সাহির লুধিয়ানভি ।। মাহমুদ আলম সৈকত

স্পষ্ট মনে আছে। আটাশি’র ডিসেম্বর। কলোনির একটা ঘরে ভিসিআর-টেলিভিশন আনা হয়েছে কোনও এক বৃহস্পতিরাতে। বাবার কোলে বসে সিনেমা দেখছি। যে সিনেমাটা চলছে, সম্ভবত সেটা সমবেতরা আগেও দেখেছেন। একটা গান শুরু হলো। একটু বড়োদের ব্যাপার স্যাপার। আমার বয়স ঠিক দশ। তখন এসব বয়সের বালাই ছিলো না তো! গানটার আগে এবং পরে, সবাই ইতস্তত কথা বলছিলেন, চাপা গলায়। কিন্তু ওই গান চলার সময় সবাই-ই চুপ। সবার মুখাবয়ব কেমন একটা ভাব। যে ভাবটা আমি আরও প্রায় দশ বছর পর নিজের মধ্যেও টের পাই, সেই একই গানে, এবং আজও।
কাভি কাভি মেরে দিল মে খ্যয়াল আ-তা হ্যায়
কিছু গানের বাণী এমন হয়, কিছু গজল, কিছু কবিতা…যা অনুবাদে মন সায় দেয় না কখনোই। সেই বাণীরা নিজেই এতো মায়াময়, এতো নিবিড়, এতোটাই স্ব-বিস্তারি, যে মনে হয়, একে ছুঁলেই যদি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে! সাহির লুদিয়ানভি’র লেখা এই গানটিও তেমন। যশ চোপড়া পরিচালিত ‘কাভি কাভি’ মুক্তি পায় উনিশশ ছিয়াত্তরে। সে বছরই সিনেমাটি জিতে নেয় ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ড। সেরা সুরকার খৈয়াম, সেরা গীতিকার সাহির লুধিয়ানভি। সিনেমার সাতটি গানই তখন তুমুল জনপ্রিয়। আজও সেই সাত-এর সেরা দুই বেজে ওঠে কোথাও, ম্যয় পল দো পল কা শায়ের হু এবং কাভি কাভি মেরে দিল মে।
এই সময়ের দেড় দশক পিছিয়ে গেলে, আমরা দেখব, হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের শতবর্ষের সেরা পাঁচ-এর একটি চলচ্চিত্র ‘মুঘল-এ-আজম’ মুক্তি পেয়েছে, সাল উনিনশ তেষট্টি। পরের বছরই চলচ্চিত্রটি তিনটি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড জিতেছে, সেরা গীতিকার সাহির লুধিয়ানভি! গানগুলো মনে আছে? `যো ওয়াদা কিয়া বো নিভানা পড়েগা’, `পা-ও ছুঁ লে নে দো ফুলোঁকো’, `যো বাত তুঝমে হ্যায়’…
এরকম লোক মুখে ফেরা বহু বহু গানের রচয়িতা সাহির লুধিয়ানভি। সংখ্যার হিসেবে তা হয়তো সাড়ে সাতশো (প্রায়) এবং এই সংখ্যার বড়ো অংশই হয়তো বাজারি বা ফরমায়েশি গান। কিন্তু বড়ো অংশটি বাদে যা থাকে তা-ও যদি আমলে নিই, নির্দ্বিধায় বলা যায় সাহিরের গান হিন্দি চলচ্চিত্রের মাইলস্টোন এবং এর ইতিহাস যতবার যতদিন পর লেখা হোক না কেন সেখানে সাহিরের নামের একটা এন্ট্রি থাকবেই। গীতিকার হিশেবে তিনি কাজ করেছেন শচীন দেববর্মণ, রবি শঙ্কর, রোশন লাল, খৈয়াম, রাহুল দেববর্মণ, লক্ষীকান্ত-প্যায়ারে লাল, শংকর- জয়কিষাণ প্রমুখ স্বনামধন্য সুরকারদের সঙ্গে।
পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জমিদার পরিবারে জন্ম, উনিনশ একুশ সালে। বাবা-মা’র দেয়া নাম আবদুল হাই। কলেজে পড়ার সময় কবিতা লিখতে শুরু করেন। নাম পাল্টে নেন ‘সাহির লুধিয়ানভি’। দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তেতাল্লিশে চলে আসেন লাহোর। সেখানে যোগ দেন প্রগতিশীল লেখক শিবিরে। গুরু হিশেবে পেলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে। বামপন্থী রাজনীতি এবং কবিতা, জীবনের যেনো এই দু-ই মোক্ষ। উনিশশ উনপঞ্চাশে তার নামে হুলিয়া জারি করে পাকিস্তান সরকার। পালিয়ে আসেন দিল্লী, সেখান থেকে বোম্বে। এখানে এসে বন্ধু হিশেবে পেলেন অমৃতা প্রীতম-গুলজার-জাভেদ আখতার-কৃষণ চন্দরদের। আমৃত্যু বোম্বেবাসী সাহির পরলোকগমন করেন উনিশশ আশি সালে।
আমরা যদি সাহিরের শুধু ‘গীতিকার’ পরিচয়েই তুষ্ট থাকি, তাহলে সেটা আমাদেরই কমতি হবে। কেননা তার নজম্, শের, গজলগুলোও সাহির (মানে‘জাগরী’) নামটি স্বার্থক করেছে। তাঁর কবিতায় প্রেম আছে বটে, কিন্তু সেই প্রেম ঠিক ‘আশিক-মাশুক’ ধাঁচের নয়, তার কবিতায় শরাব আছে বটে, কিন্তু তা মত্তমাতালের প্রকাশ নয়, তাঁর কবিতায় শ্রেণি সংগ্রাম, নারীবাদীতা, মানবিকতা…সমস্তই মজুদ। আবার কখনো লিখছেন,
ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাতা চলা গ্যয়া
হর ফিকর্ কো ধুঁয়ে মে উড়াতা চলা গ্যয়া।
♦♦♦
আমি জীবনের সাথে তাল মিলিয়েই পথ চলেছি
সকল দুর্ভাবনাকে ধোঁয়ায় উড়িয়ে উড়িয়েই পথ চলেছি।
(উনিশশ একষট্টি সালে মুক্তি পাওয়া ‘হামদোনো’ চলচ্চিত্রের গান)
যা-ই হোক। তথ্যভারে ক্লান্ত না হয়ে আসুন সাহিরের কিছু পঙক্তি পড়া যাক। মন খারাপ হলে পরে, শুনলেন দুয়েকটি।
ক.
বো আফসানা জিসে আনজাম তক্ লানা না হো মুমকিন
উসে ইক্ খুবসুরৎ মোড় দে কর ছোড়না আচ্ছা
♦♦♦
তেমন গল্প, যাকে শেষতক টেনে নেওয়া সম্ভব নয়
তাকে সুন্দর একটা মোড়ে পৌঁছে দিয়ে ছেড়ে যাওয়াই শ্রেয়।
খ.
তুম মেরে লিয়ে আব কো-ই ইলজাম না ঢুনডো
চাহা থা তুমহে ইক্ ইয়েহি ইলজাম বহত হ্যায়
♦♦♦
আমার বিপক্ষে আর কোনো অভিযোগ খুঁজো না
তোমাকে চেয়েছি, এই এক অভিযোগই তো অনেক!
গ.
লোগ অউরাত কো ফকৎ জিসম্ সামাঝ লেতে হ্যায়
রুহ ভি হোতি হ্যায় উস মে ইয়ে কাহা সোচতে হ্যায়
রুহ ক্যায়া হোতি হ্যায় ইস সে উনহে মতলব হি নেহি
বো তো বাস্ তনকে তাকাযো কা কাহাঁ মানতে হ্যায়।
♦♦♦
নারী বলতে লোকে স্রেফ শরীরটাই বোঝে
শরীরে হৃদয়ও থাকে, সে-কথা আর কে ভাবে
‘হৃদয়’ কিরকম ব্যাপার, তাতে আগ্রহ নেই কারো
তারা শুধুই শরীরের চাওয়াটাকেই মানে।
ঘ.
