দৃষ্টি সংক্রান্ত // লুনা রাহনুমা

পাওয়ার কাট হয়ে পুরো ঘরে আলো বন্ধ হয়ে গেলেও, ওরা অন্ধকার মেঝেতেই বসে থাকলো। জানালার পর্দা খোলা ছিল, আর চাঁদটি জানালার বাইরে সেই উঁচুতে বসে দেখছিলো ওদের দুজনকে। বেথের মনে পড়েনা, শেষ কবে তারা এতটা কাছাকাছি বসেছিল, এভাবে। ইভান ওর বাম হাতটি ধরে রেখেছে নিজের হাতে আর স্ত্রীর প্রতিটি আঙুলের উপর ঘুরেঘুরে নিজের আঙ্গুল বুলিয়ে খেলছে আপনমনে। বেথ ইভানের কাঁধে মাথা রাখে। স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে সে স্বামীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের উঠানামার সাথে সাথে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের নড়াচড়া অনুভব করে। বেথের মনে হয়, ঘরের ভেতরটা যেন থমকে আছে। স্থির এবং খুব ছোট এই ঘরটি। দেওয়ালগুলি যেন ওদের চারপাশে চেপে আছে।

– শোনো, আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। বেথ তাদের শিশু কন্যা রোজের ছোট্ট আঙ্গুলগুলোর কথা বলে ইভানকে। আঙুলের ডগাগুলো, যেগুলো দেখতে চিকন সূঁচের মতো পাতলা, সরু। বেথ জানায় সেই আঙুলের ভেতর থেকে কেমন একরকম আলো বেরুতে দেখেছে সে। আঙুলের ডগায়, অদৃশ্য গর্তের ভেতর থেকে আলো আসছে যেন। দেখতে তারার মত লাগে।

– কি বলছো তুমি? ইভান আঁতকে উঠে।

বেথ তাদের কন্যা শিশুর শরীরের অংশ বিশেষ হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর সেখানে অলৌকিক আলো ফুটে উঠার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে।

– এটা সম্ভব না। ইভান তক্ষুনি বাচ্চাকে পরীক্ষা করে দেখতে চায় স্ত্রীর কথা সত্য কিনা।

– রাত দশটা বেজে গেছে, এখন থাক, বেথ বলে। এখন ওর ঘুম ভাঙালে আর ঘুমুতে চাইবে না।

ইভান নিজের হাত থেকে বেথের হাতটি সরিয়ে দিলো। যদিও সে উঠে দাঁড়ায় না। নিজের কাঁধ থেকে বেথের মাথাটিও সরিয়ে দিলো। দুইহাত প্রসারিত করে শরীরের আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টা করে। হাই তুলে ইভান জানালো তার ঘুম পেয়েছে। কিন্তু সে বিছানায় যাবার জন্য মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায় না। দুইজনের মধ্যকার প্রেমময় নিস্তব্ধতাটুকু সরে গিয়েছে পুরোপুরি।
বেথ ওখানেই, মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেকরাতে যখন তার ঘুম ভাঙলো, সেখানে সে একাই ছিল। শরীরে আর মনে শক্তি ফিরে এসেছে কিছুটা। পাওয়ার কাট শেষ হয়ে ঘরে বাতি জ্বলছে আবার। রান্নাঘরে, তিনি যে রেডিওটি শুনেছিলেন, সেই রেডিও আবার কথা বলা শুরু করেছে। বেথ বসার ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। রেডিও বন্ধ করে দিলো। সিঁড়ি বেয়ে পা টিপেটিপে উপরতলায় শোবার ঘরে গিয়ে স্বামীর পাশে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিছানার চাদর খুব ঠান্ডা। তার ঘুম আসে না।

সকালে, বেথ আর ইভান বাথরুমে মেয়ে রোজকে দাঁড় করিয়ে খুব ভালো করে তার দুইহাত পরীক্ষা করে। বাচ্চাদের হাতের মতোই রোজের হাত। হাতের আঙ্গুলগুলো খুব নরম এবং নিখুঁত। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে বলে সেই হাত এখনও গরম হয়ে আছে। অস্বাভাবিক কিছুই দেখা গেল না রোজের হাতে বা শরীরে কোথাও।

