে বানালেন প্যান্ডোরাকে। প্রথম মানবী। অপরূপ সুন্দরী সে। এবার তাকে তিনি তুলে দিলেন এপিমেথিউসের হাতে। এপিমেথিউস সব কিছু ভুলে গেলেন সুন্দর মানবী পেয়ে। ভুলে গেলেন ভাই প্রমিথিউসের যন্ত্রনার কথা, ভুলে গেলেন নিজের শিল্পী সত্তার কথাও। জিউস যৌতুক হিসেবে প্যান্ডোরার সাথে দিলেন ছোট একটা বাক্স…

বড় বাক্স থেকে ছোট একটা বাক্স বের করে

এই যে.. প্যান্ডোরার বাক্স। জিউস বলে দিলেন খবরদার বাক্স খুল না! খুললেই সর্বনাশ। এপিমেথিউস বুদ হয়ে রইলেন প্যান্ডোরার সৌন্দর্যে। ওদিকে যন্ত্রণাকাতর প্রমেথিউসের চিৎকারে পাহাড়ের পর পাহাড় হাহাকার করতে লাগল। আর প্যান্ডোরার মন কুরে কুরে খায় বাক্সে কি আছে তা দেখার জন্য। প্রায়ই সে আনমনে বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকে..।

ধরেছি.. লোভ! নিশ্চয়ই আমি যখন বাক্সটা খুলেছিলাম তখন এটা বের হয়েছে। যাই হোক এক দিন প্যান্ডোরা আর সহ্য করতে পারে না। একটা সময় সে কৌতূহলের কাছে পরাস্ত হয়। বাক্সর ডালাটা খুলে ফেলে, আর অমনি বাক্সটার ভিতর থেকে হিসহিস করে বেরিয়ে আশে ব্যাধি, ঘৃণা, হিংসা। কিলবিল করে ছড়িয়ে পড়ে ঘরের প্রতিটি কোণে। তারপর বাতাসের সাথে মিশে ভাসতে ভাসতে ভরিয়ে ফেলে পৃথিবীর আকাশ। ভয়ে চিৎকার করে বাক্সটার ডালা বন্ধ করে প্যান্ডোরা। আর ঠিক এখানেই ভুলটা করে সে। ততক্ষণে বাক্সটা খালি করে সবাই বেরিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পরেছে। দখল নিয়েছে মানুষের মন-মননের। শূন্য হয়েছে তার সকল সম্ভাবনা। কেবল বাক্সের নিভৃত কোণে চুপচাপ পড়ে ছিল একমাত্র শক্তিশালী জিনিষটা যা মানুষের বড়ই প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে আশা।

বাক্সের ডালা বন্ধ করায় আশাটাই আটকা পড়ে গেল চিরদিনের জন্য। জিউসের আদেশ অমান্য করার ভয়ে প্যান্ডোরা বাক্সটাকে এমন জায়গায় লুকালো, যেন আর কখনো সেটা তার চোখের সামনে না পড়ে। কৌতুহলি হয়ে আর কখনোই সে যেন বাক্সটা খুলে না ফেলে।

এভাবেই চিরদিনের জন্য প্যান্ডোরার বাক্সটা চলে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে। হা হা হা।

এটা প্যান্ডোরার সেই আসল বাক্সটা নয় তা তো আগেই বুঝেছেন। ওইটার মত আর একটা। আসল বাক্সটা আমিও খুঁজে বেড়াচ্ছি। অলিম্পাস তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। নেই।

ওদিকে প্রমেথিউস শাস্তির যন্ত্রনার মধ্যেও ভাবলেন আশাহীন মানুষ বাঁচবে কি করে? তাই তিনি প্যান্ডোরার মন থেকে বানালেন তার দুই মানসকন্যা। আপনারও চেনেন ওদেরকে.. ওদের কাজ মায়ের বাক্সটা খুঁজে বের করা, মানুষের হাতে আশা তুলে দেয়া।

প্রমেথিউস আর সহ্য করতে পারছিলেন না হররোজ এই নিষ্ঠুর অত্যাচার, যন্ত্রনায় তার চিৎকার বাড়তে লাগলো আর যত দূর সেই চিৎকারের শব্দ পৌঁছাতে লাগলো তত দূর পাথর হতে থাকলো।

একসময় সেটা জলোচ্ছ্বাসের মত ধেয়ে এল অলিম্পাসের দিকে -মরতে লাগল সবুজ, শুকিয়ে যেতে লাগল পানির নহর, থেমে গেল সব সুর, পাথর হতে লাগল সব! প্রাসাদ, বাগান, নদী, দেবতা, দেবী সব। সেসব কয়েক লক্ষ বছর আগের কথা। আমরা অলিম্পাসের অসহায় চারজন মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছুটাছুটি করতে লাগলাম…

ধরেছি.. সন্দেহ। এরা এতো জ্বালায়..

