শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। আহাদ আহমেদ ।। জোড়া ভাই ।। বদরুজ্জামান আলমগীর

আহাদকে আলাদা করতে পারছি না, খালি ওই কথাটা মনে পড়ছে- এক ঝোড় টান দিলে বেক ঝোড় লড়ে।

আহাদকে এককভাবে ভাবতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে মধ্য আশির রাজপথ, মিছিল, অবরোধ, প্রতিদিন মধুর ক্যান্টিন। এই আগুন আর নির্ঘুমের ভিতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠে একটি নতুন ছাত্র সংগঠন : বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, পত্রিকায় যাকে বলা হয়- ক্যাকোফোনি অন ক্যাম্পাস। জন্মের প্রথম যে মিছিল বেরুলো মধুর ক্যান্টিন থেকে- ওখানে আহাদ ছিল, অবশ্যই ফয়জুল হাকিম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিল, আমরাও ছিলাম তার অংশ। নতুন সংগঠন, নতুন শ্লোগান- বুর্জোয়াদের দুই গুণ, নির্বাচন আর মানুষ খুন।

এরশাদ পড়ার আগ পর্যন্ত এমন একটি দিনও বোধকরি বাদ যায়নি- যেদিন কিছু না কিছু করা হয়নি- হয় মিছিল, নয় সমাবেশ, নয়তো লিফলেট বিলি, প্রেসে গিয়ে সংকলনের কাজ করা, নাটক লেখা, রাতদিন তার রিহার্সাল- কী নেই সেখানে! পিছনে ফিরে তাকালে অনুভব করি- বাঙলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক যে মেরুদণ্ডের উপর আমরা এখনো আস্থা রাখি, কখনো রূপকথা সাজাই- তার সিংহভাগই গড়ে উঠেছিল ৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ভিতর।

আহাদ থাকতো ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলে। আমি অনেকদিন আহাদের রুম ৭০৮ নম্বরে ছিলাম। ওখানেই আহাদের ছোটভাই প্রিন্সের সঙ্গে দেখা, পরে আশীষ খন্দকার, তার পরে এমেরিকায় এসে মোস্তাকিন।

৭০৮ নম্বর কক্ষে আহাদের কল্যাণে আমার যে কতো অতলান্ত সত্যের সঙ্গে দেখা হয়েছে তার দুই একটা জীবনের মোড় ঘোরানো।

আমি আগেই জানতাম- শহীদুল্লাহ্ হল আর ফজলুল হক হলের মাঝখানের পুকুরের তলায় আমার জন্মের পরের কাটা নাভি ডুবে আছে।

আমার ছোট মামা মিজবাহউদ্দিন আহমদ মিজু আমার জন্মের পর আমার কাটা নাভি এনে ফেলেছিলেন এই পুকুরের জলে; আমাদের লৌকিক বিশ্বাস এমন- বিদ্বান জায়গায় প্রথম কাটা নাভি ফেললে বড় হয়ে সে বিদ্বান হয়! আমার ছোট মামার বাসনা ছিল- বড় হয়ে আমি যেন জ্ঞানেগুণে বড় হই। আমার মামা তাই সুদূর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার জ্ঞানপুর গ্রাম থেকে এতোদূরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরঘাট পর্যন্ত এসেছিলেন।

মিজু মামার কপাল ভালো যে, তার সেই ভাগ্নের বিফলতা দেখার জন্য এতোদিন ধরে বেঁচে থাকতে হয়নি; একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মামা শহীদ হন। ফলে তাকে দেখতে হয়নি- তার এমন সাধের ভাগ্নে বিদ্বান হয়নি- সম্পূর্ণ পথের মানুষ হয়েছে!

