উপন্যাস-রচনা : মুন্সী প্রেমচন্দ, মূল হিন্দী থেকে তর্জমা: সফিকুন্নবী সামাদী

উপন্যাস-রচনা II মুন্সী প্রেমচন্দ II মূল হিন্দী থেকে তর্জমা: সফিকুন্নবী সামাদী

ভারতবাসী ইউরোপীয় সাহিত্যের আর কোনো আঙ্গিক এতোটা গ্রহণ করেনি যতোটা গ্রহণ করেছে উপন্যাসকে। এমন কি উপন্যাস এখন আমাদের সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। উপন্যাসের জন্ম চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। শেক্সপিয়র তাঁর কয়েকটি নাটক ইটালীয় উপন্যাসের ভিত্তিতে রচনা করেছেন। এই শৈলী এতটাই প্রিয় হয়েছে যে আজ সমস্ত দুনিয়াতে উপন্যাসেরই আধিপত্য। গত পঞ্চাশ বছরে ভারতের সাহিত্যিক শক্তির যতটা প্রয়োগ উপন্যাস রচনায় হয়েছে ততোটা বোধ করি অন্য কোনো সাহিত্যআঙ্গিকে হয়নি। বাংলা বঙ্কিম (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)সৃষ্টি করেছে, গুজরাটি করেছে গোবিন্দদাস, মারাঠি করেছে আপটে (হরিনারায়ণ আপটে) উর্দু করেছে রতননাথ( রতন নাথ ধর সারশার) এবং শরর(আব্দুল হালিম শরর)যাঁরা পৃথিবীর কোনো ঔপন্যাসিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। হিন্দী প্রথম সৃষ্টি করেছে অদ্ভুত রসের ঔপন্যাসিক। এখন ধীরে ধীরে এই ভাষায় চরিত্র-চিত্রণ, মনোবিশ্লেষণাত্মক এবং রহস্যেপন্যাসও হচ্ছে। আশা করা যায় এক্ষেত্রে হিন্দী কোনো প্রাদেশিক ভাষা থেকেই পিছিয়ে থাকবে না। বাস্তবে উপন্যাস-রচনাকে সরল সাহিত্য বলা হয়ে থাকে কারণ এর দ্বারা পাঠকের মনোরঞ্জন করা হয়। কিন্তু ঔপন্যাসিককে উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে ততোটাই বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করতে হয় যতোটা প্রয়োগ করতে হয় দার্শনিককে দর্শনশাস্ত্রের গ্রন্থ রচনায়। তাঁকে প্রথমে উপন্যাসের বিষয় খুঁজতে হয়। কী লিখবেন? ভৌতিক বিষয়ের অসারতা দেখাবেন নাকি মনস্তত্ত্বের পারস্পরিক বিরোধ? কোনো গুপ্ত রহস্য নির্বাচন করবেন নাকি ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্রণ করবেন? এদের মধ্যে থেকে নিজের প্রকৃতির অনুকূল কোনো বিষয় লেখক পছন্দ করে নেন। বিষয় নির্বাচন হয়ে যাবার পর প্লটের বিষয়ে তাঁকে চিন্তা করতে হয়। তিনি ঘুমান কিংবা জেগে থাকুন, চলুন কিংবা বসে থাকুন সকল সময় এই চিন্তাতেই ডুবে থাকেন। কখনো কখনো তো এই চিন্তায় তার মাস-বছর লেগে যায়। লেখক যতো বেশি এই চিন্তায় ব্যস্ত থাকবেন তাঁর রচনা ততোই উত্তম হবে।
উপন্যাসের বুনিয়াদ দাঁড়িয়ে গেল। এবারে আমাদের প্রয়োজন ভবন দাঁড় করানোর জন্য নানান মসলার। এর মুখ্য উপায় হল:
১. পর্যবেক্ষণ ২. অনুভব ৩. আত্ম-অধ্যয়ন ৪. অন্তর্দৃষ্টি ৫. জিজ্ঞাসা ৬. বিচার-বিবেচনা