কাল অউর আয়েঙ্গে নাগমো কি খিলতি খালিয়াঁ চুননেওয়ালে
মুঝ সে ব্যহতার ক্যহনে ওয়ালে তুম সে ব্যহতার শুননে ওয়ালে
হর নসল্ ইক ফসল হ্যায় ধরতি কা আজ উগতি হ্যায় কাল কাটতি হ্যায়
জীবন বো মেহেঙ্গি মুর্দা হ্যায় যো কাতরা কাতরা বাটতি হ্যায়
♦♦♦
সুরের বাগানে ফুল তুলতে, সুবাস কুড়াতে কাল নতুন কেউ আসবে
আমার চেয়ে ভালো তার কথা, তোমার চেয়ে ভালো সে শ্রোতা
একেকটা দানাই ফসলের সমাহার, আজ ফলেছে কাল কেউ কেটে নেবে
আর জীবন সেই দামী শব যা টুকরো টুকরো কেটে বিলিয়ে দেয়া হবে।
ঙ.
তুম নে জিস খুন কো মকতল মে দাবানা চাহা
আজ বো কুচা-ও-বাজার মে আ নিকলা হ্যায়
কাহি শোলা, কাহি না-ড়া, কাহি পাথ্থার বন কর
খুন চলতা হ্যায় তো রুকতা নেহি সংগিনোঁ সে
সর্ উঠাতা হ্যায় তো দাবতা নেহি আয়নোঁ সে
♦♦♦
কসাইখানায় মাটি-চাপা দিতে চেয়েছো যে রক্ত
আজ তা বাজারে-গলিতে ছড়িয়ে গিয়েছে
কোথাও স্ফুলিঙ্গ হয়ে, কোথাও শ্লোগান, কোথাও পাথরের ঢিল হয়ে
রক্ত যদি ছোটে তবে তা ডরায় না কোনও বেয়নেটে
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি, আয়না আর কি ভয় দেখাবে!
চ.
তেরে দুনিয়া মে জিনে সে তো ব্যহতর হ্যায় কে মর যায়ে
বোহি আঁশু বোহি আহেঁ বোহি গম্ হ্যায় জিধার যায়ে
কো-ই তো এয়সা ঘর হোতা যাহা সে পেয়ার মিল যাতা
বোহি বেগানে চেহরা হ্যায় যাহা যায়ে জিধার যায়ে
আরে ও আসমানওয়ালে বাতা ইস মে বুরা ক্যায়া হ্যায়
খুশি কে চার ঝোঁকে ’গর ইধার সে ভি গুজার যায়ে
♦♦♦
তোমার পৃথিবীতে, বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই উত্তম
সেই কান্না, সেই হাহাকার, একই কষ্ট যেখানেই যাই
এমন একটা ঘরও তো হতে পারতো যেখানে ভালোবাসা পাওয়া যেতো
সেই একই আগন্তুক মুখাবয়ব যেখানে যাই যেদিকেই যাই
ওহে আকাশবাসী, বলো তাতে কি এমন ক্ষতি হতো
যদি দু-চার ঝলক খুশির হাওয়া এদিক দিয়েও উড়ে যেতো
ছ.
গম উর খুশি মে ফরক্ না মেহসুস হো যাহা
ম্যায় দিল কো উস মকাম পে লাতা চলা গ্যয়া
♦♦♦
আনন্দ এবং বেদনার পার্থক্য অনুভূত হবে না যেখানে
আমার মনকে সে রকম স্থানেই নিয়ে গেছি নিরন্তর

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top