লেনিন-পর্ব ১৩।। আশানুর রহমান

।।গেসপার।।

জুন মাসের শেষ সপ্তাহে উলিয়ানভ পরিবার সিমবিরস্কি থেকে ককুশকিনোতে এসে পৌঁছালো। ঘোড়ার গাড়ীটা যখন সাদা রঙের বিশাল বাড়ীটার সামনে এসে থামলো সূর্য ততক্ষণে ঢলে পড়েছে। সেই ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় বাড়ীর সামনের লেবু বাগানের সবচেয়ে বড় গাছটির ছায়াটুকু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে নীচতলার বারান্দা ছাপিয়ে বাড়ীর দেয়ালের উপর গিয়ে পড়েছে। গরমের দিনে হালকা বাতাসে পাতার কাঁপুনির সাক্ষী হয়ে কয়েকটি চড়ুই পাখি এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছুটোছুটি করছে। কোচওয়ানের নির্দেশ পেয়ে ঘোড়াটা স্থির হয়ে দাঁড়াতেই সবার আগে ভ্লাদিমির গাড়ী থেকে লাফিয়ে নামে। বাড়ীটির মুখোমুখি দাঁড়াতেই তার চোখ পড়ে দোতলার বারান্দায়। বারান্দাটুকুর চারপাশে বুক সমান উঁচু কাঠের রেলিং। এতক্ষণ সেই বারান্দায় ভ্লাদিমিরদের জন্য অপেক্ষায় ছিল আন্না। গাড়ীটা বাড়ীর সামনে এসে থামতেই সে দোতলা থেকে অনেকটা দৌঁড়ে নীচে নেমে গেল। ভ্লাদিমির বারান্দা থেকে দ্রুত নেমে যাওয়া আন্নাকে শুধু পিছন থেকে এক ঝলক দেখতে পেল। দোতলা বাড়ীটার ছাদের খুব কাছাকাছি আলো প্রবেশের জন্য অর্ধেক চাঁদের মতো দেখতে স্থায়িভাবে আটকানো কাঁচের যে ঘুলঘুলিটা আছে, ভ্লাদিমির সেটার দিকে চেয়ে জোরে একটা শ্বাস নিল। এই বিশাল বাড়ীটি তৈরী করেছিলেন তার নানা আলেকজান্ডার ব্ল্যাঙ্ক। যিনি পেশায় ছিলেন ডাক্তার আর সেই সাথে খুবই সম্মানিত ও প্রভাবশালী মানুষ। তিনি জার্মান বংশদ্ভূত আন্না নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ থাকতেই। পেশা জীবনে তিনি বড় একটা সময় কাটিয়েছেন ভলগা অঞ্চলে। তিনি জেলা চিকিৎসক, পুলিশের ডাক্তার, হাসপাতালের ডাক্তার, হাসপাতালের পরিদর্শক চিকিৎসকসহ নানা দায়িত্ব পালন শেষে কাজানের স্টেট কাউন্সিলার হিসাবে অবসরে যান। আর সেই সময় তিনি কাজান থেকে পঁচিশ মাইল দূরে ককুশকিনোতে এই স্টেটটি কিনেছিলেন। তাঁর নিজের বানানো এই বাড়ীটির নীচ থেকে উঠে যাওয়া কাঠের চারটি উঁচু বড় বড় স্তম্ভ যেন তাঁর পেশা ও সামাজিক মর্যাদার উচ্চ অবস্থানই ইঙ্গিত করছে।

আন্না বাড়ীর সামনের কোমর সমান উঁচু কাঠের বেড়াটা পার হয়ে না আসতেই ভলোদিয়া দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। ততক্ষণে গাড়ী থেকে একে একে সবাই নেমে পড়েছে। ছোট্ট মারিয়া আন্না যাকে ‘মিত্তিয়া’ নামে ডাকে সে দৌঁড়ে এসে আন্নার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্না হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। দিমিত্রি গত দেড় বছরে যেন আরো লম্বা হয়েছে। সে মিত্তিয়ার মত দৌঁড়ে না এলেও আস্তে আস্তে আন্নার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালে আন্না ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তার চিবুকে চুমু খেল। ওলগা যাকে আদর করে আন্না ডাকে ‘ওলিয়া’, সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছোট ভাই-বোনের আলিঙ্গন-আদর খেয়াল করছিল। ওলিয়ার দিকে চোখ যেতেই আন্না তাদেরকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওলগা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলে। ওলিয়ার সেই কান্নাটুকু আন্নার চোখেও যেন পানি নিয়ে এলো। মারিয়া তখন কোচওয়ানের ভাড়া পরিশোধ করছিলেন। তিনি কোচওয়ানকে বিদায় দিয়ে আন্নার সামনে এসে দাঁড়ালে মাকে দেখে আন্না যেন একটা ধাক্কা খেল। গত দু’মাসে মারিয়ার সব চুল পেকে গেছে! মারিয়ার বয়স যেন গত কয়েক মাসে দশ বছর বেড়েছে। আন্নাকে দেখেও মারিয়া কম অবাক হল না। আন্না যেন আরো শুকিয়েছে। চিবুকটা আরো একটু ভিতরে ঢুকে যাওয়ায় মুখের চোয়ালের ভাঙা অংশটুকু যেন আরো ভাঙা ভাঙা লাগছে। আন্নার চেহারার লাবণ্যটুকু যেন চিবুকের উঁচু হাড় গ্রাস করতে চাচ্ছে। আন্না যখন এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো, মারিয়া তার চিবুক চুম্বন করলো অনেকটা সময় নিয়ে। অনেকদিন পর ভাই-বোনেরা যখন এই পারিবারিক মিলনটুকু উপভোগ করছে- কান্না-হাসিতে, তখন ভ্লাদিমির একটু এগিয়ে গিয়ে বড় বারান্দাটা পার হয়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকে পড়ল।