লোভটাকে বাক্সে রেখে তার গায়ে চাপড় দিয়ে

চুপ-

প্রমেথিউসের চিৎকার তখন দ্রুত এগিয়ে আসছে, আর এগিয়ে আসছে পাথরসময়। আমরা দিশেহারা। দিক বিদিক ছুটছি। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় একটা উষ্ণ হাত এসে আমার হাতের শীতল তালুতে ছড়িয়ে দিল উষ্ণতা, তাকিয়ে দেখি প্যান্ডোরা।

দিনগুলো কেমন যাচ্ছে বলো

আমার বেজায় অকাজেই টলোমলো

দুপুরগুলো কেমন যেন উড়োখুড়ো

তোমার দুপুর যাচ্ছে ভালো পুরো?

বিকাল-সাঁঝ, গুছিয়ে চলতে পার?

আমি নড়ি যেমন তুমি নাড়ো

কেমন কাটল তোমার রাত?

আমার এলোমেলো, আকাঙ্খার অশ্রুপাত..

সত্যিই বড় সুন্দর ছিল। জিউস ওকে সকল দেবীর সৌন্দর্যে তৈরি করেছিলেন। এমনভাবে বানিয়েছিলেন যাতে ওকে দেখে এপিমেথিউসের বুকের ভিতর বাতাস এলোমেলো হয়ে যায়, মাথাটা শূন্য হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, আর নাকে লাগে অদ্ভুত এক সুবাস। ওকে দেখলেই যেন থমকে যায় সময়, অনন্তকাল কেটে যায় মুহূর্তে.. সুন্দর মানেই ও। ভালোবাসা মানেই প্যান্ডোরা। জিউস ওকে এপিমেথিউসকে দান করেছিলেন..।

অলিম্পাসে দেবতার স্ত্রী হয়ে ও ছিল এক মহিয়সী মানবী। দেবতার কি আর মানুষের মতো বোধ থাকে সুন্দরের? সুন্দর তো মানুষের, তাই আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে..। মহলের পর মহল খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতো প্যান্ডোরা, আমি খিলানের ছায়ায়-ছায়ায় করতাম অনুসরণ। আর মনে মনে গুনগুন করে গান করত মেয়েটা, আমি টুপটাপ করে গিলে ফেলতাম সেসব সুর। একা একা হেসে উঠলে সে আলোর বিচ্ছুরণে এফোড় ওফোড় হতাম আমি। যখন ও ঘুমাত মেঘের মত চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, আমি স্বপ্ন হয়ে ওর দুই চোখে চুমু খেতে নেমে যেতাম। চমকে জেগে উঠলে বাতাস হয়ে ওকে নির্ভরতা দিতাম।

সেদিন ওই রক্ত হিম করা চিৎকার আর এগিয়ে আসতে থাকা অসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর প্রেমময় চোখে চোখ রেখে আমার সব সংশয় কেটে গেল। ওকে নিয়ে পালালাম, পিছনে পরে রইল রাজা-রাজ্যপাট, পাথরের দেবকুল। চলে এলাম মানুষের রাজ্যে। এই পৃথিবীতে।

আমরা তখন বড্ড ক্লান্ত। বিশ্রাম নিচ্ছিলাম এক অপরিচিত জনপদে। দেখলাম সব গৃহেই ছোট ছোট আগুন জ্বলছে আর মানুষেরা ক্লান্ত হয়ে সে আগুনের আঁচে ঘুমাচ্ছে। আমাদের কাছে কোন আগুন ছিলো না, গৃহ ছিল না। আমরা ওই জনপদের এক গাছের কোটরে, অন্ধকারে ঘুমাচ্ছিলাম।

হঠাৎ বিকট অট্টহাসির শব্দে হাসিতে জেগে উঠে দেখি আমার প্যান্ডোরাকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ভয়ানক এক রাক্ষস। বিরাট তার সুরত, বিকট তার হাসি, অতিকায় তার আকার। আমি প্যান্ডোরাকে উদ্ধার করতে পারিনি। অসহায় বসে বসে আকুল হয়ে কেঁদেছি সেই বৃক্ষের গোড়ায় সারাটা রাত। ভোর হতেই গৃহ থেকে একে একে মানুষেরা বের হয়ে এল নির্ভয়ে। আমাকে ঘিরে ধরে সব বৃত্তান্ত শুনে সবাই আহা উহু করল। কিন্তু কোন পরামর্শ দিতে পারল না। এক বৃদ্ধ আমাকে রাতে তার গৃহে আগুনের নিরাপত্তায় থাকার আহ্বান করলো। তারপর সকলের সাথে চলে গেল আহারের সন্ধানে। কেবল একটা শিশু চুপি চুপি আমাকে বলে দিলো রাক্ষসটার ঠিকানা। তারপর এক ছুটে কোথায় যেন চলে গেলো সেও।

