কহলীল জিবরানের প্রজ্ঞান ।। চয়ন ও ভাষান্তরঃ গৌরাঙ্গ হালদার

শিল্প

শিল্প অবশ্যই শিল্পীর কল্পনা এবং তার দ্রষ্টার মধ্যেকার সরাসরি এক যোগাযোগ। আর তার জন্য যতটা সম্ভব আমি অতিমাত্রার ডিটেইলের সাথে দ্রষ্টার দৃষ্টিকে ব্যস্ত করা থেকে বিরত থেকেছি এজন্য যে, তার কল্পনা হয়ত দিগদিগন্তে ঘুরে বেড়াবে। প্রাকৃতিক রূপের মত, (যে) শিল্পের সৃজন নিজেই নিজেকে প্রকাশের তাড়না দেয়; তার রূপ অবশ্যই সুন্দর হবে। অন্যথায়, শিল্প এর উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।

এটা কি সত্যি যে ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, নাকি তার উল্টোটা? কল্পনাই একমাত্র স্রষ্টা, এর নিকটতম এবং উজ্জ্বলতম প্রকাশ হল শিল্প। হ্যাঁ, শিল্প হল জীবন, জীবন হল শিল্প। এর তুলনায় অন্য সবকিছু গতানুগতিক নিরস এবং অসার।

শিল্প হল দর্শনসাধ্য জানা থেকে অজানার দিকে একটা পদক্ষেপ।

শিল্পী

যদি আমাকে আমার উপবেশনকারীর চোখ ধার করতে হয় তাহলে আমার শিল্পে আমি তো এক বিশ্বাসঘাতক। মুখ হল এক বিস্ময়কর আয়না যা সবচেয়ে বিশ্বস্তভাবে হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশকে প্রতিফলিত করে। শিল্পীর কাজ হল তাকে দেখা এবং তা আঁকা। অন্যথায়, তিনি একজন শিল্পী হিসেবে সম্বোধিত হবার উপযুক্ত নন।

সৌন্দর্য

সৌন্দর্য হল তাই যা তোমার হৃদয়কে আকর্ষণ করে। যা দিতে ভালোবাসে কিন্তু নিতে নয়। যখন তুমি সৌন্দর্যের কাছে যাবে, তুমি অনুভব করবে যে তোমার ভেতরের তুমি, গভীরভাবে তাকে তোমার হৃদয়পুরে নিয়ে আসার জন্য হাতদুটো সামনের দিকে প্রসারিত করেছে। এটা দুঃখ এবং আনন্দের এক মহৎ সম্মিলন। এটা সেই অদেখা যা তুমি দেখ এবং সেই অস্পষ্টতা যা তুমি উপলব্ধি কর। এবং সেই নৈঃশব্দ যা তুমি শ্রবণ কর। এটা পবিত্রের মধ্যে পবিত্র যা তোমার নিজের ভেতরে শুরু হয় এবং সীমাহীনভাবে তোমার পার্থিব কল্পনার বাইরে শেষ হয়।

তুমি কি বহু ধর্মবিশ্বাস দ্বারা সমস্যাগ্রস্ত যা মানুষ ঘোষণা করেছে? তুমি কি সংঘাতরত বিশ্বাসের উপত্যকায় হারিয়ে গেছ? তোমার কি মনে হয় যে আত্মসমর্পণের জোয়ালের চেয়ে ধর্মবিরোধীতার স্বাধীনতা কম দুর্বহ? এবং নীরব বশ্যতার শক্ত ঘাঁটির চেয়ে ভিন্নমতের স্বাধীনতা নিরাপদ?

ঘটনা যদি এমন হয় তাহলে সৌন্দর্যকে তোমার ধর্ম মানো। এবং তোমার ঈশ্বর হিসেবে তাকে অর্চনা কর। কারণ সে-ই দৃশ্যমান ঈশ্বরের কাজের নিখুঁত প্রকাশ। দূরে থাকো তাদের থেকে যারা ধার্মিকতার সাথে ধোঁকাবাজির খেলা খেলেছে, লোভ এবং ঔদ্ধত্যকে একসাথ করেছে। কিন্তু তার পরিবর্তে বিশ্বাস করো সৌন্দর্যের প্রত্যাদেশে যার উপাসনায় একদা তোমার জীবনারম্ভ হয়েছে এবং যা তোমার সুখের ক্ষুধার উৎস।

