।। কুশীলব ।।
অনিল টুডু
চোংগাওয়ালা
স্থানীয় নেতা
আমলা
মন্ত্রী
পুলিশ
ডাক্তার
[মঞ্চের কেন্দ্রে অনিল টুডু বসে আছে। তার চোখে-মুখে গাঢ় অভিমান। যেন সে পাথর হয়ে গেছে। আমাদের শ্রুতিতে আসে প্রথম বয়ান… ]
প্রথম বয়ানঃ
ভুলিলে চলিবে না, চলিবে না ভুলিলে সকল! এই তো সেই মাটি এই তো বাথান, যেইখানে জন্ম নেয় আমার সন্তান, এই তো সেই মাটি যেইখানে হাজার বচ্ছর আমার শিকড় যায় মাটির ভিতর, আমারে যে জিজ্ঞাস করে কি আমার জন্মলতিকা, আমি তারে থুতু দেই… ছুঁড়ে দেই তার দিকে ভাঙ্গা কলসির চাঁড়া! হা হা …
ভুলি নাই ভুলি নাই…রক্তে চাবুকের ব্যথা আজো ভুলি নাই… ভুলি নাই সিঁধু কানু ফুলমনিরে ভুলি নাই…ভুলি নাই…আলফ্রেড সরেন রে ভুলি নাই… চলেস রিসিল তোমারে ভুলি নাই… ভুলি নাই ভুলি নাই কল্পনা চাকমারে ভুলি নাই…হেই তো আমার ভাই… হেই তো আমার বোন… আমারাই তো আমাদের আপনজন… পায়ের নিচে যে মাটি যারে বলি মা… যার বুক ফুঁড়ে জন্মায় সন্তানেরা… কি করে ভুলি সেই মায়ের সন্তানের ব্যথা… কি করে ভুলি যখন মায়ের দখল নিতে আসে হায়েনারা?
[ মহিষের সিঙ্গার শব্দ মৃদু থেকে স্পষ্ট হয়ে আসে ক্রমশ ]
শুনিতে কি পাও… শুনিতে কি পাও… শুনিতে কি পাও… পাও কি শুনিতে কেহ… মহিষের সিঙ্গার ধ্বনি কি যেন কি কয়… কোথায় শঙ্কা বেজে ওঠে… বুকে ভয় হামাগুড়ি দেয়… হায় হায়… কোথায় যেন ঘর পোড়ে… গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়… আবার কি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ নরমেধযজ্ঞ চালায়? আবার কি জমিন দখল নিতে নেমে আসে মানুষের ভূত… লোভী লোভী শেয়ালেরা শুনশান পায়তারা দেয়… বাতাসে গার্হস্থ্য পোড়া গন্ধ কি পাও…বাতাসে কি মানুষের আর্তনাদ পাও… বাতাসে কি দখলের উন্মাদনা পাও… পাও কি বাতাসে কেউ ইতিহাস ভস্মের লড়াই?
[ চোংগাওয়ালার প্রবেশ]
চোংগাওয়ালাঃ হাঁই হাঁই চুপ চুপ… সত্য কথা বলা চুপ…ইতিহাস চুপ… মিথ্যা কথার জয়… মিথ্যা প্রচারণার জয়…জয় ঈশ্বরীর জয়…জয় ঈশ্বরীর শাবকদের জয়…জয় ঈশ্বরীর জয়…
ভয় নাই… ভয় নাই… হাবাগোবা মানুষের কোন ভয় নাই… ভয় কি তা জানে না তারা… বোঝেও না! অযথাই চিৎকার দেয়! হায় হায়! জানে না একবার যদি টের পায়… চিৎকার দেয়ার ঐ কণ্ঠ ছিঁড়ে নেবে… গুম করে দেবে সেই অন্ধকারের আড়ালে… হা হা… হা হা… আমি সেয়ানা মানুষ… হাওয়া যেইদিক আমার লুঙ্গি সেইদিক!
আর এই ব্যাটা অনিল টুডু গাধার থেকেও অধম… এতো বড় সুযোগ… এতো বড় বড় গাড়ি… এতো এতো বিদাশি লোক… এতো এতো এতো নেতা মন্ত্রী আমলাদের ভিড়, তবু শালা মানলো না কারোর আব্দার? একবার একটু ঘুমাইতে গেলো না? ক্যান বাবা একবার একটু চোখের পাতা বোজ… তাইলেই তো হাততালি, টাকা গুনতে গুনতে আঙুল ব্যথা; তারপর টাকা গুলা গুইনা নিয়া বাড়ি যা! কিসের জাত কিসের অভিমান!? কতবার আমি লুঙ্গি তুইলা চোখ বুইজা থাকলাম আর কতো নেতা, কতো সরকার মাইরা গেলো! একটু রক্ত পড়ছে তাতে কি! ব্যথা লাগলেও ব্যবসাটা তো জমছে! জমি গেলে জমি পাবি জান গেলে পাবি না… রাজায় যদি পোঙ্গা মারে কাউরে কিচ্ছু কবি না! হে হে… হি হি… কি চমৎকার বলেছি!