সেই মুহুর্তে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথে যাত্রা করলাম আমি রাক্ষসটার আবাসের উদ্দেশ্যে। প্রতি মূহুর্তে ভয় এই বুঝি ধরা পড়ে যাই, কিন্তু প্যান্ডোরাকে উদ্ধার এর প্রবল টানে সব তুচ্ছ করে এগুতে লাগলাম। কত দিন পথ চলেছি জানি না। এভাবে যেতে যেতে যেতে… একসময় পৌঁছে গেলাম সেখানে।

তখন বোধ হয় দিন। দেখি আমার প্যান্ডোরা বিশাল এক পালঙ্কের মধ্যে মরার মত পড়ে আছে। ওকে দেখে বুকের ভিতরটা আমার কেমন মুচড়ে উঠল। কত ডাকলাম, উঠল না। ক্লান্ত হয়ে আমি ওর পাশেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। এক সময় রাক্ষসটার ফিরে আসার শব্দে ধড়মড় করে উঠে পালঙ্কের নিচে লুকিয়ে রইলাম। চুপি চুপি দেখতে লাগলাম রাক্ষসটা কী এক জাদুতে প্যান্ডোরার ঘুম ভাঙ্গালো। তারপর ওরই নির্দেশে মন পাগল করার সুরে গান গাইতে লাগল প্যান্ডোরা। রাক্ষসটা শান্ত হয়ে শুনতে লাগল সে সুর। ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার ওকে ঘুম পাড়িয়ে কোথায় যেন চলে গেল। এই সুযোগে আমি বেরিয়ে এলাম।

ধরেছি, হিংসা.. (ধরে ফেলে) কখন বের হয়ে গেলি তোরা বল তো।

(বাক্সে ঢুকিয়ে রেখে) তোদের যন্ত্রনায় একটু বসাও যায় না। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য আগের মতো এখন আর ওদের ধরতে কষ্ট হয় না। ওরা দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে।

(বাক্সে বাড়ি দিয়ে) যতই কাকুতি মিনতি কর তোমাদের মুক্তি নেই।

কি যেন বলছিলাম… ও মনে পড়েছে। দেখি প্যান্ডোরার মাথার কাছে একটা কাঠি, আর পায়ের কাছে আর একটা কাঠি। রাতে যেরকম দেখেছি সেরকম করে কাঠিগুলোর অবস্থান বদলে দিলাম। পায়েরটা মাথায়, মাথারটা পায়ে। ব্যস জেগে উঠল আমার ভালবাসা। তারপর দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কতো কাঁদলাম! একসময় শান্ত হয়ে প্যান্ডোরা আমাকে বলল রাক্ষসটার কাছ থেকে ও জেনেছে কি করে ওকে হত্যা করা যাবে তার বৃত্তান্ত। ওইভাবে ছাড়া ওকে মারা অসম্ভব। প্যান্ডোরাকে আমি কথা দিলাম যে করেই হোক রাক্ষসটার বিনাশ করবো। তারপর আবার ওকে আদর করে কাঠি নাড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। শেষবারের মতো প্যান্ডোরার মায়াকাড়া সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে দিনের আলো থাকতেই যাত্রা করলাম রাক্ষস বধে। তারপর একসময় পৌঁছে গেলাম তেপান্তরের মাঠে, তালদিঘির পাড়ে।

শুনশান নীরব চারধার। নিথর কালো তাল দিঘির জল, টি টি করে উড়ে যায় এক ঝাঁক আবাবিল। আমি চমকে উঠি। ঠিক দুপুর বেলায় সূর্য যখন মাথার উপর, যখন আমার ছায়া পড়ে না কোথাও, তখন এক ডুবে পৌঁছে যাই দিঘির মধ্যেখানের তলার মাটিতে।

সেখানে প্যান্ডোরার কথা মতো খুঁজে পাই একটা ছোট্ট কৌটা, সেটা নিয়ে উঠে আসি পানির উপরে। কথা মতো কৌটাটা খুলি। দেখি ভিতরে তার দুইটা কুঠুরি। একটাতে লাল ভোমরা আর একটাতে নীল ভোমরা।

এদের একটাকে এক টানে ধড়-মুন্ডু আলাদা করলেই মৃত্যু হবে রাক্ষসটার। কিন্তু কোনটা? লাল না নীল? প্যান্ডোরাতো আমায় বলেনি কোনটায় আছে রাক্ষসের প্রাণ – নীল না লাল? এদিকে আলো পড়ে আসছে ক্রমশ:। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। কী করি!

