প্রবন্ধ ।। উর্দু সাহিত্যের পরম্পরা : ২ ।। জাভেদ হুসেন

জন এলিয়া : না বলা না শোনার কবি

জন এলিয়া মুশায়রায় কবিতা পড়া শুরু করলে সব শ্রোতা পিঠ সোজা করে বসতেন। ছিপছিপে গড়ন, কাঁধ পর্যন্ত এলোমেলো চুল, অধিকাংশ সময় আকন্ঠ পানে বেসামাল, জড়ানো গলা। রাতের বেলায়ও চোখে কালো চশমা, কারন, “মানুষের আসল চেহারা আর সহ্য হয় না”। কবিতা পড়তে পড়তে কপাল চাপড়াচ্ছেন, বলছেন – আমি এক ব্যর্থ মানুষ, আপনারা কেন আমার কবিতা শুনে সময় নষ্ট করছেন? পাঠের মাঝখানেই উঠে চলে যাচ্ছেন, পাশের কবিরা আবার তাঁকে ধরে বসাচ্ছেন। তিনি ভরা আসরেই বলছেন, “এই আসরেই আছে সেই মানুষ, যার জন্য আমি বরবাদ হলাম”। বলে কাঁদতে কাঁদতে কবিতা পড়া বন্ধ। সেই ‘মানুষ’কে যদিও তিনি ছাড়া আর কেউ কোন দিন দেখেনি।

জন সাহেবের প্রথম বই বের হয় মৃত্যুর বছর। উনি বই ছাপার মতো কবিতা লিখতেন বলে মনে করতেন না। ফারসি কবিতার অনূরাগী ছিলেন। বলতেন- ফারসি কবি হাফিজ, রুমি যদি পিএইচডি হন তো উর্দু কবি গালিব, মীর মাস্টার্স আর তিনি বড় জোর ক্লাস এইটের ছাত্র। সব মিলিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা পাওয়া যেত তাঁর গোটা ২৫ কবিতা । যার কাছে এইসব কবিতা ছিলো তাঁকে তরূনরা কবিতার পুজিপতি বলে ডাকতো।

জন এলিয়ার জন্ম অবিভক্ত ভারতের আমরোহায় ১৯৩১ সালে। পরিবার ছিল সৈয়দ, বাবাও ছিলেন পন্ডিত,কবি। বলা হয় যে, আমরোহার সদ্যজাত বাচ্চাও সুর আর ছন্দ ঠিক রেখে কাঁদে। জন বলতেন যে তাঁর প্রথম কবিতা লেখা হয় ৮ বছর বয়সে। এক পরিচারিকার সমবয়সি কন্যার প্রেমে পড়ে চড় খেয়ে লিখেছিলেন:

চাহ মে ইসকি তামাচে খায়ে হ্যায়
দেখ লো সুরখি মেরে রুখসার কি
(তাকে চাওয়ার বাসনায় চড় খেলাম
চেয়ে দেখো আমার চেহারার লালিমা)

কবিতার চেয়ে কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো। বন্ধুবৎসল, কিন্তু কবিতার ব্যাপারে ছাড় নেই। কবিতা পছন্দ না হলে ভরা আসরেই কবিকে যাচ্ছে তাই শুনিয়ে দিতেন। নিজে বিদ্যান মানুষ। উর্দু, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, সংস্কৃত, পাঞ্জাবি আর হিব্রু ভাষায় পন্ডিত। কিন্তু লিখতেন একদম সরল চলতি ভাষায়।

কবিরা খেয়ালের জগত থেকে কবিতা নিয়ে আসেন। জন কবিতার জগতকে নিজের বাস্তব দুনিয়ায় এনে তাতেই বাস করতেন। জন সাহেবের স্ত্রী যাহিদা হিনা নিজে একজন খ্যাতনামা লেখক ছিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিলো এরকম, “জনকে যখন সুখী মনে হতো তখন সে সুখী থাকতো না, যখন তাঁকে দুখি মনে হতো তখনও সে দুখি থাকতো না”।

জেনারেল জিয়াউল হকের মন্ত্রী সভায় ২জন জামাতে ইসলামির দুই মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হলো। জন এলিয়া লিখলেন:

নিসবতে ইলম হ্যায় বহুত হাকিমে ওয়াক্ত কো আজিয
উসনে তো কারে জেহেল ভি বেউলামা নেহি কিয়া
(জ্ঞানের সান্নিধ্য এই কালের শাসকের খুব ভাল লাগে
নির্বোধের মতো কাজও তিনি পন্ডিতদের সঙ্গে না নিয়ে করেন না)