[অফট্রাকে পাঁচালির সুরে নিচের পয়ারটি পাঠ হতে থাকে।চোংগাওয়ালা সন্ত্রস্ত হয়ে যায়। পালায়। স্থানীয় নেতার প্রবেশ।]
ইতিহাস নির্মম ইতিহাস ভূত
মরিয়া অমর হয় মানুষের পুত
সকলে মানুষ নয় কেউ কেউ হয়
যাদের অণ্ডকোষে খাঁটি বিচি রয়
তারাই মরিয়া হয়ে পুনরায় জাগে
অন্য মানুষেরা শুধু খায় দায় হাগে…
একদা অনিল টুডু নামে একজন
করেছিলো সাদামাটা ভয়ানক পণ
ক্ষমতা লোভীর জিভ লকলক করে
খেয়ে ছিলো আদিবাসীদের ঘাড় ধরে
তাদের ভূমির থেকে উৎখাত করে
বানালই চোর ফের কৌশল করে
তবু ইতিহাস সেতো নয় ধুনফুন
অনিলের পণ সেতো ছড়াল আগুন
দুর্বলের জন্ম হয় হয়ে ভাগ্য ঋণী
সকলে জানিল এ-তো বানানো কাহিনী
তথাপি সকলে থাকে এই দেশে চুপ
যেন পেটে বোমা তবু মুখেতে কুলুপ
তার মানে কাহিনীর ভেতর কাহিনী
আমরা সকল জানি কিন্তু বলিনি…
স্থানীয় নেতাঃ চুপ চুপ চুপ…! কি ছাই ভস্ম চাষবাস! সকাল বেলা কানের কাছে কাব্য? এ-তো স্বাস্থ্যকর না! যেই জাতিতে কবির সংখ্যা বেশি… সেই জাতিতে ঘাপলা ততো বেশি! ততো বেশি ঘাড় ত্যাড়ামি ততো বেশি শ্লোগান! চুপ চুপ! এই জামানার নাম হইলো চুপ! পায়খানা করবা কিন্তু পাদ দিতে পারবা না! হি হি… আমিও ভালোই বলেছি!
[আমলা আসে। সকালের ব্রাশ করতে করতে]
স্থানীয় নেতাঃ এই যে স্যর, রাতের ঘুম ভালো হয়েছে?
আমলাঃ না! মোটেই না! এই শালা আদিবাসীগুলোর মতো মশাগুলো সারারাত আমার গুষ্টি উদ্ধার করেছে!
স্থানীয় নেতাঃ ছি ছি ছি! স্যর! আপনার মুখে গালি মানায় না! আপনি হলেন গিয়ে আমলা মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, জ্ঞানী মানুষ, ঈশ্বরীর খাস মানুষ! আপনাদের মুখে গালি মানায় না! গালি তো দেবো এই গিয়ে আমরা! যারা স্থানীয় নেতা! আমরা যারে তারে শুয়োরের বাচ্চা…গাধার বাচ্চা বলে গাল দেবো… আপনারা সেখানেও ভাগ বসালে কি করে হয়?
আমলাঃ যাহ্! একবারও শুয়োরের বাচ্চা পর্যন্ত বললাম না, আর আপনি বলছেন আমি গাল দিয়ে ফেলেছি!
স্থানীয় নেতাঃ এই যে এই তো দিলেন মাত্র!
আমলাঃ অ! তা এরকম ছেলেমানুষি খেলা না খেলে, এই আদিবাসীগুলোকে ত্রাণ বিলির ব্যবস্থা করুণ, দান খয়রাত নিতে বলুন আমাদের কাছ থেকে! দুপুর নাগাদ মন্ত্রী আসবেন, সঙ্গে আসবে আমাদের বিরাট মিডিয়া টিম!
স্থানীয় নেতাঃ সে বুঝলাম, কিন্তু স্যর এই রকম একটা ফুল্টুস সমস্যা সমাধানের জন্য চালডাল মন্ত্রীর আসার কি দরকার?
আমলাঃ উনি নিজ হাতে ত্রাণ দেবেন!
স্থানীয় নেতাঃ আরে রাখেন! এই সামান্য সমস্যার জন্য এতো ঝামেলার কি দরকার! পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে এদের ত্রাণ নেয়ালেই হয়!
আমলাঃ চুপ চুপ! অতো কথার দরকার নেই! প্রচারণা প্রপাগান্ডা এসব তো আপনি বুঝবেন না! ওগুলো আমাদের ঠিক করে দিতে হয়! [মঞ্চের একপাশে গেঁড়ে বসে থাকা অনিল টুডুকে দেখিয়ে] আচ্ছা এই লোকটা কে? সেই কোন সময় থেকে ওকে দেখছি এখানে ঝিম মেরে বসে আছে! গোয়েন্দা বাহিনীর কেউ নাকি?
স্থানীয় নেতাঃ কি বলছেন স্যার, অ হচ্ছে অনিল টুডু। ওর ঘর অন্য সবার সঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে! থুক্কু আগুন লেগে পুড়ে গেছে! ও যেখানে বসে আছে সেখানে ছিল ওর জন্মভিটে!
আমলাঃ অ! তা লোকটা ওখানে বসে আছে কেন? মরে গেছে নাকি, নড়ছে না যে?
স্থানীয় নেতাঃ তা জানি না বাপু! সবাই ছাউনির নিচে চলে গেছে, কেউ কেউ চার্চে(র) আশ্রয়ে! শুধু অনিল বুড়ো যায়নি কারোর কাছে! সে নাকি ঘুমাবে না! যতক্ষণ আমাদের এই অপকর্মের থুক্কু যতক্ষণ হুতাশে আগুন লেগে ছাই হয়ে যাওয়া তাদের ক্ষতির কোন বিচার হবে!
আমলাঃ পাছায় লাথি মেরে উঠিয়ে দিন!