রোজের আঙুলের গর্তটি নাই হয়ে যাওয়ার পরে, শরীরের অন্যত্র আরেকটি আলোময় গর্ত আবিষ্কার করে বেথ। এবার বাচ্চাটির মুখে, ঠিক চোয়ালের নীচের দিকটায়। একটা বোতাম আকারের গর্ত। বেথ গর্তের ভেতর দিয়ে অন্যদিকের বস্তু দেখতে পারছে। গর্তের প্রান্তটি অস্পষ্ট, ঝাপসা। বেথ নিজের চোখ ঘষে নিলো কয়েকবার। কিন্তু তাতে গর্তটির কোন পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন বলতে যদি কিছু হয়, তবে বলা যায় গর্তটা খানিকটা বড় হয়েছে, তার ভেতরে আলোর বিচ্ছুরণ আরো উজ্জ্বল হয়েছে।

বেথ তার মাকে ফোন করে। বেথের মা, কাগজ দিয়ে নানারকম জিনিস তৈরি করতে পছন্দ করেন। জন্মদিনের কার্ড, ফুল, অরিগামি, রাজহাঁস। রোজের জন্মের আগে, তিনি দুটি কার্ড তৈরি করেছিলেন, একটি গোলাপী, একটি নীল। মেয়ে হলে গোলাপি কার্ড আর ছেলে হলে নীল। কিন্তু বাচ্চার জন্মের পর তিনি একটি কার্ডও পাঠাননি। নাতনির জন্মের পর তিনি মেয়েকে যে উপহারটি পাঠিয়েছিলেন সেটি ছিল একটি সাবান। সাবানটি একটুকরো খরখরে কাগজ দিয়ে মোড়ানো ছিল এবং তার উপরে একটা গোল্ডেন কালারের স্টিকার লাগানো ছিল। বেথ ইন্টারনেটে সাবানের ব্র্যান্ডটি খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে। ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী, সেই কোম্পানি সাবানটি ১৯৮৫ সাল থেকে উৎপাদন করা বন্ধ করে দিয়েছে। বেথ তখন মনেমনে বলেছে, আমার মা চায় আমি এই সাবানের তথ্য নিজে ঘেঁটে বের করি, আমি যেন এই পৃথিবীর মানুষ না!

মায়ের সাথে কথা বলার সময় বেথ ব্যাকগ্রাউন্ডে কাঁচি দিয়ে কাগজ কাটার খচখচ শব্দ শুনতে পায়। সে চোখের সামনে ঝাপসা দেখতে পায়, মায়ের গোড়ালি পযন্ত ডুবে আছে যেন টুকরো টুকরো কাগজের স্তুপের ভেতর। মা বেথকে কাগজ দিয়ে পুতুল বানানো শিখিয়েছিল। বেথের চারপাশে কাগজের টুকরোগুলি কাগজের পুতুলের মতো উড়েউড়ে পড়ছে। কিন্তু, বেথ আর ওর মা, একসাথে যুক্ত হবার বদলে সবসময়ই পৃথক হয়ে গিয়েছে একে অন্যের কাছ থেকে। শৈশবে যেমন পৃথক করে তারা কেঁচি দিয়ে কেটে পৃথক করে ফেলতো কাগজের পুতুলগুলোকে।

বেথ, মাকে রোজের শরীরে আলো ফুটে উঠার কথাটি বলে। তিনি বেথের কথা পাত্তা দিলেননা। বাচ্চার কোন সমস্যা নেই।
– এগুলো সব তোমার মনে কল্পনা, মা বলেন, – তোমার মনের ভেতর এখনো উদ্ভট সব চিন্তা ঘুরপাক খায়।

– হয়তো আমি খুব ক্লান্ত থাকি বলে এসব হচ্ছে।

– ওর বয়স এখন তিন, মা বলেন। – ও কেন এখনো রাতে এতবার করে তোমার ঘুম ভাঙ্গায়?

– ও আমার প্রথম সন্তান। আমি এতো কিছু জানবো কিভাবে?

