মাই ডিভাইন জার্নি : দশ ।। মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা

এই তো সেদিনের কথা, ফকির সামসুল সাঁইজির আখড়া বাড়ির সাধুসঙ্গে গেছি। তখন এপ্রিল মাস, শীত পেরিয়ে গ্রীষ্মে প্রবেশ করেছে ঋতুচক্র। আখড়ার উদ্দেশ্যে ভোরে রওনা দিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভরদুপুর। তখনো রাজশাহীতে ধোঁয়া ওঠা গরম পড়েনি; তারপরও ঘামে ভিজতে ভিজতে পৌঁছালাম ন’হাটা বাজারে। দুপুর সময়টাতে গ্রামের এই ছোট্ট বাজারে রিক্সাভ্যান পাওয়া বড়ই মুশকিল। একটা দোকান পর্যন্ত খোলা নেই। বাকি পথটা কীভাবে যাব? ফোন করতেই কয়েক মিনিটেই মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির উজ্জ্বল সাধু। বাকিটা পথ ঐ মোটর সাইকেলে চেপেই সাই সাই করে পাড়ি দিয়ে দিলাম। গ্রামের মেঠোপথ পেরিয়ে আখড়ার প্রবেশ মুখেই দেখা মিলল পরিচিত বেশকিছু মুখ। দর্শন পাওয়া গেল সামসুল সাঁইজির।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। পথের পাশে ফাঁকা অংশটায় টুকটুক করে দোকানপাট বসতে বসতে ছোটখাটো মেলায় রূপ নিতে বেশি সময় লাগলো না। টিমটিমে আলোর জায়গায় যখন ডেকোরেটরের বাতিগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করলো ততক্ষণ ছোটদের ঈদ শুরু হয়ে গেছে। বড়রাও গুটিগুটি পায়ে আসতে শুরু করেছে। সাধুগুরুরা অবশ্য বিকেলের আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই জমায়েত হয়েছেন। আসন নিয়েছেন। আমি ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছি। চা-বাদাম-তেলেভাজা-পেয়ারা-শশা এমনকি তরমুজও খাওয়া শেষ; তাও যেন মন ভরছে না। নাম ভুলে যাওয়া সামসুল সাঁইজির এক ভক্ত কিছুতেই কোন দোকানে টাকা দিতে দিচ্ছেন না। আমি খাচ্ছি আর উনি সমানে বিল মিটিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টা অল্প সময়কাল অস্বস্তি দিলেও তার সরল ভক্তি আমাকে মুগ্ধ করে নিল। আলাপ অবশ্য খুব এগুলো না তবে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ছোট্ট মেলার পরিসরে; একসময় সাথে আরো অনেকেই জুড়ে গেল। সকলের সাথে ঘুরে বেড়ালেও আমি মনে মনে যেন বারবার অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছিলাম। আসলে প্রকৃতির মাঝে গেলেই সন্ধ্যার এই সময়টা আমাকে বড় বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলে।

সন্ধ্যার এই সময়টা কিন্তু সত্যই দিনের অন্য সময় থেকে বেশ খানিকটা আলাদা এবং অনেক বেশি বিষন্ন। সাধকের জন্য ‘প্রভাত’ আর ‘সন্ধ্যা’ এ দুইটা সময় দিনের যে কোন সময় থেকে ভিন্ন এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এর প্রথমটা রাত থেকে দিনের দিকে যাত্রাকালের সন্ধিক্ষণ; অন্যটা দিন থেকে রাতের দিকে যাত্রাকালের সন্ধিক্ষণ। রাত যখন দিনের দিকে যাত্রা করতে করতে ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছায় সেই সময়টাতে সর্বত্র এক ধরনের জাগরণের ফুল ফুটতে শুরু করে। মন উজ্জীবিত হতে থাকে। প্রাণশক্তি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সজীবতা পাখা মেলে। তেমনি যখন আবার দিন ফুরাতে ফুরাতে রাতের দিকে হাঁটা দেয় তখন প্রকৃতিতে ঘটে তার বিপরীত চিত্র। সে সময় একটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয় চারপাশে। প্রাণশক্তি এই ক্রান্তিকালের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে মগ্ন হতে শুরু করে আপন বলয়ে। মনের মাঝে মেঘ জমতে শুরু করে; মন অন্তর্মুখী হতে থাকে। অবশ্য এই সময়টা খুব একটা দীর্ঘ হয় না। আবার প্রকৃতির মাঝে না থাকলে এই সময়টা টেরও পাওয়া যায় না।

নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার এই সময়টা প্রত্যেক সাধকের কাছেই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। দিনের অষ্টপ্রহরের মধ্যে সাধকদের জন্য যে কয়টা মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত; তার মধ্যে সন্ধ্যাবেলা অন্যতম। কারণ এইসময়ই সাধক তার সাধন দিনের ভিত রচনা করে। আলো যখন অন্ধকারে যাত্রা শুরু করে তখনই শুরু হয় সাধকের দিবস। কারণ সাধকের কাজই অন্ধকারে আলোর রচনা করা। সাধকের এই সাধন দিবসের সূচনাটা প্রতিদিন ছন্দময় করতে এ সময় সাধকরা নিজেকে পরিপাটি-পবিত্র করে, আখড়াবাড়ি পরিচ্ছন্ন করে, ধুপধোয়া দিয়ে সন্ধ্যাবাতি করে সমবেত হয়ে আরাধনায় বসে। লালন সাধকরা এ সময় গ্রহণ করে চাল-জল। তারপর সমবেত ভক্তি দিয়ে একে একে করে গুরুকে ভক্তি। এরপর একটু জল-খাবার সেবা। তারপর যার যার রীতি অনুযায়ী চলে সাধন-ভজন গান-বাজনা।