সৌন্দর্যের কাছে যাবার আগে প্রায়শ্চিত্ত কর এবং প্রতিকার কর তোমার পাপের। সৌন্দর্যের জন্য তোমার হৃদয়কে আনিত করো নারীর সিংহাসনের কাছে যিনি তোমার অনুরাগের আয়না, এবং প্রাকৃতিকভাবেই যে তোমার হৃদয়ের শিক্ষাদাতা, যা তোমার জীবনের আশ্রয়স্থল।

শুধু আমাদের মরম সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে  অথবা এর সাথেই বেঁচে থাকে এবং বেড়ে ওঠে। এটা আমাদের মনকে হতবুদ্ধি করে। আমরা একে ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম। এ এক অনুভূতি যা আমাদের চোখ দেখতে পারে না। এটা এসেছে উভয়ত যিনি দেখছেন এবং যাকে দেখা হচ্ছে। বাস্তব সৌন্দর্য এক রশ্মি যা মর্মের শুদ্ধতার শুদ্ধতা থেকে প্রবাহিত হয় এবং দেহকে আলোকিত করে। পৃথিবীর গভীর থেকে যেভাবে জীবন আসে এবং ফুলকে গন্ধ ও রঙ দেয়।

সৌন্দর্য চেহারায় থাকে না; সৌন্দর্য হৃদয়ের ভেতরে এক আলো।

সত্ত্বা

কল্পনার ভেতরে আত্মার আয়নার পক্ষে কোনকিছুর  প্রতিফলন ঘটানো অসম্ভব যা এর আগেই বিদ্যমান নয়। শান্ত হ্রদের পক্ষে তার গভীরে কোন পর্বতের আকৃতি অথবা কোন গাছের ছবি বা মেঘের ছায়া দেখানো অসম্ভব যদি তা হ্রদের কাছাকাছি না থাকে। আলোর পক্ষে পৃথিবীর ওপরে কোন বস্তুর ছায়া ফেলা অসম্ভব যদি না তার কোন অস্তিত্ত্ব থাকে। কোনকিছুই দেখা, শোনা বা অন্য কোনভাবে অনুভূত হতে পারে না, যদি তার বাস্তব অস্তিত্ত্ব না থাকে।

খোদা

আদি থেকে মানুষ তার নিজেরই আত্মনের উপাসনা করছে। সেই নিজকে সে উপযুক্ত নামে ডাকছে। এখন পর্যন্ত, সে যখন “খোদা” শব্দ ব্যবহার করে তার মানে সেই একই খোদ বা নিজ।

বেশির ভাগ ধর্ম পুরুষ লিঙ্গের ভাষায় ঈশ্বরের কথা বলে। আমার কাছে তিনি যতটা পিতা ততটা মাতা। তিনি একাধারে মাতা এবং পিতা উভয়ই; এবং নারী মাতৃ-ঈশ্বর। পিতা-ঈশ্বরের নাগাল হয়তো মন অথবা কল্পনার মধ্য দিয়ে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মাতৃ-ঈশ্বরকে শুধু হৃদয়ের মধ্য দিয়ে- ভালোবাসার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়। এবং প্রেম সেই পবিত্র দ্রাক্ষারস যা ঈশ্বর তাদের হৃদয় থেকে প্রবাহিত করে পুরুষের হৃদয়ে সঞ্চার করেছেন। শুধুমাত্র তারাই এই বিশুদ্ধ এবং স্বর্গীয় স্বাদ পেতে পারে যাদের হৃদয় সমস্তরকম পাশবিক ক্ষুধা থেকে পরিশুদ্ধ হয়েছে। (যে) পরিশুদ্ধ হৃদয় প্রেমের মদে মাতাল (সে) মাতাল হবে ঈশ্বরের সাথে। অন্যদিকে যারা একে জাগতিক চাওয়ার মদের সাথে মিশিয়ে পান করবে তারা স্বাদ নেবে নরকের ভোগ উল্লাসের।

যাকে আমরা বুঝতে পারি না এমন ঈশ্বরের কথা অল্প এবং যাদেরকে আমরা অধিক বুঝতে পারি সেই পরস্পরের কথা বেশি বলা হলেই সেটা হত বিচক্ষণতা। তথাপি তোমাকে আমার জানাতে হবে যে আমরা ঈশ্বরের শ্বাস এবং সৌরভ। আমরা ঈশ্বর, পাতায়, ফুলে এবং প্রায়শ ফলে।