একটা সময় ছিল যখন বেথ সবকিছুই বিশ্বাস করতো। তুষারপাত হলে, বাবা তাকে মাঠে ইয়েতির পায়ের ছাপ খুঁজতে নিয়ে যেত। কখনও কখনও তারা সেই ছাপ খুঁজেও পেত।

রোজকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় বেথ। একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে রোজ, তার পা দুটি ঝুলছে। স্যান্ডেল পরা পা দুখানি তালেতালে সামনে পেছনে দুলাতে থাকে বাচ্চাটা। বেথ ডাক্তারকে রোজের শরীরের স্থানগুলি নির্দেশ করে দেখায়, যেখানে সে গর্তগুলো দেখেছিল আগে। ডাক্তার রোজকে দেখে, তারপর আবার বেথকে দেখে। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন বেথের দিকে।

– গর্তগুলো আসে আবার চলে যায়, মনে হয়। বেথ ইতস্তত করে বলে।

– আপনি কি খুব দুশ্চিন্তা করেন? ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, – কিছু মানুষ আছে যারা অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা করে তাদের নিজেদের ও প্রিয়জনদের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে। আতঙ্কে ভোগে, এই বুঝি কিছু খারাপ হচ্ছে তাদের শরীরে।

রাতে ঘুমোনোর আগে বিছানায় শুয়ে বেথ নিজের হার্টবিট গুনতো। কোথাও পড়েছিলো, একটি মানুষের জীবদ্দশায় তার হার্ট কয়েক বিলিয়নবার বিট করে। তার ধারণা ছিল যে, মানুষের হার্ট একটি নির্দিষ্টবার বিট করে ফেলার পর সেই মানুষটি আপনাআপনি মরে যায়। তাই সে নিজে নিঃশ্বাস ফেলতো খুব সাবধানে। গুনেগুনে, গভীরভাবে আর ধীরে ধীরে। হার্ট যেন বেশিবার বিট করে না ফেলে সেই চেষ্টায় থাকতো সবসময়।

– আমি দুশ্চিন্তা করি না, ডাক্তারকে জানায় বেথ।

ডাক্তার তাকে দিনে তিনবার ব্যবহার করার জন্য কিছু ক্রিম দেয়।

ছোটবেলা থেকেই জীববিজ্ঞানের চেয়ে পদার্থবিজ্ঞান বেশি ভালো বুঝতো বেথ। স্কুলে থাকার সময় সে সার্কিট বানাতে পছন্দ করতো। বিজ্ঞানের এই বিষয়গুলো অনুমান করা যায় এবং যৌক্তিক। রবিবারের সংবাদপত্রে ডায়াগ্রাম এঁকে দেখানো থাকতো সার্কিট বানানোর পদ্ধতি, যেগুলো দেখে সহজে বোঝা যেত মেশিনগুলো কিভাবে কাজ করছে: ফটোকপিয়ার, ফ্যাক্স, ক্যামেরা, টেলিভিশন। বেথের বাবা রবিবারের এই ফিচারগুলো কেটে জমিয়ে রাখতেন মেয়ের জন্য। ডায়াগ্রামগুলো দেখলেই যেকেউ বুঝতে পারবে মেশিনগুলোর ভেতর যন্ত্রাংশগুলো কিভাবে একটির সাথে অন্যটি যুক্ত হয়ে কাজ করছে। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস ভিন্নভাবে তৈরি হচ্ছে। তাদের কাজ করার পদ্ধতিও আগের চেয়ে আলাদা। এখন এমন অনেককিছু ঘটছে যেগুলোর কর্মপদ্ধতি বেথ ধরতে পারে না। অভিনব অনেক কিছু ঘটে যায় আজকাল তার চারপাশে, যেগুলো সে একেবারেই বুঝে উঠতে পারেনা। যেন সেসবের কাছে বেথের কোন উপস্থিতিই নেই।

রোজের ডান হাঁটুর নীচে এখন আরেকটি গর্ত বা অদৃশ্য স্থান দেখা যাচ্ছে। এটি দশ পয়সার সমান আকৃতি। বেথ রোজের হাঁটুতে হাত রাখলো, ত্বকে আলাদা কিছু অনুভব হয় না। শরীর গরম আছে, হাঁটু হাতে লাগছে, শক্ত- যেন সেখানে অনুপস্থিত অংশ নেই। কিন্তু, হাত সরিয়ে নিলে হাঁটুর বিশেষ স্থানটিতে গর্ত বা অদৃশ্য আলোময় স্থানটুকু আবার দেখা গেলো। ছোট্ট রোজ ভেবেছে এটা ওর মায়ের একটা খেলা হয়তো। সে নিজেও মায়ের গায়ে হাত রাখে তারপরে আবার তা দ্রুত সরিয়ে নেয় আর দেখে যে নীচে কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা।