এমনি এক সন্ধ্যা লগ্নে রীতিমতো মাইকে ঘোষণা দিয়ে শুরু হলো সাধুসঙ্গ। প্রথমে চাল-জল তারপর ভক্তি দিয়ে অধিবাস। মঞ্চে এক এক করে আলোচকরা বক্তৃতা দিয়ে নেমে যাওয়ার পর মঞ্চে উঠলেন ফকির সামসুল সাঁইজি। সামসুল সাঁইজির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সাধুসঙ্গে। সে সময় আলাপচারিতার সুযোগ হয়নি তেমন। এরপর ফোনে কথা হয়েছে বার কয়েক। তারপর একদিন ট্রেন ধরে রাজশাহী; সেখান থেকে কয়েকবার গাড়ি পাল্টে বাগলপাড়া গ্রামে। সঙ্গ হয়েছে। জেনেছি তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ছেড়ে দিয়ে সাধক হয়ে উঠবার গল্প। কুষ্টিয়া থেকে লালন সাঁইজির বাণী কি করে নিয়ে গেছেন বাগলপাড়ার নিভৃত অঞ্চলে সেই সংগ্রামের দীর্ঘ কাহিনী। এই নিভৃতপল্লীতে একখণ্ড আনন্দনগর গড়ে তুলতে তাকে যে কতশত বাঁধাবিঘ্ন পেরিয়ে আসতে হয়েছে তার হিসেব নেই। পরমযত্নে গড়া এই ছোট্ট আনন্দনগরীর নাম দিয়েছেন “সাঁইনগর”। যেখানে লালন পিপাসুরা সত্য সুপথ অনুসন্ধানে আনাগোনা করে।

সেইবারও গিয়েছিলাম সাধুসঙ্গকে কেন্দ্র করেই। চব্বিশ ঘণ্টার সাধুসঙ্গ শেষে দূরদূরান্ত থেকে আগত সাধুগুরু-সাধক-ভক্তরা যখন একে একে আখড়াবাড়ি ফাঁকা করে চলে গেল তখন আমরা কয়েকজন রয়ে গেলাম। তাদের কারো সাথেই বিশেষ পরিচিত হইনি তখনো। তাতে অবশ্য বিশেষ কোন সমস্যা হয়নি। সাধুসঙ্গ শেষে যে ক’দিন ছিলাম সবটা সময়ই সামসুল সাঁইজি রইলেন মেঘের মত মাথার উপর। সঙ্গ হলো দিবা-রাত্রি। এরপরেও গেছি-সঙ্গ হয়েছে।

সামসুল সাঁইজির আখড়ায় যাওয়ার অবশ্য একটা ভিন্ন কারণও আছে। তার আখড়ায় গেলে, বলতে গেলে তার সান্নিধ্যে গেলে নতুন ভাবনার খোরাক পাওয়া যায়; যা আমাকে অতিমাত্রায় আকর্ষিত করে। দেখা গেছে প্রতিবারই ফিরে আসি মাথায় নতুন ভাবনা নিয়ে। এটা আমাকে বারবার নিয়ে যায় তাঁর আখড়ায়। তিনি প্রতিবারই এমন নতুন কিছু বলেন যা থেকে নতুন ভাবনার সূচনা হয়। একবার সাঁইজি বললেন, লালন সাঁইজির মাজারে পূর্ণসেবায় একসময় ইলিশ মাছ কেন দেয়া হত। ইলিশ মাছের জীবনপ্রণালীর সাথে সাধুর জীবনপ্রণালী এমন এক সাদৃশ্য তুলে ধরলেন যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

ফকির নহির সাঁইজি একবার বলেছিলেন, “বাপ! প্রতিটা সাধুসঙ্গ থেকে একটা করে কথাও যদি মনে রাখতে পার, তাহলে সঙ্গ করতে করতে দেখবা; এত কিছু জানা-বোঝা হয়ে গেছে যে, কোন কিছু জানতে হলে আর পরের কাছে যেতে হবে না।” কথাটা আমার বেশ মনে ধরেছে। তাই এক সাধুসঙ্গ থেকেই সবকিছু বা যতটা পারা যায় জেনে নেয়ার একটা প্রবণতা যে আমার ভেতরে একসময় ছিল তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি অনেকটাই। একটা সাধুসঙ্গ থেকে অনেক কিছু জানতে হবে বুঝতে হবে এই প্রবণতা মনে বিরাজ করলে আদৌ কিছুই নিয়ে ফেরা হয় না। অস্থিরতা কাজ করে; বারবার মনের মাঝে খেলা করে আহ্ ওটা জানা হল না, ইস্ এটা তো জিজ্ঞাসাই করা হল না ইত্যাদি। অবশ্য এতদিনে আমি নিজেকে এটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, একটা সাধুসঙ্গ থেকে যদি একটা বাক্য শিখতে বা জানতে বা বুঝতে পারি তাই অনেক বড় পাওয়া। সেই একটা বাক্য নিয়ে তখন অনেক বেশি ভাবা যায়-তার অনেক গভীরে প্রবেশ করা যায়। ধীর-স্থির হয়ে তার প্রতিটা পালক নেড়েচেড়ে দেখা যায়। আর বেশি জানতে বা শুনতে চাইলে তা আর হয় না। সাধনার পথ যেমন সহজ নয় তেমনই তাড়াহুড়া করার কোন উপায়ও নেই এখানে।

সেই কথা মাথায় রেখেই সাধুর বাড়ি যাই। কত কথা শুনি-বলি কিন্তু মননে রাখতে চাই অন্তত একটা মূল বাক্য। যাকে আবর্ত করে বাকি সকল কথা-চিন্তা-চেতনা-আলাপচারিতা ফিরে ফিরে আসবে। সেবার সকল বক্তার শেষে যখন সামসুল সাঁইজি মঞ্চে উঠলেন তখন আকাশে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। তবে হাবভাব এমন নয় যে এখনি, আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। কিছুটা সময় পাওয়া যাবে; হয়তো কয়েক ঘণ্টাও। আগেই দীর্ঘ আলোচনা হয়ে যাওয়ায় সাঁইজি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। অন্য কারো আলোচনায় কিছুই স্পষ্ট হলো না যদিও প্রত্যেকেই চেষ্টা করেছেন গুরুবাদী দর্শনকে বিশ্লেষণ করতে। তাই আলোচনার শেষ লগ্নে মুগ্ধ হয়ে শুনলাম ফকির সামসুল সাঁইজির কথাগুলো। সাধুসঙ্গ তার আপন গতিতে ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে একসময় শেষ হল। বরাবরের মত অন্যান্যরা চলে গেলে সামসুল সাঁইজির সাথে নিভৃতে সঙ্গ শুরু হলো। একের পর এক গান শুনিয়ে তিনি এক সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছু বলছ না যে।’ আমি বললাম, ‘সাঁইজি আপনি মঞ্চে যে লালন সাঁইজিকে ‘অযোনি’ বললেন সেই ঘোর থেকে এখনো বের হতে পারিনি। সেই ভাবনাই আমাকে ভাবিয়ে নিয়ে চলেছে।’ সাঁইজি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটু হাসি দিয়ে গাইতে শুরু করলেন-

