কাহিনী-শিল্প: দুই II মুন্সী প্রেমচন্দ II মূল হিন্দী থেকে তর্জমা: সফিকুন্নবী সামাদী

কাহিনী-শিল্প: দুই II মুন্সী প্রেমচন্দ

মূল হিন্দী থেকে তর্জমা: সফিকুন্নবী সামাদী

       এক সমালোচক লিখেছেন যে ইতিহাসে সবকিছু যথার্থ থাকলেও তা অসত্য, আর কথাসাহিত্যে সবকিছু কাল্পনিক হলেও তা সত্য।
       এই বক্তব্যের অর্থ এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে ইতিহাস আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত হত্যা, যুদ্ধ, ধোকার প্রদর্শন যা অসুন্দর এবং সেজন্যে অসত্য। লোভের ক্রুর থেকে ক্রুর, অহংকারের নীচ থেকে নীচ, ঈর্ষার অধম থেকে অধম ঘটনাবলী আপনি সেখানে (ইতিহাসে) পাবেন এবং আপনি ভাবতে থাকবেন, “মানুষ এতোটাই অমানুষ! সামান্য স্বার্থের জন্য ভাই ভাইকে খুন করে ফেলে, ছেলে বাবাকে হত্যা করে ফেলে এবং রাজা অসংখ্য প্রজাকে হত্যা করে ফেলে!”  তা পড়ে মনে গ্লানি হয়, আনন্দ হয় না, আর যে বস্তু আনন্দ প্রদান করতে পারে না তা সুন্দর হতে পারে না এবং যা সুন্দর হতে পারে না তা কখনো সত্যও হতে পারে না। যেখানে আনন্দ সেখানেই সত্য। সাহিত্য কাল্পনিক জিনিস; কিন্তু তার প্রধান গুণ আনন্দ প্রদান করা এবং সে জন্যেই তা সত্য।
       মানুষ দুনিয়াতে যা কিছু সত্য এবং সুন্দর পেয়েছে আর এখনও পাচ্ছে তাকেই সাহিত্য বলে এবং কাহিনীও (গল্প) সাহিত্যের একটি অঙ্গ।
       মানবজাতির জন্য মানুষই সবচেয়ে উৎকট প্রহেলিকা। সে স্বয়ং নিজেকে বুঝতে পারে না। কোনো না কোনো রূপে সে নিজেরই সমালোচনা করে—নিজের মনোরহস্য প্রকাশ করে। মানব-সংস্কৃতির বিকাশ এইজন্যে যে মানুষ যাতে নিজেকে বুঝতে পারে। অধ্যাত্ম এবং দর্শনের মতো সাহিত্যও সত্যের সন্ধানে নিয়োজিত আছে—পার্থক্য এটুকুই যে সাহিত্য এর মধ্যে রসের মিশ্রণ ঘটিয়ে তাকে আনন্দদায়ক করে দেয়, এজন্যে অধ্যাত্ম এবং দর্শন কেবল জ্ঞানীদের জন্য, সাহিত্য মনুষ্যমাত্রের জন্যেই।
       আমরা আগেই বলেছি, কাহিনী বা আখ্যায়িকা ( গল্প) সাহিত্যের এক প্রধান অঙ্গ; আজ থেকে নয়, আদিকাল থেকেই। হ্যাঁ, আজকালকার আখ্যায়িকা আর প্রাচীনকালের আখ্যায়িকার মধ্যে, সময়ের গতি এবং পরিবর্তনের কারণে, অনেক বড় পার্থক্য হয়ে গেছে। প্রাচীন আখ্যায়িকা ছিলো কৌতূহল-প্রধান এবং অধ্যাত্ম বিষয়ক। উপনিষদ এবং মহাভারতে আধ্যাত্মিক রহস্য বোঝানোর জন্যে আখ্যায়িকার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বৌদ্ধ জাতক-কাহিনী আখ্যায়িকা ছাড়া আর কী? বাইবেলেও দৃষ্টান্ত এবং আখ্যায়িকার দ্বারা ধর্মের তত্ত্ব বোঝানো হয়েছে। সত্য এই রূপে শেষ সাকার হয়ে যায় এবং তখনই মানুষ তাকে বুঝতে পারে আর তাকে ব্যবহার করে।
       বর্তমান আখ্যায়িকা (গল্প) মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং জীবনের যথার্থ স্বাভাবিক চিত্রণকে নিজের ধ্যানের বস্তু বলে মনে করে। তার মধ্যে কল্পনার মাত্রা কম এবং অনুভূতির মাত্রা অধিক হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বরং অনুভূতিসমূহই সৃজনশীল ভাবনায় অনুরণিত হয়ে গল্প হয়ে যায়।