বলা হয়ে থাকে যে বিনা টিকেটে ভ্রমণকারী যাত্রীদের মনের দশা কেমন হয় তা অনুভব করবার জন্য বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন বেশ কয়েকবার বিনা টিকেটে রেল-ট্রামে ভ্রমণ করেছেন। সেরকম আরও এক মহৎ সাহিত্যিক প্যারিসের অপরাধজগতের ছবি আঁকার জন্য মাসের পর মাস অপরাধী এবং গুণ্ডাদের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন। অন্যজন চোরের অনুভূতি অনুভব করবার জন্য সিঁধ পর্যন্ত কেটেছেন। এ কারণে একথা ভাবা ঠিক হবে না যে পাশ্চাত্যের লেখকেরা কল্পনাশুন্য। এরকম অবস্থা এবং মনোভাব বর্ণনা করবার জন্য নিজের কল্পনাশক্তিই ঔপন্যাসিকের সবচেয়ে বড় সহায়ক। এমন মানুষ কমই হবেন যিনি শৈশবে পয়সা অথবা মিষ্টি চুরি করেন নি, কিংবা লুকিয়ে মেলা বা কুস্তি দেখতে যাননি অথবা পাঠশালায় শিক্ষকের সঙ্গে চাতুর্য করেননি। যদি কল্পনাশক্তি প্রখর হয় তাহলে এটুকু অভিজ্ঞতাই চোরডাকাতের মনস্তত্ত্ব অঙ্কন করবার সফলতা এনে দিতে পারে। এ কথা বলবার প্রয়োজন নেই যে কৃত্রিম অবস্থায় যে অভিজ্ঞতা লাভ হয় তা স্বাভাবিক হতে পারে না। তবুও উপন্যাসের সফলতার জন্য অভিজ্ঞতা সর্বপ্রথম মন্ত্র। যথাসাধ্য নতুন নতুন দৃশ্য দেখা এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ ঔপন্যাসিকের হাতছাড়া করা উচিত নয়।
মানুষের মনোভাব ব্যক্ত করবার জন্য অন্য উপায় হল নিজের ভেতর অনুসন্ধান করা। স্যার ফিলিপ সিডনি বলেন, নিজের দৃষ্টি নিজের হৃদয়ের ভেতরে ফেলো আর যা কিছু দেখবে, লেখ। লেখক নিজেকে কল্পনার দ্বারা যতো ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে স্থাপন করতে পারবেন, ততোটাই সফল হবেন। তুলসীদাস পুত্রশোক কতোটা সফলতার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। সবাই জানেন যে তাঁর এই শোকের কোনো অভিজ্ঞতা ছিলোনা। নিজেকে শোকাতুর পিতার স্থানে স্থাপন করে তিনি নিশ্চয়ই সেই ভাব অনুভব করেছেন।
অধ্যায়ন থেকেই ঔপন্যাসিক বড় সহায়তা পেয়ে থাকেন। এক ঋষি বলেছেন, অধ্যায়ন মানুষকে সম্পূর্ণ করে তোলে। কেউ কেউ বলেন, ঔপন্যাসিকের পড়াশোনা করা উচিত নয়, এতে তার মৌলিকত্ব নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু স্বর্গীয় ডি এল রায় বলেছেন, যে লেখকের মৌলিকত্ব পুস্তক পাঠে নষ্ট হয়ে যায় তার ভেতর আসলে মৌলিকত্বই নেই। কোনো কুশলী লেখকের ভাব এবং বিবেচনা চুরি করা অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। বরং নিজের ভাব এবং বিবেচনাকে অন্য লেখকের সঙ্গে তুলনা করা এবং তা দেখে ভাল রচনার জন্য নিজেকে উৎসাহিত করা। যদি আমরা কোনো লেখকের রচনায় এমন স্থান দেখতে পাই যেখানে তাঁর কল্পনা শিথিল হয়ে গেছে তবে আমরা যেন চেষ্টা করি এরকম স্থানে আরো ভালো লিখতে। বিবিধ সাহিত্য খুঁটিয়ে না পড়ে লেখকের, বিশেষত উপন্যাস লেখকের উচিত নয় কলম ধরা। এমন নয় যে