ইভান নানা বিষয় সম্পর্কে অনেক জ্ঞান রাখে। এই যেমন, পুরো পৃথিবীতে যে পরিমাণ স্বর্ণ আছে তা দিয়ে দুটি সুইমিং পুল ভরে ফেলা যাবে এবং এরপর এই পৃথিবীতে আর কোথাও থেকে বিন্দু পরিমাণ স্বর্ণ উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। ইভান আকাশের তারা সম্পর্কে জানে, মহাকাশ, গ্রহ-নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে জানে। সে জানে যে মানুষ আসলে কতটা তুচ্ছ। মহাকালের পুরো সময়টুকুকে একটি দিনের ভেতর ঠেসে ভরে দিলে, মানুষের জীবনকাল অনাকাঙ্খিতভাবে ভীষণ ক্ষুদ্র হয়ে যাবে।

ইভান আকাশ, আলো এবং স্থান সম্পর্কে অনেক জানে। দৃশ্যমান কিংবা দৃশ্যমান নয়- এমন বিষয় সম্পর্কে জানে। শব্দ সম্পর্কে জানে। জানে যে “লিশন” বা ক্ষত শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে যার অর্থ ইনজুরি অথবা আঘাত। ইভান এক টুকরো কাগজ নিয়ে “স্কাই-সায়ান (Sky-sion)” শব্দটি লিখলো।

– তুমি যে গর্ত বা আলোর কথা বলছো, সেগুলো মনে হয় এমন কিছু হবে, কাগজটি বাড়িয়ে দিলো ইভান।

– তুমি এদের একটি নাম দিয়েছো, বেথ বলে – আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি?

– তুমি যা খুশি ভাবতে পারো।

– তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, নাকি করোনা?

– আমি জানিনা, ইভান বলে – নিজে না দেখে কীভাবে বিশ্বাস করবো?

– তুমি কি আমাকে পাগল মনে করো, বেথ জানতে চায়।

– তোমার কী মনে হয়, তুমি কি সত্যি পাগল?

বেথ আবার যায় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকে জানায় ক্রিমটি কাজ করছে না। তারপর ইভানের লেখা কাগজের টুকরোটি এগিয়ে দিলো ডাক্তারের কাছে।

– আমার অসুখটি কি এটা? আমার সাথে যা ঘটছে তার নাম কি এমন কিছু? বেথ জানতে চায়।

ডাক্তার কাগজে লেখা শব্দটি পড়ে হাসলো। বেথের সাথে কথা বলতে বলতে তিনি কাগজটিকে ভাঁজ করে আঙুলের টোকায় ছুড়ে বিনে ফেলে দিলেন।

– শব্দটা আমি লিখেছিলাম আমার অসুখটা কেমন সেটা বর্ণনা করতে, বেথ বলে, – আমার মনে হয়েছে, এই শব্দটি ধরে আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।

ডাক্তার দ্রুত হাতে বেথের জন্য একটি প্রেসক্রিপশন লিখে দিল।

– একটা কিছু নাম দিয়ে দিলেই যেকোন কিছু সত্যি হয়ে যায় যায় না, বলে ডাক্তার।

বেথের মনে পড়ে বরফের স্তুপের উপরে দেখা পায়ের ছাপের কথা, কাগজের পুতুলগুলোর কথা যাদের হাতের সাথে হাত লেগে থাকার কথা ছিল, কিন্তু তাদের হাতের সংযোগ কেটে ফেলা হয়েছিল।

ডাক্তার বলেছে ব্যায়াম করতে। তাই সাঁতার ভালো না জানলেও বেথ পুলে যায়। ভুল সময়ে বাতাস টেনে ফুসফুসে পানি ঢুকে যাবার ভয়ে থাকে। পুলে যাবার আগে বড় হলঘরটিতে, দুইটি মেয়ে টেবিলের উপরে সাদা চাদর বিছাচ্ছে। পাশে দেয়ালে একটা ছবি টানানো। ছবিতে পুলের পানিতে প্রথম সারিতে দুইজন সাঁতারু এবং পাশেরটিতে ধীর গতিতে তিনজন সাঁতারু রয়েছে। তারা পানি থেকে মুখ বের করে সাঁতার কাটছে। বেথ জানে বাচ্চারা এখন সাঁতার কাটার সময় মাথা শুকনো রাখা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা সকলেই পানির ভেতরে মুখ ডুবিয়ে এবং শ্বাস নিতে নিতেই তাদের সাঁতারের পাঠ শুরু করে। সবকিছু এখন আলাদা, এমনকি শ্বাস নেয়া ও ফেলা।