স্থানীয় নেতাঃ ছি ছি স্যার কি যে বলনে, বাপের বয়েসি লোক লাথি মারা যায় নাকি? তা আপনি যখন বলছেন আপনার সম্মানে লাথিটা মারছি, [লাথি মারে কিন্তু অনিল পাথরের মতো বসে থাকে]
এই সর্বনাশ! যা শুনেছিলাম তাই! এ যে নড়ে না, এ যে পাথর হয়ে আছে!
আমলাঃ লোক ডাকিয়ে এখানে থেকে উপড়ে ফেলুন!
স্থানীয় নেতাঃ লাভ নেই স্যর! সকালে একবার ট্রাই করেছে আমার লোকেরা! সবাই বলে, অনিলের গায়ে নাকি মৈনাক পর্বতের মতন ওজন হয়ে গেছে! ভর করেছে ওর উপর কিছু একটা! তুলে নেয়া যাচ্ছে না!
আমলাঃ মন্ত্রী আসছেন, কিভাবে ওকে সরাবেন সেটা আপনি দেখবেন, আমি জানি না! দরকার হলে ক্রেন ডাকিয়ে আনুন!
[আমলা বেরিয়ে যায়]
স্থানীয় নেতাঃ উউউউ! ক্রেন ডাকিয়ে আনুন! মাদারচোদ হুকুম দেবার লোক পাস না? এক কোপে কল্লা নামিয়ে ফেলতে পারি, শুধু সামনে ইলেকশন বলে কিচ্ছু বলছি না! বোকাচোদা বোকাচোদা মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে!
[অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়]
[চোংগাওয়ালার প্রবেশ]
চোংগাওয়ালাঃ ‘ফুটা দিয়ে যায় ফুটা দিয়া আসে’ বলেন তো জিনিসটা কি কিংবা কার অথবা কোথায়? হি হি… অশ্লীল লাগে শুনতে? কিন্তু চিনতে কষ্ট হয় না! আর চিন্তা করতে আরাম লাগে তাই না?
…এবার খেলা দেখাবে ঐ অনিল টুডু… কঠিন আদমি… মরে যাবে তবু মাটি ছাড়বে না! সবাই কি আর আমার মতো? যেখানে সেখানে যার তার প্রলোভনে লুঙ্গি খুলে দেয়? একদা যখন কিছু লোক তাদের ধর্মের বই হাতে এসে বলেছিল, যদি তাদের ধর্মে যায় তাইলে খাওয়া দাওয়া চাকরির চিন্তা নাই! আমি লাফ দিয়া গেছি সেই ধর্মে! গরিবের কি ধর্ম থাকে, থাকে শুধু ক্ষুধা, কিন্তু ক্ষুধা মিটে যেতেই টের পেলাম, হায় হায়… আমার গায়ে জামা থাকতেও জামা নাই… উদলা গায়ে আমি মানুষের মধ্যে হেঁটে বেড়াই… আমার হাজার বছরের জামা… আমার আত্মা আমার স্বর্ণবীজ আমি বিক্রি করে দিয়েছি! হায় হায়! কিন্তু অনিল বিক্রি হবে না হে! জানি জানি… আমি সবই জানি! মন্ত্রী নেতা… আমলা যারাই আসুক না কেন অনিল বিক্রি হবে না! হাঁই হাঁই…মান বাঁচাতে অনিলের বিকল্প নাই! যখন সবাই আমার মতন বিক্রি হয়ে যাবে…যখন সবাই আমার মতো পঁচে যাবে, তখনো অনিল টুডু পাথরের মতো বলে যাবে, … ‘আমার ঘর পুড়েছে তার বিচার দেও! আমার জন্মভিটা ফেলে আমি যাবো না’
[হঠাৎ পুলিশের বাঁশি বাজে। শব্দে চোংগাওয়ালা পালায়। পুলিশ বাঁশি বাজাতে বাজাতে দৌড়ে আসে, তার পেছনে দৌড়ে আসে স্থানীয় নেতা, তার পেছনে মন্ত্রী, তার পেছনে সচিব। পুলিশ দাঁড়িয়ে যাওয়া মাত্রই একজন আরেকজনের গায়ে এসে পড়ে]
মন্ত্রীঃ ছি ছি ছি! কি ঘেন্নাকর ব্যাপার, কি লজ্জাকর ব্যাপার, কি দুর্গন্ধময় ব্যাপার, কি বিরাট পরাজয়!
আমলাঃ এরকম হতে পারে সেটা স্যার ভাবাই যায়নি!
স্থানীয় নেতাঃ মাননীয় চালডাল মন্ত্রী, যদি বেয়াদপি না নেন তাহলে বলি, আমি আগেই বলেছিলাম সচিব সাহেবকে যে, দূরবীন দিয়ে পাছা দেখা গেলেও পুরোটা দেখা যায় না!
আমলাঃ উফফফফ! কি বিশ্রী!
মন্ত্রীঃ বাংলায় বল! বুঝতে পারি নাই!
স্থানীয় নেতাঃ আমি তো জানি এদের ঘাড় ভীষণ ত্যাড়া! আগেই বলেছিলাম, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে সাইজ করে ফেলতে!
মন্ত্রীঃ উঁহু! উঁহু! এটা করা যাবে না! এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল নিউজ হয়ে দাঁড়িয়েছে! ব্যাপারটা ভীষণ স্পর্শকাতর!