অখন্ড মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচর।
গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ঈশ্বর।।
 
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তিনে
ভজে তোমায় নিশিদিনে,
আমি জানি নাকো তোমা বিনে
তুমি গুরু পরাৎপর।।
 
ভজে যদি না পাই তোমায়
এ দোষ আমি দেবো বা কার,
নয়ন দুটি তোমার উপর
যা করো তুমি এবার।।
 
আমি লালন একই শিরে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে,
ভুগেছিলাম পক্সজ্বরে
মলম শাহ্‌ করেন উদ্ধার।

ফকির সামসুল সাইজির বক্তৃতা : https://youtu.be/1on6OteFhkY

সঙ্গ শেষে মধ্যরাতে যখন সকলে নাক ডাকার প্রতিযোগীতায় মেতেছে তখনো আমার চোখে ঘুম নেই। মাথার ভেতর কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল সামসুল সাঁইজির সেই কথা, লালন ফকির অযোনি? মানে কোন যোনি থেকে তাঁর জন্ম হয়নি! প্রচলিত মতে, একমাত্র যীশুই পিতা ছাড়া ধরিত্রীতে এসেছেন। অন্যদিকে সনাতন বিশ্বাসে পাওয়া যায়, বিভিন্ন দেবতা-মুণি-ঋষি মানবকুলে শিশু জন্ম দিয়েছেন বটে কিন্তু পিতা-মাতা ছাড়া ধরিত্রীতে মানবকুলে কেউ এসেছেন এমনটা আগে আমি অন্তত শুনিনি বা পড়িনি। মাথায় প্রশ্নটা প্রকট হতেই লাগলো, লালন ফকির এসেছেন পিতা-মাতা ছাড়াই? তিনি ছিলেন এবং আছেন! তাজা মানবপ্রাণ জলে ভাসে না, কিন্তু কালী নদীর তীরে লালন ফকিরকে যখন মলম শাহ্ আবিস্কার করেন তখন লালন জলে ভাসছিল। সামসুল সাঁইজি এখানেই প্রশ্নটা তুলেছেন, জ্যান্ত কি জলে ভাসে? নাহ্ ভাসে না। তাহলে লালন ভাসছিল কি করে? এই যে লালনকে জলে পাওয়া গেল এর আগে তার সম্পর্কে কোন ইতিহাস কি খুঁজে পাওয়া যায়? যায় না। কারণ লালনের মানবযোনিতে জন্মই হয়নি; তিনি অযোনি। তিনি মানবকে নির্বাণের অর্থাৎ মুক্তির বাণী দিতে ছেঁউড়িয়ায় এসেছিলেন। শুয়ে শুয়ে সামসুল সাঁইজির কথাগুলো ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে আরো গভীরে যাচ্ছিলাম। এই প্রশ্নের পক্ষে বা বিপক্ষে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ যুক্তি তো দেয়াই যায় চাইলে। আমি চিন্তাকে সেপথে নিলাম না, আমি ভাবতে শুরু করলাম যদি প্রশ্নটা যৌক্তিক হয় তাহলে এর স্বরূপ কি হবে!

যারা লেখাটার এতদূর পড়েছেন তারা হয়ত এতক্ষণে অনেক যুক্তিপূর্ণ উত্তর খুঁজেও বের করে ফেলেছেন। অল্প কিছুদিন আগে হলে হয়ত আমিও এভাবেই ভাবতাম। হুটহাট সিদ্ধান্ত নিতাম নিজের জমানো বিদ্যার বা তথ্যের উপর ভর করে। তবে আধ্যাত্ম সাধনার এই অনুসন্ধানী পথে হুটহাটের কোন পর্বই নেই। এটা রহস্যের লীলাখেলা। এই রহস্যের লীলাকে বুঝতে হয় রহস্য দিয়েই। এই লীলার জগতে প্রশ্নকে দেখা হয় একটু ভিন্নদৃষ্টিতে; এখানে প্রথমে একটা প্রশ্ন থেকে একটা চিন্তার খোরাক তৈরি করা হয়। তারপর তার ভেতর দিয়ে ধীর লয়ে হাঁটতে হাঁটতে সমস্ত সম্ভবনাকে যাচাই-বাছাই করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয় অনুভবের উপলব্ধি আবিস্কার করার লক্ষ্যে। এই অনুসন্ধানের পথে চলতে চলতে যে উপলব্ধি হয়, তাই সাধকের পরমপ্রাপ্তি। এই উপলব্ধির অভিজ্ঞতার সাথে নিজেকে, নিজের বিশ্বাসকে, নিজের সংস্কারকে মিলিয়ে নেয়া, নিজের উপলব্ধিকে বুঝতে শেখাই সাধনার প্রাথমিক পর্ব। তাই সাধনকালে নিজের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-তথ্যের উপর নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্তে না এসে, যে প্রশ্ন মনে দাগ কাটে তার বিশ্লেষণে যেতে হয় মূলখণ্ডনের মধ্য দিয়ে।