একত্ব

সৃষ্টির সকল বস্তু তোমার ভিতরে আছে এবং তোমার ভিতরের সকল বস্তু সৃষ্টির ভিতরে আছে। তোমার এবং নিকটতম বস্তুর মধ্যে কোন ভেদরেখা নেই। কোন দূরত্ব নেই তোমার এবং দূরতম বস্তুসমূহের মধ্যে। এবং সমস্ত বস্তু- সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ, ক্ষুদ্রতর থেকে বৃহত্তর সবকিছুই সমানভাবে তোমার ভিতরে আছে। একটা অণুর ভিতরে বিশ্বের সকল উপাদান নিহিত। মনের একটা গতিতে অস্তিত্ত্বের সমস্ত নিয়মসমূহের গতিসূত্র বিদ্যমান। জলের একটি ফোটার ভিতরে আছে সীমাহীন সমুদ্রের সমস্ত রহস্য। তোমার একটিমাত্র মুখাবয়বে আছে সমস্ত অস্তিত্ত্বের মুখাবয়ব।

সভ্যতা

প্রাচ্যের জাতিসমূহের দুর্দশা আমাদের পৃথিবীর দুর্দশা। এবং পশ্চিমে তোমরা যাকে বলো সভ্যতা, তা অন্যকিছু নয় কিন্তু বহু ট্রাজিক প্রবঞ্চনার আরেকটা ভৌতিক অপচ্ছায়া।

উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারসমূহ বরং দেহের জন্য পরিতৃপ্তি ও আরামের যখন তা শ্রান্ত এবং ক্লান্ত। দূরের বিজয়াভিযান এবং সমুদ্রের ওপরে আধিপত্য পক্ষান্তরে ভ্রান্ত অর্জন যা আত্মাকে সুখী করে না। তা না করে হৃদয়ের পরিপুষ্টি সাধন, না করে মর্মের উন্নতি। কেননা তারা প্রকৃতি থেকে যোজন যোজন দূরে। আর সেইসব কাঠামো এবং তত্ত্বসমূহ, মানুষ যাকে বলে জ্ঞান এবং শিল্প (art), তা লোহা এবং সোনার শিকল ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে মানুষ টেনে নিয়ে যায় এবং তাদের চকচকে প্রতিফলন আর ঝনঝন শব্দের সাথে সে আনন্দিত হয়। মানুষ এইসব দুর্ভেদ্য খাঁচাসমূহের গরাদ বহুকাল আগে থেকেই বানানো শুরু করেছিল। সে বোঝেনি যে সে এই খাঁচা বানাচ্ছিল খাঁচার ভেতরে থেকে। এবং অবিলম্বে চিরকালের তরে তাঁর নিজের খাঁচায় সে নিজেই কয়েদ হলো।

প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য

পশ্চিম পূর্ব থেকে উচ্চতর নয় অথবা নিম্নতর নয় পূর্ব থেকে। এবং এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য দাঁড়ায় তা বাঘ ও সিংহের মধ্যেকার পার্থক্যের চেয়ে বেশি কিছু নয়। এখানে আমি সমাজের বহিরঙ্গের পশ্চাতে একদম সঠিক এবং নিখুঁত এক নিয়ম খুঁজে পেয়েছি যা দুর্দশা, সমৃদ্ধি, এবং অজ্ঞানতায় সমতা দেখায়। এটা এক জাতি থেকে অন্য জাতিতে পক্ষপাত করে না, অথবা এক গোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করতে অন্য গোষ্ঠীর বিরোধীতা করে না।

ডাক্তার

পৃথিবীর শুরু থেকেই ডাক্তারগণ জনতাকে তাদের ব্যধি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ ব্যবহার করেছে ছুরি চাকু, আবার অন্যরা ব্যবহার করেছে এক মাত্রার তরল ঔষধ। তবুও মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে বাজে রকমভাবে। এটা আমার কামনা যে, রোগী তার দীর্ঘকালীন ক্ষত নিরাময়ের জন্য নিজেকে তার দূষিত শয্যায় সীমিত রাখুক। কিন্তু তার পরিবর্তে সে তার আলখাল্লার নিচ থেকে হাত বের করলো এবং যারা তাকে দেখতে এসেছিল তাদের প্রত্যেকের গলা এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যে, শ্বাসরোধ তাদের মৃত্যু অবধি নিয়ে গেল। অদৃষ্টের কি পরিহাস! দুষ্ট রোগী ডাক্তারকে হত্যা করলো এবং তারপর তাঁর চোখ বন্ধ করে নিজেই নিজেকে বললো, “তিনি ছিলেন একজন মহান চিকিৎসক।”