পড়াশোনা না করে কেউ ভালো উপন্যাস লিখতে পারেন না। যাঁকে ঈশ্বর প্রতিভা দিয়েছেন তাঁর জন্য খুব বেশি পড়া হয়তো অনিবার্য নয়। কিন্তু যেমন ব্যাকরণ না পড়ে আমরা শুদ্ধ লিখলেও অশুদ্ধি থেকে বাঁচার জন্য ব্যাকরণ পড়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, তেমনি তুলনা এবং অধ্যায়ন থেকে আমরা আমাদের ত্রুটি গুলো বুঝতে পারি। আমাদের বুদ্ধি বিকশিত হয় এবং আমরা সেই উপায় পেয়ে যেতে পারি যে উপায় দ্বারা বড় লেখকরা সফলতাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
কারো কারো ভুল ধারণা আছে যে, নিজের রচনার বিষয় অন্যের মত নেয়া অপমানকর বিষয়। কিন্তু বাস্তবে লেখকের ভেতর ততোটাই জিজ্ঞাসা থাকা উচিত যতোটা থাকা দরকার শিক্ষার্থীর ভেতর। ফ্রান্সিস বেকনের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে তিনি সকল সময় এমন মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করতে থাকতেন যিনি কোনো বিষয়ে তাঁর চেয়ে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। কোনো মানুষ যতই প্রতিভাধর হোন না কেন সকল বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারেন না। তাঁকে যদি কারো কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয় তাহলে সংকোচ কেন করবেন? ডি এল রায় মহোদয় যখন কোনো নাটক লিখতেন, তিনি রসিক বন্ধুদের সেগুলো শোনাতেন, বন্ধুদের সমালোচনার জবাব দিতেন, যেখানে জবাব দিতে ব্যর্থ হতেন সেখানে নিজের রচনা কাটছাঁট করতেন। কখনো কখনো তাকে অধ্যায়ের পর অধ্যায় এবং দৃশ্যের পর দৃশ্য বদলাতে হত। লেখকের উচিত সকল সময় নিজের আদর্শ উঁচু রাখা। তার মনে এই মনোভাব থাকা উচিত, হয় কিছু লিখবোই না, অথবা লিখলে ভালো কিছু লিখবো, যে বিষয়ে শীঘ্রই অন্য কেউ এর চেয়ে ভালো কিছু লিখতে না পারে।
কখনো কখনো এমন হয় যে পথ চলতে চলতে কোনো নতুন কথা মনে চলে আসে, অথবা কোনো নতুন দৃশ্য চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। লেখকের মধ্যে এমন গুণ থাকা জরুরী যাতে তিনি এইসব কথা অথবা দৃশ্যকে মনের ভেতর গেঁথে নিতে পারেন এবং আবশ্যক হলে এদেরকে ব্যবহার করতে পারেন। কোনো কোনো লেখকের অভ্যাস নিজের সাথে নোটবুক রাখার এবং প্রয়োজনে এসব কথা বা দৃশ্য টুকে নেবার। যে লেখকেরর নিজের স্মরণশক্তির ওপর আস্থা কম তাঁর অবশ্যই নিজের সঙ্গে নোটবুক রাখা উচিত। ডায়েরি লেখাও নিজের বিবেচনাকে লিপিবদ্ধ করবার আরেক উপায়।