দূর থেকে ভেসে আসছে রাক্ষসের হা হা করা ভয়ানক হাসি। ভয়ে আমার বুকের ভিতর কেমন করে ওঠে। আর সময় নেই। রাক্ষসটাকে এখুনি মারতে হবে, নইলে…। কী মনে হতে ধড়-মুন্ডু আলাদা করার জন্য ঝট্ করে কৌটা থেকে বের করে নিলাম নীল ভোমরাটাকে। আর এই সুযোগে উড়ে যেতে যেতে লালটা বলল – বোকা মানুষ! আমিই রাক্ষসের প্রাণভোমরা। নীলটা ছিল ভালো। আমার নাম যদি হয় আতঙ্ক তবে ও ছিলো বরাভয়। সে আরো বলল – রাক্ষসটা এখন আরো শক্তিশালী হবে, মিশে যাবে মানুষের মাঝে। তখন ও হবে অজেয়, যদিনা নীল ভোমরা কোনদিন তাকে খুঁজে বের করে নিকেশ করতে পারে। তবে তার জন্য ওর শক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন সাহসের, যা ক্রমশ: ম্রীয়মান। আর সাহসটাকে বাঁচাতে চাইলে ওকে ওর খাবার দাও। নীল ভোমরাটা যত বড় হবে, তত বাড়তে থাকবে তোমার শক্তি। তত বড় হবে দুই কুঠুরির এই কৌটাটা। সাহস আর শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ যদি করতে পার, তবেই…।

কী তবে? কী! জানি না। কারণ বাকিটা আর শুনতে পাইনি আমি।

(বাক্সকে) চুপ, একদম ঝামেলা করবি না।

প্যান্ডোরা তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি আমার ভালবাসাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। আহ্ যন্ত্রণা… হা হা হা

নীল ভোমরা বড় হচ্ছে। বাড়ছে সাহস, বাড়ছে শক্তি। আর ওকে বড় করে তুলতে পৃথিবী ঘুরে ঘুরে যোগাড় করছি ওর খাবার। হিংসা-লোভ-হতাশা-দীর্ঘশ্বাস-ঘৃণা…। নীল ভোমরা সেগুলোকে মেরে ক্রমাগত বড় হচ্ছে।

এত বড় হচ্ছে যে সত্যিই বলছি মাঝে মাঝে আমার ভয় হচ্ছে কখন যেন সে অন্য মানুষকে বা আমাকেই হুমকির মুখে ঠেসে ধরবে।

কিন্তু উড়ে যেতে যেতে লাল ভোমরা বলেছিল মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকা রাক্ষসটাকে একমাত্র ওই পারবে খুঁজে বের করতে, তাই…। আর তাতেই আমি খুঁজে পাব আমার ভালোবাসাকে, তারপর খুঁজবো লুকানো ওই বাক্সটাকে আর বাক্সের ভেতরের আশাটাকে।

শূন্যতায় অনন্তকাল মানুষ থাকবে কেন? আশা নিয়েই মানুষ বাঁচবে। লড়বে সাহস নিয়ে। গড়ে তুলবে সুন্দর এক মানবিক পৃথিবী।

তাই একটা হাতল খুঁজছিলাম। এখানে যেহেতু নেই, দেখি অন্য কোথাও। হাতলটা আমাকে পেতেই হবে। পৃথিবীর মাপে ছোট হলেও এই আমার আপাত: নিশূন্য অঞ্চল। আমার মুক্তি, আমার স্বাধীনতা-সম্ভাবনা। মুক্ত মানুষ ছাড়া মূল্যবোধ মাথা উঁচু করবে কী করে!

নেপথ্যে মেয়ে দু’জনের হাসি

ওরা আবার হাসে কেন! দেখিতো কী হলো।

আবার ফিরে এসে

যার যার বাক্সটাকে খুঁজে বের করুন। শক্ত করে হাতল ধরুন। হাতল ছাড়া শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

বাক্সটাকে পিঠে নিয়ে প্রস্থান

হাত বাড়ালে পাথর-দেয়াল

পিছনে হা করা কাল-মহাকাল

জোটে না আলো চোখের তারায়

বংশীয় শব্দরা হারিয়ে যায়

তবু পথে নেমে পথ খুঁজি, পথের বাঁকে-

 

বুকের ভিতর মেঘ, এক নদী জল

কত কথা বলে ঐ চোখের কাজল

ঝাপসা নামগুলো এলোমেলো ধায়

ইচ্ছের নুড়িদল হোঁচট খায়

তবু পথে নেমে পথ খুঁজি, পথের বাঁকে-

 

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top