সাঁতার কাটা শেষে বেথ যখন তার লকারের কাছে ফিরে এলো, তখন ওর ফোন বাজছিলো। লকারের ভেতরে সাইলেন্ট করে রাখা মোবাইলটি ভাইব্রেশনে কাঁপছে বোঁবোঁ শব্দ করে। বেথ কল্পনা করতে পারে ফোনের ওপাশে ইভানকে। একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পথে ওদের সন্তানটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে তারা দুই জন। বেথ যখন লকার খুলে ফোনটি বের করলো, তখন রিং বন্ধ হয়ে গেছে। আননোন নাম্বার থেকে কেউ ফোন করেছিল।

বড় হলঘরটিতে মেয়ে দুটি টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। তারা বিয়ে-মেলার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এখানে। একটি মেয়ে পুতুলকে গাউন পরিয়েছে, আর সেটির কোনও মুখ না থাকলেও, তার মাথায় একটি ওড়না পরানো হয়েছে। টেবিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি মেয়ে বেথকে লিফলেট দেওয়ার চেষ্টা করে। ইভান বলে রোজকে সাঁতারে নিয়ে আসতে। কিন্তু রোজ যদি সাঁতার শেখার সময় পানির ভেতর অদৃশ্য হতে শুরু করে? ওকে যদি আর খুঁজে পাওয়া না যায়?

বাড়িতে বেথ অন্ধকার বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার হাতড়ে লাইটের দড়িটি খুঁজে জোরে টান মারলো। বাথরুমের ছোট্ট বাতিটি উজ্জ্বল আলোয় জ্বলে উঠলো। আয়নার উপর ভেসে উঠা মেয়েটিকে চিনতে পারে না সে। জলদি করে দড়ি টেনে বাতিটি নিভিয়ে দিল সাথে সাথে।

সকালে ঘুম ভেঙে বেথ রোজকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।
– রোজ, বলতো, তুমি আয়নায় কি দেখছ?
– রোজ।
– ঠিক বলেছো, কিন্তু এখানে এটা কি? রোজের বাম কনুইয়ের ঠিক উপরে নতুন আরেকটি জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে দেখায় বেথ, কনুইয়ের যেখানে রোজের শরীর ভেদ করে এপাশ থেকে ওপাশে দেখতে পাচ্ছে বেথ।
– আমার হাত, রোজ বলে।

বেথ অপটিশিয়ানের কাছে গেল চোখ পরীক্ষা করতে। চৌদ্দবছর বয়স থেকেই সে চশমা পরে। অপটিশিয়ান বেথকে চেয়ারে বসিয়ে ছোট কার্ডে লেখা সংখ্যাগুলো পড়তে দেয়। বেথের মুখ থেকে আগের চশমাটি খুলে টেবিলের উপর রাখেন তিনি।

চোখ পরীক্ষা করার উদ্ভট ফ্রেমের চশমাটিকে বেথ একদম পছন্দ করেনা। লোহার মতো ভারী ফ্রেমটির ভেতরে অপটিশিয়ান একের পর এক লেন্স দিয়ে সামনের সংখ্যাগুলো পড়তে বলে। এই চশমাটি পরলে নিজেকে দৈত্য মনে হয় তার। কিছুতেই বুঝতে পারেনা, চশমা পরে সে ভালো দেখে, নাকি না পরে? চার্টের সংখ্যাগুলো মনে হয় সব ভাসছে, না হয় দুলে উঠছে।

ডাক্তার বেথের চোখে আলো ফেলে দেখতে মুখের কাছে নেমে আসে। বেথ নিজের মুখের উপর অপটিশিয়ানের নিঃশ্বাস অনুভব করে, লোকটির শরীরের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। খুব অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। বেথ ভেবে আশ্চর্য হয় তার নিজের নিঃশ্বাসের গন্ধ কেমন হতে পারে? চোখের ভেতর ব্লাইন্ড স্পট পরীক্ষা করার জন্য অপটিশিয়ান বেথকে টর্চের আলোর মতো জ্বলেজ্বলে নিভে যাওয়া লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলে। বেথের মনে পড়ে প্রথমবার দেখা রোজের আঙুলের ডগায় সেই ছোট্ট তারাটির কথা। এই আলোগুলোও ঠিক তেমন, সংক্ষিপ্ত, আর চারপাশটা খুব অস্পষ্ট।

– আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত না। রোজের শরীরে যা দেখেছি, সেগুলো আমার কল্পনা হতে পারে, অপটিশিয়ানের চোখ পরীক্ষা করা শেষ হলে বলল বেথ।

অপটিশিয়ান জানায়, বেথের চোখে কোন সমস্যা নেই। টেবিল থেকে চশমা তুলে বেথের মুখের উপরে বসিয়ে দিলো সেটিকে। বেথের চোখের সামনে সবকিছু আবার পরিষ্কার হয়ে গেল, কিন্তু মাথাটা কেমন হালকা অনুভূত হচ্ছে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো রোজের ডাকে। কিন্তু মেয়ের রুমে গিয়ে তাকে দেখতে পায় না। কয়েক সেকেন্ড পর দেখল রোজ বিছানার কোণে বসে আছে। কিন্তু সেখানে কেবল অর্ধেক রোজ। ওর শরীরের বাম দিকটি পরিষ্কার, মাঝখানের অংশটুকু বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং ডান দিকটি একেবারেই নেই। বেথ মেয়েকে কোলে করে নীচে নামায়। সে অনুভব করে মেয়ের শরীরের অদৃশ্য হাতটি তার গলায় জড়িয়ে আছে। অদৃশ্য পা`টি তার কোমরে চেপে ধরেছে। তিন বছরের একটি বাচ্চাকে কোলে নিলে যেমন হয়, সবকিছু ঠিক তেমনি আছে। শুধু বেথের বুকের খাঁচার ভেতর হৃৎপিন্ডটি খুব জোরে লাফাচ্ছে, যেন সেটি খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রোজকে রান্নাঘরে টেবিলের উপর বসিয়ে বেথ নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়। ডাক্তারের দেয়া ক্রিমটি ঘষতে থাকে রোজের শরীরের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া অংশে। সারাদিন ধরে অল্প অল্প করে রোজ আবার সম্পূর্ণ হয়ে ফিরে আসে।

এখন বেথের মনে হচ্ছে, সমস্যাটি নিশ্চয়ই ওর নিজের চোখে। ডাক্তার এবং অপটিশিয়ান যাই বলুক না কেন। তারা সব কথা জানে না। তারা সবকিছু বুঝে না। এইমুহূর্তে, বেথ তার নিজের ডানহাতের উপরে ছোটছোট অনেকগুলো তারা দেখতে পাচ্ছে। ফ্যাকাশে আর ঝাপসা আলোর স্ফুলিঙ্গ যেন ওরা। ডানহাতের কব্জিতে একটি জায়গায় তাকালো, সেখানে কিছুই দেখা যায় না। বেথ দৌড়ে বাথরুমে গেল। দড়ি টেনে আয়নার উপর লাইটটি জ্বাললো। লাইটের ভেতর মৃদু গুঞ্জন শোনা গেলো এবং আলো জ্বলে উঠলো পুরো বাথরুমে। বেথ আয়নার উপর কোথাও নিজেকে দেখতে পায় না। শুধু তার ডানচোখ, তার ভ্রূ`র একপ্রান্ত, আর গালের খানিকটা উঁচু অংশ দৃশ্যমান। মুখের উপর চশমার ফ্রেমটি বেথের দুই কানের হাতল ধরে নাকের সাঁকোর কাছে কোথাও অদৃশ্য হয়ে ভাসছে। বেথ শক্ত করে চোখ টিপলো বারকয়েক, যদিও তাতে কিছুই বদলালো না।

রেন ওয়াটসন একজন বিজ্ঞানী এবং লেখক। মুদ্রিত ও অনলাইনে তার বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, Tears in the Fence, Brittle Star, The Fiction Desk এবং Under the Raddar. তিনি ২০১৭ সালে ব্রাইটন পুরষ্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিলেন। অনূদিত গল্পটি লেখকের ইংরেজি Optics গল্পের বাংলা অনুবাদ। তিনি বর্তমানে ম্যানচেস্টার, ইউকেতে বসবাস করছেন।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top