আগেও বহুবার ভ্লাদিমির ককুশকিনোতে এসেছে। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারের আসাটা যেন একটু আলাদা। আগে গরমের সময় তারা ককুশকিনোতে আসতো বেড়াতে আর এবার এসেছে থাকতে। ভ্লাদিমির জানে না কতদিন এখানে থাকতে হবে। কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক আসলে মাত্র কয়েকমাস অন্যথায় একটা অনির্দিষ্ট সময়কাল তাদের এখানে থাকতে হতে পারে। সে পুরো বিষয়টি অনিশ্চিত । তবু সিমবিরস্কির গত কয়েক মাসের বিশ্রী অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেয়ে এখানে এসে ভ্লাদিমিরের ভাল লাগছে। ভ্লাদিমির তার নানার রেখে যাওয়া স্টেটের এই চেনা-জানা বাড়ীটিই আবার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। গত কয়েক মাস সিমবরস্কি যেন তাদের পরিবারের জন্য ক্রমাগত মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। এই মুহূর্তে এই বিশাল বাড়ীর প্রশস্ত কামরাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে ভ্লাদিমির ঢুকে পড়ল নানার লাইব্রেরি ঘরে। বইয়ের আলমারির দিকে না তাকিয়ে সে প্রথমেই ঘরের ছাদের দিকে তাকায়। উঁচু ছাদটার দিকে চেয়ে তার মনে হলো সিমবিরস্কির বাড়ীর ছাদগুলো যেন অনেক নীচু ছিল আর ঘরগুলোও ছিল যেন অনেক ছোট। বইয়ের আলমারিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে, একটা বড় আলমারির পাশে একটু কোনার দিকে সে একটা টিনের বড় বাক্স দেখতে পেল। কাছে যেতেই দেখল টিনের বাক্সের উপরে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা ‘সাশা’। ভ্লাদিমিরের বুকটা ধক করে ওঠে। এখানে নানা বাড়ীর এই লাইব্রেরি কক্ষে সাশার নামাঙ্কিত টিনের বাক্সটি দেখতে পাবে সেটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তবে কি আন্না সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সাশার বাক্সটি সাথে করে এনেছে? ভ্লাদিমির আস্তে আস্তে আরো কয়েক পা এগিয়ে বাক্সটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ডান হাত দিয়ে সাশার নামের উপর নিজের আঙুলগুলো রাখে। ভ্লাদিমিরের শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। তার মনে হলো সে যেন সাশাকে স্পর্শ করতে পারছে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে এলো একটি মাত্র শব্দ ‘সা-শা’! আর তখুনি তার চোখ গেল বাক্সের তালাটার দিকে। সে সাশার নামের উপর থেকে হাতটি ধীরে ধীরে সরিয়ে নিল। ভ্লাদিমিরের মনে পড়লো সাশার সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার আগের দিন সে এবং সাশা এই তালাটা কিনে এনেছিল। আজ এতদিন বাদেও তালাটা যেন প্রথমদিনের মতোই আছে। সাশা তার জিনিসপত্র এতটা যত্ন করে ব্যবহার করতো? সে তখন তার তর্জনী দিয়ে বাক্সের উপরে কোন ধুলো বা ময়লা পড়েছে কিনা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখে কোথাও কোন ময়লা নেই। সে একটু অবাক হলো। একটু সরে গিয়ে বাক্সটির অন্যদিকগুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। কিন্তু পুরোটা পরীক্ষা শেষে সে ভাবলো প্রতিদিন এই বাক্সটি কে পরিস্কার করে? তবে কি আন্না?

হঠাৎ ঘোড়ার হর্ষ ধ্বনি এবং অনেক মানুষের সমবেত কন্ঠস্বর কানে এলে ভ্লাদিমির ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। লাইব্রেরি ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেল সিমবিরস্কি থেকে নিয়ে আসা তাদের মালামালগুলো নিয়ে গাড়ীগুলো একের পর এক বাড়ীর সামনে এসে থামছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে আবারো নানার সংগ্রহের বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। নানার সংগ্রহ তাকে অবাক করে। মস্কো স্ট্রিটের বাড়ী থেকে বাবার লাইব্রেরির বইগুলোও তারা নিয়ে এসেছে। সেখানে সাশার সংগ্রহ করা অনেক বইপত্রও আছে। ভ্লাদিমির মনে মনে ভাবতে থাকে নানার সংগ্রহে থাকা বই এবং সিমবিরস্কি থেকে আনা বাবার লাইব্রেরির বই পড়ে ককুশকিনোতে সময়টা তার মন্দ কাটবে না। এমন সময় পায়ের শব্দ পেয়ে পিছন ফিরতেই দেখে আন্না আসছে।

ভ্লাদিমির তার দিকে দু’পা এগিয়ে যেতেই আন্না বললো,

– মা বলছিলেন তুমি নাকি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেছ?

-হ্যাঁ। সাথে হেডস্যারের দেয়া প্রশংসাপত্রটিও পাঠিয়েছি।

-প্রশংসাপত্র?

-হ্যাঁ। যদিও তিনি যে সব কথা লিখেছেন তার অনেক কিছুই সত্যি নয়।

আন্না লাইব্রেরি রুমের একটি চেয়ারে বসতে বসতে জিগ্যেস করে,

-কি রকম?