এই কবির সঙ্গে আধ ঘন্টা কথা বললে প্রতি পাঁচ মিনিটে তাঁকে কখনো শিয়া, কখনো নাস্তিক, কখনো কমিউনিস্ট বা বস্তুবাদী বলে মনে হতো। এগুলো যেন নাটক ছিলো বেশি মানুষের সঙ্গে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার। এটা সরালেই হয়তো আসল জন সাহেবকে পাওয়া যাবে:

মুসতাকিল বোলতা হি র‍্যাহতা হু
কিতনা খামোশ হু ম্যায় আন্দার সে
(সারাক্ষণ কথা বলতেই থাকি
কতটা নীরব ভেতরে ভেতরে আমি)

তবে এই নিরন্তর কথকের ভূমিকার আড়ালে আসলে নিজের অব্যাখ্যত বেদনার মান বাঁচানোর জন্য নিরন্তর চেষ্টা দেখা যায়:

চারাসাযোঁ কি চারাসাযি সে দর্দ বদনাম তো নেহিঁ হোগা
হাঁ দাওয়া দো মাগার য়ে বাতলা দো মুঝে আরাম তো নেহি হোগা
(এই সব সমব্যাথিদের সমবেদনায় বেদনা বদনাম হবে না তো?
হ্যাঁ, ওষুধ দাও, তবে ঠিক করে বলো, ব্যাথা কমে যাবে না তো?)

বেদনাই যদি না থাকে তবে অস্তিত্তই তো অর্থহীন হয়ে যায়। আর প্রেম, সে তো মনকে চিরকাল আটকে রাখতে পারে না:

যিন্দেগি কিস তরহা বসর হোগি
দিল নেহিঁ লাগ রাহা মুহাব্বত মেঁ
(কী করে যে কাটবে জীবন
মনই বসছে না ভালোবাসায়)

এই ভালবাসাও তো জীবনের, বেঁচে থাকার লক্ষ্য হিসেবে নিতান্ত কাছের জিনিস। এর জন্য জীবন ব্যয় করার মানে হয় না। একে কঠিন বলে ভেবে তো খুব বিপদে পড়তে হয়:

হাম সামঝে থে ইশক কো দুশওয়ার
য়ে ভি আসান হ্যায় কেয়া কি জায়ে
(আমি প্রেমকে কঠিন ভেবেছিলাম
এও দেখি সহজ, এখন কী করি!)

যাকে ভালবাসি, তার চেয়ে আমি যে তাঁকে চাই, সেই চাওয়া অনেক বেশি বড়। আমার জীবন কেমন কাটবে, তা সে নয়, আমার চাওয়াই ঠিক করে দেয়:

উসকি উম্মিদে নায কা হাম সে য়ে মাংগ থা কে আপ
উম্র গুযার দিজিয়ে উম্র গুযার দি গ্যায়ি
(তাকে পাওয়ার আশার অহঙ্কার আমার কাছে দাবী করলো
এমনিই জীবন কাটিয়ে দাও, জীবন কাটিয়ে দিয়েছি)

উর্দু কবিরা প্রেমাষ্পদের গলিতেই জীবন কাটিয়ে দেন। জন কিন্তু কোন কারনেই সেই গলিতে জীবনভর কাটিয়ে দিতে রাজি নন। তেমন হলে সে গলি ছেড়ে আসতে পিছপা হন না। কিন্তু তাতেও শান্তি মেলে না:

উস কি গলি সে উঠ কে ম্যায় আন পড়া থা আপনে ঘর
ইক গলি কি বাত থি অওর গলি গলি গ্যায়ি
(তার গলি ছেড়ে এসে পড়ছিলাম নিজের ঘরে
এক গলি দুরত্ব ছিলো, সারা জীবন অলিগলিতে কেটে গেলো)

আসলে যাকে পাওয়া যায়, তার জন্য সময় নষ্ট করে কী হবে! যেমন-তেমন কিছু চেয়ে নিজেকে তো ছোট করে ফেলা কাজের কিছু নয়:

ও জো না আনেওয়ালা হ্যায় না উসকো হামসে মতলব থা
আনেওয়ালে সে কেয়া মতলব আতে হ্যায় আতে হোংগে
(যে আসবে না কখনো, তাকেই আমার চাই
যে আসবে তার কাছে কী? আসছে আসবে)