অনুসন্ধানচক্রে সাধনার পদ্ধতির সাথে বিজ্ঞানের পদ্ধতির তেমন তফাৎ নেই। বিজ্ঞান গবেষণা করে গবেষণাগারে আর পরীক্ষা চালায় বেশিভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন দেহে বা ভিন্ন পাত্রে। আর সাধক তার গবেষণা বা সাধনকার্য চালায় নিজ দেহে। দেহই তার গবেষণাগার আর সাধক স্বয়ং গবেষক; গুরু হচ্ছেন পথ প্রদর্শক। গুরু বাণী হচ্ছে সাধনায় পৌঁছানোর সূত্র। গুরুর নির্দেশিত পথেই সাধক তার সাধন-ভজন চালিয়ে যায়। তবে সাধন-ভজন শুরু করলেই যে সকলে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে তা কিন্তু নয়। বেশিভাগ সাধকই আবেগের বসে বা অন্যের দেখাদেখি চরম প্রত্যাশা নিয়ে সাধনকর্ম শুরু করে এবং যথারীতি অল্পদিনেই হতাশ হয়ে পড়ে। তারপর গুরুর ভুল খুঁজতে খুঁজতে বাকিটা সময় কাটিয়ে দেয়। মূলত এই প্রকারের সাধককুলই আধ্যাত্মবাদকে কলঙ্কিত করে।

সত্যি কথা বলতে কি, বিশ্বাস আর ভরসা এই দুই অদৃশ্য ভাবাবেগ মনের ভেতর দৃঢ়ভাবে বসতি না গড়লে কোন প্রেমই স্থায়ী হয় না। বিশ্বাস আর ভরসা উবে গেলে প্রেম অসার হয়ে যায়। কার্যকারিতা অবশিষ্ট থাকে না। তা সে প্রেম প্রেমিক-প্রেমিকারই হোক বা গুরু-শিষ্যের। গুরু-শিষ্যের এই পারস্পারিক প্রেম টিকিয়ে রাখতে শিষ্যকে সর্বদা সচেতন থাকতে হয় যাতে কোন প্রকারেই গুরু রুষ্ঠ না হন। অন্যদিকে গুরু কর্মনিষ্ঠা আর ভক্তি অবলোকন করতে প্রতিনিয়ত পরীক্ষার ফাঁদে রাখে শিষ্যকে। আর প্রকৃত শিষ্য সদা-সর্বদা পরীক্ষার এই ডুবজলে ডুবে ডুবে ডুব সাঁতার শিখতে মত্ত থাকে। একবার এক কালী সাধক বলেছিল, “বুঝলা, সবার আগে হইলো গুরু; গুরুভক্তি। ধরো তুমি কোনো পূজা করছো এমন সময় গুরু স্বয়ং উপস্থিত হলেন সেখানে। তখন সকল পূজা বন্ধ রেখে প্রথমে গুরুপূজা করতে হবে। গুরু সবার আগে। তাই আগে গুরু-মুর্শিদ পূজা তারপর অন্য সব দেবদেবীর পূজা। কারণ দেব-দেবতা রুষ্ঠ হলে গুরু বাঁচিয়ে দিলেও দিতে পারে। কিন্তু গুরু রুষ্ঠ হলে দেব-দেবতারাও রক্ষা করতে পারে না। তাই গুরু যাতে কখনো মনক্ষুন্ন না হয় সেদিকে সদাসর্বদা দৃষ্টি রাখতে হয় ভক্তকে।”

এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একবার এক মাজারে গেলাম। সেখানে আলো আধারীর নিভৃত কোণে এক গুরু-শিষ্যের সাথে আলাপ জমে গেল। শিষ্যের প্রতি গুরুর ভালোবাসা আর গুরুর প্রতি শিষ্যের ভক্তি দেখে আমি তো মুগ্ধ। আশপাশের অন্যান্য সাধুগুরুর মতো তাদের আসরে নেই কোন জৌলুস। জীর্ণ মলিন ছেঁড়া ময়লা পোশাক আশাক তাতে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তাদের মুখে সর্বদা হাসি; সেই হাসিতে নেই কোন আত্ম অহঙ্কার-নেই চতুরতা। কি যে আনন্দে তারা আছে তা তারাই জানে। সর্বক্ষণ ভক্ত ছেলেটা গুরুর সেবা করেছে সাথে অনবরত চালিয়ে যাচ্ছে তার জ্ঞানের গালগল্প। আর গুরু হাসি মুখে মৃদু তালে মাথা নাড়ছেন। হরেক রঙের ছোট ছোট মোমবাতির আলোয় পরিবেশ বেশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। গোল হয়ে বসে কথা শুনছি। গুরু চোখ আধো বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসেছেন; শিষ্য দুই হাতে অতি যত্নে গুরুর পা টিপছে আর সমানে জ্ঞানের কথা আউড়ে যাচ্ছেন। তার কথার মধ্যে একটা মাদকতা ছিল যা বসে থাকা আমাদের সকলকে মনযোগী করে তুলেছিল। কথায় কথায় শিষ্য এক সময় বললেন- “বাত্তি আলাদা হইলেও আলো কিন্তুক একই। কত্ত পদের বাত্তি জ্বলে দ্বীন-দুনিয়ায় কিন্তুক আলো একই। আলোর কোন ভেদ নাই।” গুরু চোখ না খুলেই শিষ্যকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ওরে অবুঝ! থাম… থাম…। আরেকটু গভীরে ভাব। উপরি উপরি ভাবলে কি এখন হইবো। অনেকদিন তো তর হইলো। এখন ডুব দিয়া দেখ গভীর জলের ভেদ। অজ্ঞানের চশমা পরা চোখে সব বাত্তি একই লাগে। কিন্তুক ভালা কইরা খেয়াল কইরা দেখলে দেখবি বাত্তি যেমন আলাদা আলাদা আলোও তেমনি আলাদা আলাদা। সব আলোর তেজ যেমন এক না। আবার সব আলোর রঙও এক নারে। দেখ মোমবাত্তির আলোটা কেমন নরম আর ঐ বাত্তির আলোটা দেখ কেমন কেটকেটা। আবার ঐ দেখ বড় রাস্তার সাদা বাত্তির আলোটা অনেক বেশি ছড়াইলেও তেজ কিন্তুক কম। বুঝলি জ্ঞান থাকলেই সবতে জ্ঞানী হয় কথা সত্য। কিন্তু সবতের জ্ঞান কি আর সমান? মানুষ কি আর দুই হাত জড়ো কইরা সাড়ে তিন হাত শরীলটারে ভক্তি দেয়? নারে পাগল, মানুষ মানুষের ভিতরের যে জ্ঞান-যে পবিত্র আত্মা তারে ভক্তি দেয়। ঐটাই হইলো গুরু। গুরু বাইরে থাকে না। গুরু থাকে ভিতরে। মাইনষ্যের নিজের ভিতরে। প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই নিজের গুরু থাকে বুঝলি। আর বাইরের যে গুরু, সে ভক্তের ভিতরের সেই গুরুর সাথে ভক্তরে পরিচয় করায়া দেয় মাত্র। আমি কিছু না বুঝলি। আমি কিছু না।” এই বলে থামলেন গুরু। চোখটা পুরোপুরি বুজে মৃদু তালে মাথা নাড়তে লাগলেন। শিষ্য কি সব ভাবতে ভাবতে তুমুল বেগে পা টিপে চললো। অনেক সময় পরেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করব? বসে থাকব নাকি উঠে যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকার রাতে জমজমাট মাজার প্রাঙ্গনে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো দেখছিলাম। হরেক রকম আলো।