ভ্লাদিমির নিজেও আরেকটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ভ্লাদিমির বসলো জানালার দিকে মুখ করে। ভ্লাদিমির দেখলো মালামাল নিয়ে আসা গাড়ীগুলোর কোচওয়ান ও কুলিদের সাথে মা কথা বলছেন। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আন্নার প্রশ্নের উত্তরে তার দিকে তাকালে সে দেখলো আন্নাও ঘাড় কিছুটা ঘুরিয়ে জানালার দিকে চেয়ে আছে। ভ্লাদিমির আন্নার মুখের একটা পাশ শুধু দেখতে পাচ্ছে। সেই দিকে তাকিয়েই সে বলল,

-এই যেমন তিনি লিখেছেন ‘ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষাই আমার নৈতিক ভিত্তি’৷ অথচ আমি দেড় বছর হতে চলল ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছি ।

ভ্লাদিমিরের এমন কথায় আন্না জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্লাদিমিরকে ভাল করে লক্ষ্য করলো। তার মনে হলো ভ্লাদিমিরও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল! ছোটবেলার সেই চঞ্চলতা এখন আর তার মধ্যে নেই। বয়সের তুলনায় সে যেন একটু গম্ভীর হয়ে পড়েছে। ভ্লাদিমিরের কথার উত্তরে তাই সে একটু ঠাট্টা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

-ঈশ্বর অবিশ্বাসী ছেলেটা তাহলে ধর্মে ‘গ্রেড ৫’ আর লজিকে ‘গ্রেড ৪’ পেল কেন?

আন্নার কথায় যেন কিছুটা প্রশ্রয় আর কিছুটা ব্যঙ্গ ছিল। কথাটা বলেই আন্না আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কিন্তু সেই মুহূর্তে আন্নার মুখের ভঙ্গিটি দেখে ভ্লাদিমিরের মনে হল মুখটা যেন দেখতে অবিকল সাশার মত। ভ্লাদিমির এক মুহূর্তের জন্য যেন চমকে উঠলো। এই প্রথম তার মনে হলো আন্নার মুখের আদলটিতে সাশার ছায়া আছে। সেটা প্রবল ভাবেই আছে। আগে কেন সে এটা খেয়াল করেনি ভেবে অবাক হলো। আর এটা ভাবতে গিয়ে একটু আনমনা হয়ে আন্নার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে, সে আবার জানালার দিকে তাকায়। আন্নাও তখন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,

-এখনই জিনিসপত্র নামাবে। চল, মাকে সাহায্য করি।

তিন দিন হয়ে গেল তারা ককুশকিনোত। সকালের নাস্তা খেয়ে ভ্লাদিমির ও আন্না মিলে সিমবিরস্কি থেকে নিয়ে আসা বইয়ের প্যাকেটগুলো খুলে সেগুলো খালি শেল্ফে গুছিয়ে রাখছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা টুকটাক গল্পও করছে। সাশার টিনের বাক্সটার দিকে চেয়ে হঠাৎ করে ভ্লাদিমির জানতে চাইলো,

-অ্যানিউটা, সাশা কেন ধরা পড়েছিল?

ভ্লাদিমিরের এমন প্রশ্ন শুনে আন্না চমকে ওঠে। অনেকদিন পর একটা চাপা কষ্ট, একটা নিদারুণ ব্যথা যেন ভ্লাদিমিরের এই প্রশ্নে আবার জেগে ওঠে। আন্নার মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। যে কান্নাটা সে মায়ের সামনেও কাঁদতে পারেনি, আজ ভলোদিয়ার এই প্রশ্নে বরফের মতো জমে থাকা কান্নাটা যেন গলে গলে বের হতে চাইলো। সে প্রাণপণ চেষ্টা করলো কান্না লুকোতে। অনেক চেষ্টা করেও সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বরং কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় সেটা যেন গুমরে গুমরে উঠতে লাগলো। ভ্লাদিমির কোন কথা না বলে চুপচাপ আন্নাকে কাঁদতে সময় দিল। আন্না যতক্ষণ কাঁদলো, সে পলকহীন চোখে সাশার টিনের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অনেকক্ষণ পর আন্না একটু শান্ত হলে ভ্লাদিমির একটু এগিয়ে গিয়ে তার হাত দু’টো ধরে সেখানেই মেঝের উপর বসে পড়ে। আন্না নিজেকে একটু সামলে নেয়। সে সাশার বিষয়ে ভাই-বোনদের কাউকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবু কেন জানি আজ এই মুহূর্তে ভলোদিয়ার প্রশ্নটি তাকে একটু অবাক করল। এমন একটি প্রশ্ন ভলোদিয়া কেন করল সেটা ভাবতে ভাবতেই ভলোদিয়ার প্রশ্নের জবাবে বলল,

-সাশাদের গ্রুপের কিছু ছেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তাছাড়া পুলিশের কাছে তাদের গ্রুপের একজনের লেখা একটি চিঠিও ধরা পড়ে।

ভ্লাদিমির গভীর মনোযোগে আন্নার কথা শুনতে থাকে, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করে। কোন কোন বিষয় সে বারবার জানতে চাইলো। তাদের গ্রুপের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, তাদের সদস্য হবার পদ্ধতি, নিয়ম-কানুন, কাজের ধরণ, কোন ধরণের বইপত্র তারা পড়তো, সব কিছু। গল্প করতে করতে সেদিন দুপুর গড়িয়ে গেল। পরেরদিনও তাদের বই-গোছানো এবং সাশাকে নিয়ে গল্প চলছিল। আন্না সিমবিরস্কি থেকে নিয়ে আসা একটি বাক্স খুলে সেখান থেকে বইগুলো ভ্লাদিমিরের হাতে দিচ্ছিল আর ভ্লাদিমির সেই বইগুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিল। আন্না একটি বই মুছতে মুছতে ভ্লাদিমিরকে বলল,

-এই বইটি একটু ভিতরের দিকে রাখ, অন্য কিছু বই দিয়ে এটা আড়াল করে রাখ।

ভ্লাদিমির অবাক হবার ভঙ্গিতে আন্নার দিকে তাকিয়ে বলে,

-কী বই ওটা?