যুদ্ধ

তুমি আমার ভাই। তাহলে কেন তুমি আমার সাথে বিবাদ করছো? কেন তুমি আমার দেশ জবরদখল করছো এবং যারা কর্তৃত্ব ও মহিমা খুঁজছে তাদের খুশির জন্য আমাকে অধীনস্ত করার চেষ্টা করছো? যারা তোমার রক্ত দিয়ে মহিমা এবং তোমার মায়ের অশ্রু দিয়ে উচ্চ সম্মান কেনে, তাদের জন্য কেন তুমি তোমার স্ত্রী এবং সন্তানদের ছেড়ে এই দূরের ভূমিতে মৃত্যুর পেছনে ছুটছো? কোন মানুষের জন্য তার প্রজাতির অন্য কোন মানুষকে হত্যা করা কি মর্যাদার? যদি তুমি এটাকে মর্যাদার মনে করো তাহলে একে উপাসনার একটা নিয়ম হতে দাও এবং কেইনের জন্য একটা মন্দির নির্মাণ কর যে তার ভাই আবেলকে হত্যা করেছিল।

যুদ্ধক্ষেত্রের তীব্র ধোঁয়ার ভেতরে প্রেমিক প্রেমিকারা কি মিলিত হতে এবং চুম্বন বিনিময় করতে পারে?

কবি কি বন্দুকের ধোঁয়ায় ঢাকা তারকারাজির নিচে বসে তার গান রচনা করবে?

বীণাবাদক কি তার বীণা এমন রাতে বাজাবেন যে রাতের  নীরবতাকে সন্ত্রাস দ্বারা বলাৎকার করা হয়েছে?

দাসত্ব

আমি কাঞ্জির তীর থেকে ইউফ্রেটিসের তীর; নীলনদের উৎসমুখ থেকে অ্যাসিরিয়ার সমতল; অ্যাথেন্সের মল্লভূমি থেকে রোমের গির্জা; কনস্টান্টিনোপলের বস্তি থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাসাদসমূহ পর্যন্ত বহু যুগের সহগামী হয়েছি। কিন্তু সবখানেই আমি অজ্ঞানতার এক মহিমান্বিত এবং রাজকীয় শোভাযাত্রার সাথে এর সবখানেই দাসত্বের বিচরণ দেখেছি। আমি জনতাকে দেখেছি তাদের যৌবন  মূর্তির পায়ে উৎসর্গ করতে যারা তাকে বলে ঈশ্বর। তার পায়ে সুগন্ধি ও দ্রাক্ষারস ঢালে এবং তাকে রানী বলে ডাকে। তার কল্পিত ছবির সামনে ধূপকাঠি পোড়ায় এবং তাকে বলে নবী। তার সামনে হাঁটু গেড়ে উপাসনা করে এবং তাকে বলে আইন। তার জন্য মারামারি করে এবং মরে যায় আর তাকে বলে দেশপ্রেম। তার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তাকে বলে এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া। তার নামে ঘর এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করে ধূলায় মিশিয়ে দেয়া হয় আর তাকে বলা হয় ভ্রাতৃসংঘ। লড়াই, চুরি এবং কাজ করা হয় তার জন্য এবং তাকে বলা হয় সৌভাগ্য এবং সুখ। তার জন্য হত্যা করা হয় এবং তাকে বলা হয় সাম্য। সে বহু নামের অধিকারী কিন্তু বাস্তবতা অভিন্ন। তার অনেক লক্ষণ আছে কিন্তু তৈরি একটিমাত্র উপাদানে। সত্য হল, সে প্রত্যেক প্রজন্মের দ্বারা বংশধরদের জন্য রেখে যাওয়া এক চির-অক্ষয় অসুস্থতা।

তারা আমাকে বললোঃ যদি তুমি কোন দাসকে ঘুমাতে দেখ তাকে জাগিয়ো না। তাতে অন্তত সে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে পাবে।