এই একসাথে হরেক রকমের আলো দেখতে গেলে আমার ভিন্ন এক আলোর কথা মনে পড়ে যায়। বেশ অনেকটা সময় আগের কথা। তখনো আমরা পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়াতে থাকি। সেসময় আমাদের বাসায় মাঝে মধ্যে অদ্ভুত টাইপের একজন মহিলা আসতেন। উদ্ভট খসখসে গলায় ফিস ফিস করে কথা বলা এই মাঝবয়সী মহিলাকে আমরা ডাকতাম সুফিয়া ফুপু। সম্ভবত আমরা এর আগে যে বাসায় ভাড়া থাকতাম তিনি সেই এলাকায় থাকতেন। আমাদের সাথে অনেক প্যাঁচানো-ঘোরানো একটা আত্মীয়তার সম্পর্কও হয়ত ছিল। যতদূর মনে পড়ে, পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই মহিলার একটি কন্যা সন্তান হওয়ার পর কোন কারণে তার স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কন্যাটি থেকে যায় তার স্বামীর কাছে আর তিনি চলে আসেন তার ভাইদের সংসারে। বিয়ে থা করেননি আর। প্রথম দিকে সব ঠিকঠাকই ছিল। পরে কোন একসময় তার আবার স্বামী-সন্তানকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়। সম্ভবত তার ভাই ও ভাবীদের আচরণই এর কারণ। তবে তার প্রভাবশালী ভাই’রা কোনভাবেই রাজি নয় এই ব্যাপারে। উনার স্বামী তার সাথে আবার থাকতে চায় কিনা সেটা নিয়ে তিনি নিজেই সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত ছিলেন না। তবে তিনি বলতেন তার স্বামীর সাথে নাকি তার কথা হয় ফোনে। বর্তমান বউ নিয়ে তিনি সুখী নন। ফিরতে চান তার কাছে। কিন্তু সুফিয়া ফুপুর ভাইদের ভয়ে তিনি সুফিয়া ফুপুকে নিয়েও নতুন করে আর কিছু ভাবতে সাহস পান না।

এই মহিলা মধ্যদুপুরে উপস্থিত হয়ে আমার মায়ের সাথে নিচু স্বরে এসব কথা বলতেন। তার এই সব কথা বারবার শুনতে শুনতে আমাদের ঘরের সবার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার মা কাউকেই না বলতে পারতেন না। এই সূত্রে কত ইন্টারেস্টিং মানুষ যে আমাদের বাড়িতে আসত তার শেষ নেই। যাক সে কথা, যা বলতে সুফিয়া ফুপুর কথা বলছিলাম। তিনি আমাদের বাসায় কেন আসতেন তা আমার সঠিক জানা নেই, তবে আমার ধারণা তার কথা আমার মা ছাড়া কেউ শুনত না। তিনি একই কথা এতবার বলতেন যে সেটা সত্যেই চরম বিরক্তিকর। এ কারণে তিনি কোথাও বিশেষ পাত্তা পেতেন না। আর যে সময় থেকে স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার চিন্তা ওনার মাথায় ঢুকেছে সেসময় থেকে বাড়ির লোকজন উনাকে টাকা পয়সা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ সুফিয়া ফুপু স্বামী-সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য তাবিজকবজ করে বহু টাকা ইতিমধ্যেই নষ্ট করেছেন।

সুফিয়া ফুপুর ধারণা ছিল তাকে তার বাড়ির মানুষ সকল সময় অনুসরণ করে। তাই তিনি পীর-ফকিরের বাড়িতে যাওয়ার আগে প্রথমে আমাদের বাড়িতে আসতেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করতেন। তারপর যখন নিশ্চিত হতেন কেউ তার উপর নজর রাখছে না, তখন আমাদের বাসার পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে যেতেন। তিনি প্রতিবারই ঘর থেকে বণেদী কিছু না কিছু লুকিয়ে নিয়ে আসতেন। সেগুলো বিক্রি করে সেই টাকা নিয়ে তবে পীর-ফকিরের বাড়ি যেতেন। দামী কোন কিছু না পেলে নকশা করা চীনামাটির প্লেট-বাটি পর্যন্ত আনতেন। আর যাকে পেতেন সামনে তার কাছেই বিক্রি করার চেষ্টা করতেন। অবশ্য তিনি একে বিক্রি বলতেন না, বলতেন বন্ধক। টাকা দিয়ে পরে ছাড়িয়ে নিবেন।

