লেনিন-পর্ব ১২।। আশানুর রহমান

লেনিন-পর্ব ১২। বিদায় মস্কো স্ট্রীট ।।

পরীক্ষা শেষ হলে অংক খাতাটা জমা দিয়ে ভলোদিয়া বাড়ীর পথ ধরে। শীতকালটা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভোর রাতে ঠান্ডা পড়লেও দিনের বেলা কোন কোন দিন একটু গরমই পড়ে। মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল যে গ্রীষ্মের বাতাসে যেন তারই আগমনী গন্ধ। স্কুলের সামনে থেকে ফুটপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভলোদিয়া খেয়াল করে কিছুদিন আগেও দু’পাশের গাছগুলো সব পাতাহীন ছিল। হঠাৎ করে কারো মনে হতেই পারতো গাছগুলো বোধ হয় মরে গেছে বা যাচ্ছে। সেই সব গাছের ডালে ডালে এখন নতুন কুঁড়ি। একটু এগিয়ে যেতেই একটি ওক গাছের ডালে একটা মাছরাঙা দেখতে পেয়ে ভলোদিয়া খুব খুশী হলো। মাছরাঙা তার খুবই প্রিয়। কয়েকবছর আগে পোষা মাছরাঙাটার কথা তার মনে পড়লো। এমন সময় কিচিরমিচির শব্দে চোখ তুলে উপরে তাকাতেই সে এক ঝাঁক হাঁস উড়ে যেতে দেখলো। শীতের শুরুতে এই হাঁসগুলো হয়তো একটু উষ্ণতার জন্য দূর কোন দেশে পাড়ি নিয়েছিল। শীত শেষ হচ্ছে তাই তারাও ফিরে আসছে। ভলোদিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাঁসগুলো উড়ে যেতে দেখলো। হাঁসগুলো দৃষ্টি সীমার অনেক দূরে যেতেই সে আবার বাড়ীর পথে হাঁটতে শুরু করে। গত দু’মাস সিমবিরস্কির বাতাস যেন তার কাছে বড্ড ভারী ভারী লাগে। চারপাশে কেমন যেন দম বন্ধ একটা পরিবেশ। সাশার গ্রেফতারের খবরটি এখন শহরের বাচ্ছা ছেলে-মেয়েরাও জানে। যে পরিবারটির এত বন্ধুবান্ধব এবং ঘনিষ্ট সব লোকজন ছিল সেই পরিবারটিই যেন রাতারাতি সব কিছু হারিয়ে ফেললো। যারা ঘনিষ্ঠ ছিল খুব দ্রুততার সাথে তারা একটা দূরত্ব তৈরী করে ফেললো। যারা পরিচিত, তারা অপরিচিতের মতো ব্যবহার করতে শুরু করলো। মন খারাপ নিয়ে বাড়ী ফিরতে থাকা ভলোদিয়া সেসব কথায় ভাবছিল। আগামী দু’দিন তার কোন পরীক্ষা নেই। পরের পরীক্ষাটা লজিকের উপর। তাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছে মে মাসের ৫ তারিখে। মা শেষ চিঠিটি লিখেছিল দু’সপ্তাহ আগে। গত কয়েকদিন মায়ের কোন চিঠি আসেনি। তাই সাশা বা আন্নার নতুন কোন খবরও পাওয়া যায়নি। মা সেন্ট পিটার্সবার্গ গেছেন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। দেখতে দেখতে মে মাস এসে গেলো। আজ মাসের ১০ তারিখ। সময় যেন ছুঁটছে ট্রেনের মতো। ভলোদিয়া হাঁটতে হাঁটতে এক সময়  মস্কো স্ট্রীটে এসে পড়ে। মস্কো স্ট্রীটে তাদের বাড়ী ঢোকার মুখেই একটি ছোট্ট মুদির দোকান আছে। এখান থেকে অনেক সময় তারা টুকিটাকি জিনিষপত্র কিনে থাকে। দোকানী লোকটা মধ্য বয়সী। লোকটির মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। মানুষটা কথা বলতে পছন্দ করে। তার দোকানের খরিদ্দারদের সাথে সে যেমন ক্রমাগত প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথা বলে তেমনি যখন দোকানে কেউ থাকে না, তখন রাস্তা দিয়ে চলাচল করা পরিচিতজনদের ডেকে ডেকে এটা সেটা জিগ্যেস করে। মানুষটা ভলোদিয়াদের সব ভাই-বোনকেই চেনে। তার দোকানে এসময় লোকজন সাধারণতঃ কম থাকে। ভলোদিয়াকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে দোকানী বেশ জোরে জোরে ডাকলেন,

-ভ্লাদিমির, ভ্লাদিমির, একটু শুনে যাও। জরুরী কথা আছে।

ভলোদিয়া জানে তার জরুরী কথাটা আসলে জরুরী নয়। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভলোদিয়া দোকানটার কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই  লোকটি অনেকটা ফিসফিস করে জানতে চাইলো,

-আলেকজান্ডারের কোন খবর জানো?