স্থানীয় নেতাঃ অণ্ডকোষের মতন?
মন্ত্রীঃ কি বললে?
স্থানীয় নেতাঃ না বললাম, প্রজাপতির মতন!
মন্ত্রীঃ [অনিল টুডুকে দেখিয়ে] কিন্তু এ মালটা কে? বাবাজি এমন বোবার মতন বসে আছে কেন?
আমলাঃ এটাই তো একটা বড় সমস্যা স্যার! এই হচ্ছে সেই বুড়ো আদিবাসী, যার ঘর ছিল এখানে, এবং সেটা পুড়িয়ে দেয়ার ফলে, সে তার ছাই হয়ে যাওয়া ভিটেয় সেই যে গেড়ে বসে আছে আর ওঠার নাম নেই!
মন্ত্রীঃ বল কি? পাছায় কি শেকড় গজিয়ে গেছে যে উঠছে না?
স্থানীয় নেতাঃ তার চেয়ে ভয়ানক ব্যাপার! এ লোক গোঁয়ার! কারো কথা শুনবে না! এ জাতটাই এরকম!
মন্ত্রীঃ উঁহু! অতো বুঝি না! আমি শুধু জানি, এরা আমার ত্রাণের ট্রাক ফিরিয়ে দিয়েছে! আমি নিজে রাজধানী থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে এদের ত্রাণ দিতে এলাম কতো ক্যামেরা সঙ্গে করে নিয়ে, তবু এরা ত্রাণ নেয়নি, আমি অপমানিত হয়েছি! এর জন্য ঈশ্বরীর দরবারে আমাকে কি জবাব দিতে হবে জানো তোমরা? আর মানুষ হিশেবে আমার মগজ এতো বেশি উর্বর যে, লুটপাট করতে করতে এখন প্যাঁচ খেলতে পারি না! ঈশ্বরীর প্রশ্নের জবাব দিতে ভয় পাই, যদি মন্ত্রিত্ব চলে যায়! কেনোনা তিনি মানেই তাল গাছটা তার!
আমলাঃ একটু পর ঈশ্বরী দর্শন দেবেন, আমাদের তার মুখোমুখি হতে হবে, মানসিকভাবে প্রস্তুত হন! কি কি মিথ্যা বলবেন তা তৈরি করে ফেলুন! স্ক্রিপ্ট ছাড়া কেউ তার সামনে যাবেন না, কেনোনা তিনি দুর্বল অভিনয় পছন্দ করেন না!
স্থানীয় নেতাঃ আমি তো লোকাল নেতা আমার কি দরকার আছে যাওয়ার?
মন্ত্রীঃ আরে বাসসস আপনিই তো এখন হিরো বস! আপনি না গেলে আমি একা একা পকেট ভরে গালাগাল খাবো কোন দুঃখে?
[সহসা সাইরেন বেজে ওঠে বা ঈশ্বরীর হুইসেল। তারা তিনজন সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে গিয়ে মঞ্চের একপাশে অন্ধকারের দিকে হাঁটু ভেঙে বসে হাত উঁচু করে (ঠিক যেন সারেন্ডার করার ভঙ্গী) নত শিরে বসে থাকে। ঈশ্বরীর কণ্ঠ আসে ]
মন্ত্রীঃ জয় ঈশ্বরীর জয়…
আমলাঃ জয় ঈশ্বরীর জয়…
স্থানীয় নেতাঃ জয় ঈশ্বরীর জয়…
ঈশ্বরীঃ বল, হে আমার পালিত অপদার্থের দল! হালফিল শুনাও!
আমলাঃ মন্ত্রী থাকিতে আমি মুখ খুলিব কোন সাহসে হে ঈশ্বরী!
ঈশ্বরীঃ বাহ! তুমি তো দেখি আরো অপদার্থ হইয়া উঠিয়াছ! ক্রমশ তোমার উন্নতি হইতেছে দেখিতেছি! সাধু সাধু…
মন্ত্রীঃ হে মাতা… হে ঈশ্বরী এই আদিবাসীগণ বড়ই খাতারনাক চিজ! ইহারা আমাদের তোয়াক্কা করে না, পাত্তাই দেয় না!
স্থানীয় নেতাঃ আমি কইছিলাম যে পুলিশ দিয়া পিটাইলেই সব…
ঈশ্বরীঃ এই খচ্চরটির (পড়ুন,’বাইনচোদটির’) পরিচয় কিরূপ? সে কি জানে না আমার সঙ্গে আলাপ করিতে হইলে সাধু ভাষায় আলাপ করিতে হয়?
মন্ত্রীঃ দুঃখিত মাতা! গাধাটির পরিচয় আমারই দেওয়া উচিৎ ছিল! গাধাটি আমাদের পার্টির স্থানীয় নেতা! এবং একজন উৎকৃষ্ট ষড়যন্ত্রকারী এবং চরিত্রের দিক থেকে সে উত্তম দখলদার! আগুন দিয়ে জমি দখলের এই প্রক্রিয়ায় তার অবদান এবং এলেম অনস্বীকার্য! আমি তাহার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখিতে পাই!
ঈশ্বরীঃ তুমি কি নিজের স্থানে তাহাকে দেখিতে পাও?
মন্ত্রীঃ জি মাতা! সে আমার থেকেও ভয়ংকর!
ঈশ্বরীঃ উত্তম! এখন বল আমাকে কেন তোমরা ডাকিয়াছ? যদিও ইহাই সত্য যে আমাকেই তোমরা ডাকিয়া আনিবে, কেনোনা তোমাদের সকল ব্যাধির চিকিৎসা আমার নিকটে!