সুফিয়া ফুপুকে যদিও আমরা বাড়ির ছোটরা কেউ পছন্দ করতাম না তার অতিকথা বলার কারণে। তারপরও তিনি মাঝেমধ্যে সাথে করে যে মজাদার সব হালুয়া বানিয়ে আনতেন এবং অতি গোপনে এমনভাবে দিতেন তা দেখবার মতো। তার লোভও সামলাতে পারতাম না। পরিমাণ খুব সামান্য হলেও স্বাদ অতুলনীয়। আমাদের বাসার কাছাকাছি হলে উনি আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন উনার পীর-ফকিরের বাড়িতে। আমারও দারুণ লাগত নতুন নতুন পীর-ফকিরের বাড়ি যেতে। তিনি এক পীর-ফকিরের উপর বেশিদিন আস্থা রাখতে পারতেন না। নতুন নতুন পীর-ফকিরের সন্ধান যে উনি কোথা থেকে পেতেন তা তিনিই ভালো জানেন। একবার তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ইসলামপুরের জিন্দাবাহারের কোন এক চোরাগলিতে। অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে আঁকাবাঁকা গলিপথ পাড়ি দিয়ে, সরু সিঁড়ি বেয়ে। একসময় একটা অন্ধকার ঘরে পৌঁছালাম। যেন গোপন কোন ঘাঁটিতে এসেছি। যিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সেই অন্ধকার ঘরে আমাদের রেখে চলে গেলেন। সামনের ভারি পর্দা সরিয়ে আরেকজন আমাদের নিয়ে গেলেন আরেকটা করিডোর ধরে অদ্ভুত আলোকজ্জ্বল এক ঘরে। সত্যি বলছি এর আগে আমি এত বর্ণের আলো একসাথে কখনো দেখিনি। চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। বিশাল হল ঘরের মেঝেতে সাদা তক্তোপসের উপর একজন নূরানী চেহারার সবুজ পাগড়ী পরা বৃদ্ধ বসে আছেন। আর পুরো সিলিং দেয়াল মেঝেসহ ঘরের তক্তোপোস ছাড়া সর্বত্র বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন রকেমের, বিভিন্ন পাওয়ারের বাতি। আমার মনে আছে আমি প্রথমটায় এতটাই চমকে গিয়েছিলাম যে সুফিয়া ফুপুকে আকড়ে ধরেছিলাম। স্বাভাবিক হওয়ার পর লক্ষ্য করলাম বিশাল আয়তাকার ঘরটার সবগুলো দেয়াল ও মেঝে সবর্ত্রই আয়না দিয়ে মোড়া। এতে করে হাজার হাজার বাতি লক্ষ লক্ষ বাতিতে পরিণত হয়েছে। মেঝের বড় বড় মোমবাতির আলো উপরের সাঝবাতির রংবেরঙের কাঁচের উপর পড়ে কি একটা মিশ্র আলো পুরো ঘরটায় ছড়িয়ে আছে; চোখ ধাঁধিয়ে যায় রীতিমতো। মিষ্টি আতরের গন্ধ আর এতবাতি দেখে আমার ভিমড়ি খাবার জোগাড়।

এই অগুণিত বাতির এত রং বেরঙের আলোর কোনটাই খুব তীক্ষ্ম নয় যেন মোলায়েম এক উষ্ণতা। উনারা কি কথা বলছিল তা আমার আর শোনা হয়নি। আমি ঘরময় ঘুরে ঘুরে বাতি দেখছিলাম। ছোট বাতি, বড় বাতি, লম্বা বাতি, খাটো বাতি, চৌকোণা বাতি, গোলাকার বাতি আরো কতরকম যে বাতি দেখেছি সেদিন তা কথায় বলে শেষ করা সম্ভব না। একসময় তাদের কথাবার্তা শেষ হলে যখন আমরা ফিরব তখন বৃদ্ধ পীর তার সামনে বিশাল বিশাল থালার মধ্যে জলের উপরে যে বিশাল সাইজের মোমবাতিগুলো জ্বলছিল তার পাশ থেকে সাদা রঙের বিশাল সাইজের একটা সন্দেশ আমার হাতের তালুতে দিয়ে বললেন “বাইরের বাতি যতই জ্বালাও ভেতরের বাতি না জ্বালাইতে পারলে সব অন্ধকার।” তিনি উর্দু বাংলা মিশিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। আমি প্রথমটায় ভালো বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে সুফিয়া ফুপু রিকশায় বুঝিয়ে বলেছিলেন। পাছে ভুলে যাই তাই বাড়ি ফিরে ‘হাকল বেরি ফিন’ বইয়ের শেষ পাতায় কথাটা লিখে রেখেছিলাম। কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি আর ভেবেছি আসলেই কি আমাদের ভেতরে আলো থাকে?

মোতালেব শাহ্’র মাজারে এক পাগল বলেছিল, “মাইনষ্যের ভিতরের হাগা-মুতা-বমি-কফ-ঘাম-হাঁচি-কাঁশি যেমন যখনকারটা তখন বাইর কইরা দিতে হয় তেমনি ভেতরের অন্ধার বাইর কইরা দিলেই সবটা আলো আর আলো।” ক্লাসে কথা বলার অপরাধে তরুণ স্যার হঠাৎ দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বল্ জ্ঞান মানে কি?” হকচকিয়ে কিছুই বলতে পারিনি। অশেষ স্নেহ করতেন বলে আমাকে বসতে বলে বলেছিলেন, “জ্ঞান হলো আলো। এই আলো না জ্বালাতে পারলে সব অন্ধকার। তখন ক্লাসে বসে বসে কথা বলতে হয়। বুঝলা?” আবার শাস্ত্র বলছে, গুরু’র ‘গু’ হচ্ছে গুজ্জাতি গুজ্জ অর্থাৎ অন্ধকার থেকে অন্ধকার; সাধারণে বুঝতে পারে না এমনি সেই অন্ধকার। এ বড় রহস্যময় অন্ধকার। যেমন আদিতে সবই অন্ধকার। আর ‘রু’ হচ্ছে আলো। যে তোমাকে সেই অবর্ণনীয় অন্ধকার থেকে আলোতে আনবে সেই ‘গুরু’। তুমি চাইলে গুরুকে বুঝলেও বুঝতে পারো কিন্তু সামান্য জ্ঞানে সেই অসীম ও আদি অন্ধকারকে বোঝা অসম্ভব। ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-

যে জন শিষ্য হয়, গুরুর মনের খবর লয়।
এক হাতে যদি বাজতো তালি
তবে দুই হাত কেন লাগায়।।
 
গুরু-শিষ্য এমনি ধারা
চাঁদের কোলে থাকে তারা,
খাঁচা বাঁশে ঘুণে জ্বরা
গুরু না চিনলে ঘটে তাই।।
 
গুরু লোভী শিষ্য কামী
প্রেম করা তার সেচা পানি,
উলুখড়ে জ্বলছে অগ্নি
জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়।।
 
