গারো লোকগল্প ।। পর্ব ৩ ।। ম্যাগডিলিনা মৃ

আচিক গ্রন্থ
অনেক অনেক আগে আচিকরা এক দেশে বাস করত নাম ছিল মান্দালাই। সেখানে তারা নানা সাজে অনেক অর্থ ব্যয় করে একটা সুন্দর গ্রাম বানিয়েছিল। গ্রামে নিজেদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর উঁচু ঘর এবং দেব দেবীদের প্রার্থনার জন্য মন্দির বানিয়েছিল। বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া খোদাই করে আচিকরা নিজেদের সাহিত্য, ধর্মীয় জীবনযাপনের রীতি রেওয়াজ, রাজ্য শাসনের নীতি এবং নানান ঘটনা সেখানে লিপিবদ্ধ করে রাখত।

সেই সময়ে আচিকরা, যাদের মান্দি বলে ডাকা হতো, তারা ছিলো প্রচুর সম্পদশালী, সভ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সম্মৃদ্ধ জাতি। তাদের নিজেদের রাজা ছিল। যুদ্ধ করার জন্য ছিল দুই দিক ধারালো তলোয়ার, তীর-ধনুক, বল্লম এবং আরো নানা অস্ত্র যা তারা নিজেরাই বানাত । মান্দিরা ততদিনে কীভাবে লোহা এবং স্টিল খনন আনতে হয় তা শিখে গিয়েছিল। নিজেদের পোশাক তৈরি করাও শিখে গিয়েছিল। এমনকি মনোবিজ্ঞান সম্পর্কেও তাদের ধারণা জন্মেছিল। এতসব ঐশ্বর্যের মধ্যে তারা ভুলেই গিয়েছিল তাদের এই সাম্রাজ্য এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে কারো আক্রমণে।

কোনো এক বছর আচিক আসং এর দক্ষিণ থেকে একদল বুনো মানুষ আচিক আসং আক্রমণ করেছিল। আচিক আসং এর সাজানো সম্পদশালী গ্রামকে তারা পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। ঠান্ডা মাথায় অনেক জ্ঞানী এবং সাহসী মান্দিকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করে।
রাজার নেতৃত্বে আচিক আসং এর আক্রমণকারীদের একদল অরোরংদী নদীর তীরে গারো পাহাড়ের পশ্চিমে অবস্থান নেয়। আরেকদল মান্দি আসং তিবোতগিরির দিকে আশ্রয় নেয়। এই আক্রমণে আচিকদের যাবতীয় সব ধ্বংস হয়ে যায়। আচিকদের দৈনন্দিন জীবনের রীতি রেওয়াজ, দেশ পরিচালনার নীতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সবকিছুই খোদাই করা ছিলো পশুর চামড়ায় যা ধ্বংস হয়ে যায়।

সেই সময়ে তিবোতগিরি মাটি ছিল অনুর্বর, শুকনো। গারো তিবতগিরিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে লাগল। ধীরে ধীরে অনাহারে কাটাতে লাগল এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে সূর্যের দিক বিপরীতে যাত্রা শুরু করল। যখন তারা গারোয়ার ব্রী অঞ্চলে এসে পৌঁছলো তাদের সঙ্গে থাকা খাবার ইতিমধ্যে ফুরিয়ে গেছে। এই জায়গাটি ছিল অনেকটা গাছপালা শূন্য এবং চারপাশ ছিলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা । খাবার জন্য চারপাশে কোন কিছুই পেল না, এমনকি জলও পেল না। চারপাশ কেবল শুষ্ক আর শুষ্ক। গারোয়ার ব্রীতে অনেক আচিকই খাবারের অভাবে মারা গেল। দিনে দিনে খাবারের অভাবে আচিকরা তাদের গোপন বিদ্যা হারাতে লাগল। ধীরে ধীরে গারোয়ার ব্রী নামক জায়গাটি ছেড়ে যখন পাহাড় থেকে নীচের দিকে যাত্রা শুরু করল নতুন আবাসস্থলের খোঁজে তখন নতুন একটি দেশ আবিষ্কার করলো এবং সেখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। এই নতুন দেশের ভূ-প্রকৃতি এমনই যে আচিকরা শারীরিকভাবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অলস হয়ে গেল।

নতুন জায়গায় আচিকদের প্রথম চাহিদা ছিলো খাবার যোগাড় এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। ফলে তারা এই দু চাহিদার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করতে লাগল । ধীরে ধীরে আচিকরা পুনরায় তাদের বুদ্ধি এবং মেধা কাজে লাগিয়ে আগের মত করে সবকিছু নির্মাণ করতে লাগল কিন্তু দুঃখের বিষয় যে অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও তাদের হারিয়ে যাওয়া চামড়ালিপি তারা কোনোভাবেই পুনরায় তৈরি করতে পারেনি। এবং ততদিনে তা ভুলে গেছে। শুধু সেসব সোনালী দিনের স্মৃতি তাদের মধ্যে রয়ে গেছে। এই কারণেই আচিকদের মধ্যে অশিক্ষিত মানুষ দেখা যেত।

গল্প বলেছেনঃ সান্তা গাবিল
গ্রামঃ সিংলিমারি, দারাং, আসাম

 

সালারাম মিথডিচাক
আচিকদের একদল যখন সালারাম মিথডিচাক অঞ্চলে বসবাস করতে লাগল তখন দেখা গেল এক আচিক নারী নুনুই নানখি নইনি মেচিক তাঁর মাথায় সব সময় পুজুউ নামক এক দেবতার ছবি বেঁধে রাখতেন। এমনকি ঘুমানোর সময়ও সেটি মাথা থেকে সরাতেন না।