আমি তাদের বললামঃ যদি তুমি কোন দাসকে ঘুমাতে দেখ তাকে জাগাও এবং তাকে মুক্তির কথা বলো।

শিকল

সবাই শৃঙ্খলের ভেতরে দমিত হয় না; কখনো কখনো একটা শিকল একটা কণ্ঠহারের চাইতে মহত্তর হয়।

বিদ্রোহ

বিদ্রোহবিহীন জীবন বসন্তহীন ঋতুসমূহের মতো। এবং ন্যায়বিহীন বিদ্রোহ এক শুষ্ক মরুভূমির মতো…জীবন বিদ্রোহ এবং ন্যায় এই তিন একের ভেতরে অবস্থান করে যাকে আলাদা বা পরিবর্তিত করা যায় না।

ঈশ্বর কি আমাদের প্রাণবায়ু মৃত্যুর পায়ের নিচে রেখেছেন? তিনি কি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন দাসত্বের ছায়া তৈরি করার জন্য? যে তার নিজের হাতে তার আত্মার আগুন নিভিয়ে দিলো, স্বর্গের দৃষ্টিতে সে এক অবিশ্বাসী। স্বর্গের জন্য আগুন লাগিয়ে দাও যা তোমার আত্মায় জ্বলছে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করে না সে নিজেই নিজের সাথে অবিচার করে।

আইন

আইন কি? একে স্বর্গলোকের গভীর থেকে সূর্যের সাথে আসতে কে দেখেছে? মানুষ কি ঈশ্বরের হৃদয় দরশন করেছে এবং এর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে? কোন শতাব্দীতে ফেরেশতারা জনতার মধ্যে হেঁটেছে এবং এটা বলে প্রচার করেছে যে- “জীবনের উপভোগ থেকে দুর্বলকে নিষিদ্ধ কর এবং আইনের বাইরে থাকা সবাইকে তলোয়ারের ধারালো প্রান্ত দ্বারা হত্যা কর, এবং পাপীকে লৌহ পদাঘাতে মাড়িয়ে যাও”?

তুমি কি মানুষের রূঢ় আইনের দ্বারা বাধ্য হয়ে তোমার স্ত্রী এবং সন্তানদের ছেড়ে আসা এক যোদ্ধা, এবং যুদ্ধের ময়দানে লোভের নামে আগে বাড়ছো যাকে তোমার নেতারা ভুলভাবে বলে কর্তব্য?

তুমি কি কিছু ক্ষুদ্র অপরাধে অন্ধকার দুর্গের এক কারাবন্দী? এবং যারা নিজেদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে মানুষের সংস্কার করতে চায় তাদের দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্ত?

তুমি কি এক যুবতী নারী যাকে ঈশ্বর সৌন্দর্য প্রদান করেছেন কিন্তু যে ধনীর লালসার শিকারে নিপতিত হয়েছে। যে তোমাকে প্রবঞ্চনা করেছে এবং তোমার দেহকে কিনেছে কিন্তু হৃদয় নয়। এবং তোমার দুর্দশা ও বেদনায় তোমাকে পরিত্যাগ করেছে?

যদি তুমি এর মধ্যে একজন হও তাহলে তুমি মানুষের আইনের হাতে খুন হয়ে যাওয়া এক মানুষ। তুমি চরম দুর্দশাগ্রস্ত এবং তোমার দুর্দশাগ্রস্ততা অত্যাচারীর অবিচার, শক্তিমানের অন্যায়, ধনীর পাশবিকতা, লোলুপ ও কামুকের আত্মকেন্দ্রিকতার ফল।

বিধান

লোকে বলে যে আমি ন্যায়বিধান, পারিবারিক বন্ধন এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের শত্রু। ঐসব লোকেরা সত্য কথাই বলে। আমি মানুষের তৈরি বিধানকে ভালোবাসি না…আমি ভালোবাসি নিষ্কলুষ এবং আত্মিক সদাশয়তা যা এই পৃথিবীর প্রতিটি আইনের উৎস হওয়া উচিৎ। মানুষের মধ্যে দয়াময়তা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি।

