বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত পানিবালা একটি চেনা লোককাহিনীর নাগরিক মিথষ্ক্রিয়া, কৃত্যে, নাট্যে, ইতিহাস আর গার্হস্থ কৃষিকাজের বিন্যাসে তার বিস্তার। দিনাজপুর রামসাগর দিঘির একটি লোককাহিনী পানিবালা আখ্যান নাট্যের মৌল অনু। যেখানে কোন দিঘির জলধারা নেই কেবলই বালুকারাশি উতালপাতাল করে, সেখানেও মানুষের অন্তর্লোকে শ্রাবণ সন্ধ্যার ঘোরলাগা ঢল, ও জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল!
পানিবালা
সাঁঝবেলার চারপাশ খানিকটা মোলায়েম ও ফর্সা লাগে: তারই মাঝখানে চন্দ্রবালা দিঘির মুখ বরাবর কাঁঠাল পাতায় পাতায় ভাসমান বাতিসমূহ জ্বলে ওঠে; তারা কিছুটা দুলেদুলে যায়: তার ভিতর এক অনাথিনী ব্যাকুল মা হাওয়ারুন্নিসা বেওয়া সাধুবাবার আদেশ ও পরামর্শে এক দূরাভিগামী প্রার্থনা মেলে ধরে:
পুণ্যবতী বালা তুমি দুর্গতিনাশা তবনাম জপমালা
স্মরণে মোহক্ষণে তোমারই বিভঙ্গিমায় বিষজ্বালা।
তুমি কন্যাসম জননী কৃপাপ্রার্থী সুভদ্রা তোমার চরণ
ত্রুটি ক্ষমো মাতৃসম করো কৃপা জটাধারী অভাজন।
তব নামে বন্দনা করি মর্ত্যপাতাল ভূলোক
দ্যুলোক ফুলেশ্বরী আনন্দধাত্রী নৈবেদ্য গ্রহো পুণ্যবতী শ্লোক।।
তুমি যদি চাও ওগো কন্যা, ও জননী তৃষ্ণা; তোমার নামে পালা গাই সুই ও সুতায়, তোমারই রূপ নেহারি, পুণ্য নামে ওগো বিসর্জন, ও ব্যথার দাগ- উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে অশ্রু বারিবিন্দু বঙ্গোপসাগর, তোমারই নামের গুণে ভাটিয়ালি গানে পানিবালা মা,পুবের ভানুশ্বর, পশ্চিমে রক্ত হাহাকার বিচ্ছেদবর্তী এক সূর্য নমস্কার!
তোমার নামে আমরা জনমন্থন দুঃখ ও স্বপ্নকীর্ত্তন পালা করে যাই- গীতবর্তী লোক তোমার মহিমানামে আবার অশ্রুপাতে মথিত হোক, ধানদুর্বা ছিটিয়ে দিক; প্রতিজনে, প্রতিঘরে তোমার বিলাপ, তোমার আশা, ধৈর্য আর প্রতীক্ষার কথা আবার প্রাতঃস্মরণীয় হোক। তোমার কাছে আমার সামান্য চাওয়া মা পানিশ্বরী।
মায়ের বুক খালি করে কেউ তুলে নিয়ে গ্যাছে বুকের ধন- তোমার কাছে তার প্রতিকার চায়; হারানো ধন ফিরে পাবার আশায় বুক বাঁধে তোমারই কাছে।
শিলাবৃষ্টির আঘাতে ফসল ছিন্নভিন্ন লুটিয়ে পড়েছে মাটির উপর- কৃষকের বুক চৌচির উঠে গ্যাছে সাত তবক আসমানের দিক- চোখ থেকে অশ্রু নয়, ঝরে পড়ে স্মৃতি ও স্নেহের ডুমুরফল: ভাঙা কৃষক তোমার কাছেই এসে তার উদ্ধার চায়, মা।
আমিও এসেছি তোমার কাছে। আমার দুঃখী মেয়েটির আবার ধনে-মানে সংসার হোক। নাতিনাতকরের মুখ দেখি, তুমি বর দাও- আমার ব্যথিত মা, সুদূর সৌভাগ্য মন্থন করো- দয়া করো, কৃপা দাও, ভক্তি নাও- আমার সবটুকু প্রণতির অশ্রুভরা ডালা গ্রহণ করো মৎস্যের সই! আমরা তোমার নামে পুঁথি পাঠ করি, অনাদিকালের ইতিহাসটুকু বলি- আবার বলি, ফের শ্রবণ করি।
ভোরে, প্রত্যুষে প্রকৃতি আড়মোড়া ভাঙে, চোখ খোলে, নানাজাত পাখপাখালি ডাকে, কিন্তু অন্দরমহলে রাজা ধুলিয়ান খানের হুঙ্কার শোনা যাবে খানিক বাদে,সেই হুঙ্কারের আগে পাখিদের কিচিরমিচির থামাতে হবে; তাই রাজার পেয়াদা, লাঠিয়াল ব্যস্তসমস্ত- তাদের শপাং শপাং চাবুকের বাড়ি শোনা যায়; আর খাজনা শোধ না করনেওয়ালা প্রজা রাজার বাড়ির চৌহদ্দিতে গড়াগড়ি যায়- গগণছিন্ন-করা আর্তনাদ করে। চাবুকের বাড়ি শপাং শপাং! প্রজার আহাজারি আহ্! আহ্!
রাজা ধুলিয়ান খান: একই আওয়াজ, একই চিৎকার। কতোটাই একঘেয়ে। চিৎকারের অন্যথা, আহাজারির ব্যতিক্রম করতে পারো না! রাজকবি কী ঘোড়ার ঘাস কর্তন করে?
রাজার লোক: তিনি- যিনি রাজকবি- বড় ধ্যানস্থ।
রাজার লোক: আকাশ পাতাল মন্থন করে তিনি উপমা আর দুঃখ তালাশ করেন।
ধুলিয়ান খান: জানি, আমি তা বিলকুল অবগত আছি। কিন্তু তার ফল তো দেখি না- যখন বলি, শ্রবণ করো হে রাজকবি, বক্ষ বেজায় ভারী,যেন একশো মন পাথর, শিলাপ্রস্ত; এমন শায়ের বলো কবি- কেঁদে বুক হালকা করি- কোথায়, বুকের প্রান্তর খাখা মরুভূমি, কাঁদতে তো পারি না।
রাজার লোক: হুজুর, আপনাকে অনুধাবনে, অন্তর্লোক আয়ত্তকরণে আমাদের কিঞ্চিতাধিক সমস্যা হয়।
ধুলিয়ান খান: সেটা কী প্রকার, কী-বা তার হেতু- বলো, মন খোলাশা করে প্রকাশ করো।
রাজার লোক: ওই যে সেদিন, আপনি বললেন- আপনার চিত্ত ঘোলাঘোলা; বললেন- শান্ত্রী, মন ফুরফুরা চাঙ্গা করে দাও। দরকারে কারো পিঠে দাও ডলা।
রাজার লোক: আমাদের মধ্যে হুলস্থুল- নাওয়া নাই, খাওয়া নাই, বসা নাই, শোয়া নাই- দেশে দেশে লোক মোতায়েন করি, পন্থা খুঁজি।
রাজার লোক: রাজার মন ঘোলাঘোলা, রাজার মনে নৌকা ভাসাও পালতোলা; কী করি, কী করি, শেষমেশ
ভেবে দেখি- আসে সিদ্ধি।
রাজার লোক: ভিনদেশ থেকে এক জব্বর ঘোড়া- তাগড়া সেয়ানে সেয়ান অশ্ব আনানোর বিধিব্যবস্থা পাকা করি।
রাজার লোক: এই ঘোটকের দারুণ শক্তি- অমেয় মর্দামি, সাব্যস্ত করি- ঘোড়া এসে রাজপ্রাঙ্গনে হাঁক দেবে- চিঁহি… চিঁহি।
রাজার লোক: মর্ত্যপাতালবিদারী হ্রেষাধ্বনি। ফলে রাজার মন আমূল দোলানি খেয়ে আবার জেগে উঠবে-
টকটকা লাঞ্চনার দামে ঝকমকা রাজার খেয়াল!
আহা ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ
রাজা বাড়ি যায়,
রাজা করেন আনচান
সভাকে জানাই।
আহা ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ
রাজা বাড়ি যায়।
শেষপর্যন্ত লাখ টাকার আদাজল তেলপানি খরচ করে খানদানি ঘোড়া আপনার আঙিনায় এসে খাড়ায়- ঘোড়াকে পেদানো হয় বেবাক শক্তির জোরে, ভিনদেশী ঘোটক বলে কথা- আসমান চৌচির করে চিল্লান দেয়-
রাজার লোক: চিঁহি, চিঁহি!
রাজার লোক: কতো না আশায় আশায় থাকি- আপনার ঘোলা মন ফকফকা হবে, আমরা সবাই আপনার মুখপানে চেয়ে থাকি আলিম্পন।
রাজার লোক: আপনি বলেন- খামোশ! আমরা আর কী করতে পারি- রাজা বিক্রমশাল?
কোথায় গণক, কই কবিরাজ- একে একে ডেকে আনো সাতরাজ্যের গণ্যমান্যি পণ্ডিতপ্রবর, গোছাতে বলো আমার কুফা নাম- সোনাফর, সোনাফরউল্লাহ্, দেশে দেশে লোক পাঠাও, হেকমত, হেকমত আর দেরি নয়।
জি রাজা নামদার, আজ্ঞে হুজুর পাক।
ওদের কী সমস্যা, কী-বা মোকদ্দমা- মালী আর ধুপা, চাকর আর বাকর- সবাই দৌড়ায় কেন, সোনাফর?
মালী!
ধুপা!
ওরা আরো এলোপাতাড়ি দৌড়ায়।
তোমাদের কী শঙ্কা- দৌড়াও কেন, কেন বা চম্পট দাও?
শিয়াল, হুজুর শিয়াল, আস্ত এক শিয়াল, ধূর্ত প্রাণি- কী যে তার হানাহানি হুজুর! লম্বা, সোনালি, চতুর, আর পরিশ্রমী খুশ মেজাজ, এমন ফুর্তিফুর্তি প্রত্যুষে, হ্যাঁক, কী আর বলবো হুজুর- এই সেই এক কুফা শিয়াল সামনে নয়, পশ্চাতে নয়, না উপরে, না নিচে- শিয়াল আমাদের বামদিক বরাবর দৌড়ে পালায়! বামদিকে শিয়াল পালানোর তরজমা ভয়ানক, অকল্যাণ, সর্বনাশ! ঘোর অমানিশা। তাই আমরা অকূলান বেজান দৌড়াচ্ছি : যে-করেই হোক শিয়ালকে আমাদের ডানদিক দিয়ে পার করতেই হবে, রাজা নামদার।
ভোরে, প্রত্যুষে প্রকৃতি আড়মোড়া ভাঙে, চোখ খোলে, নানাজাত পাখপাখালি ডাকে, কিন্তু অন্দরমহলে রাজা ধুলিয়ান খানের হুঙ্কার শোনা যাবে খানিক বাদে, সেই হুঙ্কারের আগে পাখিদের কিচিরমিচির থামাতে হবে; তাই রাজার পেয়াদা, লাঠিয়াল ব্যস্তসমস্ত- তাদের শপাং শপাং চাবুকের বাড়ি শোনা যায়; আর খাজনা শোধ না করনেওয়ালা প্রজা রাজার বাড়ির চৌহদ্দিতে গড়াগড়ি যায়- গগণছিন্ন-করা আর্তনাদ করে। চাবুকের বাড়ি শপাং শপাং! প্রজার আহাজারি আহ্! আহ্!
