নামদেও ধাসালের কবিতা ।। অনুবাদঃ জ্যোতির্ময় নন্দী

নিষ্ঠুরতা

আমি ভাষার গোপনাঙ্গে এক যৌনক্ষত।
শত শত, হাজার হাজার বিষণ্ণ, করুণ চোখে
তাকিয়ে থাকা জ্যান্ত প্রেত
আমার মর্মমূল নাড়িয়ে দিয়েছে।
আমার ভেতরে বিস্ফোরিত বিদ্রোহে আমি ভেঙেচুরে গেছি।
কোথাও কোনো জ্যোৎস্না নেই;
কোথাও কোনো জল নেই।
এক পাগলা শেয়াল তার ধারালো দাঁতে ছিঁড়ে খাচ্ছে আমার মাংস;
আর এক ভয়ঙ্কর সর্পবিষের মতো নিষ্ঠুরতা
ছড়িয়ে পড়ছে আমার বাঁদুরে হাড় থেকে।

আমাকে মুক্তি দাও আমার নারকীয় পরিচয় থেকে।
আমাকে এসব তারার সঙ্গে প্রেমে পড়তে দাও।
গুঁড়ি মেরে দিগন্ত অবধি ছড়িয়ে পড়ছে এক স্ফূটমান বেগুনি।
ফাটল ধরা এক চেহারা থেকে উপচে পড়ছে এক মরুদ্যান।
এক ঘূর্ণিঝড় পাক খেয়ে ঢুকে পড়ছে এক অসংকোচনীয় যোনিমুখে।
একটা বেড়াল শুরু করেছে মরণযন্ত্রণার লোম আঁচড়ানো।
রাতটা অবকাশ এনে দিয়েছে আমার ক্রোধের।
একটা নেড়িকুত্তা নাচতে লেগেছে জানলাটার চোখে।
একটা উটপাখি ঠোঁট দিয়ে ভেঙে খুলতে শুরু করেছে খোলা আবর্জনা।

একটা মিশরি গাজর গিলতে শুরু করেছে দৈহিক বাস্তবতা।
একটা কবিতা একটা লাশ তুলে আনছে তার কবর থেকে।
সত্তার দরজাগুলো চটজলদি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে মুখের ওপর।
সব সর্বনামের মধ্যে দিয়ে এখন এক রক্তস্রোত প্রবাহিত।
আমার জীবন জেগে উঠছে ব্যাকরণের দেয়াল পেরিয়ে।
ঈশ্বরের মলমূত্র ঝরে পড়ছে সৃষ্টির বিছানায়।
বেদনা এবং রুটি সেঁকা হচ্ছে একই তন্দুরের আগুনে।
বস্ত্রহীনের শিখা ঠাঁই নিয়েছে পুরাণকাহিনি আর লোককথায়।
বেশ্যাবৃত্তির পাথর মিলিত হচ্ছে জ্যান্ত শেকড়ের সঙ্গে;
একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে দাঁড়াচ্ছে খোঁড়া পায়ে;
শয়তান শুরু করেছে দীর্ঘ অন্তঃসারশূন্যতার ঢাক পেটানো।
একটা কচি সবুজ পাতা দুলতে শুরু করছে কামনার দরজায়।
হতাশার লাশ সেলাই করা হচ্ছে।
এক মনোবিকারগ্রস্ত বাগ্‌দেবী ঠেলা দিচ্ছে শাশ্বতের প্রতিমাকে।
বর্মের খোসা ছাড়িয়ে নিতে শুরু করেছে ধুলো ।
অন্ধকারের পাগড়ি খসে পড়ছে।

তুমি, তোমার চোখ খোলো: এগুলো পুরোনো কথা।
খাঁড়িটা ভরে যাচ্ছে ধেয়ে আসা জোয়ারের জলে;
ঢেউগুলো স্পর্শ করছে সৈকতরেখা।

তবুও সর্পবিষের মতো এক নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পড়ছে আমার বাঁদুরে হাড় থেকে।

এটা স্বচ্ছ এবং নির্মল: নর্মদা নদীর জলের মতো।

যেদিন সে চলে গেলো

যেদিন সে চলে গেলো
আমার মুখে আমি কালো রঙ মেখে নিলাম।

বর্বর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বাতাসের গালে কষে চড় দিলাম।
আমার জীবনের ছোট ছোট টুকরোগুলোকে কুড়িয়ে নিলাম
আর ফাটা আয়নার সামনে দাঁড়ালাম নগ্ন।
সুযোগ দিলাম আমার নিজের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার।
হাসিমুখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললাম, “শালা পাগলা!”
স্বপ্ন আঁকে এমন সব শিল্পীকে বাছাই করা কিছু গালাগাল দিলাম;
প্রাচ্য থেকে হেঁটে গেলাম পাশ্চাত্যের দিকে।
রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া নুড়িপাথরগুলো ছুঁড়ে দিলাম নিজের দিকে।
উল্লাসের তোড়ে কী প্রবলভাবেই-না বয়ে চলেছে জল।
পর্বতমালা আর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে।
কোন্ মহাসাগরের সঙ্গে মিলিত হতে চাইছে সে?
নাকি সমুদ্রের সমতলে মাটি তাকে শুষে নেবে?
এমনকি আমিও কি আমার নিজের?
আমি পারি না তার মৃতদেহও জড়িয়ে ধরতে
আর হৃদয় উজাড় করে কেঁদে উঠতে।

যেদিন সে চলে গেলো
আমার মুখে আমি কালো রঙ মেখে নিলাম।

[তথাকথিত ‘অচ্ছুৎ’ বা ‘দলিত’ বংশোদ্ভূত স্বনামধন্য মারাঠি কবি, লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী নামদেও ধাসাল (পুরো নাম নামদেও লক্ষ্মণ ধাসাল) ১৯৪৯-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের মহারাষ্ট্রের পুনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৯-এ তিনি ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব অর্জন করেন। ২০০৪-এ পান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮২ ও ১৯৮৩-তে চার-চারবার মহারাষ্ট্র রাজ্য সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। প্রথম বার্লিন সাহিত্য উৎসবে তিনি অংশগ্রহণ করে নিবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ব্ল্যাক প্যান্থার আন্দোলন অনুসরণে তিনি ১৯৭২-এ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে দলিত প্যান্থার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। জাতিপাত প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে ভারতীয় সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতো ধাসালও জীবনের এক পর্যায়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০১৪’র ১৫ জানুয়ারি। দিলিপ চিত্রে’র করা ইংরেজি ভাষান্তর অনুসরণে কবি নামদেও ধাসালের দুটো কবিতার অনুবাদ করা হলো।]

Facebook Comments

comments

১ Reply to “নামদেও ধাসালের কবিতা ।। অনুবাদঃ জ্যোতির্ময় নন্দী”

  1. আনোয়ার রশীদ সাগর বলেছেন:

    নামদেও ধাসালের কবিতা এই প্রথম পড়লাম।ধন্যবাদ অনুবাদক এবং উঠান পরিবারকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top