বইটি ভ্লাদিমিরের হাতে দিতে দিতে আন্না বলে,

-চেরনিশেভস্কির ‘কী করিতে হইবে?’

বইটির মলাটের উপর হাত বুলাতে বুলাতে ভ্লাদিমির বলে,

-এই বইটি মনে হয় আমি আগেও দেখেছি। কিছুটা পড়েছিলামও। কিন্তু ভাল বুঝতে পারিনি।

আন্না বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

-তুমি এই বই পড়েছিলে? কবে? কিভাবে?

-কয়েক বছর আগে সাশাকে এই বইটি পড়তে দেখে আমার কৌতুহল হয়েছিল। তাই নিজেও পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। আচ্ছা, তুমিও কী এই বইটি পড়েছো?

-অবাক ব্যাপার! তুমি এই বই পড়তে চেষ্টা করেছিলে? আমি বইটি পড়েছি তবে বেশীদিন আগে নয়।

-আমি কিছুদূর পড়েছিলাম। শুরুটা বেশ আকর্ষণীয় লেগেছিল। আমি সাশাকে প্রশ্ন করেছিলাম কোন চরিত্রটি তার বেশী ভাল লাগে?

-বল কী? সাশা কী উত্তর দিয়েছিল?

-রাখমেটভ।

-হুম। নিজেকেও তো সে রাখমেটভের মত করেই গড়তে চেয়েছিল!

কথাটা বলে আন্না একটু আনমনা হয়ে পড়ে। ভ্লাদিমিরের আরেক প্রশ্নে সে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। ভ্লাদিমির তখন জানতে চাইছিল,

-তোমার কাকে বেশী ভাল লেগেছে?

-ভেরা। ভেরাকে আমার খুব ভাল লাগে।

কথাটা বলে সে আবারও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। কিন্তু ভ্লাদিমিরের মনে তখনও অনেক প্রশ্ন৷ সে আবার জিগ্যেস করে,

-অ্যানিউটা, এই চেরনিশেভস্কি লোকটা আসলে কে?

-আমি খুব বেশি কিছু জানি না। তবে সাশা ও মার্কের কাছ থেকে যা শুনেছিলাম সেটুকু তোমাকে বলতে পারি।

-মার্ক? মার্ক কে?

আন্না খানিকটা চুপ করে থাকে। হয়তো সেই মুহূর্তে মার্কের মুখটা তার মনে পড়ে। ভ্লাদিমিরের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে,

-মার্ক টিমোফেয়েভিচ ইলিজারভ, আমার বন্ধু। সে সাশারও বন্ধু ছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গে আমরা এক সাথে কিছু পাঠচক্র গ্রুপে যেতাম।

-তিনি কি সাশাদের গ্রুপের কেউ?

-সেও সমাজতন্ত্রী তবে সাশাদের গ্রুপের কেউ ছিল না।

-তোমার সাথে এখনও যোগাযোগ আছে?

ভ্লাদিমিরের এই প্রশ্নে আন্না কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। আন্নার শেষ চিঠির জবাব মার্ক এখনও দেয়নি। কি নিয়ে ব্যস্ত মার্ক? পড়াশুনা? নাকি যেমনটা সে আগের চিঠিতে জানিয়েছিল-সে কিছু দিনের জন্য ‘সামারা’ যেতে পারে। সে কী তবে সামারা’য়? এখান থেকে সামারা কী অনেক দূর? আন্নার অন্যমনস্কতায় ভ্লাদিমিরের মনে হল প্রশ্নটা বোধ হয় বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। প্রসঙ্গ থেকে সরে যেতে তাই সে আবার জিগ্যেস করে,

-তুমি চেরনিশেভস্কি সম্পর্কে বলছিলে।

আন্না ভ্লাদিমের হাতে কয়েকটা বই দিয়ে সেগুলো আলমারিতে রাখতে চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করে। আন্না যেন স্মৃতি হাতড়াতে থাকে। গত বছরের শরতে এক সন্ধ্যায় সাশা চেরনিশেভস্কি সম্পর্কে তাকে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো মনে পড়ে।

এন জে চেরনিশেভস্কির জন্ম রাশিয়ার ‘সারাটভে’ ১৮২৮ সালে। যাজক পিতার সম্তান হলেও ধর্ম এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে বাবার সাথে তাঁর বিরোধ বাঁধে। তবুও পড়াশুনা শেষে সারাতভেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ১৮৫৫ সালে বিয়ে করেন বাবা-মা’র অপছন্দে। তাই বিয়ের পর শিক্ষকতা ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে যান। যোগ দেন ‘Contemprorary’ পত্রিকায়। লেখক ইভান তুর্গেনেভও তখন ঐ পত্রিকায় লিখতেন। তারা দু’জন সমসাময়িক হলেও তাঁদের রাজনৈতিক ভাবনা একই রকম ছিল না। সে কথা আন্না জেনেছিল আরো কয়েকদিন বাদে। একদিন এক পাঠচক্রে সাশা বলেছিল, “তুর্গেনেভের ‘পিতা ও পুত্রের’ বাজারভ নয়, আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত চেরনিশেভস্কির ‘কী করিতে হইবে?’র রাখমেটভ”।

সাশার কাছ থেকে শুনা কথাগুলো ভ্লাদিমিরকে বলতেই সে প্রশ্ন করে,

-এ সব বিষয় নিয়ে সাশারা পাঠচক্র করত?