রাজা ধুলিয়ান খান: একই আওয়াজ, একই চিৎকার। কতোটাই একঘেয়ে। চিৎকারের অন্যথা, আহাজারির ব্যতিক্রম করতে পারো না! রাজকবি কী ঘোড়ার ঘাস কর্তন করে?
রাজার লোক: তিনি- যিনি রাজকবি- বড় ধ্যানস্থ।
রাজার লোক: আকাশ-পাতাল মন্থন করে তিনি উপমা আর দুঃখ তালাশ করেন।
ধুলিয়ান খান: জানি, আমি তা বিলকুল অবগত আছি। কিন্তু তার ফল তো দেখি না- যখন বলি, শ্রবণ করো হে রাজকবি, বক্ষ বেজায় ভারী, যেন একশো মন পাথর, শিলাপ্রস্ত; এমন শায়ের বলো কবি- কেঁদে বুক হালকা করি- কোথায়, বুকের প্রান্তর খাখা মরুভূমি, কাঁদতে তো পারি না।
রাজার লোক: হুজুর, আপনাকে অনুধাবনে, অন্তর্লোক আয়ত্তকরণে আমাদের কিঞ্চিতাধিক সমস্যা হয়।
ধুলিয়ান খান: সেটা কী প্রকার, কী-বা তার হেতু- বলো, মন খোলাশা করে প্রকাশ করো।
রাজার লোক: ওই যে সেদিন, আপনি বললেন- আপনার চিত্ত ঘোলাঘোলা; বললেন- শান্ত্রী, মন ফুরফুরা চাঙ্গা করে দাও।
রাজার লোক: আমাদের মধ্যে হুলস্থুল। নাওয়া নাই, খাওয়া নাই, বসা নাই, শোয়া নাই- দেশে দেশে লোক মোতায়েন করি, পন্থা খুঁজি।
রাজার লোক: রাজার মন ঘোলাঘোলা, রাজার মনে নৌকা ভাসাও পালতোলা; কী করি, কী করি, শেষমেশ
ভেবে দেখি- আসে সিদ্ধি।
রাজার লোক: ভিনদেশ থেকে এক জব্বর ঘোড়া- তাগড়া সেয়ানে সেয়ান অশ্ব আনায়নের বিধিব্যবস্থা পাকা করি।
জার লোক: এই ঘোটকের দারুণ শক্তি- অমেয় মর্দামি, সাব্যস্ত করি- ঘোড়া এসে রাজপ্রাঙ্গণে হাঁক দেবে- চিঁহি… চিঁহি।
রাজার লোক: মর্ত্যপাতালবিদারী হ্রেষাধ্বনি। রাজার মন আমূল দুলুনি খেয়ে আবার জেগে উঠবে-
টকটকা লাঞ্চনার দামে ঝকমকা রাজার খেয়াল!
আহা ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ
রাজা বাড়ি যায়,
রাজা করেন আনচান
সভাকে জানাই।
আহা ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ
রাজা বাড়ি যায়।
শেষপর্যন্ত লাখ টাকার আদাজল তেলপানি খরচ করে খানদানি ঘোড়া আপনার আঙিনায় এসে খাড়ায়- ঘোড়াকে পেদানো হয় বেবাক শক্তির জোরে, ভিনদেশী ঘোটক বলে কথা- আসমান চৌচির করে চিল্লান দেয়-
রাজার লোকেরা: চিঁহি, চিঁহি!
রাজার লোক: কতো না আশায় আশায় থাকি- আপনার ঘোলা মন ফকফকা হবে, আমরা সবাই আপনার মুখপানে চেয়ে থাকি আলিম্পন।
রাজার লোক: আপনি বলেন- খামোশ! আমরা আর কী করতে পারি- রাজা বিক্রমশাল?
কোথায় গণক, কই কবিরাজ- একে একে ডেকে আনো সাতরাজ্যের গণ্যমান্যি পণ্ডিতপ্রবর, গোছাতে বলো আমার কুফা নাম- সোনাফর, সোনাফরউল্লাহ্, দেশে দেশে লোক পাঠাও, হেকমত, হেকমত আর দেরি নয়।
জি রাজা নামদার, আজ্ঞে হুজুর পাক।
ওদের কী সমস্যা, কী-বা মোকদ্দমা- মালী আর ধুপা, চাকর আর বাকর- সবাই দৌড়ায় কেন সোনাফর?
মালী!
ধুপা!
ওরা আরো এলোপাতাড়ি দৌড়ায়।
তোমাদের কী শঙ্কা- দৌড়াও কেন?
শিয়াল, হুজুর শিয়াল, আস্ত এক শিয়াল, ধূর্ত প্রাণি- কী যে তার হানাহানি হুজুর! লম্বা, সোনালি, চতুর, আর পরিশ্রমী খুশ মেজাজ, এমন ফুর্তিফুর্তি প্রত্যুষে, হ্যাঁক, কী আর বলবো হুজুর- এই সেই এক কুফা শিয়াল সামনে নয়, পশ্চাতে নয়, না উপরে, না নিচে- শিয়াল আমাদের বামদিক বরাবর দৌড়ে পালায়! বামদিকে শিয়াল পালানোর তরজমা ভয়ানক, অকল্যাণ, সর্বনাশ! ঘোর অমানিশা। তাই আমরা অকূলান বেজান দৌড়াচ্ছি : যে-করেই হোক শিয়ালকে আমাদের ডানদিক দিয়ে পার করতেই হবে রাজা নামদার৷
সোনাফর, হেকমত ওদের নির্ভয়ে সত্য ভাষণ দিতে বলো; জিজ্ঞেস করো- ওরা কেন আমার মুখপানে দৃষ্টিপাত করে না, কেন শুধু ভূমি পানে চোখ নিবদ্ধ রাখে?
বলো, তোমরা নির্ভয়ে ব্যাখ্যা করো।
কিছু না, অন্য কিছু না হুজুর, শিয়াল নিমিত্ত।
বলো আর না-ই বলো, আমি জানি কেন ওরা উপরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে না; কারণ, আমি রাজা ধুলিয়ান খান! পবিত্র ভোরবেলা ওরা আমার কুফা মুখ দেখতে চায় না- হা আল্লাহ্!
হুজুর! হুজুর!
জগবন্ধু।
সোনাফর।
হুজুর!
রাজনর্তকী কই? আহ্! আমার দুর্ভাগ্য ছিঁড়েফুঁড়ে নয়া নর্তকীর তরবারি চোখের নিচে আমাকে খণ্ডবিখণ্ড করে দাও হেকমত। কই, ঘুঙুরের সর্বনাশ কই?
রাজার লোক: ভাবি রাজা মশাই,
নির্ঘাত ভাবি ভাবি
দিনশেষে ফল নাই ডৌল নাই
সবই হাবিজাবি।
রাজার লোক: মন বলে আগুন লাগুক
ভিতরে বাইরে রাজার মনে ফাগুন জাগুক।
রাজার লোক: মিয়া তানসেন গান ধরুক
মর্ত্য-পাতাল স্বর্গ-নরক কেঁপে কেঁপে উঠুক
কম্পনে ঘর্ষণে রাজার মনে আগুন জ্বলুক।
রাজার লোক: তানসেন তনয়া ধরুক
রাগ কী মেঘমল্লার
বৃষ্টি নামুক উপরে
আগুনের ও হল্লার!
রাজার লোক: চুপ রও বেতমিজ,
মেঘমল্লার না কিয়া বাত
দীপক রাগ হো সারারাত!
অতঃপর নাচঘরে দীপক রাগে বাইজিনাচের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে!
দীপক রাগ ও নৃত্যের জমকালো আসর।
দীপক রাগ ও নাচের রেশ থাকতে থাকতেই হাডুডু খেলার হুল্লোড় জমে ওঠে। ঢাক বাজে, ঝাঁজর পিটায়, প্রতিপক্ষ দুই গ্রামের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই:
ডুক্কু, ডুক্কু, ডুক্কু, ডুক্কু…
ধরছে! ধরছে!
ডুক্কু, ডুক্কু…
ছাড়ছে, ছাড়ছে!
হাডুডু খেলার শেষদিকে রাজদরবারের ভিতর থেকে একটা বড় আওয়াজ আসে। মনে হয়, ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা ধুলিয়ান খান কিছু ভেঙে ফেলছেন; না হয় হুড়মুড় করে কিছু পড়ে ছিটকে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে।
আহা, আহা,গেল রে গেল, সব গেল! আর সামলানো গেল না। আজ দ্বিতীয় দিবস পার হয়ে এখন বেলা তিনপ্রহর। কী যে করি, কিফাতুল্লাহ্’র ফেরার নামগন্ধও নাই। নদীর ওইপাড়ে বোধ করি আটকা পড়েছে। আর এদিকে ঝড়-বৃষ্টির কী মাতম দেখো দেখি! মনে হচ্ছে কিয়ামতের আলামত শুরু হয়েছে।
ঘোরতর বর্ষায় দু’জন নদীর দুই পাড় থেকে চিৎকার করে কথা বিনিময় করে:
কিফাতুল্লাহ! কিফাতুল্লাহ!
সোনাফর,আইয়েচি,আমি আইয়েচি সোনাফর। ঝড়-তুফান বড় লাগিচ্ছি।
কিফাতুল্লাহ্! নাও পাঠামু, কিফাতুল্লাহ্?
গুদারা নৌকায় পার হতিচি সোনাফর।
কিফাতুল্লাহ্, জলদি কর না রে বাবা!
গণক পেয়েচি। সঙ্গে লইয়ে এয়েচি। বেশুমার গণকরে বাবা! বিশ্বাস করো, আমি ক’লাম কতিচি।
বল, বল কিফাতউল্লাহ্ জলদি কর, আর ত্বর সইছে না।রাজা মশাই সব ভেঙেচুরে মিসমার করে দিলো।
এই দেখো গণক এনেছি… কলাম… এই দেখো। প্রফুল্ল মেধাকর সপ্ততীর্থ মহাশয় বড় এয়েছেন।
গণক: গ্রহ-নক্ষত্র অভিক্ষেপ করতঃ দেখতে পাচ্ছি চার বিবাহ- আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ যথোচিত অভ্যর্থনাপূর্বক কন্যাকে সুচারু বস্ত্র আচ্ছাদনে বিবাহ বিহিত- প্রাজাপাত্য বিবাহ-ই এমত ভূষণে সিদ্ধ, কিন্তু দৈব বিবাহের যোগ অগ্রবর্তী।
যজ্ঞে তু বিততে সম্যগ ঋত্বিজে কর্ম কুর্বতে।
অলঙ্কৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে।।
নয়া ভার্যা নতুন স্ত্রী সহযোগে রাজার পুত্রযোগ।
গণক প্রফুল্ল মেধাকরের মন্ত্র জিহ্বানিঃসৃত হতে যা কিছুটা সময় লাগে- কিন্তু কোন কালক্ষেপ না করে আস্তাবলের ঘোড়া সময়ের পিঠে ভাঙে বিদ্যুৎ চিঁহি, ঘোড়া ছোটার আওয়াজে চারদিকে মুহূর্তে শোরগোল পড়ে যায়।
ঘোড়সওয়ার: ডানদিকে হলো খোঁজ।
ঘোড়সওয়ার: বামদিকে ধাও।
ঘোড়সওয়ার: বামদিকে ছাইপাশ।
ঘোড়সওয়ার: উত্তরে চাও।
ঘোড়সওয়ার: উত্তরে ফক্কা।
ঘোড়সওয়ার: দক্ষিণে পাও।
ঘোড়সওয়ার: নাই ছক্কা, নাই ছক্কা
সবদিকে ফাও।
সম্মিলক:
খোঁজ, খোঁজ ধাও, ধাও
কোনদিকে রাণী পাও
চাও, চাও, ধাও ধাও।।।
হ্যাঁ রে, আহা রে, বাহ্! বাহ
কোন ঝলকানি দেখো না-কী!