ভ্লাদিমির মাথা নেড়ে ‘না’ বলে আবার বাড়ীর পথ ধরে। দোকানী ভলোদিয়া চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গেট দিয়ে বাড়ীর সামনের লনে এসে পৌঁছাতেই ভলোদিয়ার কানে এলো ওলগা এবং ছোট্ট মারিয়া কথা বলছে। এমন সময় প্রতিবেশী মারিয়া সাবেনকো পিছন থেকে ভ্লাদিমির, ভ্লাদিমির বলে জোরে জোরে ডাকতে ডাকতে তাদের বাড়ীর দিকে আসতে থাকে। ভলোদিয়া সেই ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মারিয়া সাবেনকো অনেকটা যেন ছুটে এলেন। তাঁর হাতে একটি পত্রিকা। মারিয়া সাবেনকোর কন্ঠ শুনতে পেয়ে ইতোমধ্যে বাড়ীর ভিতর থেকে ওলগা এবং ছোট্ট মারিয়াও লনে এসে দাঁড়ায়েছে। তিনি কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে পত্রিকাটি ভলোদিয়ার হাতে দিয়ে বলে,

-তোমরা এখনও খবর পাওনি? দেখো পত্রিকায় কি লিখেছে!

ভলোদিয়া বেশ অবাক হয়ে তাঁর হাত থেকে পত্রিকাটি নিলো। পত্রিকাটির নাম ‘সিমবিরস্কি প্রাদেশিক খবর’। ততক্ষণে ওলগাও এসে ভলোদিয়ার কাঁধ ঘেষে দাঁড়ায়। বিশেষ বুলেটিন নাম দিয়ে ছাঁপানো পত্রিকাটি বড় বড় অক্ষরে লিখেছে, ‘জার হত্যার ব্যর্থ চেষ্টার দায়ে আলেকজান্ডার উলিয়ানভসহ পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর’। হেডলাইনটি দেখেই ভলোদিয়া পত্রিকাটি হাতে ধরা অবস্থায় লনের ঘাসের উপর ধপ করে বসে পড়ে। ওলগা ‘ও মাগো’ বলে মাটির উপর শুয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার কান্না যেন বিলাপে রুপ নেয়। সে ক্রমাগত গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করতে থাকে ৷ তার চিৎকার শুনে ভিতর থেকে তাদের খালা আন্না এবং ন্যানী বারবারা সারবাতরোভাও ছুটে আসে। সেই সাথে  দিমিত্রিও। ওলগা তখন চিৎকার করে বলতে থাকে,

-আমি জারকে নিজ হাতে খুন করবো।

খালা আন্না দ্রুত তার কাছে এসে ওলগার মুখ চেপে ধরে। চাপা কন্ঠে বলে,

-ওলগা, মা আমার! এসব কথা বলতে হয় না!!

কিন্তু ওলগা মুখ থেকে খালার হাতটি সরিয়ে দিয়ে বিলাপ করতেই থাকে। ওলগার কান্না দেখে এবং ভলোদিয়াকে লনের ঘাসের উপর বসে থাকতে দেখে কি হয়েছে সেটা না বুঝেও ছোট্ট মারিয়া এবং দিমিত্রি কাঁদতে শুরু করে। প্রতিবেশী মারিয়া সাবেনকো এই অবস্থায় কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি তখনও ভলোদিয়া খুব কাছেই দাঁড়িয়ে। এমন সময় কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট মারিয়া ভলোদিয়ার কাছ ঘেঁষে তার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। মারিয়ার মনে হলো ভলোদিয়া বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। নয় বছরের মারিয়া ভলোদিয়া কি বলছে সেটা শোনার জন্য ঝুঁকে ভলোদিয়ার মুখের কাছে মাথাটা নিয়ে এলে শুনতে পেলো ভলোদিয়া বলছে, “এ পথে নয়, সাশা। অন্য পথও আছে”।

ভলোদিয়াকে বিড়বিড় করতে দেখে মারিয়া সাবিনকোও নিচু হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আসেন। ভলোদিয়া কি বলছে তিনিও শোনার চেষ্টা করলেন। তিনি যেন শুনতে পেলেন ভলোদিয়া বলছে,

-জারকে কড়ায়-গন্ডায় এর জন্য মূল্য দিতে হবে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি।

বিস্মিত মারিয়া সাবেনকো তখন নীচু গলায় প্রশ্ন করে,

-কিভাবে জারকে মূল্য দিতে হবে?