প্লট সেইসব ঘটনাকে বলে যেসব ঘটনা চরিত্রদের জীবনে ঘটে। কিন্তু কেবল ঘটনার বর্ণনা দ্বারা কাহিনীতে মনোরঞ্জন গুণ নিয়ে আসা যায় না। কল্পনার দ্বারা সেই সব ঘটনাকে এমন সজীব করে তুলতে হয় যেন এদের মধ্যে বাস্তবতা ঝলমল করে ওঠে। এক ঔপন্যাসিক লিখেছিলেন যে ইউক্লেডিসের(গ্রিক জ্যামিতিবিদ) মতো আমাদের উচিত নিজের কথাকে সামনে রেখে দেয়া এবং তারপর সে বিষয়ে মীমাংসা করা। ইউক্লেডিসের বিচার-শৃংখলায় এমন কোনো যুক্তি প্রবেশ করতে পারে না, সেখানে যার কোন অনিবার্য স্থান নেই। আমরাও তাকে অনুসরণ করে উচ্চমানের উপন্যাস রচনা করতে পারি। সাধারণভাবে প্লট সেই কাহিনী, যা উপন্যাস পাঠের পর পাঠকের হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে যায়। পুরানো ঢঙের গল্পে কেবল প্লটই থাকতো। তাতে রঙ-পালিশের কোনো মাত্রা থাকতো না, ফলে তা চাকচিক্যপূর্ণ হতো না। আজকাল পাঁচ-ছ’ শ’ পৃষ্ঠার উপন্যাসের কথা দশ-পাঁচ পংক্তিতে সমাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই দশ-পাঁচ পংক্তির কথা চিন্তা করতে যতটা মনন এবং চিন্তন খরচ করতে হয়, সমস্ত উপন্যাস লিখতেও তা করতে হয় না। বাস্তবে প্লট চিন্তা করে নেবার পর লেখা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু প্লট চিন্তা করবার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রও কল্পনা করে নিতে হয় যাদের দ্বারা প্লট প্রদর্শিত হয়। চার্লস ডিকেন্স সম্পর্কে বলা হয় যে যখন তিনি কোনো নতুন উপন্যাসের কল্পনা করতেন, তখন কয়েক মাস নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে চিন্তামগ্ন থাকতেন, না কারো সঙ্গে দেখা করতেন না কোথাও বেড়াতে যেতেন। দু’তিন মাস পর যখন তার ঘরে দরজা খুলে যেত, তখন তার দশা কোনো রোগীর চেয়ে ভালো মনে হতো না, মুখ পাণ্ডুর, চক্ষু কোটরে বসে যাওয়া, শরীর দুর্বল। থ্যাকারের বিষয়ে বলা হয়, তিনি সন্ধ্যাবেলা কোনো নদীর তীরে বসে প্লট চিন্তা করতেন। কিন্তু প্লট দ্রুত কিংবা বিলম্বে চিন্তা করা লেখকের বুদ্ধি-সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। জর্জ স্যান্ড ফ্রান্সের সুবিখ্যাত ঔপন্যাসিক। তিনি একশ’র কম উপন্যাস লেখেননি। কিন্তু প্লট চিন্তা করতে তাঁকে বুদ্ধি খাটাতে হতো না। তিনি কলম হাতে নিয়ে বসে যেতেন আর লেখার সাথে সাথেই প্লট গড়ে উঠতো। স্যার ওয়াল্টার স্কট সম্পর্কেও এ কথা প্রচলিত আছে যে প্লট চিন্তা করতে তাকে মাথা খাটাতে হতো না। কিছু কাহিনী এমনও হয়ে থাকে যেখানে কোনো প্রকার প্লটই থাকে না। মার্ক টোয়েনের Innocents Abroad এই ধরনের উপন্যাস।
প্লটের কল্পনা ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সাধারণত এর ছটি ভাগের কথা স্বীকার করা হয়।
১.কোনো অদ্ভুত ঘটনা
২. কোনো গুপ্ত রহস্য
৩.মনোভাব চিত্রণ
৪. চরিত্র বিশ্লেষণ ও তুলনা
৫.জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা
৬.কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক সংশোধন

