আল্পসের কোলে আদিম এক জগতে।। তন্ময় ধর

আল্পসের এই উত্তর ইতালি ঘেঁষা পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্যের মধ্যে পড়ে না। এখানে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্বতারোহীদেরই শুধু আনাগোনা। জার্মানি থেকে আসা এরিকা আর হেলমুটের অ্যাডভেঞ্চারটা একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতির টাইম মেশিনে চড়ে তাঁরা যেন চলে গিয়েছিলেন ৫৩০০ বছরের এক আদিম প্রাগিতিহাসে। মৃতদেহটা দেখে চমকে উঠেছিলেন এরিকা-হেলমুট। বরফ ঢাকা আল্পসের ওটজ উপত্যকায় বেড়াতে এসে স্কেটিং করতে করতে তাঁরা যে অমন একটি বস্তুর সন্ধান পাবেন, সেটা ভাবতেও পারেন নি। মৃতদেহের বাদামী রঙ দেখে তাঁরা ধারণা করেছিলেন, সেটা পুরনো। কিন্তু সেটা যে ৫৩০০ বছরের পুরনো, তা তাঁরা বোঝেননি। ইউরোপের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের সেরা এই আবিষ্কারকে বিজ্ঞানীরা পরে বলেছেন ‘যেন আফ্রিকা থেকে প্রত্ন-অবশেষের একমুঠো বালি এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল আল্পসের মেঘ-বরফের রাজ্যে’। চমকে উঠেছিল বাকি পৃথিবীও। আল্পসের হিমবাহের শীতলতায় অমন পূর্ণাঙ্গ মৃতদেহ যে ৫৩০০ বছর ধরে সংরক্ষিত থেকে যাবে, তা কেউ কল্পনাই করেনি। আর শুধু কি মৃতদেহ? ঘাসে-চামড়ায় তৈরি পোশাক, তীর, ধনুক, কুঠার, এমনকি পাকস্থলীতে খাদ্যকণিকার অবশেষ –প্রত্নবিজ্ঞানীদের কাছে এসব ছিল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। ৫৩০০ বছরের পুরনো সেই মানুষের নাম রাখা হল ‘ওটজি’। আর আল্পসের ওটজ উপত্যকা লাগোয়া বোলজানো শহরে ‘ওটজি’র জন্য বানানো হল এক চারতলা মিউজিয়াম। সে মিউজিয়ামের পরতে পরতে রহস্যময় ইতিহাসের আলো-আঁধারি। হালকা সেই আলো-ছায়া মাখা পথে এক মহাসময়ের আবেশের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে কখন আপনি ‘ওটজি’র ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতেই পারবেন না। অন্ধকার, শীতল একটা ঘর। আল্পসের ওই হিমবাহের বরফে ঠিক যে তাপমাত্রায় যে আর্দ্রতায় ‘ওটজি’ ৫৩০০ বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল, তেমন পরিবেশেই রাখা হয়েছে তাকে। ঠিক সেই ভঙ্গিমাতেই শুইয়ে আছে ‘ওটজি’। যেন মহাকাল নিদ্রিত রয়েছে দর্শকের সামনে।

অন্ধকার শীতলতায় কেদারনাথ বা পাতাল-ভুবনেশ্বরের গর্ভগৃহের মতোই পরিবেশ। এখানে সেলফি বা ফটো তোলা চলবে না। ওটজির ঘর থেকে পায়ে পায়ে চলে আসুন অন্য ঘরে। এই সাউথ টাইরোল মিউজিয়াম অফ আর্কিওলজির দেওয়ালে দেওয়ালে মুগ্ধতা। রয়েছে ইন্টার‍্যাক্টিভ ভিডিও। কেন এবং কিভাবে মৃত্যু হয়েছিল ওটজির? তার বাবা-মা কোথা থেকে এসেছিলেন ওখানে? ওটজির সঙ্গী-সাথীরা কেমন ছিল? তার অস্ত্রশস্ত্র কোন খনির তামা থেকে তৈরি হয়েছিল? কিভাবে তৈরি হয়েছিল তার পোশাক ও জুতো? –ইত্যাদি অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর রয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে। সবকিছুর ভেতর মায়াময় উপস্থাপনা এবং উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ দেখে থমকে থাকতে হয়। দক্ষিণ টাইরোল প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ৯ ইউরো, ছ’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের প্রবেশমূল্য লাগে না। এক ‘ওটজি’ তুষারমানবই যদিও একাই একশো এই জাদুঘরে, তবুও বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়। যেমন, ২০০৬ সালে পেরুর চাকাপয় মমি নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রস্তরযুগীয় তীর-ধনুক নিয়ে, ২০০৯ সালে ম্যমি নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে।ছোট এই বোলজানো শহরে সবশুদ্ধ ২৭ খানা জাদুঘর রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর থেকে একটু দূরেই দক্ষিণ টাইরোল প্রকৃতিবিজ্ঞান সংগ্রহশালা। প্রবেশমূল্য ৫ ইউরো (৬ বছর বয়সের কমবয়সী শিশুদের অবাধ প্রবেশ)। আল্পস ঢাকা উত্তর ইতালীর আঞ্চলিক ভূতত্ত্ব ছাড়াও বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিজ্ঞান প্রদর্শনী এই জাদুকরে। কাছাকাছির মধ্যে মেসনার পার্বত্য জাদুঘরও অবশ্যই দর্শন করে উচিত পর্বতপ্রেমীদের। প্রাচীন এক দুর্গে গড়ে তোলা এই জাদুঘরের ভিতরে ঢুকলে ত্রিমাত্রিক পার্বত্য দৃশ্যকাব্যের উপস্থাপনায় চমকে যেতে হয়।যতই নয়নাভিরাম হোক, একইরকম জাদুঘর দেখতে দেখতে আপনার চোখ ক্লান্ত হয়ে গেলে স্বাদবদল করতে দেখে নিতে পারেন সুদৃশ্য গীর্জাগুলি। বোলজানো ক্যাথিড্রাল গথিক-রোমান স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে গীর্জার গায়ের ফ্রেস্কোগুলি তৈরি হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ডোমিনিকান চার্চ এবং সেন্ট অগাস্টিন চার্চ। প্রতিটিই মুগ্ধ করবে দর্শককে।গীর্জা দেখে সম্পৃক্ত হয়ে গেলে দেখে নিতে পারেন বোলজানোর প্রাসাদ এবং দুর্গগুলি। রুঙ্কেনস্টাইন দুর্গ ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ। কাছেই সুন্দর বনভূমি দ্বারা বেষ্টিত উপত্যকায় অবস্থিত মারেশ দুর্গ। শুধু মঙ্গলবারের পরিদর্শনের জন্য খোলা থাকে এটি। এছাড়া রয়েছে মার্কেন্টাইল প্রাসাদ যা ভেরোনা থেকে সুবিখ্যাত স্থপতি ফ্রান্সেস্কো পেদ্রোত্তিকে এনে বানানো হয়েছিল।শুধু গীর্জা-প্রাসাদ-জাদুঘর নয়, শহরের সাধারণ বাড়িঘরগুলোর দিকে দেখুন। সদর দরজা, জানালা, বাগান- সর্বত্র শিল্পের গভীর ছোঁয়া। দরজার পাশে লাগানো ডাকবাক্সটির দিকে চেয়ে দেখুন। শৈল্পিক ইতিহাসের কত আভিজাত্যের স্পর্শ।