ভলোদিয়া তার প্রশ্নের মুখে নিজের মধ্যে যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। মারিয়া সাবেনকোর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়ে সে বলে ওঠে,

-বাদ দিন সে কথা। কিন্তু আমি জানি এর জন্য তাদের মুল্য দিতেই হবে।

ঠিক সে সময় সাশার পোষা বিড়ালটা বাড়ীর ভিতর থেকে ভলোদিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিড়ালটি এদিক-ওদিক তাঁকালো। মাথাটা নীচু করে যেন ঘাসের গন্ধ নিতে চেষ্টা করলো। তারপর পিছনের দু’টি পায়ের উপর ভর দিয়ে সামনের দু’টি পা সোজা করে বিড়ালটি ভলোদিয়ার সামনে সটান বসে পড়ে। ভলোদিয়া চকিতে একবার বিড়ালটির দিকে তাকায়। বিড়ালের বসার ভঙ্গি দেখে ভলোদিয়া একটু অবাক হলো। বিড়ালটিও বোধহয় ভলোদিয়ার চোখে কিছু একটা খুঁজছিল। বিড়ালটি সামনের বাম পা’টি দিয়ে বারবার নিজের মুখ ঘষতে থাকে। অনেক সময় মুখে মাছি বা অন্য কোন কিছু বসলে যেমনটা সে করে থাকে। ভলোদিয়া প্রথমে দু’হাত বাড়িয়ে বিড়ালটিকে কোলে তুলে নিলো। তারপর নিজেও উঠে দাঁড়ায়। বিড়ালটিকে ডান হাতের উপর বসিয়ে বাম হাতের কব্জিটা একটু বাঁকা করে ভলোদিয়া বিড়ালটিকে আদর করতে শুরু করে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর খবর পেয়ে ভেরা কাশকাদামোভা এলেন ৬৪ নম্বর মস্কে স্ট্রীটে । তিনি বসার ঘরে ঢুকেই দেখলেন কালো সোফাটার উপর বসে ওলগা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে জড়িয়ে ধরে ওদের খালা আন্না বসে আছেন। তাঁর চোখে-মুখেও কান্নার ছাঁপ। অন্যপাশের সোফায় বসে ভলোদিয়া মারিয়া এবং দিমিত্রিকে সামলাচ্ছে। তিনি কিছুটা ইতস্ততঃ করে শেষ পর্যন্ত ভলোদিয়া যেখানে বসে আছে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। ভলোদিয়া তাঁকে দেখতে পেয়ে  একটু সরে বসে তাঁর বসার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা করে দিলো। ভেরা কাশকাদামোভা ভলোদিয়াকে দেখে আরেকবার অবাক হলেন তার এমন শান্ত ও দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করতে দেখে। এমন বয়সী একটি ছেলের কাছ থেকে এমন আচরণ তিনি ঠিক আশা করেননি। ভলোদিয়াদের বাসায় আসার পথে তিনি দেখে এসেছেন শহর কর্তৃপক্ষ সিমবিরস্কিবাসীদের জানানো কর্তব্যজ্ঞান করে সাশার ফাঁসি নিয়ে শহরে পোষ্টার লাগাচ্ছে। এই সংবাদটি এখনই দেয়া ঠিক হবে কিনা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বাড়ীর পরিবেশটি বিবেচনা করে তিনি একবার ভাবলেন কথাটা এখনই জানাবেন না। আবার ভলোদিয়ার এমন দায়িত্বশীল আচরণ করতে দেখে ভাবলেন কথাটা ভলোদিয়াকে বলা যেতে পারে। মারিয়া এবং দিমিত্রি একটা খেলনার দিকে মনোযোগী হতেই তিনি যতটা সম্ভব নিচু গলায় ভলোদিয়াকে বললেন,

-সাশা কেন যে এমন একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল?

কথাটা বলার পর তাঁর মনে হলো তিনি কথাটি না বললেও পারতেন। তাঁর এমনও মনে হলো ভলোদিয়া বোধহয় কথাটা শুনতে পায়নি। কারণ সে সময় দিমিত্রিও ভলোদিয়ার কাছে কিছু একটা চাচ্ছিল। কিন্তু ভেরাকে অবাক করে দিয়ে ভলোদিয়া বলে ওঠে,

-এটার কারণ হয়তো এটাই যে, ঐ কাজটি করা ছাড়া সাশার অন্য কোন বিকল্প ছিল না। ভলোদিয়ার উত্তর শুনে ভেরা কাশকাদামোভা চমকে উঠলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে ভলোদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