১. অদ্ভুত ঘটনা: কাহিনী সেটাই অদ্ভুত হয় যা নিয়মের বিরুদ্ধে যায়। প্রাচীন কাহিনী প্রায়শই এধরনের হতো। এ ধরনের কাহিনীর উদ্দেশ্য কেবল পাঠকের মনোরঞ্জন। এগুলো পড়লে কল্পনাশক্তি বিকশিত হয় বলে অনেক বালকোপযোগী গল্পে এধরনের কৌশল উপযুক্ত মনে করা হয়। প্রৌঢ় অবস্থায় এসব কাহিনীতে মন ভরে না। অনেক নৈতিক এবং আচরণসম্বন্ধীয় উপদেশ এসব কাহিনী দ্বারা দেয়া হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লেখক (জোনাথন) সুইফট ‘গালিভার’স ট্রাভলস’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে সমাজকে ব্যঙ্গ করেছেন। ‘এলিগরি’তে অদ্ভুত ঘটনার দ্বারা জীবনের গূঢ় তত্ত্ব প্রকাশ করা হয়। ইংল্যান্ডের জন বনিয়নের ‘পিলগ্রিম্স প্রোগ্রেস’ এলিগরি হিসেবে অদ্বিতীয়। আমাদের দেশে প্রাচীন ঋষিগণ প্রায়শই দৃষ্টান্তের দ্বারা জনসাধারণকে উপদেশ দিতেন। মহাভারত, পুরাণ, উপনিষদে এ ধরনের দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। বর্তমানকালে টলস্টয় এবং হথর্ন এ বিষয়ে শিক্ষণীয় অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং অতিপ্রাকৃত ঘটনাপ্রধান উপন্যাসরচনা একদিকে যদি খুব সরল হয় তবে অন্য দিকে বেশ কঠিনও।
২. গুপ্ত রহস্য: রহস্যোপন্যাস সব এই ধরনের। এই ধরনের উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে লেখককে দুধরনের বড় শঙ্কার মুখোমুখি হতে হয়। হতে পারে যে রহস্য প্রথম দিকেই উদঘাটিত হয়ে যায় অথবা রহস্যোদঘাটন পাঠকের জন্য সন্তোষজনক না হয়। ভারতবর্ষে আগে এ ধরনের কাহিনীর প্রচলন ছিলো না। ইউরোপে এ ধরনের কাহিনী মানুষ আনন্দের সঙ্গে পাঠ করে। কিছুদিন হলো পৈশাচিক ঘটনাবলীও রহস্যের দ্বারা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। ইংল্যান্ডে ক্যানন ডায়েল এই শ্রেণীর ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সিদ্ধহস্ত, ফ্রান্সে মার্স লেম্বাঙ্ক এবং আমেরিকায় পো। ক্যানন ডায়েল এখনো জীবিত রয়েছেন এবং অপরাধমূলক বিষয়ের দিকে তাঁর প্রবৃত্তি এখন বেশি। রহস্যোপন্যাসের লেখক কোনো ঘটনা ভেবে এক কল্পিত গোয়েন্দাকে তার সমাধান করতে লাগিয়ে দেন। এ ধরনের ঘটনাবলীতে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হলো, ওই ঘটনা বা রহস্যের সমাধান বাহ্যত অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু লেখক যখন একে খোলাসা করেন তখন পাঠক আশ্চর্য হয়ে যায় এই ভেবে যে আমার মনে এ কথা আসেনি কেন, এ তো অতি সাধারণ ব্যাপার। সেই সাথে পাঠক এই রহস্যকে অন্য কোনো পদ্ধতিতে সমাধান করতে অসমর্থ হয়। লেখকেরর কৌশল এখানে, যে চরিত্রকে পাঠক স্বয়ং দোষী মনে করে শেষ অবধি সেই চরিত্র নির্দোষ সাব্যস্ত হয়। এ ধরনের উপন্যাস আনন্দদায়ক হয়ে থাকে এবং এদের পাঠ করলে বুদ্ধি খুলে যায়, কঠিন সমস্যায় মগজ খাটানোর ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু এ ধরনের উপন্যাস রচনা এতোটাই কঠিন যে হিন্দিতে আজ অবধি ক্যানন ডায়েল কিংবা অন্য কোনো লেখকের অনুবাদ ছাড়া কেউ স্বতন্ত্র কল্পনা করেননি।
