শেষ মুঘল বাদশাহ ও সুফি কবি বাহাদুর শাহ জাফরের দরগাহের উদ্দেশ্যে সেদিন গেস্ট হাউস থেকে বের হই। এখানকার সাধারণ মানুষ খুব একটা জানে না যে, এই মাটিতেই ঘুমিয়ে আছেন সুফি বাদশাহ। আমার ড্রাইভারও দরগাহ চেনেন না। অনেকভাবে বুঝিয়েও লাভ হলোনা। শেষতক বুদ্ধি করে তাকে আমি হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোন থেকে ম্যাপ খুলে দেখাই। এতে দারুণ কাজ হলো! তো, মিনিট কুড়ি ড্রাইভের পর আমরা দরগাহের মূল ফটকের সামনে এসে থামি। ঝকঝকে ছোট্ট একটি সড়ক। ইয়াঙ্গুন শহরের ঠিক মাঝখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান তীর্থকেন্দ্র শ্যাডাগন প্যাগোডার পাশ ঘেষেই জিওয়াকা রোড। দু’একটা বাড়ি পার হতেই হাতের বাম দিকে দেখি একটি সাদামাটা লোহার ফটক। প্রবেশ ফটকের উপরে গ্রীলের মাঝখানে লেখা ‘দরগাহ অব বাহাদুর শাহ জাফর, এম্পেরর অব ইণ্ডিয়া, ১৮৩৭ -১৮৫৭’। গাড়ি থেকে নেমে ৬ জিওয়াকা রোডের গেট ঠেলে ছোট্ট একটি আঙ্গিনায় ঢুকলাম। আমি ব্যাকপ্যাক কাঁধে চাপিয়ে অপূর্ব এক অনুভূতি নিয়ে দরগাহের মূল ফটকে প্রবেশ করি। প্রথমেই চোখে পড়লো দেয়ালে ঝুলানো বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের বর্ণাঢ্য তসবির। লেখা আছে মসোলিয়াম । উপরে লেখা দরগাহ। এখানকার লোকজনের কাছে বাদশাহ’র পরিচিতি একজন সন্ত বা সুফি-দরবেশ হিসেবেই। দরগাহ কর্তৃপক্ষের ক’জন সদস্যের সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা হয়। তাঁরা আমাকে বিশেষ সহযোগিতা করেছেন।
দরগাহ-মসজিদের ইমাম সাহেব নাজির ভাই (মৌলনা নাজির আহমেদ বাশারী) আমাকে প্রতিটি স্থান দেখিয়ে সাধ্যমতো বিবরণ দিলেন। লোহার গেটের তালা খুলে বাদশাহ’র মূল সমাধিস্থলে নিয়ে গেলেন। আমি বাদশাহ’র রওজা মুবারক জিয়ারত করি। কিছুটা সময় নিজের মতো কাটাই। ঘোরের মধ্যে বাদশাহ আলমপনাহ’র সঙ্গে আমার কথা হয়…
ঘোর কেটে গেলে, মূল সমাধিস্থল থেকে বের হই। দেখি, নিচতলায় নানা দেশ-বিদেশের মহিলারা এবাদতে নিমগ্ন হয়ে আছেন। আমার ভিনদেশী বন্ধু অ্যামি লিলিয়ান বললো, ‘চলো উপরের তলায় যাই’।
উপরের তলায় সমাধি সৌধের মূলকক্ষে সবুজ চাদরে ঢাকা পাশাপাশি তিনটি কবর । যার একটি হলো বাহাদুর শাহ জাফরের কবরের রেপ্লিকা । বাকি দু’টির একটি বাদশাহ’র প্রিয়তমা বিবি সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলের। তিনি বাদশাহ’র ইন্তেকালের ২০ বছর পর ইন্তেকাল করেন। অন্যটি তাঁদের পুত্র মির্জা জওয়ান বখতের। চারিদিকে দেয়ালের গায়ে ঝোলানো বাদশাহ’র বিভিন্ন সময়ের ছবি । এছাড়াও রয়েছে তাঁর বিবি ও পুত্রদের আলোকচিত্র। আরো আছে বাদশাহ’র শের, সুবিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি এবং নিকাহনামা (কাচের ফ্রেমে বাঁধাইকৃত)। এগুলো প্রত্যেকটি এক-একটি ইতিহাস তুলে ধরেছে আমাদের সামনে।
দরগাহ-মসজিদে পবিত্র জুম্মার নামাজ শেষে দরূদ শরিফ ও মিলাদ পড়ানো হলো। আল্লাহ্ তা’আলা’র বিশেষ কৃপায় আমিও এই মসজিদে জুম্মার নামাজ ও মিলাদে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। মুসল্লিরা আবেগে আপ্লুত হন। কেউ কেউ নীরবে কাঁদেন…
আমি মনে মনে ভাবি, বাদশাহ’র শেষ দিনগুলোর কথা। এখানেই কারাগারের অভ্যন্তরে এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠে, শতরকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই ৮২ বছরের বৃদ্ধ বাদশাহ রচনা করেছিলেন অসংখ্য সুবিখ্যাত পংক্তিমালা। গজল ও শায়েরি। সীমাহীন কষ্ট ও বিষাদে ভরা তাঁর সেসব কবিতা। এর সাথে আছে দেশ ও জাতির পরাধীনতার কথা।
একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
“Umer e daraz mang ka lae the char din,
Do arzo me kat gae; do intezar me.”
তর্জমা:
“চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম।
দু’দিন কাটলো প্রত্যাশায় আর দু’দিন প্রতীক্ষায়।”
Very Good and resourceful information. Coincidentally My son’s name is BahadurShah Zafar . I love this poet and name his name after my son emotionally .