বোধ করি, চোখ খুলে দেখো দেখি।
ওই যে ওই নদীর ঘাটে, একা বধু যায় হেঁটে;
কপাল এবার খোলে বটে- যাও ছুটে বোটে ঘোটে-
বের করো দড়াদড়ি তরোয়ালখান,
তুলে নেবো বউটারে রাখি রাজার মান।
একদল ঘোড়সওয়ারী রাজার লোক চাবুক হেঁকে অশ্ব ছোটায় নদী পাড়ের দিকে।
চারদিক ঘেরাও করে ছুটি গাঙ্গের পাড়
দাঁড়াও কন্যা, রোখ যাও পানির কিনার।
না, না, কে তোমরা!
পথ আগলে আমার দাঁড়াও
আমার বাড়ি ইচুনবিচুন
ঘোড়াগুলি সরাও!
তুমি বড়, কপাল খোলো তোমারো আমারো
রাণী হবা রাজার বাড়ি ইচুনবিচুন ছাড়ো!
না না পথ ছাড়ো, যাবো আমার ছনে বানানো বাড়ি।
এই জেনানা খামোশ! খোশ দিলে পরো রাণীর শাড়ি।
আমার বাড়ি ইচুনবিচুন ছাড়ো চুলের মুঠি
সৈন্য সামন হাঁকাও ঘোড়া রাজবংশের খুঁটি।
চিঁহি চিঁহি চিঁহি!
ঘোড়াদের প্রাণপণ চিঁহিধ্বনি আর শেষ হয় না,
ডাঙ্গুলি খেলার কাঠির মত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।
ঘোড়ার চিঁহি বেশিক্ষণ ফাঁকা মাঠে সর্দারি করতে পারে না, তাদের মুখের উপর একটি প্রতিপক্ষ গড়ে ওঠে: বাতাসের ক্ষিপ্রতায় শাঁইশাঁই দৌড়ে আসে ষাইটা, ধুলিয়ান খানের দহলিজ পর্যন্ত আসে; এসেই বাঘের হুঙ্কার ছোঁড়ে- আমার তাজিরণ কনে- বল নাফরমানের দল, আমার পরিবার তাজিনরে কোথায় রাহিছিস?
রাজার পাইক: ধুর চাষা সর সর, রাজার উঠানে আসি আবোলতাবোল বকিস কোন কারণ! তোর মরার ডর নাই!
ষাইটা: তোরা আমার তাজিরনরে তুলে আনিছিস, বল পেয়াদার দল, কোথায় লুকাইছিস তারে!
পাইক: শোন। শোন, দেখো দিনি হাঃ হাঃ হাঃ। শোন, শোন, মুনি মুনিষ্যির বাক্যি শোন শোন! তোর তো কপাল খুলি গেছে। কপালের গোড়ায় হাত দিয়ে দেখো দিনি- তোর বউ রাণী হয়া গিছি! তুই এখন রাণীর ধোয়া মোছা খালিও দিন চলি যাবা হাঃ হাঃ হাঃ। দেখো দিনি!
ষাইটা: মাথা দুই ফাঁক করে ফালামু কলাম- আমি সাচ্চা লাঠিয়ালের পো।
পাইক: একটা ছেমরিকে তুলে আনিছি বটে, কিন্তু বেটি তোর নাম বলে নি যে তুই তার আই।
ষাইটা: সে বলিছে, চিৎকার করে করে আমার নাম বলিছে।
পাইক: হাঃ হাঃ হাঃ। ললনা বলে কী-
তিন তেরো দিয়া বারো
নয় দি আনি পূরণ করো
আমার স্বামীর এই নাম
পার করি দাও নাইওর যাম।
ষাইটা: হ, হ, হ। আমার পরিবার ইভাবেই আমার নাম কয়- আমিই তার স্বামী ষাইটা।
পাইক: হাঃ হাঃ হাঃ।
ষাইটা: হাসো কেনি হালার পো। আমার তাজিরণকে বার করি দে। মাথা ফাটাই দিমু কলাম। আউ… আউ..আউ।
অতঃপর ষাইটা রাজার পাইকপেয়াদার সঙ্গে তুমুল লাঠি মারামারিতে অবতীর্ন হয়।
ষাইটা প্রতিরোজ এ-পথেই যাওয়া-আসা করে। সে-যে আহামরি রাশভারী ভীষণ একজন লোক তা-ও নয়। অতি সাধারণ; ওই পাকুড়গাছের নিরিবিলি ছায়াটুকুর মতোই নিরহংকারী আর শীতলস্বভাব। কিন্তু বেঙ্গমী, আজ কী হলো বলো তো- চাষাভুষা লোকটাকে এতো পেরেশান আর মারমুখো মনে হচ্ছে কেন?
বেঙ্গমি, বেঙ্গমি। তোমাকেও আজ দেখি বড়ো ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ মনে হয়- এক ডাল থেকে আরেক ডালে কেবলই তড়পাচ্ছো, লাফ ঝাপ মারছো- মনে হচ্ছে, তোমার মধ্যেও একটা ছটফটানি দেখতে পাই!
আমি জানি, বনের, রাজ্যের সব্বাই জানে- তুমি এক আলসের নাটাই, খুঁড়ের বাদশা- খালি পড়েপড়ে ঘুমাও; কাজকাম কিছু করতে হয় না- এই দাসী তো রয়েইছে। সংসার, জগদ্দারি সব আমিই করি। দেখো, বনের পাখপাখালির মধ্যে কেমন একটা চিন্তাচিন্তা ভাব- বেমালুম দুঃসংবাদ আছে!
কী হয়েছে গা বেঙ্গমি, জলদি বলো- মন উচাটন, বলো, বলো-
ওই যে প্রতিদিন সকাল-বিকাল দেখতে না কিষকের বেটি- চাষাভুষার বৌটা কলসি কাঁখে নদীর ঘাটে জল আনতে যেতো?
জানি তো, আলবৎ জানি- রাতদিন ঘুমিয়ে থাকলেও এই কথা জানি হে- কেমন করে হেঁটে যে যায়- সুতী শাড়িপরা, কোমরও খানিকটা দোলায়!
ওরে ও মিনসে, আমি তো জানি আমার মিনসে খালি ঘুমায়, এখন দেখি- ভিতরে ভিতরে বজ্জাতের আঁটি- সব দ্যাখে!
কী হয়েছে তাই বলো!
সেই চাষার বৌটাকে আজ রাজার লোক ধরে নিয়ে গ্যাছে।
বলো কী, তাই না-কী!
চলো, চলো, জলদি করো- রাজার বাড়ির দিকে একচক্কর মেরে বউটার খোঁজ নিয়ে আসি।
চলো, তাই যাই চলো।
বেশ কতকটা ওড়াউড়ি করে বেঙ্গমা-বেঙ্গমি রাজার বাড়ির অন্দরমহলের ঘুলঘুলিতে এসে বসে।
বেঙ্গমি, বেঙ্গমি, এতোক্ষণ অবধি বাতাসে গোত্তা খেয়েখেয়ে এদ্দূর এলাম বটে- রাজার বাড়িতে নোতুন রাণী এলো- রাজা পুত্রসুখে উল্লাস করবে, রাজকুমার আসবে- কিন্তু কোথায় কী- ফুর্তিবাজির উল্লাস মাতামাতি কই? সবকিছু এমন গম্ভীর কেন?
চুপ, একদম চুপ! কথা বলো না, জোরে শ্বাস ফেলো না- লেজ আর পাখনা ঘষাঘষি করে যেন খসখসে আওয়াজ না তোলে- দেখো, দেখো, আগের রাণীমা কেমব রাগে কটমট করছে!
কে জানে- কী জানি হয়, অবস্থা ভালো ঠেকছে না।
বেঙ্গমি, কেবল আজ যে রাজবাড়িতে গুমোট দেখতে পাচ্ছি ঘটনা এখানেই শেষ নয়- আমি ভবিষ্যৎ দিনকালও ভালো ঠাহর করছি না- বড় আইডাই লাগছে। মাস কয় পর আবার এসে দেখবো ক্ষণ রাজার পুত্র লাভের লক্ষ্মণ দেখা যায় কী-না, আজ চলো যাই।
ঠিকই কয়েছো, বিষয়পত্র ভালো ঠেকছে না- পরে আসবো- চলো, চলো, আজ উঠি চলো।
বেঙ্গমা বেঙ্গমি ভবিষ্যতের আশা- নিরাশায় বনের দিকে উড়ে যায়। ওরা নিজেদের কায়কারবার, ওড়াউড়ি, খুনসুটির ভিতর রাজবাড়ির অন্দরমহলের কথা একপ্রকার ভুলেই যায়। মাস আটেক নয়েক পর হঠাৎ বেঙ্গমির পেটেই কথাটি গুরগুর করে ওঠে।
বেঙ্গমা, কিগা বেঙ্গমা!
কী, কী হয়েছে গো!
সব ভুলে একেবারে কাঠ!
কেন, কী হয়েছে?
রাজাবাড়ির কোন খোঁজই নিচ্ছি না- কেমনতরো প্রজা হলাম মোরা?
তাই তো, তাই তো, এক্ষুনি চলো।
আঙিনায় এসে বেঙ্গমা-ই প্রথম মুখ খোলে- মেলাদিন পর এসে তোমার কেমন ঠেকছে বেঙ্গমি বলো তো দেখি? আমার মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি কিছুটা হালকাহালকাই পেটাচ্ছে। বাড়ির উঠানে দেখো একটু লঘুচিত্তের নিত্যও হচ্ছে, না হয় বলছি কী!
হ্যাঁ গো হ্যাঁ, রাজার ছাওয়াল হবে যে! তারপরও আমার অতোটা ভালো ঠেকছে না, বলি কী- আমার কেমন কেমন জানি লাগছে। গানটা যদিও হচ্ছে বটে।
পাটিশাপটা মিঠামণ্ডা ধুম পড়ে উঠানে
চুপ থাকো তেড়িবেড়ি ছিঁড়ে খাবে দু’টানে।
সারে সারে জবে হয় খাশি আর মহিষা
রুইমাছ ভাজা হবে শৌল আর খলিশা।
পোলাপানে সার গায় তিনকুড়ি চোঙ্গা
জিলাপি ও সন্দেশে ছিঁড়ে পড়ে ঠোঙ্গা।।
রাজার লোক, উজির নাজির, অমাত্য, মন্ত্রী, খানসামা আর বাবুর্চি, চাশনিগীর মিলে চলনে, বলনে, কানাঘুষা, হাসিঠাট্টা, মশকরায় পরিবেশটা কেমন মৌমৌ করছে!
তার মধ্যেই দেখো দেখি নি বাড়ির কিনারা ঘেঁষে এক বেকুব বৈদেশী পণ্ডিতপ্রবর- এক ত্রিকালদর্শী ইতিউতি আনাগোনা করছে! লক্ষ্মণ ভালো নয়- বিলকুল মন্দাক্রান্ত অশনি সংকেত আঁচ করি, নাকে কীসের বুঁই এসে লাগে। বিদেশী মন্ত্রখোর পণ্ডিত- চুল উসকোখুসকো, মুখশ্রী ব্যাদান, অস্থির দৌড়ঝাঁপ পায়চারি খামোশ, থামান!