-হ্যাঁ। ওদের পাঠচক্রে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হত। ওদের অর্থনীতির এক পাঠচক্রে সাশা আমাকে বক্তা করেছিল রাশিয়ার কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তন নিয়ে কথা বলার জন্য। মার্ক যদিও আমার বক্তব্য তৈরি করতে অনেক সাহায্য করেছিল, বিশেষতঃ অনেক তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে। তবু ওদের পাঠচক্রের বিষয়বস্তুর গভীরতা যতটা ছিল, আমার প্রস্তুতি ততটা ভাল ছিল না।

-তোমরা পাঠচক্রে এত সব আলোচনা করতে?

-আমি শুরুতে এসব আলোচনায় অত বেশি আগ্রহ পেতাম না। কিন্তু সাশা ও মার্কের অনুপ্রেরণায় ক্রমেই আকৃষ্ট হই। সে সব পাঠচক্রেই শুনেছিলাম তুর্গেনেভ নাকি মনে করতেন সংস্কার প্রক্রিয়ায় কৃষকরাই একদিন সমাজতন্ত্র নিয়ে আসবে। অন্যদিকে চেরনিশেভস্কি মনে করতেন কৃষক নয়, শ্রমিক শ্রেণিই হবে বিপ্লবের নিয়ামক শক্তি।

-অবাক ব্যাপার। আমি তো চেরনিশেভস্কির প্রতি দারুণ আগ্রহ বোধ করছি। তুমি তাঁর সম্পর্কে আর কি জানো?

আন্না চুপ করে থাকে। সে আবারও ফিরে যায় স্মৃতির পাতায়। সে ঘুরতে থাকে নেভেস্কি এভিনিউ, সাডোভায় স্ট্রিট হয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় রাস্তায়।

১৮৬১ সালে জারের ভূমিদাস প্রথা ও সংস্কার কর্মসূচির সমালোচনা ও বিরোধীতা করেছিলেন চেরনিশেভস্কি। আর সেগুলো তিনি লিখতে থাকেন ‘কনটেমপোরারি’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে। সেই লেখাগুলোই তাঁর জন্য শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল। আন্না এই পর্যন্ত বলে থামলে, ভ্লাদিমির প্রশ্ন করে,

-মানে?

-চিঠিগুলো যখন প্রকাশিত হচ্ছিল তখনই পুলিশ তাঁর উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করে।

-কেন?

-চিঠিগুলো যে জারের উদ্দেশ্যে লেখা সেটা বুঝতে পুলিশের খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করার দরকার পড়েনি যে!

-হুম। তারপর?

আন্না তখন সাশা ও মার্কের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো ভ্লাদিমিরকে বলতে থাকে। ১৮৬২ সালের শুরুতে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েক রাউন্ড গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। কারা ঘটায়, কেন ঘটায় সেটা জানা না গেলেও পুলিশ সুযোগটি হাত ছাড়া না করে চেরনিশেভস্কিকে গ্রেফতার করে। তাঁকে নেয়া হয় পিটার এন্ড পল কারগারে। বন্দী থাকাকালে তিনি ভাবলেন সরাসরি কিছু লিখলে সেটা প্রকাশ করা যাবে না অথবা সেটা নিষিদ্ধ করা হবে। তাই তিনি সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা থেকে তাঁর লেখাকে রক্ষা করতে ‘ফিকশন’ লেখার পরিকল্পনা নিলেন। তিনি কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে মাত্র চার মাসে লেখাটি শেষ করেন। সেই খসড়া লেখাটা তিনি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিলে অসাবধানতা বশত:ই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই তারা সেটা অনুমোদন দিয়ে Sovremennik পত্রিকার সেন্সর বোর্ডের কাছে পাঠায়। তারাও সেটা অনুমোদন করে পত্রিকার সম্পাদক নেক্রাসভের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সম্পাদক নেক্রাসভ ভাড়া করা গাড়ীতে ভুল করে লেখাটা ফেলে আসেন। সেন্ট পিটার্সবার্গ পুলিশের অফিসিয়াল গেজেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে, পুলিশের সহযোগিতায় পরে তিনি লেখাটা ফিরে পেয়ে প্রকাশ করেন। এদিকে চেরনিশেভস্কিকে প্রথমে ১৪ বছরের জেল দেয়া হয়। তারপর সাজা কমিয়ে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং বাকী জীবন তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়।

এই পর্যন্ত বলা শেষ হতেই ভ্লাদিমির চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে,

-আর তাঁর বইটি?

-প্রকাশের পরপরই ছাত্র-তরুণরা তাঁর বইটিকে লুফে নিয়েছিল। পরিবর্তনকামী তরুণরা তাঁর বইটি ‘বাইবেল’ এর মতো সম্মান দিতে থাকলে জার সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে। তাতে অবশ্য ফল হয় বিপরীত।

-বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তিনি এখন কোথায়? তাঁর কি হলো?

-রায় হয়ে যাবার পর জার সরকার তাঁকে একটি সুযোগ দিতে চেয়েছিল।

-কি রকম?

-তাঁকে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে বলা হয়েছিল।

-তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন?

বিস্ময় এবং গভীর আগ্রহ নিয়ে ভ্লাদিমির আন্নাকে প্রশ্নটি করে। ভ্লাদিমির প্রশ্নটি করে এমনভাবে আন্নার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন আন্নার ‘হ্যাঁ বা না’ উত্তরের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আন্না ভ্লাদিমিরের চোখ-মুখে এমন আবেগ ও বিস্ময় দেখে, চেরনিশেভস্কি নিয়ে তার এতটা আগ্রহে কিছুটা অবাক হলেও, হেসে ভ্লাদিমিরের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

-না। ক্ষমা তিনি চাননি। বরং তিনি সেই বিচারককে বলেছিলেন “ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু কোন অজুহাতে আমি ক্ষমা চাইবো? আমার কাছে মনে হয় আমাকে নির্বাসন দেয়া হচ্ছে, কারণ আমার মস্তিস্কটি পুলিশ প্রধানের মস্তিস্ক থেকে ভিন্নভাবে তৈরি এবং ঠিক সেই কারণে আমি কি ক্ষমা চাইতে পারি?”