৬৪ নন্বর মস্কো স্ট্রীটের যে বাড়ীটা কিছুদিন আগেও ছেলে-মেয়েদের হৈ চৈ এবং ছুটাছুটিতে সরগরম থাকতো সেই বাড়ীটিই এখন বাইরে থেকে মনে হয় মৃতপূরী। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। তখনও ওলগা এবং ভলোদিয়ার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সেদিন ১৫ ই মে। দুপুর বেলা। ভলোদিয়া এবং ওলগা স্কুল থেকে তখনও ফেরেনি। ন্যানী বারবারা সারবাতরোভা রান্নাঘরে কাজ করছে। ছোট্ট মারিয়া বসার ঘরে তখন একাই খেলছিল। হঠাৎ বারবারা রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ীর পিছনের বাগানের দিকে তাকাতেই দেখে ধীর পদক্ষেপে মারিয়া আলেকজান্দ্রাভা বাড়ীর দিকে এগিয়ে আসছেন। প্রথমে বারবারা তাঁকে ঠিক চিনে উঠতে পারেনি। গত কয়েক মাসে একি চোহারা হয়েছে? চুলে পাঁক ধরেছে, শরীর ভেঙে গেছে। সে রান্নাঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে পিছনে যাবার দরজার দিকে ছুটে গেলো। মারিয়াকে এভাবে বাড়ীর পিছন দিয়ে ঢুকতে দেখে বারবারা অবাক হলেও মুখে কিছু না বলে সে দরজাটা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। মারিয়া দরজা দিয়ে ঢোকার সময় বারবারার কাঁধে একটা হাত রাখলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। রান্নাঘর দিয়ে তিনি বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই মায়ের পায়ের শব্দ পেয়েই যেন ছোট্ট মারিয়া খেলা ফেলে ঘুরে তাকায়। মাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে সে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মারিয়া আলেকজান্দ্রাভা দু’হাত বাড়িয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতেই সে কাঁদতে শুরু করে। ছোট্ট মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মারিয়া ভাবলেন, ‘কেন সে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল? তাকে তো বাঁচতে হবে তার সন্তানদের জন্যই। শেষ সাক্ষাতের সময় সাশাও তো এই কথাটাই তাকে বলেছিল’।’

মারিয়া ফিরে আসার দিন তিনেকের মাথায় ঘটনাটি ঘটলো। সাশার ফাঁসির খবরটি পাবার পর বাড়ীর পরিবেশটাই পাল্টে গেছে। ভলোদিয়া বাড়ী ফিরে দেখে ওলগা তখনও পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী আসেনি। সাধারণত ওলগা ভলোদিয়ার একটু আগেই ফেরে।

ওলগাকে দেখতে না পেয়ে বসার ঘরে ঢুকেই ভলোদিয়া মাকে প্রশ্ন করে,

-মাম্মাচুকা (রুশ ভাষা, বাংলায় মা), ওলগা এখনও ফেরেনি?

মারিয়া ভলোদিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলে,

-না, এখনও তো ফেরেনি। অন্যদিন তো আগেই ফেরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে হয়তো।

মায়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ভলোদিয়া বসতে যাবে এমন সময় ওলগা ঢুকলো ঝড়ের বেগে। সোজা মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ওলগার এমন আচরণে মারিয়া ও ভলোদিয়া অবাক হলো। মারিয়া জোর করে ওলগাকে ছাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইলো,

-ওলগা, কি হয়েছে? এমন করছো কেন?

ভলোদিয়াও এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে,

-ওলগা, শান্ত হও! কি হয়েছে? আমাদেরকে বলো!

অন্যদিনের মতো আজ ওলগারও পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার পনের মিনিট আগেই সে পরীক্ষার হলে পৌঁছায়। তাদের ক্লাসের সবাই ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। পরীক্ষার হলে শিক্ষকও উপস্থিত। ওলগা ঢোকার সাথে সাথে হলের সবাই একযোগে উঠে দাঁড়ায় এমনকি শিক্ষকও। ওলগা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই রুম থেকে চলে যেতে থাকে। শেষ মেয়েটিও বের হয়ে গেলে শিক্ষকটিও যখন চলে যাচ্ছে তখন ওলগা দৌঁড়ে গিয়ে জানতে চাইলো,

-স্যার, কি হয়েছে? সবাই এভাবে বের হয়ে গেলো কেন? আপনিও বা এভাবে চলে যাচ্ছেন কেন?

শিক্ষকটি প্রথমে কোন কথা না বলেই চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রুমের দরজাটা পার হবার আগে কি মনে করে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন,

-তোমার ভাই আলেকজান্ডার উলিয়ানভ যে জঘণ্য কাজ করেছে সে কারণে তোমার ক্লাসের মেয়েরা এমনকি আমি নিজেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার সাথে বসে আমরা কিছুই করবো না। মেয়েরা তোমার সাথে বসে আজ পরীক্ষা দিতেও রাজী নয়।

-মানে? আমি তাহলে পরীক্ষা দিতে পারবো না?