মন্ত্রীঃ আমরা বড়ই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে আছি হে ঈশ্বরী! এই আদিবাসী যাহাদেরকে আমরা ফাঁপরে ফেলিয়া উহাদের ভূমি এবং সম্পদ দখল নিয়া থাকি এবং উহাদের ফুটেজ বিক্রি করিয়া বৈদেশিক খয়রাত আনি সেই সাদামাটা আদিবাসীগণের সহিত আমরা লড়াই করিরা পারিতেছি না! উহাদের বাসস্থান ভস্ম হইয়া যাইবার পরেও উহারা দৃঢ়!
ঈশ্বরীঃ …উহাদের খাদ্য দাও পর্যাপ্ত এবং অতিপ্রচারণা চালাও যে উহারা ভরা পেটে আনন্দের দিনাতিপাত করিতেছে!
মন্ত্রীঃ উহারা আমাদের দান লইতে রাজি নহে, ফিরাইয়া দিয়াছে ত্রাণের ট্রাক!
ঈশ্বরীঃ এতো সাহস!
আমলাঃ ওরা বড় বেশি অভিমানী!
ঈশ্বরীঃ তুমি আবালের মতো কথা বলিবে না হে আমার আমলা! তুমি জানো না, দরিদ্র এবং সংখ্যালঘু মানুষদের অভিমান থাকিতে নাই!
মন্ত্রীঃ কিন্তু আমি এখন কি করিব হে মাতা, হে ঈশ্বরী আমাকে ফর্মুলা দান করুণ!
ঈশ্বরীঃ বন্দুক ঠেকাইয়া ত্রাণ লওয়াও; আর সেই ছবি ছড়াইয়া দাও মিডিয়ায়! কেনোনা মিডিয়া মিথ্যাকে পাঁচবার সত্য বলিয়া প্রচার করিলে ষষ্ঠবারেই উহা সত্য বলিয়া লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়!
মন্ত্রীঃ আপনি মহান হে ঈশ্বরী!
[ বিদায়ী সাইরেন বেজে ওঠে]
স্থানীয় নেতাঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
আমলাঃ জয় মিথ্যার জয়!
মন্ত্রীঃ জয় প্রপাগান্ডার জয়!
[তারা উঠে বেরিয়ে যায়। অন্য দিক থেকে পুলিশ ঢোকে। অস্ত্র তাক করে মঞ্চে ছোটাছুটি করে। এক দল আদিবাসীদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়।]
[মাঝরাত স্থানীয় নেতার সঙ্গে মন্ত্রী, হাতে মদের বোতল; টলতে টলতে মঞ্চে ঢোকে। অনিল টুডুর গায়ে ধক্কা খেয়ে পড়ে যায়]
স্থানীয় নেতাঃ আমি বলেছিলাম না মন্ত্রী স্যার! দেখলেন ঠিক আমার কথারই কপি করে মেরে দিয়েছে ঈশ্বরী!
মন্ত্রীঃ তুই আবার কবে কি বললি?
স্থানীয় নেতাঃ কেন বলেছিলাম না যে, পুলিশ দিয়ে পেঁদিয়ে দিলেই সব সাইজ হয়ে যাবে! ঈশ্বরী তো আমাকে কপি করে একই ফর্মুলা দিলো!
মন্ত্রীঃ অ তাতে খুশির কি আছে? যেই জামানায় সকল সমস্যার সমাধান গুগোল দেয় সেই জামানায় ঈশ্বরীরাও কাট কপি পেস্ট করেই বাণী ছেড়ে দেয়! কর্মীদের মনের ভাষা কোটা দিয়ে পেড়ে খাওয়াই তো ঈশ্বরীর কাজ! প্যাটেন্ট বলে তো কিছু নেই পার্টিতে! হে হে![ উল্টে পড়ে যায় অনিলের গায়ে লেগে] যা বাবা পাথর নাকি? আমি কি পাহাড়ে?
স্থানীয় নেতাঃ অ! এতো সেই মাল! যার চোখে কোন ঘুম নেই! এই শালা আবার ত্রাণও নেয় নাই স্যার! এরে কি করা যায় স্যার!
…বাবা অনিল একটু মাল খাও বাবা! কেউ কিচ্ছু দেখবে না! সবাই তো গোপনে খায়! তুমি বাদ যাবে কেন বাবা! এসে একটু চুমুক দেও! দিয়ে অনশন ভেঙে আমাদের রক্ষে করো বাবা! তোমার যন্ত্রণায় আমাদের শান্তিসংঘ ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে! নে বাবা! মাল খেয়ে অন্তত একটু ঘুমো! আমরা যেন বলতে পারি তুই চোখ বুঝেছিস! তার মানে তোর আন্দোলন শেষ!
মন্ত্রীঃ সব বলে দিও না! লোকে হাসবে! অনিল বুঝে ফেললে, মাল খাবে না!
[সচিব ব্যস্ত এসে]
আমলাঃ এই যে আপনারা মাল নিয়ে টানাটানি করছে? আর ঐ দিকে সর্বনাশ!
মন্ত্রীঃ কেন আমার বউ এসেছে নাকি? মাল খেয়েছি শুনলে আমাকে পেঁদাবে!
স্থানীয় নেতাঃ যা শালা! আপনারও দেখি আমার কেস! জগতে ঐ একটি প্রাণীকেই আমি ভয় খাই!