গুরু-শিষ্যে প্রেম করা
মুঠের মধ্যে ছায়া ধরা,
সিরাজ সাঁই কয়, লালন ভেঁড়ো
এমনই প্রেম করা চাই।।

একবার রাজিবের সাথে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গেছি। ঘুরতে ঘুরতে শুক্রবারের বিকেলের হিমেল হাওয়ায় ইটের ভাটায় গিয়ে উপস্থিত। বন্ধের দিন তাই লোকজন নেই বললেই চলে। সারি সারি ইটের ভাট্টিগুলো যেন ছোট ছোট একেকটা দ্বীপ। দূর থেকে ইটের ভাটা দেখেছি, এত কাছে আগে কখন যাওয়া হয়নি। কথা বলতে বলতে আমি আর রাজিব গিয়ে উঠলাম এক ভাট্টির উপর; যার এক কিনারে দুই শ্রমিক ভাট্টির উপরের ছোট্ট ছোট্ট ঢাকনা লোহার চিমটা দিয়ে দূর থেকে তুলে তুলে কি যেন দেখছে। আমরা হড়হড় করে ভাট্টির উপর উঠে উঁকি দিয়ে সেই দেখবার চেষ্টা করি তারা কি দেখছে। শ্রমিক দুজন আমাদের হঠাৎ আগমনে চেহারা কঠিন করে বললেন, ভাইজানরা নড়ন চড়ন কইরেন না ডাইব্ব্যা যাইবেন। আমরা তাদের কথা পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শ্রমিক দুজন হতাশ হয়ে বলতে লাগলো, “গরিবের কথা তো শুনবেন না, আগুনের ভেতরে ডাইব্ব্যা গেলে তয় বুঝবেন।” এই কথা শুনে আমি আর রাজিব ভাট্টির প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছে যেয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। এখন আর পা চলছে না। এগিয়ে যাব নাকি ফিরে আসবো কিছুই বুঝতেছি না। শীতল হাওয়াও আর নাই আশেপাশে। রীতিমত ঘামতে শুরু করছি। পায়ের নিচে গনগনে আগুন ততক্ষণে টের পেতে শুরু করেছি। যেকোন অসতর্ক পদক্ষেপে ডেবে যেতে পারি। ভয় ভয় কণ্ঠে জানতে চাইলাম, ডেবে গেলে কি হবে? শ্রমিক দুই জনের একজন অতি স্বাভাবিকভাবে হাতের চিমটা দেখিয়ে বললো, “পা ডাইব্ব্যা গেলে চিমটা দিয়া মাথায় বাড়ি দিয়া ভাট্টির ভেতরে হান্দায়া দেই। নইলে বেশি লড়াচড়া কলে ভাট্টি ভাইঙ্গা সবাই ভিতরে যামু গা। আর পা ঢুইক্ক্যা গেলে হেরে বাইরও করোন যায় না। আর করলেও বাঁচে না।” তারপর তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো কে কবে কিভাবে ভাট্টিতে ডুবে মরছে। কোন ভাট্টিতে কিভাবে মাথায় বাড়ি মেরে ভাট্টির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই গল্প শুরু করে দিল নিজেদের মাঝে। আমরা তখন দরদর করে ঘামছি। কণ্ঠ দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। চি চি কণ্ঠে বললাম, এখন কিনারে আসব কেমনে? শ্রমিক দুজন আমাদের দিকে তাকিয়ে চেহারা এমন করল যে, দেখে মনে হলো দুই জন নিশ্চিত মৃত মানুষকে দেখছে। রাজিব ততক্ষণে দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে দিয়েছে শব্দ করে। আমিও টের পাচ্ছি আমার হাঁটুর নিচে কাঁপতে শুরু করেছে। কিছু সময় শ্রমিক দুইজন, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল। বড় একটা বাঁশ নিয়ে। তারা ছোট ছোট ঢাকনাগুলো তুলে দেখে দেখে কোথায় কোথায় পা দিয়ে আসতে হবে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে বলে বলে আমাদের কিনারায় আনার চেষ্টা করতে লাগল। যাওয়ার সময় তো গল্প করতে করতে বড় বড় পা ফেলে ফেলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন কি করে যে সেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মাঝে ফিরে ছিলাম আজ মনে করলেও দেহের সমস্ত লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়।

এভাবে না জেনে আগুনের উপর দিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিব্যি হেঁটে চলা যায়। কিন্তু যখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয় পায়ের তলায় গনগনে আগুনের লেলিহান শিখা। একটু অসতর্ক পদক্ষেপে ঘটতে পারে চরম বিপদ। তখন জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। জীবনে চলার পথে জন্মজন্মান্তরের বাঁধা টপকে সাধকের ভেতর যখন নিজেকে জানার চেতনা জাগ্রত হয়। যখন যে জানতে পারে পরমকে প্রাপ্তি ভিন্ন এ জীবনযাত্রা অর্থহীন; নিজেকে না চিনতে পারলে, নিজেকে চেনার মাধ্যমে পরমকে না চিনতে পারলে ব্যর্থ এই মানবজনম। তখনো সাধকের এই পরিস্থিতিই হয়। তখন সাধকের কাছে এই জন্মজন্মান্তরের গমনাগমন আগুনের লেলিহান শিখায় পরিণত হয়। তখন সে হয় দিশেহারা-আতঙ্কিত। সাধুগুরুরা বলেন, এই সময়ই সাধকের প্রয়োজন পড়ে একজন সদগুরুর। সদগুরুই সাধককে নিজেকে জানার পথ সুগম করে। সাধক এগিয়ে যেতে পারে সাধনার পথে। অন্যথায় ফিরে আসতে হয় বা বিভ্রান্তিতে কাটাতে হয়। আবার যেতে হয় জন্মান্তরের চক্রে। গুরু এখানে পরম ভূমিকা রাখে সাধককে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে। তাই গুরুবাদী মতে সকল সময়ই গুরুর আসন রাখা হয়েছে সবার উপরে। এ প্রসঙ্গে সাঁইজি বলেছেন-

হক নাম বল রসনা ।
যে নাম স্বরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা।।
 