৩. মনোভাব-চিত্রণ: এ ধরনের উপন্যাসে লেখকের খেয়াল ঘটনা-বৈচিত্র্যের দিকে খুব কম থাকে। তিনি এমন ঘটনাবলীর আয়োজন করেন যেখানে তার চরিত্রদের নিজের মনোভাব প্রকাশ করবার সুযোগ থাকে। ঘটনা কম হয়, চরিত্রের চিন্তাভাবনা বেশি। টলস্টয়েরর উপন্যাসে এই গুণ প্রধান। এ ধরনের উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে আবশ্যক হয় নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় প্রকাশ করবার মতো লেখকের শক্তি। এই প্রকারের কাহিনীতে প্রয়োজন হয় পাঠকের সামনে লেখকের হৃদয়কে অনিবার্যভাবে অধিকতর প্রকাশিত করা। অন্যের মনোভাব জানবার জন্য তার কাছে আর কী উপায় বড় হতে পারে? কেউ তার মনোভাব কারো কাছে প্রকাশ করে না, বরং তা আরো লুকিয়ে রাখে। যদি কেউ তার বন্ধুর মনোভাব জানতেও পারে সেটা খুবই কম। তাই এ ধরনের উপন্যাস রচনা লোহায় তৈরি ছোলা চিবানোর মত। ঔপন্যাসিককে সকল সময় নিজের হৃদয়ের দিকেই লক্ষ্য রাখতে হয়। জর্জ এলিয়টের অধিকতর উপন্যাস এই শ্রেণীর।
৪. চরিত্র-বিশ্লেষণ এবং ৫. জীবনের অভিজ্ঞতার প্রকাশ—এই দুই ধরনের উপন্যাস লেখার জন্য জরুরী লেখকের মধ্যে উচ্চ কল্পনাশক্তি এবং অবলোকন ও পর্যবেক্ষণের উচ্চ ক্ষমতা। এজন্যই বলা হয় যে সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ঔপন্যাসিকের জন্য আবশ্যক। তাঁর কান এবং চোখ সকল সময় খোলা রাখা উচিত। একই পরিস্থিতিতে দুজন ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনার মানুষ কী করেন, একই ঘটনা তাদের দুজনের মধ্যে কী রকম প্রভাব বিস্তার করে, তা নিরূপণ করা সহজ কাজ নয়। অভিজ্ঞতা যেমন বাহ্য জগৎ সম্পর্কিত তেমনি অন্তর্জগত সম্পর্কিত হয়। লেখকের উচিত প্রাকৃতিক জগৎ এবং বিচিত্র ঘটনাকে মনোযোগ সহকারে অবলোকন করা। সকালবেলা বাতাসের ঝোঁকে নদীর ঢেউয়ে কেমন দৃশ্য তৈরি হয়, আকাশ কোন কোন রূপ ধারণ করে—এমন অগণন দৃশ্য তিনি সফলতার সঙ্গে চিত্রায়িত করতে পারেন যিনি এসকল দৃশ্য মনোযোগ সহকারে দেখেছেন। কেবল কল্পনায় এখানে কাজ হবে না। উচিত হলো লেখক সে সকল দৃশ্য দেখাবেন, সে সকল চরিত্রের তুলনা করবেন যেগুলো তিনি নিজে অনুভব করেছেন। যিনি সমুদ্রই দেখেননি তিনি কোনো বন্দরের দৃশ্য কী করে আঁকবেন? যিনি গ্রামীণ জীবনের সংসর্গে যাননি তিনি কী করে গ্রামীণ জীবনের ছবি আঁকবেন? এই সফলতা পাওয়ার জন্য ইউরোপের অনেক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বেশ বদল করে সেই সব পরিস্থিতি অধ্যয়ন করেছেন যে পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে তিনি তার উপন্যাস লিখতে চান।