চিত্ত কেন ব্যাকুল পেরেশান, ঘনঘন পদবিক্ষেপ, মন কেমন আইডাই- তার তড়িৎ সোজাসাপটা ব্যাখ্যা চাই।
পণ্ডিতপ্রবর: যদি নির্ভয়ে বলার অনুমতি পাই, ভৎর্সনা না শুনি, ঘাড় থেকে গর্দান না খোয়াই তাহলে রাজার অন্দরমহলে পৌঁছে দেবার নিমিত্ত কথাটা পেট থেকে উগড়ে জিহবা, জিহবা থেকে টোকা দিয়ে ছুঁড়ে দিতে পারি সকলের সম্মুখে। হ্যাঁ হ্যাঁ পারি, কথাটা উগড়ে দিতে পারি- বাতাসে।
রাজার লোক: তিলেক দণ্ড ভয় নাই, কোন ভয় নাই।
পণ্ডিত: গা ঘামে ভিজে, কথা খুঁজে পাই না কন্ঠের মাঝে।
রাজার লোক: আর বিলম্ব সইছে না- হরহর করে বলে ফেলো পণ্ডিতপ্রবর।
পণ্ডিত: তবে তাই করি, তাই করি তবে। আমার দিব্য চোখে একটা পরিস্কার দোটানা, খটকা দেখতে পাই। নোতুন রাণীর ঘরে সন্তান হবে, ঘটনা সত্যি- সন্তান হবে।খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের মতো সত্যি।
রাজার লোক: তা জানি, জানি; আকাশ জানে, পাতাল জানে- এ খবর সবাই জানে, কী দুঃসংবাদ দেখো তাই বয়ান করো স্বচ্ছ পরিস্কার মনে!
পণ্ডিত: রাজার সন্তান দেখতে পাই।
রাজার লোক: হ্যাঁ দেখতে পাও।
পণ্ডিত: পুত্রসন্তান- বেটাছেলে- বিবরণ হাচাই, তা-ও দেখতে পাই।
রাজার লোক: চুপ হারামখোর, খামোশ বেতমিজ।
পণ্ডিত: জি জি।
রাজার লোক: আর ধৈর্য সইছে না। কী দেখতে পাও না- কী বিষয়ে অমানিশা ঘোর, বলো, তাই বাতলাও।
পণ্ডিত: রাজপুত্রের পিতৃপরিচয় চাক্ষুষ দেখতে পাই না- কেমন ধুয়াশা কুয়াশা লাগে!
রাজার লোক: ত্রিকালদর্শী পণ্ডিতপ্রবর, তুমি কী বলছো- তুমি জানো?
পণ্ডিত: জি জি আগাপাশতলা জানি, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে জানি।
রাজার লোক: মুহূর্ত বিলম্ব নয়, এক্ষুনি বলো।
পণ্ডিত: জল খাবো, পানি খাবো!
রাজার লোক: পরে হবে।
পণ্ডিত: জানি, জানি। রাজকুমারের পিতৃপরিচয়: দোলাচল, নয় স্থির নির্দিষ্ট। যে-কোন একজন।
রাজার লোক: সে কোন জন?
পণ্ডিত: হতে পারে চাষাভুষা ষাইটা। হতে পারে রাজা ধুলিয়ান খান। এ বড় এক লম্বালম্বি অমীমাংসা- ষাইটা অথবা ধুলিয়ান খান!
আকস্মিক অন্দরমহল থেকে রাজা আসেন।
রাজার লোক: রাজা নামদার!
ধুলিয়ান খান: শুনেছি। আমি সব শুনেছি- আহ্! ভারী পর্দা এক বিন্দুবিসর্গও বাধা দিতে পারে নি। সবকথা শুনেছি। আর বিলম্ব নয়। আরো মায়া বসার আগে – আজ সন্ধ্যায় নোতুন রাণীকে বনসত্র আর খাড়াইয়ের কিনারে শক্ত গদামুগুরের আঘাতে তার গর্ভপাতের ব্যবস্থা করো। হবে না- এ দিয়ে কাজ হবে না শান্ত্রী। আমার দরকার পরিপূর্ণ, নিঃসংশয় উত্তরাধিকার একটি পুত্রসন্তান। একমুহূর্ত বিলম্ব নয়। চাষীর বেটিকে এক্ষুনি টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাও- এক্ষুনি!
অতঃপর পিছনে ঢোল বাজে, ঝাঁজর বাজে। একটি শীর্ণকায় নদীর পাড় ঘেঁষে ছোটরাণী তাজিরনকে মহিষের গাড়িতে তোলা হয়। পথ ভাঙা, বাঁকা সড়ক।
দুই গাড়িয়াল ভাই মনের ভুলে মনের কাছে হেলেঢুলে পড়ে। তারা জানে না কখন ফাটাফাটা মাটি, নির্দয় নিশানায় দুই গাড়োয়ানের দেহকল ঝাঁকি দিয়ে ওঠে, আর কোন বা দেশের ব্যথার টানে গানে গানে ডোবে :
মনে আমার লক্ষ রে তারা বিলাপ করে জ্বলে
নদী হয়ে ছিলাম আমি চিতলডুরীর বাঁকে,
মাছগুলি তার লতাপাতা পা জড়িয়ে থাকে।
ধুলায় উড়ি তোমার আশায় হাওয়া ধরার কলে
মনে আমার লক্ষ রে তারা বিলাপ করে জ্বলে।।
তুমুল বাদ্য বাজে। কানফাটানো বাজনা- সম্মিলিত চিৎকার, আতঙ্ক হৈচৈ, তারমাঝে ছোট রাণীকে নিয়ে রাজার লোক, পাইক, শান্ত্রী, জল্লাদ- তারা সকলে নির্ধারিত জঙ্গলে খাড়াইয়ের পাশে এসে পৌঁছায়।
চোখবাঁধা জল্লাদ,বা গদাহাতে রাজকর্মচারী, বা পাথর হাতিয়ারসমেত রাজার লোক ছোটরাণীর গর্ভবতী পেট খালাশে প্রস্তুত।
ছোটরাণী তাজিরনের সামনে কেবল একটি নিরেট সিদ্ধান্ত- ধুলিয়ান খানের অনড় আদেশ! চোখে পানি নাই, পানি সামান্য যা আছে খালি বিলের উপর। কোন বিচলন নাই, যেমন একখণ্ড পিতলের পাতে একটি চাক্ষুষ আঘাত- শুধুই একটি আওয়াজ- টং!
মুহূর্তকালেই তাজিরনের পেটের বাচ্চাটিকে এক আঘাতে নামিয়ে ফেলা হয়। পিতলের পাতের মতোই তাজিরন খালি একটি অলঙ্কারবিহীন সামান্য আর্তনাদ করে ওঠে- আহ্!
সঙ্গেসঙ্গে একদলা মানবশিশু উপর থেকে শাঁই করে খাড়াইয়ের নিচে গর্তের দিকে পড়ে, কিন্তু আশ্চর্য কী- একটি ময়ূর শাঁৎ করে একদলা শিশুটিকে তার পাখার ওমের ভিতর তুলে নেয়।
এদিকে রাজা ধুলিয়ান খানের দরবার উত্তেজনায়, ধমকে ধামকে অস্থির।
রাজার লোক: কী মুশকিলে পড়া গেল বলো দেখিনি!
রাজার লোক: কী ঘটেছে, কী তার বিবরণ!
রাজার লোক: বন্দীশালায় চাষার পুত ষাইটা- গলাকাটা মুরগী বুঝি ছটফট করে,গরাদে মাথা ঠোকায়।
রাজার লোক: ষাইটা তো জানবার কথা নয় যে, নয়া রাণীর গর্ভ খালাশ করা হয়েছে! নিশ্চয়ই কেউ না কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করছে।
রাজার লোক: ষাইটা বলছে- সে স্বপ্নযোগে দেখে শুনতে পায়- কেউ ছোটরাণীর পেটে আঘাত করে, আর রাণী তার নাম ধরে চিৎকার করে! কী তাজ্জব ব্যাপার বলো দেখিনি!
ধুলিয়ান খান: কী ব্যাপার, এতো চিৎকার, চেঁচামেচি কীসের? আমি চাই- সবাই আগাগোড়া চুপ রও- তরবারির ধারের মতো ঠাণ্ডা।
রাজার লোক: অতি অবশ্য। জি বিলকুল।
ধুলিয়ান খান: আশা করি, রাণীকে বনে নেবার পথে কেউ বাহাদুরি ফলায় নি, পথ আটকে দাঁড়ায় নি- কেউ কর্মসম্পাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি করার হিম্মত দেখায় নি।
রাজার লোক: না রাজা মশাই, বাহাদুরি ফলাতে কেউ আসে নি- কাজ হয়েছে ষোল আনা। অভিযান সুসম্পন্ন।
ধুলিয়ান খান: রাণী এখন কোথায়?
রাজার লোক: বিবেচনা করি, দরবারের পথে ফিরে আসছে সকলে।
ধুলিয়ান খান : রাণীর সেবাশুশ্রূষার যেন অন্যথা না হয়। সেরা বৈদ্য ডাকো, সর্বোত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা নাও, রাণী যেন দ্রুত ক্ষত সেরে ওঠে।
রাজার লোক: আলবৎ। ষোল আনা। সব ব্যবস্থা পাকাপাকি এই মুহূর্তে। এক্ষুণি। সামান্য অন্যথা হবে না, একচুল চব্বিশ-পঁচিশও গ্রাহ্য হবে না- আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন। আপনার পারিষদ-সুশক্ত আজ্ঞাবাহীর দল।
রাজা জানে না রাজা শোনে না
রাজাবাড়ি ভাগ হয় সমানে সমান।
রাণী আসে রাজবাড়ি, কুমার হয় বনের পালৈ
রাজবাড়ি সুনসান জঙলায় ময়ূর সাপ ঘুঘু হৈচৈ।
রাণী তড়পায়, বনে কুমার পরাণ
রাজবাড়ি ভাগ হয় সমানে সমান।
রাজা জানে না রাজা শোনে না
রাজবাড়ি ভাগ হয় সমানে সমান।।
অতঃপর বনের নাগরিকগণ- ময়ূর, ময়ূরী, শজারু, ঘুঘুপাখি, কাঠঠোকরা, অজগর, হরিণ-হরিণী, আরো বনপঞ্চায়েতের সবাই- ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি, দাদা-দাদু, পিসিমা, জেঠিমা, খালা-খালু, ঠাম্মা, জাম্বু, শ্যালক-শ্যালিকা, বিয়াই-বিয়াইন সকলে আনন্দে উল্লাসে, নীরবে, চিৎকারে বলাবলি করে, সুযোগ পেলেই বন্দনায়, নৃত্যগীতে মাতে।
আর তারমধ্যে হঠাৎকরে যদি অন্য বন থেকে কোন অতিথি এসে ওঠে, বা ধরুন, বলা নেই কওয়া নেই কোন মনুষ্যসন্তান এই বনাঞ্চল এলাকায় চলে আসে- তাহলে তো দুনিয়া মিসমার, দুন্দুমার ব্যাপার ঘটে: অতিথিকে হাতের নাগালে বসিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে তারা ফয়সলের বৃত্তান্ত খুলে ধরে:
ওখানে, ওইখানে, রাজার লোকেরা- সৈন্য সামন্ত, পাইক পেয়াদা- ওরা তো খাড়াইয়ের উচ্চতায়- শীর্ষে, মাথায়! রাণীমা আস্তেধীরে চলেন- পোয়াতি, জননী গো, পেটে তার ঝিনুকের মুক্তা। তিনি যে ধাত্রী- জগতের মা। অনাগত রাজকুমার- সেই তার কাল হয়, আহ! রাণীমা সমস্ত অসহায়তা নিয়ে স্তব্ধ, তার গর্ভধারিণী পেট উন্মুখ, একটি নীরবতা একটি কোলাহল প্রস্তুত, রাজার লোক- তার গদামুগুর প্রস্তুত। মুগুর আকাশে উত্থিত হয়- একটি মুক্তাভরা সিন্দুকে- গর্ভবতী পেটে এসে পড়ে- ধাম! আকাশ থেকে একদলা মাংস- এক রাজার কুমার পাতালের দিকে ছিটকে নামে। একমাত্র বিধাতাই জানে মুহূর্তে খাড়াইয়ের ঢালে এতো ময়ূর কোত্থেকে এসে নামে। একটি নাদুসনুদুস বলবান ময়ূর একঝটকায় লাফ দিয়ে পেখম তুলে উড়ন্ত মাংসপিণ্ড পাখের ওমের ভিতর তুলে নেয়। আর তখনই উপরওয়ালার কী কুদরত- এক মনুষ্য শিশু কেঁদে ওঠে- ওঁয়া!