-এ প্রশ্নটি তুমি স্কুল প্রধানকে করো, আমাকে নয়।

কথাটা বলেই তিনি হন্ হন্ করে চলে গেলেন। ওলগা সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে। তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসছিল। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সে ছুটে যায় হেডস্যারের কাছে। সব শুনে হেডস্যার বললেন,

-ওলগা, আমি অন্যদের এমন ব্যবহারে সত্যিই মর্মাহত। তুমি চিন্তা করো না। আমি আলাদা করেই তোমার পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা করছি।

অন্য শিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী ফিরতে তাই ওলগার আজ একটু দেরী হয়। স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথটুকু  কান্নাটা চেপে রাখতে পারলেও বাড়ীতে এসে কোনভাবেই সে আর চাপা কান্নাটকু ধরে রাখতে পারেনি। সব শুনে মারিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ক্রোধে ভলোদিয়ার মুখ লাল হয়ে ওঠে।

সেদিনের পর থেকেই মারিয়া যেন অনুভব করলেন প্রতিবেশীরা বা ইলিয়ার বন্ধুস্থানীয় যারা তাদের বাড়ীতে আসতেন তারা কেউ এখন আর আসে না। উলিয়ানভ পরিবারের এমন দূর্ভোগ ও কষ্টকর দিনে তাদের না আসার বা যোগাযোগ বন্ধ করে দেবার কারণও কি তাহলে একই? উলিয়ানভ পরিবার এখন জারের শত্রু? জারের শত্রু মানে দেশের শত্রু? চার্চগুলোর কাছে যেমন জার বিরোধীতা আর ধর্ম বিরোধীতা সমান? আর একারণেই কী নানা বিবেচনায় এই মানুষগুলো তাদের সাথে সব ধরণের সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো? কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো যে ভেরা কাশকাদামোভা এবং অল্প কিছু পরিবার ছাড়া কেউ তাদের সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। সিমবিরস্কির যারা সম্মানীয় যেমন ডাক্তার, শিক্ষক, প্রশাসনের লোকজন, সামরিক বাহিনীর লোকজন তারা সবাই যেন উলিয়ানভ পরিবারটিকে বয়কট করলো।

এমন পরিস্থিতিতে মারিয়া উলিয়ানভা দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভেবে দেখলেন সিমবিরস্কিতে তাদের সামাজিক অবস্থাটা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে চেনা মানুষগুলো যেন হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। চারপাশের পরিবেশটা এমনই যেন ভাল করে নিঃশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। আন্না এখন ককুশকিনোতে। ভলোদিয়া পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে কিন্তু সে কোথাও ভর্তির অনুমতি পাবে কিনা সেটা এখনও নিশ্চিত না। ভলোদিয়া যদিও সেন্ট পিটার্সবার্গে পড়তে চায় কিন্তু মারিয়া জানে সে অনুমতি তাকে হয়তো দেয়া হবে না। এখান থেকে খুব কাছের বিশ্ববিদ্যালয় হলো কাজান ইমপেরিয়াল। ভলোদিয়ার বাবা ইলিয়াও ঐখান থেকে পাশ করেছিলেন। ককুশকিনো থেকে কাজানের দূরত্ব মাত্র ৩০ মাইল। কাজানে তার নিজের ছোট বোন থাকে। চেষ্টা করলে ভলোদিয়াকে কাজানে ভর্তি করা যেতে পারে। প্রয়োজন হলে তিনি কাজানে ভলোদিয়ার সাথেই থাকবেন এবং পরিবারের সবাইকে সেখানে নেবেন। তাছাড়া মারিয়া চান না ভলোদিয়া একা একা গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাক এবং সাশার মতো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ুক। সব দিক বিবেচনা করে মারিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন আপাততঃ তাঁরা ককুশকিনোতে যাবেন। ভলোদিয়া কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে তাঁরা কাজান চলে যাবেন। মনে মনে এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে তিনি তাঁর বোন আন্না ভেরেটেননিকোভা এবং লুবভ আরদাশেভাকে চিঠি লিখলেন এই বলে যে  জরুরীভাবে ককুশকিনো ষ্টেটে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের থাকার দরকার পড়েছে। তাদের কোন আপত্তি আছে কিনা। চট জলদি বোনেরা জানালো তাদের কোনই আপত্তি নেই। আর তখনই মারিয়া ৬৪ নম্বর মস্কো স্ট্রীটের বাড়ীটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি ভেরা কাশকাদামোভা ও থিডোর কেরেনেস্কিকে খরিদ্দার দেখতে অনুরোধ করলেন। দিন সাতেকের মধ্যেই ক্রেতাও জুটে গেলো। সিমবিরস্কির পুলিশ প্রধান বাড়ীটি কিনে নিলেন ছয় হাজার রুবলে। ভলোদিয়াদের পরীক্ষা শেষ হবে জুন মাসের ছয় তারিখ। গোছগাছ করার জন্য হাতে দু’সপ্তাহ সময় নিয়ে তিনি ক্রেতাকে জানালেন বাড়ী ছেড়ে দেবেন জুন মাসের বিশ তারিখে। বাড়ী বিক্রি চূড়ান্ত হলে তিনি গেলেন ব্যাংকে। ষ্টেট ব্যাংকে ইলিয়ার একাউন্টে প্রায় দু’হাজার রুবল ছিল। মারিয়া হিসাব করে দেখলেন ককুশকিনোর ষ্টেটের আয়, নাবালক বাচ্ছাদের জন্য সরকারের দেয়া ভাতা এবং ইলিয়ার পেনশন বাদে মোট আট হাজার রুবল এখন তার হাতে আছে।