একবার অসমীয়া রাজা লিলাসিং যখন সালারামে বসবাসরত আচিকদের উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে আচিকরাও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে লিলাসিং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। লিলাসিং এর বিরুদ্ধে আচিকদের প্রধান যুদ্ধারা হলেন -গুমি, রোটি, আসাল, জেরিন, দমিপা, জিরিক, সাকসো, ওয়াসাং, অথো, বাদিংগ্রিং, বোরিডিং, কেপেসা, জেজাং, সিলমা এবং রোথাং।

যুদ্ধকালীন নুনুই নানখি তার ছেলেমেয়েদের সহযোগীতা করার চেষ্টা করছিলো তাঁর মাথা থেকে দেবী পুজুউ’র ছবিটি খোলার জন্য। অনেক চেষ্টা করেও তারা সেটি নুনুই এর মাথা থেকে খুলতে পারেনি। শেষমেষ ব্যর্থ হয়ে নুনুই দেবী পুজুই এর পূজা শুরু করেন। ইতিমধ্যে লিলাসিং এর সৈন্যরা চারপাশে আক্রমণ শুরু করলেও নুনুই দেবী পুজুই এর পূজা সম্পন্ন করে প্রথমবার তাঁর মাথা থেকে থেকে ছবিটি নামায় এবং এরপরই লিলাসিং এর সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। দেবী পুজুই এর আরাধনা করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে নুনুই। সেই থেকে সেই জায়গাটিকে আচিকরা পবিত্র ভূমি হিসেবে পূজা করে। আর বয়োজ্যেষ্ঠরা এই জায়গাটিকেই কামাখ্যা বলে।

গল্প বলেছেনঃ সোনারাম আর সাংমা
গ্রামঃ সালপাড়া, গোয়ালপাড়া, আসাম

 

সাম্মিসি সামজাংগি
খাচি এবং ইনদিক নামে দুই কুমারী ছিল। একদিন তারা দুজনে জাদুর ভুট্টা সাম্মিসি সামজাঙ্গি নিয়ে ভাবছিল। খাচি প্রতিজ্ঞা করলোদ- আমি একমাত্র তাকেই বিয়ে করবো যে আমাকে সেই জাদুর ভুট্টা এনে দিতে পারবে। না হলে সারাজীবন কুমারীই থেকে যাব।

সেই জাদুর ভুট্টা (সাম্মিসি সামজাঙ্গি) দুর্গম জায়গায় জন্মায় যেখানে পৌঁছানো অনেক কঠিন। আর সেখানে পৌঁছানোর পথে রয়েছে নানা প্রলোভন এবং বন্য-ভয়ংকর প্রাণী। এই জাদুর ভুট্টায় রয়েছে- প্রচুর দৈহিক শক্তি, সৌন্দর্য এবং চিরযৌবন প্রাপ্তির রস। কেবল সৈনিকরাই এই জাদুর ভুট্টার অন্বেষণে হাজার হাজার পথ পাড়ি দেয়। কিন্তু কেউ আর কোনোদিন ফিরে আসে না। সেখানে যাওয়ার পথে নানা প্রলোভনে কেউ সাপ, পাখি কিংবা বন্য পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

খাচি সেই ভুট্টার প্রলোভনে তার প্রিয়তম দিক্কিকে পাঠাল। খাচিও যাওয়ার পথে তার ছোট ভাই ইনদিকের প্রিয়তম বান্দিকে সঙ্গে নিয়ে গেল। দিক্কি ও বান্দি ভুট্টার খোঁজে ভুগর্ভের কঠিন পথে যাত্রা শুরু করল। সে পথে প্রবেশ করতেই প্রথম দরজায় এক সুন্দরী মহিলা আহনিং চিরে চিনিং নরে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। আহনিং চিরের স্বামীও দুরি সেংসং জেকিংও তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই জায়গার নাম নামজিগা অঙ্গচেংগানি বিয়াপ যা কিনা শয়তানের আখড়া। এখানে যে যার মতো করে অপরাধ করে। ইচ্ছে মতো নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। নরে ও দুরি দুই ভাই দিক্কি-বান্দিকে একটি সুসজ্জিত চেয়ারে বসার অনুরোধ করল। কিন্তু দিক্কি-বান্দি জানে এই চেয়ারে বসলেই বন্য প্রাণিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তাই তারা নরে ও দুরির কোন প্রলোভনে না পড়ে সামনে দিকে এগুতে শুরু করল। বলা হয়ে থাকে দিক্কি আর বান্দি ভূগর্ভের সেই কঠিন পথে হারিয়ে যায়। আর কখনো ফেরেনি। অথবা এখনো তাদের পথচলা শেষ হয়নি? হয়তো কোনো একদিন সাম্মিসি সামজাঙ্গি নিয়ে ফিরবে?

আর খাচি ও ইন্দিক হলো স্বর্গীয় কুমারী। যারা আজও তাদের প্রিয়তমের জন্য অপেক্ষা করছে। দিক্কি-বান্দি পৃথিবীতে ফিরে এলেই খাচি ও ইন্দিক বিয়ের সাজে সজ্জিত হবে। আর তখনি পৃথিবীতে সুখের দিনে নেমে আসবে। সত্য-ন্যায়-ভালবাসা-শান্তি পৃথিবীতে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

গল্প বলেছেনঃ সোনারাম আর সাংমা
গ্রামঃ সালপাড়া, জেলাঃ গোয়ালপাড়া

*গল্প সংগ্রহঃ দ্য ফোক টেলস অব দ্যা গারোস (গোহাটি বিশ্ববিদ্যালয়-১৯৬১) / ইংরেজী সংকলনঃ দেওয়ান সিং রংমুথু  

পর্ব-১ পড়তে ক্লিক করুন
পর্ব-২ পড়তে ক্লিক করুন

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top