       কিন্তু এ কথা ভাবা ভুল হবে যে গল্প জীবনের যথার্থ চিত্র। যথার্থ জীবনের চিত্র তো মানুষ নিজেই হতে পারে, কিন্তু গল্পের চরিত্রের সুখ-দুঃখে আমরা যতোটা প্রভাবিত হই, যথার্থ জীবন দ্বারা ততোটা হই না—যতক্ষণ পর্যন্ত তা নিজের পরিধির মধ্যে না আসে। গল্পের মধ্যে চরিত্ররা দু-এক মিনিটের পরিচয়ে আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় এবং আমরা তাদের সঙ্গে হাসি-কান্নায় যোগ দিই। তাদের হর্ষ-বিষাদ আমাদের হর্ষ-বিষাদ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, গল্প পড়ে সেই সব লোককেও হাসতে বা কাঁদতে দেখা যায়, যাদের ওপর বাস্তবে সুখ-দুঃখের কোনো প্রভাব পড়ে না। যাদের চোখ শ্মশান বা কবরস্থানেও সজল হয় না, তারাও উপন্যাসের মর্মস্পর্শী স্থানে পৌঁছে কাঁদতে শুরু করে।
       সম্ভবত এর কারণ এই যে স্থূল প্রাণী সূক্ষ্ম মনের ততোটা কাছে পৌঁছতে পারে না, যতটা গল্পের সূক্ষ্ম চরিত্রের কাছে যেতে পারে। গল্পের চরিত্র এবং মনের মধ্যে কোনো জড়তার পর্দা থাকে না, যা এক মানুষের হৃদয়কে অন্য মানুষের হৃদয় থেকে দূরে রাখে; আমরা যদি যথার্থকে হুবহু এঁকে রেখে দিই, তবে সেখানে শিল্প কোথায় থাকে? শিল্প কেবল যথার্থের নকলের নাম নয়।
       শিল্পকে দেখতে যথার্থই মনে হয়; কিন্তু আসলে যথার্থ নয়। তার সৌন্দর্য এই যে যথার্থ না হলেও তাকে যথার্থ বলে মনে হয়। তার মানদণ্ড জীবনের মানদণ্ড থেকে স্বতন্ত্র। বাস্তবে অনেক সময়েই আমাদের জীবন সে সময় শেষ হয়ে যায় যখন তা বাঞ্ছনীয় নয়। জীবন কারো কাছে দায়ী নয়, তার সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জীবন-মৃত্যুতে কোনো ক্রমেই, কোন সম্পর্ক জানা যায় না—অন্তত মানুষের জন্যে তা অজ্ঞাত। কিন্তু কথাসাহিত্য মানুষের রচিত জগৎ এবং পরিমিত হবার কারণে সম্পূর্ণত আমাদের সামনে প্রকাশিত আর যখনই তাকে আমরা আমাদের মানবীয় ন্যায়-বুদ্ধি বা অনুভূতিকে অতিক্রম করতে দেখি আমরা তাকে দণ্ড দেবার জন্য তৈরি হয়ে যাই। গল্পে যদি কোনো চরিত্র সুখ পায় তবে তার কারণ বলা জরুরী হয়; দুঃখ পেলেও তার কারণ দেখাতে হয়। এখানে কোনো চরিত্র মরতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মানবীয় ন্যায়-বুদ্ধি তার মৃত্যু না চায়। স্রষ্টাকে তার সকল সৃষ্টির জন্যে জনতার আদালতে জবাব দিতে হয়। শিল্পের রহস্য ভ্রান্তি, যার ওপর বাস্তবের আবরণ থাকে।
       আমাদের একথা স্বীকার করে নিতে সংকোচ হওয়া উচিত নয় যে উপন্যাসেরই মতো গল্পের শিল্পও আমরা পাশ্চাত্যের নিকট থেকে নিয়েছি—অন্তত তাঁর আজকের বিকশিত রূপ তো অবশ্যই পাশ্চাত্যের। অনেক কারণে জীবনের অন্য ধারার মতোই সাহিত্যেও আমাদের প্রগতি থমকে আছে এবং আমরা পুরনো থেকে বিন্দুমাত্র এদিক সেদিক বিচ্যুত হওয়াকে নিষিদ্ধ মনে করি। সাহিত্যের জন্য প্রাচীন মনীষীরা যে যোগ্যতা বেঁধে দিয়েছিলেন তাকে অমান্য করা নিষিদ্ধ ছিলো। সুতরাং, কাব্য, নাটক, গল্প কোথাও আমরা আগে পা বাড়াতে পারি নি। কোনো জিনিস অত্যন্ত সুন্দর হওয়া সত্বেও অরুচিকর হয়ে যেতে পারে, যতক্ষণ তার মধ্যে কোনো নতুনত্ব নিয়ে না আসা হয়। একই রকমের নাটক, একই রকমের কাব্য পড়তে পড়তে মানুষ বিরক্ত হয়ে যায় এবং সে নতুন