ভলোদিয়ার পরীক্ষার ফলে বের হলে দেখা গেলো লজিক ছাড়া ভলোদিয়া সব বিষয়েই সর্বোচ্ছ ‘গ্রেড ৫’ পেয়েছে। শুধুমাত্র লজিকে সে পেয়েছে ‘গ্রেড ৪’। তবু ক্লাসের ২৯ জন ছাত্রের মধ্যে সে প্রথম হলো। ফলে সেরা ছাত্র হিসাবে

সাশার মতো ভলোদিয়াও গোল্ড মেডেল পেলো। অন্যদিকে ওলগা সিমবিরস্কি মেরিনস্কয়া জিমনেজিয়া থেকে প্রথম হওয়ায় সেও গোল্ড মেডেল পায়। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় দুই ভাইবোন একই সাথে গোল্ড মেডেল পাওয়ায় শহরে শোরগোল পড়ে গেলো। স্থানীয় পত্রিকাগুলো, চার্চের লোকজন এবং শহরের গণ্যমান্যরা দু’টি স্কুলেরই প্রধান শিক্ষককে ব্যপক সমালোচনা করতে শুরু করে। এই ঘটনায় মারিয়া আলেকজান্দ্রাভা আরেকবার ভীষণ মর্মাহত হলেন এবং একই সাথে ভাবলেন তাঁর সিমবিরস্কি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়েছে।

থিডোর কেরেনেস্কির কাছ থেকে প্রশংসাপত্র নিতে হবে। ভলোদিয়া নিজেই গেলো প্রশংসাপত্রের জন্য। স্কুল বন্ধ হলেও অফিস খোলা। ভলোদিয়া হেডস্যারের রুমে ঢুকতেই দেখে স্যারের টেবিলে সাত/আট বছরের একটি ছেলের ছবি। ভলোদিয়া শুনেছিল স্যারের এই বয়সী একটি ছেলে আছে। তবে কি এই সেই ছেলেটি?

ভলোদিয়াকে দেখে খুব আন্তরিকতার সাথে তিনি বসতে বললেন। ভলোদিয়া একটু ইতস্ততঃ করে বসলো। তিনি জানতে চাইলেন,

-তুমি কোথায় পড়তে চাও?

-আমার ইচ্ছে ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গে পড়ার। কিন্তু মাকে বলতেই মা জানালেন যে সেখানে পড়ার অনুমতি হয়তো পাওয়া যাবে না। তাই মা চাচ্ছেন যেন আমি কাজান ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করি।

-হুম। তোমার মা ঠিকই অনুমান করেছেন। উলিয়ানভ পরিবারের যে কারোর জন্যই সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনুমতি পাওয়াটা এখনই সহজ হবে না। কিন্তু কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চাও?

-আমার ইচ্ছে জুরিপ্রুডেন্স পড়ি।

-জুরিপ্রডেন্স? তোমার কি মাথা খারাপ? তুমি কেন ল’ পড়বে? তোমার উচিত সাহিত্য এবং ইতিহাস নিয়ে পড়া। তুমি গ্রীক এবং ল্যাটিনে এত ভাল যে এমন ছাত্র আমি আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে পাইনি। আমি মনে করি এটা খুবই ভুল একটা সিদ্ধান্ত। তোমার মা জানেন যে তুমি ল’ পড়বে?

-আমি কথা বলবো।

-তোমার মা কি তোমার সাথে কাজানে থাকবেন?

