মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির পাঁচটি কবিতা ।। অনুবাদ-মনজুরুল ইসলাম

প্রসন্নতার প্রদীপ্ত বেলা
কোনো এক প্রদীপ্ত প্রসন্ন বেলায় বসে আছি বারান্দায়
তুমি আর আমি।
আপাতদৃষ্টিতে দুজন হলেও
আমরা যেন দুজনে মিলে একক আত্মা।
আমরা প্রবাহিত জলধারার মতো এখানে জীবনকে অনুভব করি,
পুলকিত হই বাগানের সৌন্দর্যে, পাখির কলতানে।
আকাশের তারাগুলি আমাদের দেখতে থাকবে,
আর আমরাও দেখতে থাকবো তাদের।

বেঁকে যাওয়া অতি সূক্ষ্ম অর্ধচন্দ্রের মতো
আজ দুজনই আমরা আলাদা,
হয়ত একত্রিত হবো একদিন।
ধীরে ধীরে উদাসীন হয়ে,
শুধু তুমি আর আমি।

আমরা যেমন করে এক সুরে হাসি
একত্রিত হয়ে এই পৃথিবীর নিচে,
ঠিক একই সুরে,
বেহেশতের পাখিরা কর্কশ শব্দে উপভোগ করবে।
এবং অন্যভাবে সময়হীন সুমধুর ভূমি জুড়ে।

নীরব ভালোবাসার প্রাপ্যতা
নিঃসীম নীরবতার আবহে তোমায় ভালোবাসতে পছন্দ করি আমি,
যেহেতু এই নীরবতার অন্তরালে প্রত্যাখানের কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পাই না।

একাকীত্বের মায়াবী প্রহরে তোমায় ভালোবাসতে পুলক বোধ করি,
যেহেতু একাকীত্বের এই চারণভূমিতে,
আমি ছাড়া আর পৃথিবীর কেউই অধিকার করতে পারে না তোমাকে।

অতি দূর হতে তোমার জন্য আরাধনা করতে নিরাপদ বোধ করি,
যেহেতু এই সীমানাবিহীন দূরত্বই আমাকে রক্ষা করবে দুঃসহ যন্ত্রণার উত্তপ্ততা থেকে।

প্রবহমান সুরেলা বাতাসের মিষ্টতায় তোমার নরম ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে আকর্ষণ বোধ করি,
যেহেতু এই অকৃত্রিম বাতাস আমার দু’ঠোঁটের চেয়েও অধিকতর প্রশান্ত।

অন্তরিত স্বপ্নের ভেলায় তোমায় আঁকড়ে ধরে রাখতে অসীম সুখ অনুভব করি,
যেহেতু এই স্বাপ্নিক স্নেহময়তার স্পর্শে কোনোদিনও হারিয়ে যাবে না তুমি।

অমর পংক্তিমালা
আমার এ দু’চোখের দৃষ্টি কোথায় প্রক্ষেপ করা উচিত?
অনির্বাণ জিজ্ঞেস করি আমি।
ও বলে, অনিঃশেষ অসীম পথের দিকে তাকিয়ে থেকো।

আর আমার তীব্র অনুভূতির?
জিজ্ঞেস করতেই ও উত্তর দেয় এভাবে,
পুড়িয়ে ফেলো,
পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করো তোমার অনুভূতির তীব্রতাকে।

আমি আবারও জিজ্ঞেস করি,
জিজ্ঞেস করি আমার হৃদয়ের কথা।
তোমার হৃদয়ের অতলে কী ধারণ করো তুমি?
প্রত্যুত্তরে বলে উঠে ও।
আহত স্বরে আমি বলি: দু:খ ও অসহ্য যন্ত্রণা।

এবার ও দৃঢ় চিত্তে বলে,
ওদের সাথেই থেকে যাও,
কণ্ঠটিকে উঁচুতে নিয়ে বলে-
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হওয়ার অনুভূতিই পৃথিবীর একমাত্র পাদপীঠ,
যেখানে প্রবেশ করে অবারিত আলোকরশ্মি,
একমাত্র সেই আলোই আলোকিত করতে পারে তোমাকে।