কিছু চায়—তা ততোটা সুন্দর এবং উৎকৃষ্ট না হলেও। আমাদের দেশে হয় সেই ইচ্ছা জাগেইনি অথবা আমরা তাকে এতটাই দলিত করেছি যে তা জড়িভূত হয়ে গেছে। পাশ্চাত্য প্রগতি করে গেছে—তাদের মধ্যে নতুনত্বের ক্ষুধা ছিলো, ছিল মর্যাদা নামক বন্ধনের প্রতি বিরক্তি। জীবনের সকল দিকেই তার এই অস্থিরতা এবং অসন্তোষের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার আকুতি মুদ্রিত হয়ে আছে। সাহিত্যেও তারা বিপ্লব ঘটিয়েছে।
       শেক্সপীয়রের নাটক অনুপম; কিন্তু মানুষের জীবনের সাথে তার আজ আর তার কোনো সম্পর্ক নেই। আজকালকার নাটকের উদ্দেশ্য অন্যকিছু, আদর্শ স্বতন্ত্র, বিষয় স্বতন্ত্র, শৈলী স্বতন্ত্র। কথাসাহিত্যেও বিকাশ ঘটেছে এবং তার বিষয়ে ততোটা পরিবর্তন না হলেও শৈলী তো পুরোপুরি বদলে গেছে। আলিফ লায়লা সেই সময়ের আদর্শ ছিলো— তার মধ্যে বহুরূপতা ছিলো, বৈচিত্র্য ছিলো; কৌতূহল ছিলো, রোমান্স ছিলো— কিন্তু তার মধ্যে জীবনের সমস্যাদি ছিলো না, মনোবৈজ্ঞানিক রহস্য ছিলো না, অনুভূতির এতো প্রাচুর্য ছিলো না, জীবন তার সত্য রূপে এতোটা স্পষ্ট ছিলো না। তার রূপান্তর ঘটেছে এবং উপন্যাসের আবির্ভাব ঘটেছে, যা কাহিনী এবং নাটকের মধ্যবর্তী জিনিস। পুরানো দৃষ্টান্তও রূপান্তরিত হয়ে গল্প হয়ে গেছে।
       কিন্তু শতবর্ষ আগে ইউরোপও এই শিল্পে অনভিজ্ঞ ছিলো। বড়-বড় উচ্চকোটির দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক উপন্যাস লিখে যাচ্ছিলো; কিন্তু ছোট ছোট গল্পের দিকে কারো মনোযোগ আকর্ষিত হয়নি। হ্যাঁ, পরী আর ভূতের গল্প লেখা হচ্ছিলো। কিন্তু এই এক শতাব্দীর ভেতর, বা তার চেয়েও কম সময়ের মধ্যে, ছোটগল্প সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গকে জয় করে নিয়েছে আর একথা বলা ভুল হবে না যে যেমন একসময় সাহিত্যিক অভিব্যক্তির ব্যাপক রূপ ছিলো কাব্য ঠিক তেমনি এখন গল্প। আর এই আঙ্গিক অসাধারণ গৌরব অর্জন করেছে ইউরোপের অনেক মহান শিল্পীর প্রতিভা দ্বারা যাঁদের মধ্যে বালজাক, মোপাসাঁ, চেখভ, টলস্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি মুখ্য। হিন্দিতে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে পর্যন্ত গল্পের জন্ম হয়নি। কিন্তু আজকাল এমন কোনো পত্রিকা পাওয়া যাবে না যাতে দু’চারটে গল্প মুদ্রিত হয় না—এমনকি কোনো কোনো পত্রিকায় কেবল গল্পই মুদ্রিত হয়ে থাকে।
       গল্পের এই প্রাধান্যের মূল কারণ আজকের জীবন-সংগ্রাম এবং সময়াভাব। সেই জামানা এখন আর নেই যে ‘বোস্তানে খয়াল’ নিয়ে বসে যাব এবং সারাদিন তার টীকা-টিপ্পনী মধ্যে ঘুরে বেড়াবো। এখন তো আমরা জীবন-সংগ্রামে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে মনোরঞ্জনের জন্যেও সময় পাইনে। যদি সামান্য মনোরঞ্জন স্বাস্থ্যের জন্যে অনিবার্য না হতো, আর মানুষ বিক্ষিপ্ত না হয়ে প্রতিদিন আঠারো ঘণ্টা কাজ করতে পারতো তবে সম্ভবত সে মনোরঞ্জনের নামও নিতো না। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের নিরুপায় করেছে। আমরা চাই অল্প সময়ের মধ্যে অধিক মনোরঞ্জন—এইজন্যেই সিনেমাঘরের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। যে উপন্যাস পড়তে মাস-মাস লেগে যায়, তার আনন্দ আমরা দুঘন্টার মধ্যেই পেয়ে যাই। গল্পের জন্য পনেরো-কুড়ি মিনিটই যথেষ্ট। সুতরাং আমরা এরকম গল্প চাই অত্যল্প শব্দের মধ্যে যা বলা হয়, যার মধ্যে অনাবশ্যক কোনো বাক্য বা শব্দ আসতে না পারে, প্রথম বাক্য থেকেই যার প্রতি মন আকর্ষিত হয় এবং শেষ অব্দি সেই মুগ্ধতা থাকে এবং যার মধ্যে কিছু চটপটে বিষয়, কিছু তাজা বিষয়, কিছুটা বিকাশ এবং সেইসাথে খানিকটা তত্ত্বও থাকে। তত্ত্বহীন গল্পে মনোরঞ্জন খানিকটা হলেও মানসিক তৃপ্তি হয় না। এ কথা সত্য যে আমরা গল্পে উপদেশ চাইনা; কিন্তু বিবেচনা কে জাগানোর জন্যে, হৃদয়ের মনোহর ভাবকে জাগ্রত করবার জন্যে, কিছু না কিছু অবশ্যই থাকা চাই। সেই গল্পই সফল হয়ে থাকে, যাতে এই দুইয়ের মধ্যে—মনোরঞ্জন এবং মানসিক তৃপ্তির মধ্য থেকে—একটা অবশ্যই থাকে।
       সবচেয়ে ভালো গল্প সেটাই হয়ে থাকে যার আধার কোনো মনোবৈজ্ঞানিক সত্য। পুত্রের কুপ্রবৃত্তির কারণে সৎ পিতার বেদনা মনোবৈজ্ঞানিক। এই আবেগী পিতার মনোভাবকে চিত্রিত করা এবং এই মনোভাবের অনুকূল পিতার ব্যবহার প্রদর্শন করা গল্পকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। মন্দ মানুষও পুরোপুরি মন্দ হয় না, তার মধ্যে অবশ্যই দেবতা কোথাও লুকিয়ে থাকে—এটা মনোবৈজ্ঞানিক সত্য। সেই দেবতাকে বের করে দেখিয়ে দেয়া সফল আখ্যায়িকা-লেখকের কাজ। বিপত্তির পর বিপত্তি আসতে থাকলে মানুষ কতোটা সাহসী হয়ে উঠতে পারে—এমনকি সে ভীষণ থেকে ভীষণ সংকটের মোকাবেলা করবার জন্যে তুড়ি মেরে তৈরি হয়ে যায়, তার দুর্বাসনা পালিয়ে যায়, তার হৃদয়ের কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা অমূল্য সম্পদ বেরিয়ে আসে এবং আমাদের আশ্চর্য করে দেয়—এ হলো মনোবৈজ্ঞানিক সত্য। একই ঘটনা অথবা দুর্ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রভাবিত করে—আমরা যদি গল্পে তাকে সাফল্যের সঙ্গে দেখাতে পারি তবে গল্প অবশ্যই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। কোন সমস্যার উপস্থাপন গল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে সবচেয়ে উত্তম উপায়। জীবনে এরকম সমস্যা নিত্যই আসতে থাকে এবং তার থেকে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব আখ্যায়িকার মধ্যে চমক আনতে পারে। সত্যবাদী পিতা জানতে পারেন যে তার পুত্র খুন করেছে। তিনি তাকে ন্যায়ের বেদিতে বলিদান করবেন, নাকি জীবনের আদর্শ কে হত্যা করবেন। কি ভীষণ দ্বন্দ্ব! পশ্চাত্তাপ এধরনের দ্বন্দ্বের অখণ্ড স্রোত। এক ভাই আরেক ভাইয়ের সম্পত্তি ছলনা-কপটতার মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে, তাকে ভিক্ষা করতে দেখে কপট ভাইয়ের কি সামান্য পাশ্চাত্তাপ হবে না? যদি তা না হয়, তবে সে মানুষই নয়।