রাজার লোকেরা তেড়ে এসেছিল বটে, কিন্তু এ-তো বনাঞ্চল- আমাদের রাজত্ব, ময়ূরকে আর পায় কোথা?
তারপর থেকে সে ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই, কিংবা পিসতুতো মাসতুতো ভাই, কখনো কখনো এক্কেবারে সোদ্দর ভাই। আমাদের সঙ্গেসঙ্গে বেড়ে ওঠে- আমরা খানিকটা মোটাতাজা হই- সেও তাই, আমাদের শরীরে কালি পড়ে- যদি একটু মিইয়ে যাই- ফয়সালও কেমন রোগা-সোগা হয়ে পড়ে- ঢেঙ্গা দেখা যায়। এভাবেই কোনদিক দিয়ে ফয়সাল সোমত্ত হয়ে ওঠে:
এক্কাদোক্কা হাসি খুশি
দোলন দালন গায়।
ফয়সাল দেখি ইচুন বিচুন
মোচড় দিয়া চায়।
আহা কেমন ফুলকলি চমকায়
হাওয়ার ঢঙ্গে বাঁশি কে বাজায়।
এক্কাদোক্কা হাসি খুশি
দোলন দালন গায়।।
আমরা ফয়সালের সাথে হাসিঠাট্টা মশকরায় কথা বলাবলি করি-
ঠিক করে কওতো দেখিনি বাপু- তুমি কে গা? তোমাকে দেখে ঠাহর করি, তুমি শিকারীর ছাওয়াল, হাতে-কাঁধে সারা দিনক্ষণ তীর ধনুক- তুমি কী আদতে সাঁওতালের পো- কও দেখিনি!
ফয়সাল: তোমরা যতো কথা-ই বলো আমায় ওগো সখা-সখীগণ, বলো, বলো আমায়- কোথা গেলে পাবো স্বপ্নে দেখা আমার এক মধুমালার মন!
পাখপাখালি:
বলো, বলো, বলো আজ
আমাদের মন খুলে বলো,
কী-বা নাম ধাম, কাহার লাগি
করে তোমার মন ছলোছলো!
ফয়সাল: ভুলে গ্যাছি, সব ভুলে গ্যাছি বেমালুম। খালি মনে পড়ে একটি মায়াহরিণ নদীর জলে মুখ বাড়ায়।
পাখপাখালি: কীভাবে হয়, কীভাবে কুমার- স্বপ্নে, না জাগরণে হয়?
ফয়সাল: বেমালুম হারিয়ে গ্যাছি- ভুলে গ্যাছি বেবাক কথা। কেবল একটি সুর প্রাণে উতলা বাজে।আমি স্বপ্নে দেখি, না স্বপ্ন আমাকে দেখে তা-ও জানা নাই। মায়াহরিণ, মায়াহরিণ, নদীর কিনার ধরে এক মায়া হরিণ…
ফয়সাল বুঝি এক বনাঞ্চলে, ঝিলের ধারে চন্দ্র নাম মায়াহরিণের সাথে খোয়াবে,গানে, ভাবে-নির্ভাবে অতলে ডোবে:
চন্দ্র:
নদীর পাড়ে তারা ফুটি ছায়া মনের ভুল।
ফয়সাল:
ঢেউয়ের মেয়ে ভুলের ধামে মনে চম্পা ফুল
তিন সন্ধ্যায় তারা ফুটো দীঘল নদীর কূল।
চন্দ্র:
নদীর পাড়ে তারা ফুটি ছায়া মনের ভুল।
ফয়সাল:
সব হারাইয়া খুঁজি আমি বন্ধু বটের মূল
মেয়ে না-কী মায়াহরিণ ভেবে হই আকুল।
চন্দ্র:
নদীর পাড়ে তারা ফুটি ছায়া মনের ভুল।।
কথাকার: ওই খোয়াবের পরে, এ-মতো তিনসন্ধ্যার তারাফুল, মায়াহরিণের পথ হারানোর পরে ফয়সালের সামনে বুঝি আর কোন বনাঞ্চল থাকে না- তামাম দুনিয়া এক মাকড়সার জালের ধুয়াশায়, কুয়াশায়, কুহক মায়ায়, যাদু সংকেতে আড়ালে আবডালে বয়।ফয়সাল বোঝে ফুল নয়, তার রঙ নয়- গোপন তার অদেখা গন্ধ, সুবাসই আসল ফুল।
ফয়সাল: আমি কে- তার উত্তর তো আমি জানি না। কেবল জানি শিকারের জন্য হাত নিশপিশ করে, হতে পারে শুধুই শিকার, নয়তো শিকারের চেয়েও বড় কিছু। কিন্তু কী করি বলো দেখি! কার দিকে, কার উদ্দেশে তীর ছুঁড়ে মারি? তোমরা সব পাখপাখপাখালি- বনের সাধারণ- আমার ভাইবোন। দেখো, আমার তীর বিষমাখানো অস্ত্র নয়- ময়ূর পাখের তীর। হাতের নিশানা ঠিক করার জন্য নিরুদ্দেশে ছুঁড়ে মারি। আকাশের কোন এক শূন্য বিন্দুকে লক্ষ্য বানাই- তারপর যা যা যা তীর শূন্যে আগুন লাগা- শূন্যে মারি ঘাই। তীর কোথায় গিয়ে পড়ে, কার আমপাতা জামপাতা বুক বিদীর্ণ করে তার হিসাব জানা নাই।
পড়ে,পড়ে, পড়ে, ফয়সালের নিক্ষিপ্ত আকাশব্রহ্ম তীর কারো পাখিআকীর্ণ বুকের পাশে এসে পড়ে! নদীর আঙিনায় চন্দ্রনাম যে একটি মেয়ে তার বক্ষে এসে বিঁধে।
শীর্ণকায় এক গাঙ্গের কোল বরাবর বিচরণ করে যে চন্দ্র তার প্রজাপতি হিয়ায় মেঘবিহ্বল সুরে বুকের বামপাশে ময়ূর পালকের তীর এসে বিদ্ধ হয়। মুহূর্তে চন্দ্র ভুলে যায় সে চন্দ্র, ভুলকরে সে বুঝি হঠাৎ একটি পাখি হয়ে যায়- ময়নাপাখি, না-কী হয়ে পড়ে বাতাসে কম্পনশীল একটি পাতামাত্র; চোখের পাতা, না-কী তারা একটি- যে কোন কারণ ছাড়াই কেবল মিটমিট করে জ্বলে! চন্দ্র বোধ করে সে আর কোন আয়তন নয় আর, না কোন ফুল, না ফুলের পাপড়ি; ময়ূর পাখের সংহারে সে এখন রঙেরও অধিক এক গন্ধের ঢেউ, সুবাসের মোচড়ে মৌমৌ!
তারা ওড়ে তারা ঝরে
তারা উজায় ঘরে।
রঙ ফকিরি আঁধার নাচে
মন ভুবনের পুরে।
তারা ওড়ে তারা ঝরে
তারা উজায় ঘরে।
তীরের মাথায় জবা ফুল
হিয়ার ঢালে পড়ে।
তারা ওড়ে তারা ঝরে
তারা উজায় ঘরে।।
তীরের বেশে চন্দ্রবালার পাশে যে ময়ূরের পাখ এসে পড়ে- তাদের নিয়ে হৈচৈ অঙ্গে জড়ায়, খোঁপায় পরে, চকিতে চন্দ্র তার বনসঙ্গীদের সাথে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে।
রাখালিয়া বাঁকা পথ বুঝি হ্রদ- তার মাছমাছালি, রাখীবন্ধনে জড়াজড়ি গাছগাছালি, চুলেচুলে রঙিন ফিতার গিঁট পাখপাখালি- তারা সকলে আমার ভাইবোন। কেউকেউ যেমন চিতল, মৃগেল, কাতল, বোয়াল আমার বড় বোন হয়- আমি তাদের বুবাই বলে ডাকি; ডানকিনা, পাবদা, তিড়িংবিড়িং পাটেশ্বাড়ি আমার ছোটবোন হয়, তাদের আমি ধমক দিয়ে শুধাই। এমনদিনে মনে হয়, দুনিয়াজোড়া সরিষাফুল ফুটে আছে আমার লাগি- ফলে সখীদের কাছে আসতে হয়, তোমরা কে কোথায়- আমার মনের মানুষ প্রাণের সখী বেঙ্গমা-বেঙ্গমি শোন, শোন, আমার মনে ঝলমল রঙ্ধনুর কথা শোন।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি: জানি, জানি গো বৃত্তান্তের সবকথা-ই জানি। তীর হয়ে ময়ূর পাখা কেমনকরে আসে, শোন তবে সেই কথা-ই টানি।
এক কুমার- কী তার দৌলত, কী-যে তাকদ, ময়ূর কোলে পাখপাখালির মোকামে বড় হয়। দেখলে মনে হয় সাঁওতালের বেটা গো। বুকখান এমন চওড়া বিঘত যেমন তিনবিঘা জমি- কী তার চুলের বাহার, হাতে বাজুবন্ধ- সেই বলবান হাতে ফয়সাল নাম কুমার- যেই না তীর ছুঁড়ে মারে- সেই তীরে বিষ নাই, মরণ নাই- কী আছে? আছে, আছে- আছে হাওয়া শিহরনের মৌ, আর সোহাগের উপচানো বাটি!
সখী, সখী, বলো- কী তার পরিচয়?
দিনেদিনে বুঝে নিও সই। তুমিই হেলোঢলো কলমির লতি!
ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমি: চল, চল ফুরুৎ করে যাই। কুমারকে গিয়ে বলি যে- তার তীর দুধে-আলতায় রাঙা হয়েছে। হিঃ হিঃ হিঃ। হিঃ হিঃ হিঃ। চল চল, কী যে করি সই- হাসি পায়, আর চোখে পানি আসে ছাই।
ময়ূর পাখের তীরে সখী ফুলের মৌ বাটা
নগরে কী জঙলা বাড়ি যমুনা নদীর ঘাটা।
ঘুম জড়ানো আকাশ জুড়ে নিদ্রাবিহীন রাতে
কে আসে যায় জলের ঘাটে মনতিরতির প্রাতে!
চিত্রাহরিণ গঙ্গা ফড়িং চন্দ্র বানের পা-টা
নগরে কী জঙলা বাড়ি যমুনা নদীর ঘাটা।।
বনের সাধারণ কৃষিজীবী- বনমোরগ, উদবিড়াল; শিল্পজীবী ময়ূর, টিয়াপাখি, হয়তো বা একখান অজগরও আশেপাশে; শিয়াল, সজারু সহযোগে ফয়সাল- গভীর ধ্যানাকীর্ণ তীরন্দাজি মহড়ায় নিষ্ঠ।
ফয়সাল বুঝি অন্তর্হিত, তাকে দেখা যায়, কিন্তু আসলে হয়তো কারো নির্দেশে, কারো প্রার্থনায় নাই হয়ে যায়।
ফয়সাল: ওই যে দেখো- ফয়সাল, একমনে একপ্রাণে চোখ নিবিষ্ট করে। দীর্ঘ, সুউচ্চ গগণশিরীষ মেলা দূরে ওই যে- সবগুলো গাছের সারি পার হয়ে দৃষ্টি স্থির করার পর গোচরে আসে গগণশিরীষ- একা, নির্ভয়; আছে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে, সেই বৃক্ষের শীর্ষদেশ- শীর্ষদেশেরও উপরিভাগ- গগণশিরীষের পাতাটি তিরতির করে- মোটেও স্থির নয় সে- কম্পমান উত্তুঙ্গ পাতা- আমার তীর ছিন্ন করবে সেই একা দূরবর্তী তিরতিরানো পাতাটির বুক! ওহ! কে আমার ধ্যান ভাঙে- এ কার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ!