এখন এই না-পাওয়াকে চাওয়ার মাঝে এক ঝুঁকি আছে। যদি জেনেই যাই যে তাকেই চাই যাকে কখনো পাবো না, বা যাকে কখনো পাবো না তাকেই চাই, তাহলে বহমান জীবনে এক শুন্যতা জমাট বাঁধে। জীবনে শুধুই বেঁচে থাকার বিপদ হাজির হয়:

বেদিলি কেয়া য়ুহি দিন গুযার জায়েঙ্গে
সির্ফ যিন্দা রহে হাম তো মর জায়েঙ্গে
(এমন মন খারাপ করেই জীবন কেটে যাবে নাকি?
যদি শুধুই বেঁচে থাকি, তাহলে তো মরেই যাবো)

একা ভালোবাসা যায়, প্রেম একপাক্ষিক হয় না। ফলে যখনই প্রেম নিয়ে বাগাড়ম্বর হয়, জন সন্দিহান হয়ে পড়েন:

কেয়া কাহা ইশক জাভেদানি হ্যাঁয়
আখরি বার মিল রহে হো কেয়া
(কী বললে? প্রেম অমর?
এই কি আমাদের শেষ দেখা নাকি?)

প্রেমে ভালবাসার মানুষকে নিজের জীবন বলার প্রথা আছে। এখানে একটা ধাঁধা তৈরি হয়। তুমি যদি আমার জীবন হও, তাহলে তুমি চলে যাবার পর আমি বেঁচে আছি কী করে? আর তুমি ছাড়া এই যে অসহ জীবন, সেই জীবনও কী তুমিই?

আব মেরি কোয়ি যিন্দেগি হি নেহি
আব ভি তুম মেরি যিন্দেগি হো কেয়া
(এখন আমার জীবন বলতে কিছু বাকি নেই
বলো তো, এখনো কি তুমি আমার জীবন?)

এই জীবন নিতান্তই দিনগত কাল ক্ষয়, মানুষ তাকেই কি অপূর্ব দক্ষতায় কাল কাটানোর শিল্প করে তোলে:

যিন্দেগি ইক ফন হ্যায় লমহোঁ কো
আপনে আন্দায সে গাঁওয়ানে কা
(জীবন হচ্ছে মুহুর্তগুলোকে
নিজের মতো করে নষ্ট করার কৌশল)

কিন্তু যাই বললেই যাওয়া হয় না। মনে দ্বিধা থেকেই যায়। এই দ্বিধা যে কতো বড় আশা হয়ে জীবন হয়ে উঠতে পারে তা জনের অগ্রজ মির্জা গালিব বলেছিলেন:

হুয়ি মুদ্দত কে গালিব মর গ্যায়া পর য়াদ আতা হ্যায়
ও হর ইক বাত পর ক্যাহনা কে য়ুঁ হোতা তো কেয়া হোতা
(বহু দিন হলো গালিব মরে গেছে, তবু মনে পড়ে
প্রতিটি কথায় সে বলতো – এমন হলে কেমন হতো)

কেমন হতো? জনও জানেন না সে প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু তিনিও বার বার সেখানেই ফিরে যান:

জানে গুমান কি ও গলি অ্যায়সে জাগা হ্যায় কওন সে
দেখ রহে হো তুম কে ম্যায় ফির ওহি জা কে মর রাহা
(কী জানি দ্বিধার গলি কোন এমন জায়গা
দেখছ তো, আবার সেদিকেই মরতে এসেছি আমি)

কিন্তু এত কিছুর পর, প্রেম তো সেই যা প্রেমাষ্পদের সব ঘাটতি, অবহেলার পরও তাকেই অনন্য ভেবে নেয়:

য়ে মুঝে চ্যায়েন কিউ নেহি পড়তা
ইক হি শখস থা জাহান মে কেয়া
(এই আমি কিছুতেই শান্তি পাই না কেন
এক জনই মানুষ ছিলো না কি পৃথিবীতে!)

এই পাওয়া না-পাওয়া, অবহেলা আর মায়ার আবরণেও একটা বড় প্রশ্ন মনে আসে:

কিতনা দিলকশ হো তুম কিতনা দিল জু হু ম্যায়
কেয়া সিতম হ্যায় হাম লোগ মর জায়েঙ্গে
(কতো সুন্দর তুমি, কতো কোমল হৃদয় আমার
আমরা দুজনেই মরে যাবো একদিন, এ কেমন অন্যায়!)