আমলাঃ ফাৎরামি বাদ দিয়ে আসুন, ঈশ্বরী আপনাদের খেয়ে ফেলবে নির্ঘাত এবার!
মন্ত্রীঃ হয়েছে কি?
আমলাঃ মিডিয়ায় একটা ফুটেজ ছড়িয়ে গেছে যে, আমার বন্দুক ঠেকিয়ে ত্রাণ নেয়াচ্ছি!
স্থানীয় নেতাঃ হায় হায়! সামনে ইলেকশন! আমার কি হবে? আমার ইমেজ গেলো!
মন্ত্রীঃ চুপ চুপ! তারপর বল…
আমলাঃ অনিল টুডুর গল্প সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে যে, একজন আদিবাসী বুড়ো প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে তার ভিটে পুড়িয়ে জমি দখল নেয়ার বিচার না হওয়া পর্যন্ত সে ঘুমাতে যাবে না, এই কনসেপ্টের আঘাতে সারা দুনিয়ার আন্দোলনকারীরা তোলপাড় করে ফেলছে! বিলাতি মালেরা আসছে, অনিল দলে ভারি হয়ে যাচ্ছে!
মন্ত্রীঃ মানে?
স্থানীয় নেতাঃ অনিল হিট! তাইলে শালা নির্ঘাত ইলেকশনে দাঁড়াবে! আর আমারে হারাবে! ইইইই
আমলাঃ দ্রুত ঈশ্বরী নিকট চলুন, কেনোনা তিনিই সকল ব্যাধির চিকিৎসা!
[তারা হাঁটু মুড়ে নত শিরে হাত উঁচু করে বসে। হুইসেল বেজে ওঠে। ঈশ্বরীর কণ্ঠ শোনা যায়]
ঈশ্বরীঃ বল… মধ্যরজনীতে আমাকে কেন জাগাইয়াছ? তোমাদের সহিত নিশ্চয়ই আমার অভিসারের সম্পর্ক নাই?
আমলাঃ ক্ষমা করিবেন হে মাতা! আমিই উহাদের বলিয়াছি আপনার দ্বারস্থ হইতে! কেননা আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমরা সকলকে বন্দুক ঠেকাইয়া ত্রাণ নিতে বাধ্য করিতে গিয়া পুরা ব্যাপারটা প্যান্টে হাগিয়া মাখাইয়া ফেলিয়াছি!
ঈশ্বরীঃ তোমাকে সকাল বিকাল থাপড়ানো দরকার! আমার সঙ্গে রসিকতা করো?
আমলাঃ আমি অধম মাতা! উত্তেজনায় সাম্লাইতে পারি নাই!
মন্ত্রীঃ এখন আমরা কি করিব?
ঈশ্বরীঃ উহাদের ঘর নির্মাণ করিয়া দাও এবং উহাদের জন্য আলাদা পল্লি নির্মাণ করিয়া দাও!
আমলাঃ উহাদের জন্য পূর্বেই একটি বিশেষ ধর্মের লোকেরা খাদ্য এবং নিশ্চিন্ত জীবনের গন্ধ ছিটাইয়া উহাদের ধর্মনাশ করিয়া তাহাদের ধর্মে দিক্ষিত করিয়াছে এখন উক্ত ধর্মের কোটালেরা বৈদেশিক চাপ দিতেছে এবং তাহারাও আগ্রহী এই খেলায় অংশগ্রহণে!
ঈশ্বরীঃ তুমি পুনরায় দীর্ঘ বাক্য কেন ব্যবহার করিতেছে, তুমি কি জানো না রাজনীতিবিদদের সময়ের মূল্য অর্গাজম করিবার থেকেও মূল্যবান?
আমলাঃ দুঃখিত হে মাতা; আমি আপোনার একনিষ্ঠ ভৃত্য দয়াপূর্বক আপনি রুষ্ঠ হইবেন না, কেনোনা আমার শিশু পুত্র কন্যা এবং একটি রূপবতী স্ত্রী আছে যাহাদের অন্নসংস্থান আপনাকে দোহন করিয়াই অর্জিত হয়, আমি ক্ষমাপ্রার্থী আমার অদক্ষতায়!
[ বিদায়ী সাইরেন বেজে ওঠে]
মন্ত্রীঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
স্থানীয় নেতাঃ জয় ষড়যন্ত্রর জয়!
আমলাঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
[তারা বেরিয়ে যায়। প্রবেশ করে চোংগাওয়ালা]
চোংগাওয়ালাঃ ‘পেছন দিয়া ঢোকে পেছন দিয়া বাইর হয়!’ কন তো জিনিসটা কি? পারলেন না তো? ভাইবা সময় নষ্টের সময় নাই! উত্তর আমিই বলে যাই, জিনিসটা হইলো বাঁশ! পেছন দিয়া ঢুকলে অইটারে পিছন দিয়াই টাইনা বাইর করতে হয়! নাইলে জানে বাঁচা যায় না!