৬. কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক সংশোধন: কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে লেখা উপন্যাসের সংখ্যা আজকাল সকল ভাষাতেই অধিক। উর্দুতেও এমন অনেক উপন্যাস রয়েছে, প্রধান প্রধান ভাষার ক্ষেত্রে আর বলার কী আছে? আজকাল ‘সংশোধন-সংশোধন’ জাতীয় গর্জনে আকাশ বাতাস নিনাদিত। কোথাও পুলিশের সংশোধনের আলোচনা, কোথাও সামাজিক প্রথার, কোথাওবা শিক্ষা-পদ্ধতির।উপন্যাস কোনো উদ্দেশ্যে লেখা উচিত কি উচিত নয় সেটা বিতর্কিত বিষয়। প্রবীণ সমালোচকদের রায়, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কেবল ভাব-চিত্রণ। কোনো উদ্দেশ্যে লেখা কাহিনীতে অনেক সময় বাধ্য হয়ে লেখককে অসঙ্গত কথা বলতে হয়, অনাবশ্যক ঘটনার আয়োজন করতে হয় এবং সবচেয়ে বড় শক্ত ব্যাপার এই যে তাকে উপদেষ্টার স্থান গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু রসিকসমাজ কারো নিকট থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় না, উপদেশে তার অরুচি এবং উপদেষ্টার প্রতি ঘৃণা। রসিক কেবল মনোরঞ্জন এবং মনোদর্শন আশা করেন। কিন্তু সেইসাথে একথাও মানতে হবে যে গত শতকে( উনিশ শতক) পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সমাজের যত সংশোধন হয়েছে তার বেশিরভাগেরই বীজ বপিত হয়েছিল ঔপন্যাসিকদের হাতে। ডিকেন্সের প্রায় সকল উপন্যাস, টলস্টয়ের কয়েকটি উত্তম উপন্যাস, ম্যাক্সিম গোর্কি, তুর্গেনিভ, বালজাক, হুগো, মেরী করেলী, জোলা প্রমুখ ঔপন্যাসিক প্রায় সকলেই সংশোধনীর জন্যেই তাঁদের গ্রন্থ রচনা করেছেন। হ্যাঁ, কুশলী লেখকের একথা খেয়াল থাকা উচিত সংশোধনের জোশ যেন লেখার উপভোগ্যতাকে নষ্ট করে না দেয়। তিনি তাঁর উপন্যাস এবং চরিত্রগুলোকে এমন পরিস্থিতিতে স্থাপন করেন যে পরিস্থিতির সংশোধন করতে চান। এও অত্যাবশ্যক যে তিনি সংশোধনের বিষয়টি খুব ভালোভাবে ভেবে নেবেন এবং অত্যুক্তি থেকে বিরত থাকবেন। নইলে তাঁর প্রয়াস কখনোই সফল হবে না। লেখক প্রায়শই তার কালের বিধাতা হয়ে থাকেন। তাঁর মধ্যে নিজের দেশকে, নিজের সমাজকে দুঃখ, অন্যায় এবং মিথ্যাচার থেকে বাঁচানোর আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে। এমতাবস্থায় এটা কিছুতেই সম্ভব নয় যে তিনি সমাজকে নিজের মনমতো চলতে দেবেন এবং হাতের উপর হাত রেখে সে দৃশ্য দেখবেন। তিনি যদি আর কিছু করতে নাও পারেন, কলম তো চালাতে পারেন। শেক্সপিয়র এবং কালিদাসের সময়ে সংশোধনের প্রয়োজন আজকের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো না, কিন্তু সেই সময় রাজনৈতিক জ্ঞানের এতোটা প্রসার ছিলো না। অভিজাতরা ভোগবিলাস করতেন, কবি এবং লেখকেরা তাদের বিলাসবৃত্তিকে আরো উত্তেজিত করতেন। প্রজার জীবন কীভাবে কাটে সে বিষয়ে কারো কোনো খেয়াল ছিলো না। এখনকার সময় জীবনসংগ্রামের। আজ যাঁদের শিক্ষিত বলা হয়ে থাকে, তারা তটস্থ হয়ে অন্যায় দেখতে পারেন না।