শিয়রে শমন বসে
কখন জানি বাঁধবে কসে,
ভুলে রইলি বিষয় বিষে
দিশে হল না।।
 
কয়বার যেন ঘুরে ফিরে
মানব জনম পেয়েছো রে,
এবার যেন অলস করে
সে নাম ভূল না।।
 
ভবের ভাই বন্ধুয়াদি
কেউ হবে না সঙ্গের সাথী,
ফকির লালন বলে গুরুরতি
কর সাধনা।।

যারা গুরুবাদী দর্শনকে সুনজরে দেখেন না তাদের কাছে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ঠেকে শিষ্যের গুরুকে সেবাআত্ত্বি-ভক্তির চিত্র। সমাজ এই প্রথাকে কখনো সহজভাবে মেনে নেয়নি হয়ত নেবেও না। তাতে অবশ্য প্রকৃত ভক্তের কিছু যায় আসে না। সে যখন গুরুর প্রেমে পড়ে তখন সে গুরুকেই মান্য মেনে সাধন পথে এগোয়। এই তো কয়েক বছর আগে সাঁইজির মাজারে সন্ধ্যা ভক্তির সময় সাথের ভদ্রলোক আমার হাত খামচে ধরে বলেছিলেন, “ভাই! এ আপনি কোথায় নিয়ে এলেন?” তার দিকে তাকিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। হতবাক হয়ে ভদ্রলোক প্রায় রক্তশূণ্য হয়ে গেছেন। কিছুতেই মানতে পারছেন না গুরুভক্তির বিষয়টা। আমি যতই তাকে কোমল স্বরে বুঝিয়ে বলতে চাই তিনি ততই চটে উঠেন। শুরু করে দিলেন তুমুল সমালোচনা। কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারি না। অল্প সময় পর আমি হাল ছেড়ে দিলাম। তিনি বলেই চললেন। এভাবে চলতে চলতে মেলার শেষ দিন যখন ভদ্রলোককে বললাম ভাই চলেন ঢাকায় ফিরে যাই, উনি অবাক হয়ে বললেন আজকেই ফিরে যাবেন? থাকি না ভাই কয়েকদিন, আমার তো ভালোই লাগতেছে।

ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটে। কোনকিছু বোঝার আগেই যারা উত্তেজিত হয়ে উঠে তাদের জন্য কোনকিছুর গভীরতায় পৌঁছানো দুষ্কর হয়ে যায়। যারা ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে কোনকিছু বোঝার চেষ্টা করে তারপর সমালোচনায় যায় তাদের ভেতরেই জ্ঞানের উদয় হয়। আর তাদের জন্যই গুরুবাদী দর্শন। যারা আমিত্ব ছেড়ে, নিজেকে ছেড়ে জগৎ-সংসার নিয়ে ভাবতে পারে তাদের জন্য এই দর্শন। যারা নিজের গণ্ডিটা নিজ সংসার থেকে বের করে জগৎ সংসারে লীন করতে পারে তার জন্যই এপথ। গুরু-শিষ্যের এই প্রেমকে অনুধাবন করতে গেলে বুঝতে হবে, গুরু মূলত শিষ্যের সর্বপ্রকার বিকার মুক্ত করার জন্য সেবা নিয়ে থাকেন। এই সেবা গুরুর জন্য অপরিহার্য নয় মোটেও। এই সেবা করতে হয় শিষ্যকে নিজের জন্যই; নিজের সাধনভজনের জন্যই এই প্রস্তুতিমূলক আচার করতে হয় প্রত্যেক সাধককে। বিজ্ঞানে যেমন যুক্তির পাল্টা যুক্তি; ধর্মে তেমন বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে বিশ্বাস হলেই হয় কিন্তু রহস্যে ঘেরা আধ্যাত্মবাদে এসবের বিশেষ মূল্য নেই। আধ্যাত্মবাদকে বুঝতে গেলে সাধককে সর্বদেহে-সর্বমনে-সর্বক্ষণের জন্য প্রস্তুত হতে হয়।

বেশিভাগ মানুষই আধ্যাত্মবাদের গভীরতায় না ডুবেই সমালোচনা শুরু করেন। কোন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তো থাকবেই। কোনটা শুদ্ধ আর কোনটা অশুদ্ধ তার বিচার-বিবেচনা সর্বকালে-সর্বস্থানে-সর্বব্যাপী যে একই তাও কিন্তু নয়। সহনশীলতাই জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে। সহনশীল হয়ে যারা বোঝার চেষ্টা করে-ভাববার চেষ্টা করে তারাই এই মতে ডুবতে পারে। আর যারা না বুঝেই সমালোচনার ঝড় তোলেন তাদের বোঝান প্রায় অসম্ভব। তাদের জন্য বব ডিলানের একটা কথাই বারবার মনে পড়ে, “Don’t criticize what you can’t understand.”

এই আষাঢ় মাসের জল-জোছনার পূর্ণিমা গুরুবাদীদের কাছে পরিচিত গুরুপূর্ণিমা নামে। গুরুর প্রতি ভক্তি প্রকাশের লক্ষ্যে গুরুপূর্ণিমায় বিভিন্ন মত-পথের সাধক নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী আচার পালন করে থাকে। বছরের অন্যান্য পূর্ণিমা থেকে আষাঢ়ে পূর্ণিমা অনেকটাই ভিন্ন। কারণ মেঘ-বৃষ্টির কারণে আকাশ স্বচ্ছ না থাকায় বেশিভাগ সময়ই এই পূর্ণিমার দর্শন পাওয়া সহজ হয় না। যেমন গুরুর দর্শন পাওয়া সহজ নয় তেমনই গুরুপূর্ণিমার দর্শন পাওয়াও সহজ নয়। ভক্ত যেমন মনের সকল অন্ধকার মেঘ দূর করতে পারলেই গুরুর সান্নিধ্য লাভ করে; তেমনি আকাশের সকল মেঘ সরে গেলেই আষাঢ়ে পূর্ণিমার গুরুরূপী আলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তেমনি জন্মজন্মান্তরের সাধনার পর সাধক যখন গুরুর দর্শন পায় তখন তার জন্ম সার্থক হয়। সাধক জন্মজন্মান্তর ধরে সেই নামেরই অনুসন্ধান করে বেড়ায়- “যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা”।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top