ফয়সালের আশপাশের পাখপাখালি ও বননাগরিকদের মধ্যে এক ত্রস্ততা,উদ্বেগ, কানাকানি ছড়িয়ে পড়ে।
তাই, তাই তো!
সত্যি, তিন সত্যি, হাচাই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ।
আরো যে এগিয়ে আসতে শুনি।
কে আসে?
কারা আগায়?
সবাই দাঁড়াও, তৈরি হয়ে নাও, একাট্টা খাড়াও- কে কোথায়!
ভয় নেই, যে আসে আসুক, আসতে দাও- ঘাড়ের উপরকার শির ফেলতে দাও!
দুই ঘোড়সওয়ার ব্যাকুল,পেরেশান এই বনসমাশের সামনে এসে উদ্বিগ্ন দাঁড়ায়।
ফয়সাল: ঘোড়চাপকানেওয়ালা, তোমরা এ বনের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছো, উসকে দিয়েছো সুশান্ত প্রাণ- এ সাহস, না দুঃসাহস?
ঘোড়সওয়ার: না সাহস, না দুঃসাহস। আমাদের শক্তি দরকার। প্রাণবায়ু হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। ছোটরাণীর কান্না আর সহ্য হয় না।
ফয়সাল: কে ছোটরাণী, কেন তার কান্না- খোলাসা করে বলো।
ঘোড়সওয়ার: সে অনেক কথা। আপনার এতো সময় হবে? আমাদের হাতেও সময় নিতান্ত কম।
ফয়সাল: হবে, হবে, বিস্তর সময় হবে। নির্ভয়ে বলো।
ঘোড়সওয়ার: ছোটরাণী ঠিক যেমন এক ঘুঘুপাখি- সারাদুপুর খালি বুক চাপড়ায়, আর পুত পুত বলে বিলাপ করে।
ফয়সাল: কোথায় তার ছেলে, কী হয়েছে তার?
ঘোড়সওয়ার: ধারণা করি, অনুমান হয়- তাঁর পুত্র অদ্যাবধি বেঁচে থাকলে আপনার বয়সীই হতো।
ফয়সাল: কীভাবে, কেমন করে?
পাখপাখালি: আমাদের ছেলের সঙ্গে কার কী তুলনা- ভাগো, ভাগো দূর গ্রামের দুই বেটাছেলে- আমাদের ছেলের সঙ্গে কারো তুলনা করো না, কস্মিনকালেও করো না। যাও, ভেগে যাও, চম্পট দাও- ভালো বোঝো তো দূর হও।
ফয়সাল: অনুরোধ রাখি, জোড়াত করি- তোমরা শান্ত হও। আমাকে শুনতে দাও। সবটুকু জানতে চাই।
ঘোড়সওয়ার: সে মেলা দিন, অনেক বছর আগের কথা- ছোটরাণী গর্ভবতী সরস্বতা- আঁটকুড়া রাজা শেষপর্যন্ত পুত্রসন্তানের মুখ দেখবে!
ঘোড়সওয়ার: রাজ্যজুড়ে উৎসব। পাখপাখালি, গাছগাছালি, ছেলেবুড়া, নাতিনাতকর নাচে।
পাখপাখালি: বাহ্! বাহ্! তারপর কী হয়?
ঘোড়সওয়ার: সবই ঠিকঠাক ছিল- বেবাক ঠিকঠাক অবিকল। আগাপিছা নাই- সবই ঠিকঠাক।
ঘোড়সওয়ার: সবকিছু উলটপালট করে দেয় ত্রিকালদর্শী।
ঘোড়সওয়ার: ত্রিকালদর্শী গণক- ফ্যাকড়া তোলে হারামজাদা গণকের বাচ্চা।
ঘোড়সওয়ার: সে আদি ইতিহাস ধরে টান দেয়। ছোটরাণীকে সিপাহী বরকন্দাজরা তুলে আনে নদীর পাড় থেকে। কারণ কী, কী তার ইতিহাস? কারণ অতি সাচ্চা-
ফয়সাল: একটানে বলো ঘোড়সওয়ার। কোন থামাথামি নাই- একনিঃশ্বাসে বলে যাও। একটি কথা মনে রেখো- যদি মিথ্যা বলো, যদি প্রমাণিত হয়- তোমরা আসলে রাজার চর- ঘাড়ের উপরকার মাথা একনিমেষে নাই হয়ে যাবে, বলে দিলাম। এবার একঝটকায় বলো ঘোড়সওয়ার।
পাখপাখালি: কী ব্যাপার, বলো দেখি- ঘটনা ঘোর ঘোর ঠেকে। অমানিশার সংকেত।
পাখপাখালি: এই ঘন জঙ্গলের ভিতর তোমরা কী এক আগুনের টুকরা ঠাসকরে জ্বালো ঘোড়সওয়ারের বেটা, আগুন নিয়ে খেলতে নেমেছো? সোজাসাপ্টা বলো ঘোড়সওয়ার, পথে বড় ভাগ, পথে বিভক্তি, আঁকাবাঁকা- বড় বেদিশায় পড়া গেল!
ঘোড়সওয়ার: গণক বলে, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিধারা, চলাচল হিসাবে অতি সংকট।
ঘোড়সওয়ার: ত্রিকালদর্শী বলে- সন্দেহ নাই, ছোটরাণীর গর্ভে পুত্রসন্তান আছে।
পাখপাখালি: আছে, আছে, আছে।
ফয়সাল: সন্দেহ কোথায় তবে?
ঘোড়সওয়ার: সন্দেহ বড় বিশাল- আজদাহা জটিল।
ঘোড়সওয়ার: সন্দেহ পিতৃপরিচয়ে। রাজকুমার হতে পারে চাষাভুষার পোলা- আবার হতে পারে রাজার দুলাল।
ফয়সাল: কুয়াশার পর্দা আস্তেআস্তে সরে যায়- আহ্, সব পরিস্কার হয়ে ওঠে।
ঘোড়সওয়ার: রাজার নির্দেশে অতঃপর-
ঘোড়সওয়ার: রাজার পাইক, বরকন্দাজ, জল্লাদ।
ঘোড়সওয়ার: রাণীকে নিয়ে বনের গহীনে খাড়াইয়ের উপরে ওঠে-
ঘোড়সওয়ার: রাণীর পেটে গদামুগুর মারে পাইক।
ফয়সাল: বন্ধ করো! ঘোড়সওয়ার ভাই, তারপর আমি সবটুকু জানি। বেঙ্গমা-বেঙ্গমির কাছে, আমার পাড়া-পড়শী পাখপাখালির মুখে, আমার ময়ূর মায়ের কোলে বসে সব শুনেছি।
ঘোড়সওয়ার: আপনি শুনেছেন! আপনি কী শুনেছেন বনের কুমার?
ফয়সাল: বলো না আমায় কুমার! আমিই সে! আমি সেই রাণীমার পেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা মাংসের দলা। আহ্! আমি, আমিই সেই দু’মুখা সাপ, অমীমাংসার দলিল, কালশিটে জন্মদাগ। আমি, আমি, এই দেখো আমি!
ঘোড়সওয়ার: আপনি!
ঘোড়সওয়ার: আপনিই সেই রাজার কুমার?
ঘোড়সওয়ার: কে জানে- কীসের আশায় এতোদূর বন-বনান্ত আসি!
ঘোড়সওয়ার: এসে পাই যোগফল, আদেশ ও গন্তব্য।
ঘোড়সওয়ার: আনন্দে আমার সবকিছু উলটপালট হয়ে গ্যাছে- জানি না কী করা আশু কর্তব্য, কী-ই বা বলা দরকার!
ঘোড়সওয়ার: কী বলবো কুমার নামদার, এ-যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, বজ্রপাত, কী বলবো শাহজাদা!
ঘোড়সওয়ার: তুমি কাঁদছো কেন!
ঘোড়সওয়ার: কাঁদছি! ভেবেছিলাম হাসছি।
ফয়সাল: আমি, আমি-ই সেই! আমাকে কিছু স্পর্শ করছে না। আমি কেবল একটি সর্বনাশ, আমি পাহাড়ের তীব্র খাড়া- উদ্যত শিরে দাঁড়িয়ে আছি। কোন আশ্রয় নেই। খসে পড়ে যাবার কথা ছিল সুগভীর খাদে। কিন্তু পড়ি না- আমার অসহায়ত্ব আমি সার্কাসের বীরত্বের মতো খুলেখুলে দেখাই।
ঘোড়সওয়ার: আমরা এসেছি- ঘোড়ার কেশরের ফণায় জীবন বাজি রেখে আমরা এসেছি।
ঘোড়সওয়ার: আপনি একমুহূর্তের জন্যও আর একা নন।
ফায়সাল: এই যে- হতে পারি চাষাভুষার পুত, হতে পারি রাজার দুলাল। আমি শঙখিনী সাপের শিরদাঁড়া, আমি ধাবমান তীব্র তীরের চোখা মুখ।
ঘোড়সওয়ার: বিশ্বাস করুন কুমার, আপনার মায়ের কান্দন সহ্য হয় না।
ফয়সাল: আর বসে থাকা নয়। তোমাদের আর লোক কোথায়?
ঘোড়সওয়ার: পথে পথে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে।
ফয়সাল: রাজা ধুলিয়ান খানকে পায়ের তলায় পিষে মারবো। আর বিলম্ব নয়। এই যে আমার তীর- নিক্ষেপ করলাম রাজবাড়ির দিকে- যুদ্ধের আগাম সংকেত। হাঁকাও অশ্ব, তোলো তরবারি তীক্ষ্ণ ধার! শান দাও তীরের ফলা, আর দেরি নয়।
ঘোড়সওয়ার: আমরা তৈরী। এখনই শুরু হোক।
ঘোড়সওয়ার: আমরা আছি পথে-প্রান্তরে, আড়ালে আবডালে। আপনার সঙ্গে সবাই আসবে।
ঘোড়সওয়ার: আপনি কেবল হাঁক দিন। প্রলয় হুঙ্কার।
হুঙ্কারে, দামামায়, প্রতিহিংসায় বনও হিসহিসিয়ে ওঠে। জঙ্গলও বুঝি মোচড় দিয়ে ওঠে। তোলপাড় শুরু হয়: ঘোড়ার চিঁহি। খুরের আওয়াজ। তরবারির ঝনাৎকার। পাখপাখালির চেঁচামেচি। উদ্বেগ। কঁ কঁ। পকপক পকপক। চিঁচিঁ। চিঁচিঁ।
কথাকার: আপনার কী মনে হয় বিবেচক ভাই-বন্ধুগণ, দেখলেন তো খালি বনবনান্ত, গাছবিরিক্ষিই মোচড় দিতা ওঠে নি। মোচড় দিয়া ওঠে ফয়সালের মন, তার মনের অন্দরমহলে জমেথাকা ধুলাবালি আর কেবল ধুলাবালিই থাকে না- তারা হয়ে ওঠে রামদা কিরীচ ধার দেবার বালু। বালুতে ধারদেয়া দা এবার চিকচিক করে ওঠে।
কথাকার: ফয়সাল এবার সৈন্যসামন্ত, তীরধনুক, ঢাল তরবারি, ঘোড় শাবল হেঁকে রাজা ধুলিয়ান খানের দরবার দখলে উদ্যত, তখনই মনে হয়, তার পিছন দিক থেকে কে যেন তারে গোপনে আবডালে টান দিয়া ধরে।
কথাকার: এমতাবস্থায় দিশা বেদিশা হইয়া কী করে কী করে ফয়সালের বেটা- তীর ধনুক টান দিয়া আবার সে ময়ূর পাখের তীর নিরুদ্দেশে শূন্যে ছুঁড়ে মারে- ভেবে দেখুন, চিন্তা করে দেখুন ভাই-বন্ধুরা, লড়াইয়ের আগে নিজের লড়াই, যুদ্ধের আগে ঘরের যুদ্ধ। এ বড় দারুণ যুদ্ধ ভাই! যুগের পর যুগ, ইতিহাসের পর ইতিহাস তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!