       উপন্যাসের মতো গল্পও কোনোটা ঘটনা-প্রধান কোনোটা চরিত্র-প্রধান হয়ে থাকে। চরিত্র-প্রধান গল্পকে উচ্চশ্রেণীর বলে মানা হয়, কিন্তু গল্পে অনেক বিস্তৃত বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে না। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ মানুষকে চিত্রিত করা নয়; বরং তার চরিত্রের একটি অংশ দেখানো। আমাদের গল্প শেষে যে পরিণাম বা তত্ত্ব প্রকাশিত হয় তা সর্বমান্য হওয়া উচিত এবং অবশ্যই সূক্ষ্ম হওয়া উচিত। এটা একটা সাধারণ নিয়ম যে আমরা সেই বিষয়ে আনন্দ পাই যার সঙ্গে আমাদের কিছু সম্পর্ক রয়েছে। জুয়াড়ীর যে উন্মত্ততা এবং উল্লাস হয়, তা দর্শক কখনোই পেতে পারে না। যখন আমাদের গল্পের চরিত্র এমন সজীব এবং আকর্ষণীয় হয় যে পাঠক তার স্থানে নিজেকে স্থাপন করে তখনই গল্প থেকে আনন্দ পাওয়া যায়। যদি লেখক নিজের পাত্র-পাত্রীর প্রতি পাঠকের মনে সহানুভূতি জাগ্রত করতে না পারেন তবে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে ব্যর্থ।
       পাঠককে একথা বলার প্রয়োজন নেই যে এই কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দি কাহিনী-শিল্প(গল্প) কতোটা পরিপক্বতা লাভ করেছে। আগে আমাদের সামনে কেবল বাংলা গল্পের উদাহরণ ছিলো। এখন আমরা পৃথিবীর সকল বিখ্যাত গল্পকারের রচনা পাঠ করি, তাদের বিষয়ে বিচার-বিতর্ক করি, তাদের দোষ-গুণ খুঁজে বের করি এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকতে পারি না। এখন হিন্দি গল্পকারদের মধ্যে বিষয়, দৃষ্টিকোণ এবং শৈলী স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হতে শুরু করেছে—গল্প জীবনের অনেক নিকটবর্তী হয়ে গেছে। তার জমিন এখন ততোটা লম্বা-চওড়া নয়। তার মধ্যে অনেক রস, অনেক চরিত্র, অনেক ঘটনার স্থান নেই! গল্প এখন কেবল একটি প্রসঙ্গ, আত্মার এক ঝলকের সজীব হৃদয়স্পর্শী চিত্রণ। এই একত্বতা তাকে প্রভাব, আকস্মিকতা এবং তীব্রতায় ভরে দিয়েছ। এখন তার মধ্যে ব্যাখ্যার অংশ কম, সংবেদনশীলতার অংশ বেশি। তার শৈলীও এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। লেখকের যা কিছু বলার থাকে তা কম থেকে কম শব্দের মাধ্যমে বলে ফেলতে চান। তিনি নিজের পাত্র-পাত্রীর মনোভাবের ব্যাখ্যা করতে বসে যান না, সেদিকে কেবল ইশারা করেন। কখনো কখনো তো সম্ভাষণে দুয়েক শব্দের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলেন। এমন অনেক সময় আসে যখন পাত্র-পাত্রীর মুখ থেকে একটি শব্দ শুনেই আমরা তার মনোভাব পুরোপুরি অনুমান করে নিই, পুরো বাক্যের কোনো প্রয়োজন হয় না। এখন আমরা গল্পের মূল্য তার ঘটনা-বিন্যাস দ্বারা বিচার করি না, আমরা চাই পাত্র-পাত্রীর মনোগতি ঘটনার সৃষ্টি করুক। ঘটনার স্বতন্ত্র কোনো মহত্বই নেই। তার মহত্ব কেবল পাত্র-পাত্রীর মনোভাবকে ব্যক্ত করবার দৃষ্টি থেকেই—ঠিক সেরকম, যেমন শালগ্রাম স্বতন্ত্রভাবে কেবল এক পাথরের গোল টুকরা, কিন্তু উপাসকের শ্রদ্ধায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেবতা হয়ে যায়। একথা স্পষ্ট যে গল্পের আধার এখন ঘটনা নয়, অনুভূতি। আজকে লেখক কোনো সুন্দর দৃশ্য দেখে গল্প লিখতে বসে যান না। স্থূলসৌন্দর্য তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি তো এমন কোনো প্রেরণার প্রত্যাশী, যাতে সৌন্দর্যের ঝলক থাকে এবং তার দ্বারা তিনি পাঠকের সুন্দর ভাবনাকে স্পর্শ করতে পারেন।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top