আন্নার উত্তর শুনে ভ্লাদিমির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,

-দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর তো। আচ্ছা অ্যানিউটা, তুমি জানো তিনি এখনও বেঁচে আছেন কিনা?

-আমি জানি না, ভলোদিয়া। তবে গত বছর পর্যন্তও তিনি বেঁচেই ছিলেন এবং শুনেছিলাম তিনি সাইবেরিয়াতেই আছেন।

ভ্লাদিমির কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। দু’জনের কেউ কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না। আন্না তার হাতের কাছে থাকা বইয়ের আরেকটি বাক্স খোলে। সেখানে দেখতে পেলো বাবার সংগ্রহে থাকা ‘কনটেমপ্ররারি’ পত্রিকার বেশ কিছু পুরাতন সংখ্যা। সেগুলো ভ্লাদিমিরের হাতে দিয়ে বলল,

-তুমি এই সংখ্যাগুলোতে তাঁর সম্পর্কে হয়তো আরো কিছু জানতে পারবে। এগুলো যত্ন করে রেখে দাও।

ভ্লাদিমির সেই পত্রিকাগুলোর কয়েকটি পাতা উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলো। আন্না দেখে ভ্লাদিমির বই না গুছিয়ে পত্রিকাগুলো পড়তে শুরু করেছে। আন্না সেদিকে তাকিয়ে বলল,

-ভলোদিয়া, আগে বইগুলো গুছিয়ে ফেলো। পরে না হয় পত্রিকাগুলো দেখো।

আন্নার কথায় ভ্লাদিমির পত্রিকাগুলো এবং চেরনিশেভস্কির বইটি গুছিয়ে আলমারির ভিতরের দিকে রেখে দিল। এমন সময় দিমিত্রি এসে ঢোকে। সে আন্নাকে বলল,

-মা তোমাকে ডাকছে।

আন্না ও দিমিত্রি চলে গেলে ভ্লাদিমির আবার সেই পত্রিকাগুলো বের করে। চেরনিশেভস্কির জেল এবং নির্বাসনের রায় হবার পর কনটেমপ্ররারি পত্রিকায় যে খবরটি ছাপা হয়েছিল সেই খবরের সাথে তাঁর একটি ছবিও ছাপা হয়েছিল। ভ্লাদিমির গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখতে থাকে। কালো কোট, গলায় কালো একটি টাই। মাথার চুল বাম দিক থেকে সিঁথি করা। সিঁথি বরাবর বেশ কিছুটা ভিতর পর্যন্ত চুল নেই। তাছাড়া মাথা ভর্তি লম্বা চুল। চোখে কালো ফ্রেমের গোলাকার চশমা। সেই চশমার ভিতর দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত দু’টো চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে। ছবির এই মানুষটিকে ভ্লাদিমির ভীষণ রকম পছন্দ করে ফেলল। সে উঠে গিয়ে প্রথমে একটা কাঁচি নিয়ে ফিরল। তারপর খুব সুন্দর করে ছবিটা পত্রিকার পাতা থেকে কাটলো। ছবিটা কাটা হয়ে গেলে সে কাঁচি নিয়ে আবার উঠে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ফিরে এলো একটি মানিব্যাগ নিয়ে। চেরনিশেভস্কির ছবিটা দু’ভাঁজ করে সে তার মানিব্যাগে যত্ন করে রেখে দিল।

সন্ধ্যা হতে আর দেরি নেই। ছোট্ট মিত্তিয়া লাইব্রেরি ঘরে এসে ভ্লাদিমিরকে বললো,

-আমাকে আজ পড়াবে না?

ভ্লাদিমির তাকে কাছে ডেকে আদর করে বলল,

-তুমি তো অ্যানিউটার কাছে পড়তে চেয়েছিলে? আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি তৈরি হয়ে এসো, আমি যাচ্ছি।

পত্রিকাগুলো গুছিয়ে রেখে ভ্লাদিমির উঠে পড়ে। মারিয়ার বয়স নয় হচ্ছে। মারিয়া আলেকজান্দ্রাভা চাচ্ছেন ভ্লাদিমির কাজানে ভর্তি হলে সবাইকে নিয়ে তিনি কাজান যাবেন। আন্নাকে ককুশকিনোতেই থাকতে হবে। তবু এটা ভাল যে ককুশকিনো থেকে কাজান বেশি দূরে নয়। তিনি এটাও ভাবছেন সব ঠিকঠাক থাকলে কাজানেই ছোট্ট মিত্তিয়াকে ভর্তি করিয়ে দেবেন। স্কুলে ভর্তির প্রস্তুতি নিতেই সে এখন কখনো আন্নার কাছে কখনো বা ভ্লাদিমিরের কাছে পড়াশুনা করে।