আহাদকে কাটা নাভির কথা বললে আহাদ শিউরে উঠে বলে- বলেন কী! আমাদের তাহলে পুকুরে নামতেই হবে। আহাদ এবং আমি ছাড়া এ-কথা আর কেউ জানে না। আমরা সত্যিসত্যিই পুকুরে নামি- যদ্দূর মনে পড়ে, হাবিব,লিটন, দীপু, মতিন, চপলও ছিল।

সেদিনের শিহরণের কথা আজও আমাকে নাড়িয়ে দেয়। পুকুরে নেমে মনে হয়- ২টা আমি, একজন ভাসে, একজন ডোবে।

পরেও আহাদ কতো বিষয়ে খাপেখাপ রেফারেন্স দিয়েছে। রশীদ খানের ইয়াদ পিয়া কি আয়ে গানটা আমার ভীষণ পছন্দ। আহাদের সঙ্গে এসব জিনিস শেয়ার করাই আমার রেওয়াজ। আমি গানটা আহাদকে পাঠালে সে এই গানের নাড়িনক্ষত্র আমাকে মুহূর্তের মধ্যে বলে দেয়। বড়ে গোলাম আলী খানের ওরিজিনাল কম্পোজিশন। স্ত্রী বিয়োগের পর খাঁ সাহেব এই বন্দিশ রচনা করেন।

সারাদেশে আহাদদের ৪ভাইয়ের সঙ্গেই আমার এক অকাট্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ৪ভাই, কিন্তু আমার কাছে ওরা একজোড়া ভাই। আমি এখনো মিলাতে পারি না- কীভাবে সবগুলো ভাইয়ের একযোগে এমন মেধাবী আর সৃজনশীল হয়ে ওঠা সম্ভব! আজ অন্যদের কথা না বলে কেবল আহাদ আহমদের কথা-ই বলি।

আহাদ যখন ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত নিয়ে কথা বলে, তখন মনে হয়- এ কী সেই একই আহাদ যে মধুর ক্যান্টিন থেকে উঠে এসেছে! আহাদের অনুবাদ দেখলে যে কেউ ভাববে- সে বুঝি তুলনামূলক সাহিত্য পড়ে আসা ছেলে; আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসম্পর্ক বিষয়ে যে কোন অধ্যাপকের চেয়ে আহাদের গভীরতা অনেক বেশি।

আহাদ বিষয়ে এই চালচিত্রের ভিতরে একদিন শুনি- আহাদ বিএনপি করছে। আমি সঙ্গেসঙ্গে আহাদকে জিজ্ঞেস করি- এইগুলান কী শুনতেসি আহাদ- আপনি নাকি বিএনপিতে গ্যাচেন? আমার প্রশ্নটাতে আহাদ কেমন জানি পিছলাইয়া যায়। প্রশ্নের উত্তর না দিয়া আহাদ আমাকে বলে- কবে দেশে আসবেন নির্জন? চলেন মধুর ক্যান্টিনে গিয়া বসি!

একজন বাবা যেমন তার সন্তানকে কাঁধে নিয়ে ঘোরে, একটি জাতিও তার সন্তানদের কাঁধের চওড়া অভয় ভূমি বাড়িয়ে ধরার কথা। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত দুর্ভাগ্য- কতোটাই না ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছি আমরা!

আমরা বুঝি সেই জেনারেশন- যাদের চন্দ্রবোড়া সাপে দংশন করে অমাবস্যায়, কিন্তু বিষ উজায় পুর্ণিমায়!

যে এতোকিছু জানে- সে চলে যেতেও জানবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! আহাদের কাছে লেখা পাঠালে আহাদ সাধারণত উদ্বেলিত হয়ে বলতো- কিয়া বাত, কিয়া বাত!

আপনি আমাদের একনিষ্ঠ খাঁটি বন্ধু; তাই এই অবেলায় একটি মোক্ষম জ্ঞানের সারবস্তু বলে গেলেন- শিকারী বনের চারদিক ঘিরে আস্তে মধ্যবনের দিকে ঘন হয়ে আসে- আমরা আটকেপড়া হরিণ; ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পুরিয়া ধনশ্রী রাগের মতোই ভয়ানক সুন্দর সেই বাণী- আমাদেরও জীবন মাধুরি ক্ষয় হইয়া আসে, কিয়া বাত, কিয়া বাত!

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top