-মায়ের ইচ্ছে তেমনই।

-সেটাই বোধ হয় ভাল হবে। তাছাড়া এতে তোমার ভর্তির অনুমতি পেতে সুবিধা হবে। তুমি একটু বসো।

তিনি পাশের ঘরে গেলেন। ভলোদিয়া বুঝলো তিনি মনে মনে একটু বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু ভলোদিয়া জানে সে কি করতে চায়। হেডস্যার চলে গেলে ভলোদিয়া ছোট্ট ছেলেটির ছবিটির দিকে ভাল করে লক্ষ্য করতে থাকে। ছেলেটির দাঁড়াবার ভঙ্গি, পোষাক, এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দু’টো যেন বলে দিচ্ছে ছেলেটি আর পাঁচজনের থেকে একটু আলাদা। এমন সময় হেডস্যার ঘরে ঢুকলেন। ভ্লাদিমিরকে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন,

-ওর নাম আলেকজান্ডার কেরেনেস্কি। আমার ছেলে। তোমার সাথে বোধ হয় ওর দেখা হয়নি। সে তো এখানে থাকে না, তাই বোধ করি তুমি দেখোনি।

চেয়ারে বসতে বসতে তিনি প্রশংসাপত্রটি ভলোদিয়ার হাতে দিয়ে বললেন,

-পড়ে দেখো।

ভলোদিয়া দ্রুত একবার চোখ বুলায়। থিডোর কেরেনেস্কি লিখেছেন,

“অত্যন্ত মেধাবী, প্রবল উৎসাহী এবং নিখুঁত চরিত্রের অধিকারী উলিয়ানভ সব ক্লাসে সবার শীর্ষে ছিল এবং স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় যোগ্যতম ছাত্র হিসাবে সে স্বর্ণপদক লাভ করেছে।

স্কুলের ভিতরে এবং বাইরে কথায় বা কাজে উলিয়ানভ কোনদিন কোন শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের সাথে কোনরকম অসদাচরণ করেনি। তার পিতা-মাতা অত্যন্ত যত্নের সাথে তার লেখাপড়ার তদারকি করেছেন এবং তার বাবার মৃত্যুর পর তার মা লেখাপড়া এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছেন। ধর্ম এবং নৈতিকতা হলো উলিয়ানভের শিক্ষার ভিত্তি। পারিবারিকভাবে সঠিকভাবে বেড়ে উঠায় উলিয়ানভের এমন চমৎকার ব্যবহারের কারণ।

তার পারিবারিকভাবে বেড়ে উঠা এবং চারিত্রিকগুণাবলী ঘনিষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করার কারণে আমি এ কথা উল্লেখ না করে পারছি না যে, সে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখতে পছন্দ করে এবং অন্যদের, যারা নিজেরাও সবাই চমৎকার ছাত্র তাদের থেকে উলিয়ানভ নিজেকে আলাদা করে রাখতো বিশেষতঃ তার অন্তর্মুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। এ কারণে উলিয়ানভের মা চান না যে তার পুত্র বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার তদারকির বাইরে থাকুক।”

ভলোদিয়া প্রশংসাপত্রটি পড়ে হেডস্যারের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় চেয়ে থাকে। হেডস্যার তখন বললেন,

-এটা তোমার প্রাপ্য।

সেদিন বাড়ী ফিরেই হেডস্যারের দেয়া প্রশংসাপত্র, স্কুলের ছাড়পত্র, দেশের জন্য ভলোদিয়ার বাবার অবদানের একটি প্রত্যায়নপত্র, জন্ম সনদপত্র, বাপ্টিজমের সনদপত্র এবং দুই কপি ছবি সংযুক্ত করে উলিয়ানভ কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর এন. এ. ক্রেমলেভ বরাবর ল’ অনুষদের ছাত্র হিসাবে ভর্তির সুযোগ চেয়ে তার আবেদনপত্রটি পাঠিয়ে দিলো। আবেদনপত্রটির সাথে যে ছবি দু’টো সে রেক্টরকে পাঠালো সেটা ছিল স্কুলের ইউনিফরম পরা। সেই ছবিতে নিটোল চেহারার ভ্লাদিমিরকে দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগছিল। মাথার চুল পিছন দিকে আঁচড়ানো। ছবিতে ভলোদিয়ার ঠোঁটদুটো দেখতে অনেকটা মেয়েদের মতো লাগলেও, খাড়া নাক এবং বুদ্ধিদীপ্ত চোখের ভলোদিয়াকে সবকিছু মিলিয়ে খুব আকর্ষণীয় লাগছিল। ভলোদিয়া সেই আবেদনপত্রে যোগাযোগের ঠিকানা হিসাবে ব্যবহার করলো ককুশকিনোকে।