সেদিন রাতের খাবার শেষে ভ্লাদিমির আবার ঢুকলো লাইব্রেরিতে। নির্দিষ্ট আলমারি থেকে চেরনিশেভস্কির ‘কী করিতে হইবে?’ বইটি বের করে সে পড়তে বসে। সাথে সে একটি নোটবুক ও একটি পেন্সিল নিল। পড়তে পড়তে যে সব কথা বা আলোচনা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে সেগুলোর সে নোট নিতে থাকে। রাত বাড়তে থাকে কিন্তু ভ্লাদিমিরের চোখে ঘুম নেই। অনেক দূর পড়ার পর ‘রাখমেটভ’ চরিত্রটির আগমন ঘটলো।  উপন্যাসটির নায়িকা ভেরা পাভলোভনাকে একটি চিঠি দিতে চরিত্র হিসাবে তার আগমন। এই চরিত্রটিই তো সাশার সব থেকে বেশি ভাল লেগেছিল? আন্নাও বললো, সাশা নিজেও রাখমেটভের মতো হতে চেয়েছিল! তাই রাত গভীর হলেও ভ্লাদিমির আরো গভীরভাবে বইটি পড়তে থাকে। রাখমেটভ সম্পর্কে তার নোট বুকে সে অনেকগুলো নোট নিল। ভ্লাদিমির দেখলো উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের তুলনায় রাখমেটভের উপস্থিতি একেবারেই কম। ভ্লাদিমির রাখমেটভ সম্পর্কে সারসংক্ষেপ তার নোট বুকে লিখে রাখে-

‘রাখমেটভ তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০০ ভূমিদাস এবং ৭০০ একর জমি পেয়েছিল। তার বয়স যখন ১৫ তখন সে তার বাবারই এক রক্ষিতার প্রেমে পড়ে। উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত সে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে কিন্তু সেটা শেষ না করেই সে ভ্রমণে বের হয় এবং ভাই-বোনদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে। ভ্রমণকালে তার সাথে এক তরুণ জার্মান দার্শনিক এবং বিপ্লবীর সাক্ষাত হয়। ১৭ বছর বয়স থেকে সে নিয়মিত শরীরচর্চা করে নিজেকে তৈরি করতে থাকে এবং সেই ভ্রমণকালে সে সব ধরণের শারিরীক পরিশ্রম করে। মাটি কাটা, গাছ কাটা থেকে শুরু করে লোহা গলিয়ে কামারের কাজ পর্যন্ত। সাধারণ মানুষ যা যা করে তাই সে করে তাদের মতো একজন হতে। সে একটানা ৮২ ঘন্টা বই পড়ে। নিজেকে সতেজ এবং ঘুমিয়ে পড়া থেকে রক্ষা করতে এই সময়ে সে ৮ বার কড়া কফি খায় তারপর ১৫ ঘন্টা টানা ঘুমায়। সে কম ঘুমিয়ে, নিজেকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে চেয়েছে। সে পোড়া কালো রুটি খেয়ে দিনের পর দিন অভ্যাস করেছে। রাতে সে ঘুমায় নখের তৈরি বিছানায়। নিজের জন্য বিলাস যদি তার কিছু থেকেই থাকে সেটা সিগারেট।’

ভ্লাদিমির উপন্যাসের এই জায়গাটা যখন পড়ছে তখন ভোর হচ্ছে। লেবু বাগানের দিক থেকে চড়ুই পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছে। ভ্লাদিমির তখন পড়ছে রাখমেটভ নিজের সিগারেট খাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে বলছে,

“সিগারেট ছাড়া আমি চিন্তা করতে পারি না। এটা যদি সত্য হয় তবে সেটা আমার দোষ নয়, সম্ভবতঃ এটা হয়েছে আমার ইচ্ছে শক্তির দূর্বলতার কারণে।”

এই লাইনটি পড়া শেষ করে ভ্লাদিমির বইটি বন্ধ করে ফেলল। বাইরে ততক্ষণে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পড়ার টেবিলের আলোটা নিভিয়ে জুতাটা পরে ভ্লাদিমির ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। বাড়ীর সবাই তখনও ঘুমাচ্ছে। সে শব্দ না করে বাড়ীর পিছনের দরজাটা আস্তে করে ভিড়িয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে।

আলো ফুটেছে কিন্তু সূর্যটা তখনও আড়মোড়া ভেঙে দৃশ্যমান হয়নি। বাড়ীর পিছনের ফটক দিয়ে সামনের সদর দরজায় যাবার পথে হাতের বামে গোয়ালঘরটা চোখে পড়ল। সেখানে দুধের জন্য কেনা দুটো গাভীও সে দেখতে পেল। একটা গাভী কয়েকদিন আগে একটি ফুটফুটে বাচ্ছা দিয়েছে। ভ্লাদিমির দেখলো মা গাভীটি বসে বসে ঘুমাচ্ছে আর বাছুরটি ঘুমন্ত গাভীটির দুধ খাচ্ছে। একটু কাছে যেতেই সেই সাত সকালে গরুর গোবরের উষ্ণ একটা ভাব তার  নাকে এসে লাগে। ভ্লাদিমির গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে বাড়ীর সামনের সদর রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে গ্রীষ্মের এই ভোরে সে হাঁটতে শুরু করে। এই সকালেও সে দেখলো কৃষকদের কেউ কেউ কাজের জন্য বেরিয়ে পড়েছে। ছোট্ট সরু রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভ্লাদিমিরের ভীষণ ভাল লাগতে থাকে। ভ্লাদিমিরের গন্তব্য বেশ কিছুটা দূরের একটি মুদির দোকান। সে যদিও জানে না এত সকালে দোকানটা খোলা থাকবে কিনা বা সেটা কখন খোলা হয় সে বিষয়েও তার কোন ধারণা নেই। চেরনিশেভস্কির উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এবং রাখমেটভ চরিত্রটি তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে সে সিদ্ধান্ত নিল, সেও রাখমেটভের মত সিগারেট খাবে। আগে কোনদিন সে সিগারেট টানেনি। এই ককুশকিনোতে দোকান-পাট তেমন নেই। যে মুদি দোকানটা আছে সেটাও অনেক দূরে। তবুও এই সাত-সকালে ভ্লাদিমির সিগারেটের জন্য হাঁটতে থাকে।

দোকানদার লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। দোকানের পুরোটা তখনও সে খুলে পারেনি এমন সময় ভ্লাদিমির সেখানে পৌঁছে বললো,

-সিগারেট আছে?