মানবসমাজ সত্তুর শতাব্দী দিয়েছে বিধানসমূহের  বিকৃতিতে যতক্ষণ না এটা চিরকালীন এবং উত্তম বিধানাবলী বুঝতে পেরেছে…আত্মিক অসুখ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে উত্তরাধিকার হয়ে এসেছে যতক্ষণ না এটা জনজীবনের অংশে পরিণত হয়। এবং তারা এটাকে অসুখ হিসেবে দেখে না, দেখে স্বাভাবিক উপহার হিসেবে, ঈশ্বর কর্তৃক আদমের উপরে বর্ষিত হিসেবে। এই সকল লোক যদি উক্ত অসুখের জীবাণু থেকে মুক্ত কাউকে পায় তাহলে তারা তাকে ভাবে লজ্জার এবং কলঙ্কের।

স্বাধীনতা

আমি স্বাধীনতা ভালোবাসি। এবং সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য আমার ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে দাসত্বের কাছে জনতার আত্মসমর্পণের, নিপীড়ন ও অত্যচারের, অতীতকালে নির্মিত ভয়ঙ্কর মূর্তিসমূহের কাছে তাদের দাসখতের, এবং দাসদের খসখসে ঠোঁট দ্বারা চকচকে হওয়া জ্ঞানের জন্মের সাথে। কিন্তু আমি আমার স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসার সাথে সেইসব দাসদের ভালোবাসি- শান্তরূপে হিংস্র পশুর চোয়ালে তাদের অন্ধ চুমু খাওয়ার জন্যে। যন্ত্রণাকর অসচেতনতায় ভাইপারের হাসিতে বিষ অনুভব না করার জন্যে এবং অজান্তে তাদের নিজেদের কবর নিজেদেরই আঙুলে খোঁড়ার জন্যে।

ভীরু আত্মসমর্পণের ছায়ার ভেতরে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্তির জন্য মৃত্যু মর্যাদার। যিনি সত্যের তরবারি হাতে নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তিনি সত্যের অবিনশ্বরতার সাথে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। জীবন মৃত্যুর চেয়ে দুর্বল এবং মৃত্যু সত্যের চেয়ে দুর্বল।

পৃথিবীতে মুক্ত তার নিজের বিরোধিতা করে নিজেকে কয়েদ করার জন্য তৈরি করলো এক কারাগার। সে যখন তার নিজের জ্ঞাতি থেকে বিচ্ছিন্ন সে তখন ভালোবাসার স্নেহস্পর্শে এবং চিন্তায় দাস।

স্বাধীনতাবিহীন জীবন আত্মাবিহীন দেহের মত। এবং চিন্তাবিহীন স্বাধীনতা এক বিভ্রান্ত আত্মার মতো। জীবন, চিন্তা এবং স্বাধীনতা একের ভিতরে তিন। চিরকালীন এবং কখনো ছেড়ে যায় না।

স্বাধীনতা তার টেবিলে আমাদের আহবান করে যেখানে আমরা তার সুস্বাদু খাদ্য এবং উত্তম মদ্য পেতে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু যখন আমরা তার সাথে বসি, আমরা লোলুপের মত খায় এবং পেটের ভারে নিজেদেরকে হাঁসফাঁস অবস্থায় নিয়ে যায়।

তুমি হয়তো আমার হাত এবং পা শিকল দিয়ে বাঁধতে পারো; তুমি এমনকি আমাকে একটা অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করতে পারো। কিন্তু তুমি আমার ভাবনাকে দাস করতে পারো না কারণ তা মুক্ত।

ন্যায়বিচার

কর্তৃপক্ষ যখন হত্যাকারীকে হত্যা করে তা কী ন্যায়বিচার প্রদর্শন করে? যখন তা ডাকাতকে কারারুদ্ধ করে? যখন তা প্রতিবেশী দেশের জনগণকে হত্যা করার জন্য পাঠায়? কর্তৃত্বের ব্যাপারে ন্যায়বিচারক কি চিন্তা করে যার অধীনে এক খুনি খুনির শাস্তি দেয় এবং এক চোর চোরের দণ্ডবিধান করে?