এ বড় সহজ, কিন্তু উত্তরহীন নিষ্ঠুর প্রশ্ন। প্রায় হাজার বছর আগে ওমর খৈয়ামও তা করেছিলেন। কাজী নজরুলের অনুবাদে:

আকাশ যেদিন দীর্ণ হবে, আসবে যেদিন ভীম প্রলয়
অন্ধকারে বিলীন হবে গ্রহ তারা জ্যোতির্ময়
প্রভূর আমার দামন ধরে বলবো কেঁদে ‘হে নিঠুর
নিরপরাধ মোদের কেন জন্মে আবার মরতে হয়?’

প্রচলিত মতে, সৃষ্টিকর্তা বলেছিলেন, ‘হও’, আর তাতেই এই বিশাল জগত সৃষ্টি হয়েছে। জনের কাছে মনে হয়েছিল, তিনি আর একটু সময় নিয়ে জগত তৈরি করলেও পারতেন। এতো তাড়াহুড়োর কাজে খুব ভালো কিছু আশা কর যায় না:

হাসিলে কুন হ্যায় য়ে জাহানে খারাব
ইয়েহি মুমকিন থা ইতনি উজলাত মেঁ
(‘হও আর হয়ে গেল’ এরই ফল এই এলোমেলো জগত
এতো তাড়াহুরোতে এর চেয়ে ভাল কিছু সম্ভব ছিলো না)

এই অসম্পূর্ণতার জগতে সবচেয়ে বেশি ভোগে মানুষ। কারন তার বুঝতে পারার চেষ্টা। কিন্তু পরিতাপের ব্যপার, এখানে তার দূঃখ নিয়ে তার পক্ষ নিয়ে কথা বলবার কেউ নেই:

সব খুদা কে ওয়াকিল হ্যায় লেকিন
আদমি কা কোয়ি ওয়াকিল নেহি
(সবাই খোদার পক্ষ্যের উকিল
মানুষের পক্ষ্যে ওকালতির কেউ নেই)

মানুষের ভাবনার খোরাক আসে তার চার পাশ হতে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যে চিন্তার জন্ম, সেই চিন্তা সাব্জেক্টিভ। এই একাকীত্ব চিরকালীন নয়, সেও আমার সমাজ আর জগত চলার ধরণের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এখন সেই সত্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না:

দুনিয়া মেরে ওজুদ কে আশোবগাহ হ্যায়
অওর ইস হুজুম মেঁ তানহা খাড়া হু ম্যায়
(জগত আমার অস্তিত্তের বিলাপঘর
আর এই কোলাহলে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি)

জন এলিয়া করাচিতে গত হয়েছিলেন ২০০২ সালে নভেম্বরের ৮ তারিখে। তিনি কথা বলতে ভালবাসতেন। মনে করতেন এই বলা শুধু একা মানুষের নয়। মানুষের ইতিহাসও কথা বলে। যা অনূভব করা যাচ্ছে, ব্যক্তি আর সমগ্র যা বুঝতে পারছে তা বলা দরকার। তা বলতে পারার মতো দুনিয়া সৃষ্টি করার কাজ সবচেয়ে আগে অনূভব করতে পারা চাই কবির। এক মুশায়রায় তিনি বলছিলেন, মানুষের গত ছয় হাজার বছরের ইতিহাস দুই লাইনে এভাবেই বলা যায়:

ইক হি হাদসা তো হ্যায় অওর ও য়ে
বাত কহি নেহি গ্যায়ি বাত সুনি নেহি গ্যায়ি
(ঘটনা তো একটাই, আর তা হলো এই
কথা বলাই হয়নি, কথা শোনাই হয়নি)

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

Facebook Comments

comments

১ Reply to “প্রবন্ধ ।। উর্দু সাহিত্যের পরম্পরা : ২ ।। জাভেদ হুসেন”

  1. Sekander Abu Zafar বলেছেন:

    লেখাটি পড়ার শুরুতে ভেবেছিলাম দু-একটি লাইনের উদ্ধৃতি দিবো, কিন্তু পুরো লেখাটা পড়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, আসলে পুরো লেখাটাই উদ্ধৃতি। লেখাটা তুলে রাখলাম সময়ে-সময়ে পড়া জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top