লোকটা ভ্লাদিমিরকে ভাল করে না চিনলেও শুনেছে ডাক্তার ব্ল্যাঙ্কের নাতিরা বেড়াতে এসেছে। ছেলেটি ডাক্তার ব্ল্যাঙ্কের কেউ হবে ধরে নিয়ে বেশ সম্ভ্রমের সাথে সে বলে,

-এখানে ভাল সিগারেট তো কেউ খাই না। খুব সস্তা একটা সিগারেট আছে। নাম ‘গেসপার’। এটা চলবে?

ভ্লাদিমিরের তখনই সিগারেট চায়। সে সস্তা বা দামী সিগারেটের পার্থক্যও বোঝে না। তার মনে হয়েছে রাখমেটভ সিগারেট খায়, সিগারেট তার চিন্তা করতে সাহায্য করে ফলে তাকেও সিগারেট খেতে হবে। তাছাড়া, সাধারণ মানুষ যেহেতু সস্তা সিগারেট খায়, তাহলে রাখমেটভও নিশ্চয় সস্তা সিগারেটই খেতো। তাই অন্য কিছু চিন্তা না করেই সে বলল,

-গেসপারেই চলবে।

দোকানী তখন জানতে চাইলো,

-কয়টা দেবো? নাকি প্যাকেট ধরে দেবো?

-প্যাকেটই দিন।

-দেয়াশলাই লাগবে?

ভ্লাদিমিরের এতক্ষণ মনেই হয়নি যে একটা দেয়াশলাই লাগবে। দোকানীর কথায় সে খুশী হয়ে হাসিমুখে বলে,

-হ্যাঁ, একটা দেয়াশলাইও দিন।

দোকানী এক প্যাকেট সিগারেট ও একটা দেয়াশলাই হাতে দিলে সে মানিব্যাগ বের করে। মানিব্যাগটা খুলতেই সদ্য রাখা চেরনিশেভস্কির ছবিটার দিকে চোখ যায়। দাঁড়িমুখের ছবিটার দিকে গভীরভাবে সে একবার তাকালো। তারপর দোকানীর পাওনা মিটিয়ে সে সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিল। গন্ধটা বেশ কড়া মনে হলো। দেয়াশলাই জ্বালাতে সে কয়েকটা কাঠি খরচ করে ফেলল। দোকানী তার এই অবস্থা দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মিটিমিটি একটু হেসে নিল। সিগারেটটিতে আগুন লাগাতে গিয়ে সে জোরে জোরে টান দিলে, মুখ ভর্তি ধোঁয়ার কিছু অংশ সে গিলে ফেলল। আর তখনই যেন তার বুকে ধাক্কাটা এসে লাগলো এবং সে প্রবলভাবে কাশতে শুরু করল। ছেলেটি যে আজই প্রথম সিগারেট খাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে এবং ছেলেটির এরকম কাশতে দেখে দোকানী এবার তার দিকে ফিরেই হাসতে থাকে। ভ্লাদিমিরের সেদিকে খেয়াল করার সময় নেই। হাতে তখনও সিগারেট ধরা, কাশতে কাশতে তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে এবং নিজের শরীরটা যেন ধনুকের মতো সামনের দিকে বেঁকে আসে। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর সে যখন আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল, হাতের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে দেখে আগুন ও বাতাসে সিগারেটটি অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। দোকানী লোকটা হাসি হাসি মুখেই জিগ্যেস করে,

-আজই প্রথম?

ভ্লাদিমির তার দিকে না তাকিয়েই মাথা নাড়ায়। লোকটা তখন বলে,

-প্রথম প্রথম এমন হয়। আস্তে আস্তে টান দিয়ে ধোঁয়াটা মুখ থেকেই ছুঁড়ে দিন। একটু অভ্যস্ত হলে তারপর ধোঁয়াটা গিলবেন। তখন আর এমনটা হবে না।

লোকটার এমন অযাচিত উপদেশে ভ্লাদিমির বিরক্ত না হয়ে বরং কৃতজ্ঞবোধ করে। পুরোপুরি ভাল বোধ করলে সে আস্তে করে সিগারেটে আবার একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটা শুন্যে ছেড়ে দিল। এবার কোন কাশি এলো না। সে আবার একই কাজ করলো। এবারও কোন সমস্যা হল না। প্রথম সিগারেটটা সে এভাবেই শেষ করল। দোকানী তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। ভ্লাদিমির পকেট থেকে প্যাকেট বের করে আরেকটি সিগারেট ধরালো। এবার সে প্রথমবারের মতো ভুলটি করল না। সিগারেটে আগুন জ্বালানোর সময় সে আস্তে আস্তে টান দিল এবং ধোঁয়া শুন্যে ছুঁড়ে দিল। কাজটা সে ঠিক মতো করতে পেরে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। তার এই হাসিটি ভীষণ সক্রামক। দোকানী নিজেও খুশীতে হেসে ফেলল। ভ্লাদিমির সিগারেট টানতে টানতে আবার বাড়ীর পথ ধরলো। ঠিক তখনই সূর্যটা গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ভ্লাদিমিরকে যেন একবার দেখে নিল।

Facebook Comments

comments

১ Reply to “লেনিন-পর্ব ১৩।। আশানুর রহমান”

  1. aslam hayat বলেছেন:

    Waiting for the next part

aslam hayat শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top