কথাকার: এ তীর রক্তপিপাসু তীর নয়। এ তীর দরগায় মনের মাকসুদ পূর্ণকরার মানত, মন্দিরে দেবীর পায়ে পুষ্পার্ঘ্য।
কথাকার: আর কী কাম করে ফয়সাল শোনেন বন্ধুগণ।তীরের মুখে বেন্ধে দেয় এক রূপার নোলক নাকফুল- এবার দেখো তাইরে নাইরে তাইরে নাইরে না- উড়ন্ত নাকফুলের কী-বা গতি হয়- ময়ূর পাখের তীর শূন্যে মারে ওড়া, বিধির কী-যে লীলা।
কথাকার: যেমন তেমন সড়ক যেমন দুইদিকে চলে। তীর-ধনুক তলোয়ারসহ ফয়সালের চোখ ও হাত নিশানা করে রাজা ধুলিয়ান খানের দিকে, কিন্তু তার দুঃখভরা মন বাতাসের আগেআগে ছোটে চন্দ্রবালার পানে।
কথাকার: ডেউয়া ফল দেখতে বাইরে যেমন আপনার শুকনাশাকনা থাকে, কিন্তু তার নিচ পরতেই থাকে কেমব এক পানির ধারা, চোখের ভাঁজ থেকে যেমন সরানো যায় না ঘুমের দেশের মায়া- কার লাগি এমন লাগে ফয়সালের নাই যে জানা- কোন মেঘের কন্যা রঙ্গিলা মধুমালা গো তুমি কোন বা দেশে থাকো, কার বা চোখের ঘুম কাড়িয়া অন্তরালে ডাকো!
ঘুমের দেশে জাগি আমি তোমার ঢেউয়ের আড়ি
তুমি ভাঙো ঢেউয়ের আগায় কেমনে দিবো পাড়ি
আবার তোমায় সেলাই করি তোমার মুখের ছবি
ভাবতে লাগি ডুবতে লাগি উজান গাঙ্গের কবি।
ঘুমের দেশে চাঁদের বেশে এক ব্যথার রুমাল নাড়ি।
ঘুমের দেশে জাগি আমি তোমার ঢেউয়ের আড়ি
তুমি ভাঙো ঢেউয়ের আগায় কেমনে দিবো পাড়ি।।
কথাকার: ফয়সালের ময়ূর পাখের তীর ছুটে যায় মানুষরূপ কলমল টিয়াপক্ষীর দিকে, কিন্তু বাস্তবিক রক্তমাংসের ফয়সাল রাজা ধুলিয়ান খানের সঙ্গে মারাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
কথাকার: বাজানরে বাজান, যেই না কথা সেই না কাজ! বাঘে- সিংহে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই বাঁধে: হুড়মুড় হুড়মুড় ঝনাৎ ঝন হুড়মুড় হুড়মুড় ঝনাৎ ঝন ধুলিয়ান বাহিনী হামলে পড়ে ফয়সাল বাহিনীর উপর, মনে হয় গেল, গেল, গেল- ফয়সাল বাহিনী বুঝি ধূলিসাৎ হয়ে গেল! কিন্তু না- ডিডি, ডিডি। ডিডি, ডিডি ফয়সাল বাহিনী ঘুরে দাঁড়ায়, হামলা, হামলা!
কথাকার: শেষপর্যন্ত ডুক্কুরে ডুক্কু। ডুক্কুরে ডুক্কু। ফয়সালের বাহিনীর জবরজং ঠাসানির মুখে ধুলিয়ান বাহিনী ঢিলা লুঙ্গির মতো ছিঁড়ে খানখান হয়ে পড়ে।
কথাকার: মনে হয়, ফয়সাল মানুষের শারীরিক কাঠামোর মধ্যে আর আবদ্ধ নাই- ফয়সাল বুঝি আর ফয়সাল থাকে না, একটি চন্দ্রবোড়া সাপে রূপান্তর লাভ করে।
কথাকার: ঘোড়ার উপর হিসশিস করে ফয়সাল- একটি চন্দ্রবোড়া সাপ: তোমরা কে কোথায়, কেউ ক্লান্তির কথা বলো না এখন। টেনেহিঁচড়ে বের করে আনো রাজা ধুলিয়ান খান। তাকে চৌহদ্দির উপরে ছুঁড়ে ফেলো- একটি বেজী। আমি তার উপর চন্দ্রবোড়া সাপ। আমি চাই আমার মায়ের মতো সে আজ অসহায় হোক- বাঁচার জন্য চিৎকার করুক!
কথাকার: অতএব চৌহদ্দির উপর ছিটকেপড়া একটি বেজী- একদলা মানুষের পোটলা ধুলিয়ান খানের উপর ফয়সাল লাল ঘোড়া দাবড়ে দেয়। ধুলিয়ান খান একা পরিত্যক্ত একটি গুবরে পোকা কিলবিল করে। আবার। ওফ। ছিন্নভিন্ন। লণ্ডভণ্ড হয় ধুলিয়ান খান।
ছিন্নভিন্ন রাজদরবার, ত্রস্তসমস্ত গ্রামের লোক। মনে হচ্ছে, হঠাৎ ঘুমন্ত পাড়ায় বাঘ পড়েছে- যে যার মতো পালাচ্ছে, ছুটছে।
গ্রামের লোক: তাড়াতাড়ি পা চালাও। জলদি করো। থেমেছো কী ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছো তো মারা পড়েছো। তাড়াতাড়ি হাঁকাও। ছুটো।
গ্রামের লোক: আর কী বিপদ হবে- বিপদের আর কিছু বাকি আছে? সবই তো গেল। তেঁতুল গাছের ডালের মতো পটাপট ভেঙে পড়ে গেল!
গ্রামের লোক: এখনো তো প্রাণবায়ু হাতে নিয়ে পালাতে পারছি। সবই গ্যাছে। কিন্তু প্রাণখানি এখনো ধুকপুক করছে। তা-ও কম কী-সে!
গ্রামের লোক: হালের গরু, জমিয়ে রাখা পিঁয়াজ রসুন। লোকমানি বন্ধের পিঁয়াজ, কী তার ঘ্রাণ! কোথায় কোনদিকে ছিটকে পড়েছে- তার হদিসই পেলাম না।
গ্রামের লোক: মনে হচ্ছে, আমাদের পুরা গ্রাম কী গ্রাম, মোকাম কী মোকাম পদ্মার পাড়ের মতো ধপাস পড়ে ভেঙে খানখান। কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার ঠায়ঠিকানা কিছু জানা নাই- ছেলেপুলে বেঁচে আছে কী-না তার নাই নিশানা।
গ্রামের লোক: বাপরে বাপ, কী সে লড়াই!
গ্রামের লোক: যাই বলো না বলো, রাজার নাম মুখে নিও না।
গ্রামের লোক: লোকমুখে শুনি- বাপ বেটায় লড়াই।
গ্রামের লোক: চুপ, চুপ। একদম চুপ। বেড়ার কান আছে, পশুপাখিরও কান আছে। আগে তো পালা, জান বাঁচা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো,জলদি পা চালা। কোথায় কে ঘাপটি মেরে আছে- কে জানে!
গ্রামের লোক: দেখো, দেখো, ওইদিকে দেখো।
গ্রামের লোক: কোনদিকে, কোনদিকে?
গ্রামের লোক: রাজার বাড়ির দিকে।
গ্রামের লোক: কী দেখা যায়?
গ্রামের লোক: দেখো, দেখো সব ভাঙাচোরার ভিতর একখান হারিকেন বাতির টিমটিম আলো দেখা যায়!
গ্রামের লোক: কে বাতি জ্বালায়? সেখানে শ্মশান। কেউ বেঁচে থাকার কথা নয়।
গ্রামের লোক: সত্যি সত্যিই হারিকেন বাতির আলো। গা ছমছম করে বাপ। তাড়াতাড়ি পালা।
কীভাবেতে হয় ভাই, কীভাবেতে হয়? চাষাভুষার বউ ছোটিরাণী তাজিরন বুঝি মাটি ফুঁড়ে বেরোয়। সবকিছু বিরান। বিরান দহলিজ। বিরান এতো লোকসমাগম। বিরান হাটবাজার।
গ্রামের লোক: এই বিরান, বিরান ভূমির উপর তাজিরন বানু কী যেন খোঁজে। দেখার চেষ্টা করে।
ধ্বংসস্তূপের উপর মুখোমুখি তাজিরন আর ফয়সাল।
তাজিরন: সবকিছু খোয়াব, খোয়াব, আবছা আবছা ঠেকে। তবু মন বলে তুমিই সেই ছেলে! তোমাকে দেখার জন্যই আজও ধুঁকেধুঁকে বেঁচে আছি। আর কোন সাধ নাই। দেখি, দেখি, তোমার মুখখানা দেখি?
ফয়সাল: কিছু স্থির নয়। সব কেবলই দূরে সরে যায়। তোমার মুখ কেবলই জলের উপর ভেঙেভেঙে যায়। কে তুমি মা?
তাজিরন: না, না মা বলে ডাক দিবা না। এই মধুনাম শোনার মুখ আমার কী আছে বাপ?
ফয়সাল: তুমি কেন নিজেরে ঠকাও- তোমার তো কোন অন্যায় দেখি না!
আমি এক চাষাভুষার দাসী- রাজকুমার জন্ম দেওয়ার সাধ্য আমার নাই। তোমার জয় হয়েছে বাবা। বীরের মতো লড়াই করে বিজয়ী হয়েছো। কিন্তু পাপ একখান হয়- বড় পাপ। তুমি যে ইনারে পায়ের তলায় পিষে মারছো- এ বড় পাপ!
ফয়সাল: কিন্তু তোমারে যে খাড়াইয়ের নিচে একা, অসহায় গদামুগুরে পিটানো হয়- পেটের এই এতোটুকু মানবশিশু খালাশ করা হয়, সেকথা কেন বলো না?
তাজিরন: তিন তেরো দিয়া বারো নয় দে আইনা যোগ করো- যেই নাম হয়, তিনিই আমার স্বামী। কিন্তু। কিন্তু। কার রক্তে তোমার জন্ম- আমি জানি না। আমি সত্যি জানি না। জানার সময় আমি পাই নি। ঘৃণা। ঘৃণা, বাপ। আমার গায়ে থকথকে ঘা, কলঙ্ক! আমি উপরওয়ালার খেলার পুতুল।
ফয়সাল: না। আমি তা মানি না। তুমি এই জগৎ সংসারে ভেদ-ব্যবস্থার ঘা, কালশিটে দাগ।
তাজিরন: আমি অমীমাংসা। একটি গোঙানি। পুলসিরাতের সুতা। মধ্যবর্তী নারী- পুলসিরাতের চিকন সুতার উপর দিয়া হাঁটি। ডানে পড়লে আগুন। বাঁয়ে বরফ। ঠাণ্ডা। দু’পাশেই মৃত্যু।
ফয়সাল: এতো রক্তপাতের ভিতর রাজপ্রাসাদ আমার দখলে। চলো মা।
তাজিরন: না রে বাবা, না। এই রাজপ্রাসাদ আমার তো না। আসো, তোমার মুখখান আরো ভালোকরে একবার দেখি। কী যে ব্যাপার বলো দেখি বাছা- যতোবার দেখি- আরো বেশি দেখতে মন চায়। তোমার মুখখান একবার আঁচলে মুছতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ধুলিয়ান খান সাহেবের লাশ তোমার-আমার মাঝখানে শুয়ে আছে। তিনি এখন মৃত, কিন্তু জীবিতেরও অধিক জীবিত। এ-লাশ ডিঙিয়ে কেমনে তোমার কাছে যাই?