ভলোদিয়াদের ককুশকিনোতে যাবার প্রস্তুুতি চলছে। সব কিছু গোছগাছ হয়ে গেলে মারিয়া ঠিক করলেন জুন মাসের ২০ তারিখেই তারা রওনা দেবেন। মস্কো স্ট্রীটের বাড়ী থেকে স্টীমার ঘাট প্রায় ৪ মাইল। মালামাল বহন করার জন্য কুলি এবং গাড়ী ঠিক করা হয়ে গেছে। আগামীকাল সকালেই রওনা দেবার কথা। মারিয়া তাড়াতাড়ি  ছেলেমেয়েদেরকে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে বললেন। ডিনার শেষে ভলোদিয়া তার ঘরে যেতেই ওলগা এসে হাজির। ভলোদিয়া দেখে ওলগার চোখের কোনায় পানি। তাকে হাত ধরে নিজের চেয়ারটিতে বসিয়ে বলে,

-ওলগা, বাস করার জন্য ককুশকিনো পৃথিবীর অন্যতম সেরা জায়গা। ওখানে গেলে আমাদের ভাল লাগবে। তাছাড়া কতদিন পর আমরা অ্যানিউটাকে দেখতে পাবো!

ভলোদিয়ার কথায় ওলগা মাথা নাড়ে। হাতের আঙুল দিয়ে চোখের কোনায় জমে থাকা পানিটুকু মুছে ফেলে। ভলোদিয়া আবার বলে,

-তোমার মনে আছে? বাবা তখন বেঁচে আছেন। এক বড় দিনে বাবা জানতে চেয়েছিলেন আমরা মস্কো গেলে কেমন হয়? তুমি তখন জানতে চেয়েছিলে, ‘বাবা, মস্কোতে নিশ্চয় সিমবরস্কি স্ট্রীট আছে? তাহলে আমার আপত্তি নেই’। মনে আছে তোমার?

-হ্যাঁ। আমার খুব মনে আছে। বাবা তখন বললেন, ‘তাইতো, এমনটা আমার কেন মনে হয়নি? ভলোদিয়া, পড়ার ঘরে একটা ম্যাপ আছে। খুঁজে দেখো তো, মস্কোতে সিমবিরস্কি স্ট্রিট বলে কিছু আছে কিনা। তারপর তুমি আর আমি দু’জনেই তন্ন তন্ন করে মানচিত্র ঘাঁটলাম। কিন্তু ঐ নামের কোন রাস্তা খুঁজে পেলাম না।

-তবে কি জানো? সেই ঘটনার পর মানচিত্র দেখে যে কোন শহরের রাস্তা-ঘাট খুঁজে খুঁজে বের করা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

-তোমার খারাপ লাগছে না? এত বছর আমরা এই বাড়ীতে থাকলাম, কত স্মৃতি! এই বাড়ী ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি! তোমার সত্যিই খারাপ লাগছে না?

ওলগার কথায় ভলোদিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তাটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। চোখটা একটু সরিয়ে ভলোদিয়া দেখে বাড়ীর পিছনের লেবু গাছের পাতাগুলো জোসনার আলোয় যেন ঝকমক করছে। হঠাৎ ভলোদিয়া বলে ওঠে,

-চলো, বাগানে যাই।

-এখন? মা রাগ করবেন না?

-চলো, মাকে বলেই যাই।

কিছুক্ষণ পরই দেখা গেলো বাড়ীর পিছনের লেবু বাগানে ভলোদিয়া এবং ওলগা হাত ধরাধরি হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে আসে বাড়ীর এক পাশে সেই ঘরটির কাছে যে ঘরটিকে সাশা ল্যাবরেটরী বানিয়েছিল। চাঁদের আলোয় ঘরের দরজার কড়ায় হাত দিতেই ওলগার হাত জড়িয়ে যায় মাকড়সার জালে। ওলগা দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হু হু করে কেঁদে ফেলে। ভলোদিয়া এগিয়ে এসে ওলগার কাঁধে নিজের হাতটি রাখে। মৃত সাশার জন্য, মস্কো স্ট্রিটের স্মৃতিময় এই বাড়ীটার জন্য ওলগার সেই কান্নাটুকু ভলোদিয়াকেও যেন স্পর্শ করে। নিজের চোখের কোনায় একটা শিরশির অনুভূতি টের পেয়ে ভলোদিয়া দূর আকাশের চাঁদের দিকে তাকালো। হঠাৎ এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদকে ঢেকে ফেলে। নিঝুম এবং শুনশান সেই রাতে ভলোদিয়ার কানে আসে অদূরে ভলগার তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ।

Facebook Comments

comments

১ Reply to “লেনিন-পর্ব ১২।। আশানুর রহমান”

  1. আসলাম হায়াত বলেছেন:

    লেনিন-পর্ব ১৩ কবে পাবো?

আসলাম হায়াত শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top