একটা জাতির শিল্পচেতনা এবং ভালোবাসা কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছলে পরিবেশের প্রতিটি পরতে এমন নন্দনতত্ত্বের বিকাশ হয়। এবং কী গভীর মমত্বে সেই শিল্প-ঐতিহ্যের প্রতিটি অংশকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আর শহরের পরিচ্ছন্নতা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এত প্রাচীন শহর, কিন্তু কোথাও এতটুকু ময়লা আবর্জনা নেই।যাক সে কথা। জাদুঘর-প্রাসাদ-গীর্জার ঐতিহাসিক স্বাদের বাইরে বেরিয়ে এবার চলুন যাওয়া যাক রেস্তোরাঁয়। ভূমধ্যসাগরীয় স্বাদ এখানে এসে মিলেছে মধ্য ইউরোপের পাহাড়ী স্বাদের সাথে, জার্মান-ইতালি-ফরাসী-সার্বীয় নানা রন্ধনশৈলীর ভেতরে কোথাও যেন দূর এশিয়ার মশলার গন্ধ এসে মিশে গিয়েছে। রেস্তোরাঁর রাঁধুনীর দিকে অবাক চোখে তাকাতেই তিনি বলে উঠবেন ‘ইস্তানবুল, ইস্তানবুল’। পিৎজা খেয়ে দেখতে পারেন। দক্ষিণ ইতালীর রোম-নেপলসের পিৎজার সাথে স্বাদে বেশ পার্থক্য খুঁজে পাবেন। বোলজানো ঘুরে চলে যাবেন, আর এখানকার সুবিখ্যাত ফলের বাজারটি দেখবেন না, তা হয় নাকি? শহরের পিয়াৎজা দেল এর্বে চৌমাথায় রবিবার বাদে রোজ বসে এই ফলের বাজার। সাপের মতো আঁকাবাঁকা গলিপথগুলি এসে মিলেছে এই ছোট্ট চৌমাথায়। মানুষ আর দোকানের ভিড়ে চৌমাথার স্পষ্ট চেহারা বোঝা মুশকিল। ত্রয়োদশ শতকে শহরের অভিজাত মানুষেরা পত্তন করেছিলেন এই বাজারের। আঙুর-অ্যাপ্রিকট-আপেলের স্বাদ নিতে নিতে চলুন একটু অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়া যাক।শহরের সিটি সেন্টার থেকে চেপে পড়ুন কেবল কারে। আপেল বাগিচা আর গোলাপী ডলোমাইট পাহাড়ে মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি খেলার ভেতর দিয়ে ১২ মিনিটের স্বর্গীয় যাত্রাপথ। আর যদি হালকা তুষারপাত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। শীতকালে গেলে বোলজানো শহরের আশেপাশে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে অনবদ্য কয়েকটি স্কি-রিসর্ট পাওয়া যাবে। মাউন্টেন ট্রেকিং করতে চাইলে পোয়া-বারো। প্রচুর সংস্থা আপনাকে সাহায্য করার জন্য তৈরি। তবে উপযাচক হয়ে তারা কেউ সাহায্য করতে আসবে না। বোলজানো ট্যুরিজম অফিসে একবার যোগাযোগ করে নিতে হবে। বোলজানো শহর এবং তার আশেপাশে ভ্রমণের স্মৃতি আপনার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকার মতোই। শুধু কয়েকটি ব্যাপার একটু খেয়াল রাখলে, পায়েসে কাজুবাদাম-পেস্তা যোগ করার মতো বা পিৎজায় অতিরিক্ত চীজ যোগ করার মতো ভ্রমণের স্বাদ বাড়তে পারে আরো। জার্মান বা ইতালিয়ানের প্রচলিত এবং প্রয়োজনীয় কিছু শব্দ বা বাক্য আগে শিখে নিতে হবে। কাউকে পথনির্দেশ জিজ্ঞাসা করার সময় সেগুলিই ব্যবহার করতে হবে। উত্তরদাতা তুখোড় ইতালিয়ান বা জার্মানে উত্তর দেবেন। সেটা শুনে বুঝতে হবে। টাকা-পয়সা এবং পাসপোর্ট একটু সাবধানে রাখতে হবে। পথে-ঘাটে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। শীতকালে গেলে ট্রেনে যাওয়াই উচিত। ট্রেন-বাস-কার যাতেই যান, পথের ধারের প্রাকৃতিক শোভা প্রাণভরে উপভোগ করুন। রেলপথে বা বাস রাস্তার ধারে এমন বিস্তীর্ণ আপেল-অ্যাপ্রিকটের বাগিচা পৃথিবীতে খুব বেশী দেখা যায় না।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top