ফয়সাল: হাত ফসকে পড়ে গেলে জলের বাটি ভাঙে, আঘাতে মানুষের পা ভাঙে। যে আঘাত করে তার দোষ নয়, যে আঘাতে ভেঙে পড়ে তার কেন দোষ!
তাজিরন: তাই তবে বলো। আঘাতে ধুলিয়ান খান ভেঙে তছনছ হয়। আঘাত করো তুমি। তবে কার দোষ বলো?
ফয়সাল: সে আগে তোমাকে আঘাত করে। তুমি ভেঙে ভেঙে পড়ো নি? তুমিই বলো- তাহলে কার দোষ হয়?
তাজিরন: শোন বাবা, আমরা সবাই খেলার অধীন। ধুলিয়ান খান নিয়তির পুতুল, আমরাও সকলে অদৃশ্যের হাতে অসহায় লাটিম।
ফয়সাল: তোমার কথা মানলাম- আমরা নিয়তির লাটিম। কিন্তু লাটিমের দড়ি আমাদের হাতে।
তাজিরন: তারচে আমি যাই। ওই খাড়াইয়ের দিকে যাই। যার নিচের ঢালু জায়গায় মুগুর মেরে তোমারে নামানো হইছিল। ওখানেই যাই। ঢালু জায়গাটাই আমার স্বামী। এবার যাই। যাই বাপ।
কথাকার: সভাসদ বোঝে। দিগ্বিদিক চাউর হয়। সবাই জানে, বাতাসের আগেআগে বার্তা ছড়িয়ে পড়ে: তরুণ, যুবক, বিজয়ী যুবরাজ আমাদের নোতুন রাজা। কিন্তু রাজার চোখে ঘুম নেই! ভাঙা মনে ফয়সাল নাঙা তরবারি হাঁকায়: কোথায় মন্ত্রী, কোথায় পারিষদ, কোথায় বা সেপাইয়ের দল? আমার একজন প্রজাও যেন ভয়ে, দুঃখে, অনাহারে দিনাতিপাত না করে। কৃষি পরামর্শদাতাকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে বলুন। আমার সবিনয় অনুরোধ: উত্তম বীজের ব্যবস্থা করুন। মন্ত্রী, শুনতে পাই- সেচের জল, পান করার পানির ঘাটতি হচ্ছে। না। না। এভাবে একদিনও চলতে পারে না।
মন্ত্রী: বিষয় খানিকটা আতঙ্কের বটে।
ফয়সাল: কী রকম?
মন্ত্রী: গেল বর্ষায় পানি আসে স্বল্প। অতি অল্প। ধানের পেট, কথা নিরেট, থাকে অপুষ্ট। কমে যায় মাছের ঘাইগুই, খালি থাকে সিদামের খলুই। দুর্দিন বটে- না চাইলেও এইকথা রটে।
ফয়সাল: না, না, এভাবে চলতে দেয়া যায় না। কোথায় পয়াভারী মন্ত্রীর দল; কোথা বা জলদগম্ভীর পরামর্শক বুদ্ধিজীবীর পাল? তারা কী সবাই নৌবিহার, বনবিহারে মত্ত! রাজ্যজুড়ে হাহাকার। তাদের উদ্বেগ নাই। উৎকন্ঠা নাই। সাধারণ কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, নৌকাজীবী, বীজবণিকের দুর্দিনে একদিনও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। আজ, এক্ষুনি চারদিকে লোক পাঠাও। মাটিশ্রমিক জড়ো করো। হাজারে হাজার।উত্তম, সুশীতল, কাকচক্ষু পানির নহর। দিঘি খননের ব্যবস্থা নাও। আজ। এক্ষুনি।
কথাকার: বৃষ্টি ও জলের আশায় দশগ্রামে বেঙ্গির ঝিয়ের বিয়ের ধুম পড়ে যায়। গ্রামকেগ্রাম পুরুষ সম্প্রদায় বাড়ি ছেড়ে মাঠে এসে জড়ো হয়। এ বুঝি এক ইবাদতের বাজার। প্রার্থনার হাট।
কথাকার: তাদের সামনে খাখা জমির উপর লাঙলের ঈশ উলটা করে মাটিতে পোঁতা। পিপাসার্ত কিশোর-কিশোরীর দল ঢলের আশায় নাচে আর গীত গায়:
আড়িয়া মেঘা হাড়িয়া মেঘা কুড়িয়া মেঘার নাতি
নাকের নোলক বেচিয়া দিবো তোমার মাথার ছাতি।
কৌটাভরা সিঁদুর দিবো সিঁদুর মেঘার গায়
আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়।।
একদিকে গীতে নৃত্যে লুটোপুটি হুটোপুটি, অন্যদিকে ঝুড়িনামা বটের নিচে বৃষ্টি আর ফসলের আশায় হালদৌড়ের চিৎকার।
হুরুর। হুরুর।
দৌড়। দৌড়।
হুরুর। হুরুর।
নাই। তবু বৃষ্টির দেখা নাই।
দিকে দিকে আওয়াজ। ঘোষণা। চোঙ্গা। মাটিয়াল। ঘাম। গীত। মানুষ। কামলা। উদাম গা। ঘাম। কোদাল। ওঠে। নামে। শত শত। হাজার হাজার। মানুষ। নিরাশা। ভুত। বুঝি মানুষ নয়। ভুত। মাটি কাটে। দিঘি বানায়। গভীর। গভীর। গর্ত। পাতাল। পাতালপুরী। খোয়াজ খিজির। কই খোয়াজ খিজির কই? নাই। নাই। একফোঁটা পানি তো নাই!
ছটফট করে। আশায় নিরাশায় ফয়সাল ছটফট করে। ফয়সালের সামনে সারাদুনিয়া মনে হয় একটা জৈষ্ঠ্যমাসের কুকুর- পিপাসায়,খরানে লকলকে জিভ বের করে হাঁপায়!
কেবল কি একা ফয়সাল মাথা কুটে মরে? ছটফট করে সবাই- মনে হয় উড়াল দিয়া গাঙ্গে ডুব দিতে যায় শতবর্ষী বটগাছ। পাখিরা ঘাড় বাঁকা করে আপন পালকের নিচে খুঁটেখুঁটে দেখে ওখানে আছে কী-না একটি ছোট জলাশয়।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি ভঙ্গুর, কাতর। এ-গাছ থেকে ও-গাছে এ-ডাল থেকে ও-ডালে অস্থির যাওয়া আসা করে। এবার দুজনে একদৌড়ে যায় চন্দ্রের কাছে।
চন্দ্র: কী করি, কী করি বলো বেঙ্গমা বেঙ্গমি।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি: বড় দুর্দিন, ঘোর অমানিশা চন্দ্র।
চন্দ্র: কী হবে, এখন রাজ্যে পানির কী হবে?
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি: দিঘি- তুমি যদি বিশ্বাস করো চন্দ্র- সাতপুরী সমান পাতাল- হাজার হাজার লাখে কৌরাল মাটিয়াল- কী গহীন খাদ! কিন্তু একফোঁটা পানি নাই।
চন্দ্র: শুধু দুঃসংবাদের কাহিনী বলে লাভ কী! একটা পথ বলে দাও বেঙ্গমা। একটা উপায় বের করো বেঙ্গমি।
কথাকার:
এতো বড় দিঘি কাইটা গো
ও দিঘির পানি কোথায় গেল গো।
চন্দ্রবালা মাথা কুটে
ফয়সালের লাইগা গো।
পানি কোথায় গেল গো
এতো বড় দিঘি কাইটা গো
ও দিঘির পানি কোথায় গেল।।
চন্দ্র: কী করলে দিঘির পানি আসবে, পাতালে পানির পীর খোয়াজ খিজির দয়া করবে? বাবা খোয়াজ খিজির, এমন কিছু নাই আমি কুমার ফয়সালের জন্য করতে পারি না। তার জয়ের জন্য, রাজ্যের শান্তির জন্য আমি সব করতে প্রস্তুত।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি: কীভাবে বলি। কীভাবে যে বলি!
চন্দ্র: বলো। নির্ভয়ে বলো বেঙ্গমা-বেঙ্গমি।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি: দিঘি ভয়ানক কথা। দিঘি রাক্ষসী। রাক্ষসী মাথা চায়।
চন্দ্র: মাথা চায়! কার মাথা?
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি: রাজকুমার ফয়সালের সবচেয়ে প্রিয় যে-জন তার মাথা চায়! তার আত্মবিসর্জন।
চন্দ্র: তাই! তার মাথা চায়? হোক। তবে তাই হোক। একটিবার যে দেখা হলো না! তাতে কী। তাতে কী! তথাস্তু। এতো সামান্য চাওয়া।
কথাকার: অতঃপর রাত্রি নিশাকাল। আকাশে পোকায় খাওয়া আধখানা সফেদার মতো চাঁদ। ছানিপড়া চোখের ঘোলাঘোলা চান্নি।
ধান্দা খাইয়া সারাদুনিয়া বুঝি বেজান খাড়ায়।
ফেরেশতারা শেরপুটি মাছের আঁশের আবছায়ায় চোখের নিরলে হারায়।
একটি মেয়ে। না-কী একটি খয়েরি ডানার কথা।
একটি ধানের কুড়া। একটি বুঝি ছিঁড়া ডুমুরের পাতা।
সম্পূর্ণ বিয়ের সাজে রঙিন। হলুদ বাটো, মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ।
মাথায় টিকলি। হাতে বালা। পরণে কাতান শাড়ি। নাকে রূপালি নোলক: রূপালি নোলক ধীরে, শুকনা, খাখা দিঘির তলার দিকে নামতে থাকে। আরো গহীনের দিকে, তলদেশের আদি আক্রোশ, প্রথম ক্ষুধা আর ধারালো নিয়তির তরবারির মুখের উপর মেয়েটি নিজেকে রুজু করে।
মুহূর্তে সারাদুনিয়া গমগম। আকুল দুনিয়া ভেঙেচুরে কিয়ামত নেমে আসে। একটি নোলকের সাকল্য কাতরতা ভেঙে পানির ঢল নেমে আসে। আহা পানি!
এই সবকিছুর সাক্ষী থাকে ওই আকাশে দণ্ডায়মান খয়েরি একখণ্ড চাঁদ।
দেখি যে চন্দ্রের কেবল মেটেমেটে একটি চাঁদের সঙ্গেই দেখা হলো।
কিন্তু যার সঙ্গে দেখা হবার কথা ছিল, তার সাথে দেখা করার ব্যগ্রতা নিয়ে চন্দ্র ওই দেখো- প্রতি পুর্ণিমায় দিঘির জলে আসে। কী এক ব্যাকুলতায় বারবার পানির উপর মুখ বাড়িয়ে চক্কর খেয়ে যায়! চন্দ্র- একটি রূপালি নোলকপরা চান্দা মাছ। প্রতি পুর্ণিমায় চন্দ্রবালা দিঘির ঢেউয়ে ঢেউয়ে আসে। আর কাকে খোঁজে!
আর ভর দীঘল পুর্ণিমা রাতে পানির নকশায় দূর থেকে চন্দ্রবালার নয়নের পাশে কে বাঁশি বাজায়- বাঁশি এক বাজে, ও বাঁশুরিয়া!