হে হে… আদিবাসীদের গ্রামে এখন কারেন্ট আসবে, আসবে জলের কল, ছনের ঘরে লাগবে এবার টিন! হে হে! উন্নয়ন হবে! খবর যখন হয়ে যায় তখন দ্রুত উন্নয়ন হয়! অথচ জমি তো দখল হয়ে যাবে! জন্মভিটা ছেড়ে দিতে হবে! আহা! কি তাজ্জব তামাশা! কিন্তু অনিল টুডুরে কি কেউ সরাইতে পারবে? তার দাঁতভাঙা পণ তো পাহাড়ের মতো ভারি হয়ে ঠায় বসে আছে! এতদিন হয়ে গেছে সে ঘুম যায় নাই! হাই হাই! এইবার আসল খেলা এইবার তামাশার ঘুল্লি! অনিলের গোত্রের সকলে যখন মেনে নেয় সিদ্ধান্ত, যখন সবাই আঁতাতে চলে যায়, যখন সকলে মেনে নেয় ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে আন্দোলন, তখন তারা নিজেরাই আসে অনিলকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে! অনিল না ঘুমালে যে এই কাহিনীর শেষ নেই… তাই তারা আসে দল বেঁধে! কিন্তু সে গান কি তারা প্রাণ থেকে গায়, নাকি তারা গানের ভেতরে ব্যথা রুয়ে দিয়ে যায়… হাঁই হাঁই… চলুন দেখি সেই দৃশ্যের রোশনাই…
[মঞ্চে স্থির অনিল টুডুকে ঘিরে বৃত্ত হয়ে বা সার বেঁধে মেয়েরা ছেলেরা মাদল বাজিয়ে গেয়ে যায়…]
‘ঘাড় ধাক্কা খেয়ে বাপুর নাম ফুইটেছে
ছনের ঘরে এবার টিনের চাল লেইগেছে
লম্বা লম্বা খাম্বা বেয়ে কারেন্ট আসিছে
লুঙ্গি খুলে মাথায় বাপুর পাগড়ি উঠিছে,
তোমার নামে হামাদের গো নাম ফুটিছে
ঘাড় ধাক্কা খেয়ে কাউয়া কোকিল হয়িছে…’
কিন্তু অনিল ঘুমায় না! হায় হায়! তার চিবুকে এক ঘৃণার হাসি ফোটে! যেন নিজের রক্তের মানুষদের এই পরাজয় তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনকে ফুরিয়ে দেয়! যেন সে ঘৃণা করে নিজেকেই নিজে! তার চোখ রক্ত জবার মতো লালা হয়ে আসে! যেন ফেটে পড়বে বোমার মতো…যেন রক্তে ভাসাবে এই চরাচর!
[ হুইসেল বেজে ওঠে। চোংগাওয়ালা বেরিয়ে যায়। তারা চারজন প্রবেশ করে ]
মন্ত্রীঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
আমলাঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
স্থানীয় নেতাঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
পুলিশঃ জয় ঈশ্বরীর জয়!
ঈশ্বরীঃ বল…তোমাদের ব্যর্থতা বল?
মন্ত্রীঃ …আমরা ঐ বৃদ্ধ আদিবাসীর কাছে পরাজিত হইয়া যাইতেছি, সে আমাদের নির্মিত গৃহ নেয় নাই এবং সে এক পা নড়েও নাই…এবং সে এখনো বিচার চায়!
আমলাঃ এই তাজ্জব আদমিটি ঘুমাইতেছে না; উহার জন্য আমরা কি করিব?
ঈশ্বরীঃ তোমাদের বেতন দেওয়ার থেকে গাধা পালন উত্তম, এইরকম সাধারণ ব্যাপারেও তোমরা আমাকে ডাকো আমি হতাশ তোমাদের কৃতকর্মে, যাই হোক; সিভিল সার্জনকে ডাকো উহার সঙ্গে পরামর্শ করো, আর সৈনিক নামাইয়া দাও অত্র এলাকাকে কর্ডন করিয়া ফেলাও, উহার বৃত্তে কেউ যেন প্রবেশ কিংবা কোন প্রকার ফুটেজ সংগ্রহ করিতে না পারে, বিদেশি দাতাদের উঁকিঝুঁকি বন্ধ করিয়া দাও, কেনোনা আমিই শেষ চিকিৎসা।
[পুলিশ এসে ঢোকে। অনিলকে ঘিরে ফেলে। একজন ডাক্তারকে দেখা যায় আমলার সঙ্গে। অনিলকে নেড়েচেড়ে ইনজেকশন দেয়]
ডাক্তারঃ যে পরিমাণ ঘুমের ওষুধ বুড়োর শরীরে দেয়া হয়েছে তাতে বুড়োর ঘুরে পড়ে যাওয়া কথা।
আমলাঃ আরো দাও, ওর ঘুমাতে না যাওয়া আমাদের ঘুমকে হারাম করে দিয়েছে।
ডাক্তারঃ আরো দিলে ও মরে যাবে।
আমলাঃ চলো চলো এখান থেকে বিদায় নেই, ওর চোখে চোখ রাখা যাচ্ছে না, উফফফ; কেমন জানি ভয় ভয় লাগে।
[ফাঁকা মঞ্চে অনিল একা পাথরের মতো কাঁপতে থাকে। একটা মাদল নিয়ে গানের দল সার বেঁধে গান গায়]
[গান]
কার গাছেতে আম ধরেছে কে নিয়েছে পেড়ে
কার কাছেতে নালিছ দেবো বলবো কাকে গিয়ে
বলবো কাকে কার কাছে বিচারপতি আমগাছে
আম পেড়ে খায় গাছের ডালে বসে
নালিশ দেবো আমরা বাবু কাকে
নালিশ করে আমজনতা পাবে শুধু বালিশ