তুমি কি আমায় ভালোবাসো?
আমার প্রতি ভালোবাসার যে সৌধ তুমি নির্মাণ করেছো,
সে সৌধের উচ্চতা কি তোমার প্রতি তোমার ভালোবাসার চেয়েও ক্ষুদ্র?
একজন প্রেমিক প্রশ্ন করলো তার প্রেমিকাকে।

আমার নিজ জীবনের আত্মাহুতির মধ্য দিয়েই
আমি বাঁচতে চেষ্টা করেছি সতত
তোমার জীবনের মাঝেই।
প্রেমিকাকে উত্তর দিল তার প্রিয়তম।

অদৃশ্য হয়েছি আমি আমার আত্মজীবন
এবং অন্তরিত সমস্ত গুণের আঁধার থেকে।
বেঁচে আছি আমি শুধু তোমারই জন্য।

আমার জীবনে অর্জিত সকল শিক্ষাই
আজ আমি ভুলে গেছি।
কিন্তু তোমার সাথে পরিণয় হবার পর থেকেই
হয়েছি আমি বিরল প্রতিভাবান।

সকল শৌর্য আজ হারিয়ে ফেলেছি আমি।
কিন্তু জানো?
তোমার শক্তির স্পর্শে স্পর্শিত হয়ে
হয়েছি প্রবল শক্তিমান।

যদি আমাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসি,
তবে জানবে, আমি তোমাকেও ভালোবাসি।
আর যদি, আমি তোমাকেই ভালোবাসি,
তবে জানবে, ভালোবাসি আমাকেও, আমার আত্মাকেও।

ভালোবাসার সমীকরণ
তুমি এসেছ আমাদের মাঝে
তারকারাজির উর্ধ্বলোক থেকে,
মহাশূণ্যের নিঃসীম শূণ্যতা থেকে,
এসেছ তুমি অপরিচিত অন্য এক পৃথিবী থেকে।

অকল্পনীয় সৌন্দর্যের সীমাতিক্রমী শুদ্ধতা,
তোমার অবয়বকে জারিত করেছে
ভালোবাসার ঈপ্সিত নির্যাস দ্বারা।

তোমার এই মোহনীয় সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতা দ্বারা
স্নাত হয়েছে তারাই,
যাদের স্পর্শ করেছো তুমি।

জাগতিক উদ্বিগ্নতা, উৎকণ্ঠা এবং সমস্ত দুঃখবোধ
উৎসাদিত হয়েছে তোমারই প্রোজ্জ্বল উপস্থিতিতে।
আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছে
শাসক এবং শোষিতের মাঝে,
বইয়েছে রাজা এবং প্রজাদের মাঝে।

তোমার অণুগ্রহে অনুপ্রাণিত হয়ে
হারিয়ে ফেলেছি আমাদের ভাষা।
সমস্ত পাপাদি পরিণত হয়েছে পুণ্যে।
তুমি সত্যিই মহান প্রভু!

তুমিই প্রজ্জ্বলিত করেছো ভালোবাসার লেলিহান অগ্নিশিখা
ঐ দূর অন্তরীক্ষে, পৃথিবীর প্রান্তর থেকে প্রান্তরে।
তোমার সৃজিত মানবের হৃদসরোবর এবং আত্মার গভীরতম প্রদেশে।

তোমার এই বাঁধহীন ভালোবাসা একীভূত করেছে,
অস্তিত্ববাদ এবং অনস্তিত্ববাদকে।
সকল বিরোধীরা হয়েছে একত্রিত।
স্রষ্টা এবং পবিত্র সৃষ্টির প্রতি বিদ্বেষী
সবাই হয়েছে আবারও পবিত্র।

Facebook Comments

comments

১ Reply to “মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির পাঁচটি কবিতা ।। অনুবাদ-মনজুরুল ইসলাম”

  1. Azad বলেছেন:

    যখন আমার মৃত্যু হবে, আমার কাছে এই কবিতাটা অনেক বেশি ভালো লাগে। এই কবিতার অনুবাদ আশা করছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top