যখন এক মানুষ আরেক মানুষকে হত্যা করে, জনতা বলে সে একটা খুনি। কিন্তু শাসক যখন তাকে হত্যা করে, শাসক একদম সঠিক। যখন কোন লোক ধর্মশালা থেকে কিছু হরণ করে জনতা বলে সে একটা চোর। কিন্তু আমির যখন তার জীবন থেকে ছিনিয়ে নেয়, আমির তখন মাননীয়। যখন একজন নারী তার স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তারা বলে সে এক ব্যভিচারিণী। কিন্তু আমির যখন তাকে উলঙ্গ করে রাস্তায় হাঁটায় এবং পরে পাথর নিক্ষেপ করে, তখন আমির মহৎ। রক্তপাত নিষিদ্ধ কিন্তু কে একে আমিরের জন্য আইনসম্মত করেছে? কারো টাকা চুরি করা অপরাধ কিন্তু কারো প্রাণনাশ করা এক মহৎ কাজ। স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা একটা খারাপ কাজ কিন্তু জীবন্ত আত্মাকে পাথর নিক্ষেপ করা এক মনোহর দৃশ্য। আমরা কি মন্দকে মন্দ দিয়ে মোকাবিলা করবো এবং বলবো যে এটাই হল আইন? আমরা কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো ব্যাপক দুর্নীতি বিস্তার করে লড়বো এবং বলবো যে এটাই নিয়ম? আমরা কি অপরাধ জয় করার জন্য আরো অধিক অপরাধের সাথে অগ্রসর হবো এবং বলবো যে এটাই ন্যায়বিচার?

ন্যায়বিচার থেকে যে উপহার আসে তা পরোপকারের বসন্তের চাইতে মহত্তর।

মানবতা

পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সত্ত্বার মর্মবস্তু হল মানবতা এবং মানবতা ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়ায়। ছেড়াখোঁড়া কাপড়ের পিছনে লুকায় এর উলঙ্গতা। গর্ত হয়ে যাওয়া গালের ওপরে ঝরায় অশ্রু এবং দরদী স্বরে তার সন্তানদের ডাকে। কিন্তু সন্তানগণ তাদের গোষ্ঠীর গীত গাওয়াতেই ব্যস্ত। তারা ব্যস্ত তাদের তলোয়ারে ধার দিতে এবং তাদের মায়ের কান্না তারা শুনতে পায় না।

পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সত্ত্বার মর্মবস্তু হল মানবতা এবং সেই সর্বোচ্চ সত্ত্বা প্রেম ও সদিচ্ছার প্রচার করে। কিন্তু জনতা ওই ধরনের শিক্ষাকে উপহাস করে। নাজারিনের যিশু শ্রবণ করেছিলেন এবং ক্রুশে মৃত্যু ছিল তার নিয়তি। সক্রাতেস এই স্বর শ্রবণ ও অনুসরণ করেছিলেন এবং তিনিও তার শিকার হয়েছিলেন। নাজারিন এবং সক্রাতেসের অনুসারীগণ ঈশ্বরের অনুসারী এবং যতক্ষণ না জনতা তাদের হত্যা করে, তারা উপহাস করবে। বলবে, “হত্যার চাইতে উপহাস আরও বেশি তিক্ত।”

আমার আত্মা আমাকে বললো এবং দেখালো যে, আমি পিগমিদের থেকে বেশি কিছু নই অথবা দৈত্যের থেকে কম কিছু নই।

শীঘ্রই আমার আত্মা আমাকে বললো, আমি মানবতাকে দুজন মানুষ হিসেবে দেখিঃ একজন দুর্বল, আমি যাদের দরদী, এবং অন্যজন শক্তিশালী যাদের আমি অনুসরণ করি অথবা প্রতিরোধ করি।

কিন্তু এখন আমি জানি যে আমি ছিলাম উভয়ই এবং অভিন্ন উৎস থেকে জাত। আমার উৎস তাদের উৎস। আমার চৈতন্য তাদের চৈতন্য। আমার বিবাদ তাদের বিবাদ এবং আমার তীর্থ তাদের তীর্থ।

যদি তারা পাপ করে তাহলে আমিও পাপী। যদি তারা ভালো কিছু করে আমি তাদের ভালো কিছু করার গর্ব গ্রহণ করি। যদি তারা জেগে ওঠে আমিও তাদের সাথে জেগে উঠি। যদি তারা নিষ্ক্রিয় থাকে আমি তাদের অক্রিয়তা ছড়িয়ে দেই।

*ভাষান্তরের জন্য ১৯৯৬ সালে ইউবিএস পাবলিশার্স লিমিটেড, দিল্লী থেকে পুনঃপ্রকাশিত ‘দ্য উইসডম অফ কহলীল জিবরান’ এর ইংরেজি সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top