প্লটের গুরুত্ব জানার পর এখন আমরা জানতে চাইবো প্লটে কোন কোন বিষয় থাকা উচিত। সমালোচকগণের মতানুসারে সেগুলো হলো— সরলতা, মৌলিকতা, উপভোগ্যতা।
প্লট সরল হওয়া জরুরী। খুব জটিল, প্যাঁচানো, দীর্ঘ কাহিনী যা পড়তে পড়তে মন অধৈর্য হয়ে যায় পাঠক তাকে মাঝপথে ছেড়ে দেয়। এক প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ হতে না হতেই অন্য প্রসঙ্গ চলে আসে, সেটাও অপূর্ণ থাকতে তৃতীয় প্রসঙ্গ আসে, এতে পাঠকের মন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পেঁচানো প্লটের কল্পনা এত কঠিন কিছু নয় যতটা কঠিন সরল প্লটের কল্পনা। সরল প্লটে অনেক চরিত্রের কল্পনা করতে হয় না, এইজন্য লেখক অল্প সংখ্যক চরিত্রের ভাব-বিবেচনা, দোষগুণ, আচার-ব্যবহার সূক্ষ্মরূপে দেখানোর সুযোগ পান। তাতে এসকল চরিত্রে সজীবতা আসে এবং তারা পাঠকের হৃদয়ে নিজের ভালো অথবা মন্দ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এরকম কাজ অনেক বেশি চরিত্রের ভেতর করা সম্ভব নয়। প্লটে মৌলিকত্ব থাকা অত্যাবশ্যক। যে কথা বা বিষয়ে অন্য লেখক লিখে ফেলেছেন তাকে খানিকটা হেরফের করে নিজের প্লট বানাতে চেষ্টা করা অনুচিত। প্রেম, বিরহ ইত্যাদি বিষয়ে এতবার লেখা হয়েছে যে এতে নতুনত্ব কিছু আর বাকি নেই। এখন তো পাঠক কাহিনীর মধ্যে নতুন ভাব, নতুন বিবেচনা এবং নতুন চরিত্রের নিদর্শন প্রত্যাশা করেন। অন্তত ‘শুকবহত্তরী’ (নীতিকথা জাতীয় রচনা)তে পাঠক আর সন্তুষ্ট থাকেন না। প্লটে কিছু না কিছু সজীবতা, অনন্যতা থাকা জরুরী। বাকী রইল উপভোগ্যতা, সেতো মৌলিকতার সহগামী। মৌলিক প্লট হলে তা অবশ্যই উপভোগ্য হবে। কিন্তু কাহিনীর উপভোগ্যতা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়।প্লটের সৌন্দর্য, চরিত্র-চিত্রণ, ঘটনাবৈচিত্র্য সবকিছু মিলিত হলে উপভোগ্যতা আপনাআপনি এসে যায়। হ্যাঁ, ঔপন্যাসিক এ কথা কখনো ভুলতে পারেন না যে তাঁর প্রধান কর্তব্য হলো পাঠকের বেদনা প্রশমিত করা, পাঠকের মনোরঞ্জন করা। বাাকী সব বিষয় এর অধীনস্ত। যদি পাঠকের মনই কাহিনীতেে না বসে তবে সে লেখকের মনোভাব জানবে কী করে? তাঁর অভিজ্ঞতায় কীই বা লাভ হবে পাঠকের। সে ঝট করে বই বন্ধ করে দেবে এবং চিরতরে উপন্যাসের নিন্দাকারী হয়ে উঠবে। আজও অনেক মানুষ আছে যারা উপন্যাসের ওপর বিরক্ত। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে উপন্যাস কখনোই পড়বেনা। কারণ এই যে বর্তমান হিন্দী উপন্যাস তাদের নিরাশ করে দিয়েছে। নতুন উপন্যাস রচয়িতাদের কর্তব্য হলো উপন্যাসসাহিত্যের মুখ উজ্জ্বল করা, এই দুর্ণাম মিটিয়ে দেয়া।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top