তাইতো নালিশ করবো না আর দেবো না গো সালিস
কলাপাতার বিনুনি বাপের জন্মে শুনিনি
এ দেশেতে এখন সবই হয়
কার গাছের আম কে যে পেড়ে নেয়
[গানের দলের প্রস্থান। দেখা যায় মঞ্চে অনিল নেই! বা তার সারা গায়ে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ । চোঙগাওয়ালার দ্রুত প্রবেশ]
চোংগাওয়ালাঃ হায় হায় একি ঘটে যায়! তাজ্জব ঘটনা হে! কোথায় সমঝদার লোকেরা সকল! আসুন সকলে হে, দেখুন সকলে হে… অনিল টুডুর শরীরে সেই রাত্রিরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে! সে আগুন নেভাবার নয়! নয় সে আগুনে জল দিলে নিভে যায়। যেন সে দাবানল। সে আগুন নিভাবার জন্য জল খুঁজে পাওয়া যায় না! খুঁজে পাওয়া যায় না কে আগুন দিলো! কেম্নে এমন করে মানুষের দেহে আগুন জ্বলে? হাঁই হাঁই! কি তাজ্জব দেখি ভাই! অনিল টুডু ভস্ম হয়ে যায়! চোখের নিমেষে সৈন্যদের পাহারার মধ্যে সে ভস্ম হয়ে যায়, কিন্তু তারে কেউ বাঁচাতে পারে না! লোকে বলে যাদুটোনা কিন্তু আমরা জানি এ এক অন্য টোনা! আদিবাসীরা জানে, অনিল তাদের সেই আগুন ছিল যার বক্ষে হাজার বছরের পুঞ্জিভুত সাহস! সেই আগুনের তাপেই সে নিজেরে শেষ করে দেয়! থুতু দিয়ে দেয় দখলদার আর রাজনীতিবিদদের মুখে! হাঁই হাঁই… তাজ্জব হয়ে যাই অনিল টুডু মুহূর্তের মধ্যে সকলের চক্ষের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়! নিজের আগুনে সে নিজেরে অঙ্গার করে দেয়!
[ ব্যস্ত ছুটে আসে সকলে ]
আমলাঃ হায় হায়! সর্বনাশ!
মন্ত্রীঃ নির্ঘাত গোপন ষড়যন্ত্র!
স্থানীয় নেতাঃ আমার দিকে তাকান কি জন্য?
আমলাঃ সব তো আমাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল, তাহলে আগুন লাগলো কি করে?
পুলিশঃ আমরা কিছুই জানি না! ঘিরে ছিলাম! হঠাৎ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো!
আমলাঃ উঁহু উঁহু! এমন তো হবার কথা নয়! তদন্ত হওয়া চাই! কেরোসিন আসলো কোত্থেকে?
পুলিশঃ চারপাশের পুকুরে একফোঁটা জল খুঁজে পাওয়া যায়নি! আচমকা রাতের আঁধারে সব শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে গিয়ে দেখুন!
আমলাঃ উঁহু! ম্যাচ আসলো কার পকেট থেকে?
মন্ত্রীঃ কি আশ্চর্য! এর মধ্যে তুমি কি শুরু করলা?
আমলাঃ আমার চাকরি না বাঁচলে না খেয়ে মরবো!
মন্ত্রীঃ আরে রাখো তোমার চাকরি! চলো আগে ঈশ্বরীরে সামলাই!
[তারা হাঁটু ভেঙে বসে। সাইরেন বেজে ওঠে]
মন্ত্রীঃ ঈশ্বরী আমরা পরাজিত!
ঈশ্বরীঃ …তোমাদের থেকে গাধারা অতি উত্তম কেননা গাধারা দুধ দেয় আর তোমরা কেবলই গু উৎপাদন করো, তবু ভালো তোমরা শেষমেশ আমার কাছেই আসো কেনোনা আমিই শেষ চিকিৎসা।
আমলাঃ এখনই একটা উপায় বাতলে দিন নইলে এই খবরের দায় আমাদের কাঁধে পড়িবে আর বিশ্ব মিডিয়া সরব হইলে আপনার তখৎ নড়িয়া যাইতে পারে!
ঈশ্বরীঃ হা হা হা…! তোমরা জানোই না আমি কি মাল, তথাপি আগামী সূর্যের আলো ফুটিবার সঙ্গে সঙ্গে বড় কোন ঘটনা ঘটাও, এবং অভিযানটি সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা সৃষ্টি করো, পুরা জাতি ইন্দুর বিলাই খেলা দেখিতে দেখিতে ভুলিয়া যাইবে অনিল টুডু বলিয়া কেউ ছিল কিংবা তাহাদের কোন গল্প ছিল! হা হা হা…
[বিদায়ী সাইরেন বেজে ওঠে। সকলে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ‘জয় ঈশ্বরীর জয়’]
[ সবাই বেরিয়ে যায়। চোংগাওয়ালা আসে। অফট্রাকে মৃদু বাজে, ‘ঘাড় ধাক্কা খেয়ে বাপুর নাম ফুইটেছে…’ ]
চোংগাওয়ালাঃ না না অনিল টুডু মরে নাই! আমি জানি মরে নাই! সকলে চলে যেতেই আমি দেখেছি, আমি দেখেছি সে আছে; তার গল্প আছে তার ছায়া আছে, অনিল টুডু মরে নাই…ঘুম যায় নাই অনিল টুডু, আমি দেখেছি… দেখেছি তার দেহভস্মের উপর পড়ে আছে তার দুটো তাজা নির্ঘুম চোখ!
সমাপ্ত