এবার যৌথভাবে প্রিজকার জিতেছেন আন্নে লাকাতঁ ও জ্যঁ ফিলিপ ভ্যাসেল। লাকাতঁ প্রথম ফরাসি নারী স্থপতি যিনি এই পুরস্কার পেলেন, আর চতুর্থ প্রিজকার জয়ী নারী স্থপতি। গত ১৬ মার্চ তাদের নাম ঘোষণা করেন দ্য হায়াত ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান টম প্রিজকার।
১৯৭০ এর দিকে স্থাপত্যকলা পড়তে গিয়ে লাকাতঁ ও ভ্যাসেলের চেনাজানা, পরে ১৯৮৭ সালে লাকাতঁ অ্যান্ড ভ্যাসেল ফার্ম স্থাপন করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেন তারা। ২০০১ সালে কমিশন হওয়া কাজ পেলে দো তোকিও যা প্যারিসে অবস্থিত, এটি আর্ট গ্যালারি এবং এবারের পুরস্কারের জন্য মনোনীত কাজ।
১৯৫৫ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন আন্না লাকাতঁ এবং ১৯৫৪ সালে মরক্কোতে জন্মান জ্যঁ ফিলিপ ভ্যাসেল। পশ্চিম আফ্রিকার নাইজারের তাদের প্রথম কাজ ছিল একটি বিদ্যালয়; দারিদ্র্য, খটখটে মরুভূমি, অপর্যাপ্ত রসদের মাঝে করা হয় স্থাপনাটি। তথ্য হিসেবে যত সহজে পাঠ করা যাচ্ছে নাইজারের বাস্তব অবস্থা জানলে ততটাই কঠিন এবং ব্যাপক লড়াইয়ের উপস্থিতি বোধে আসবে।
সময়টাও অনেক আগের, ১৯৯৩ সাল। তাদের এমন জায়গায় একটা স্কুল করতে বলা হয়, যেখানে ইট-কাঠ-পাথর প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো, আবার প্রাকৃতিক রসদও অপ্রতুল। সেখানে খড় দিয়ে স্কুলটি তৈরি করা হয়। নকশা উপাদান সাদামাটা, শুধু ব্যবহার হবে জাঁকালোভাবে। আদতেই তা-ই হয়েছে।
তাদের কাজের ব্যাপারে নিউইয়র্ক টাইমসে রবিন পোগ্রেবিনের পর্যবেক্ষণটি খুব জরুরি— আগের প্রিজকার লরিয়েটদের কাজের কোনো না কোনো ধরন ছিল, যা দেখলে বোঝা যেতো এটা অমুকের কাজ কিন্তু লাকাতঁ-ভ্যাসেলের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়!
আধুনিক স্থাপত্যকলা যেমন মেদহীন বাহুল্যবর্জিত তেমনি আরও পরিষ্কার করে বললে স্থাপত্যকলায় ভবিষ্যৎমুখী কাজ খুব জরুরি বলে বিবেচনা হয়। এ ভবিষ্যৎমুখী হওয়ার একাধিক ব্যাখ্যা ও অবস্থান আছে। এ জুটি আরেকটু অগ্রসর হয়েছেন; বিশ্বায়নের এই যুগে যখন জীবনযাত্রায় ব্যয় শুধু বাড়ছে, জায়গা-জমি কমছে সে সময়ে সম্পদের বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। কত কম বিনিয়োগে একটা স্থাপনা অনেকগুলো কাজে ব্যবহার করা যায়— এটা হালের জরুরি বাস্তবতা। ১৯৬০ এর দিকে করা তিনটি বড় বিল্ডিং রিনোভেশন করেন যা সোশ্যাল হাউজিং নামে পরিচিত,সরকারি বা কোন সংস্থার মালিকানায় এগুলো থাকে, খুব অল্প ভাড়ায় নিম্নবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত লোকজন বসবাস করে। ইউরোপে এ রকম সোশ্যাল হাউজিংয়ের দেখা মেলে। ২০১৬ সালে বখদোতে অবস্থিত একটি প্রকল্প যাতে ১০ হতে ১৫ তলা বিল্ডিং ছিল, ওখানে বসবাসকারীদের না সরিয়েই রিনোভেশন শুরু করেন এবং সফলভাবে তা শেষ করেন তারা।
লাকাতঁ ও ভ্যাসেলের স্থাপত্যের মূলমন্ত্র ছিল ‘never demolishe’। ছোটখাটো কাজে এ মন্ত্র বাস্তবায়ন করা, আর অনেকগুলো মানুষের বসবাস এমন একটা বিল্ডিংকে একসঙ্গে রিনোভেট করা বেশ জটিল। অধিকতর অনিশ্চিত, পরিবেশবান্ধব, কম সম্পদ ব্যবহার করে স্থাপনাকে বহুবিধ ব্যবহারের উপযোগী, সংযোজন পরিবর্তনের সুযোগ করা মানে পৃথিবীর ওপর চাপ কমান আর সুন্দর প্রতিবেশ ও প্রকৃতিকে নিশ্চিত করা। এসবে নজর দিতে গেলে তাদের কিছু ক্ষেত্রে হাত গুটানো জরুরি বা অনিবার্য করে তোলে। স্থাপত্যকলার ‘ক খ’ না বুঝলেও একটা কাজ দেখলে যে কারো ভালো লাগা তৈরি হয়— ঠিক যেন রিয়েলিস্টিক পেইন্টিংস, লাকাতঁ-ভ্যাসেলের কাজ তা নয়।
তাহলে কী? অ্যাবস্ট্রাক্ট! জ্বী তাই, আপনাকে সক্রিয় হতে বাধ্য করবে যদি একে বুঝতে চান, ভালোবাসতে চান; আদতে যা পৃথিবীকে দূষণ করা থেকে দূরে রাখবে অনেকাংশে। তাদের রিনোভেশনে কোন কাজকে গুঁড়িয়ে না দেওয়া বা নতুন করে যেসব কাজ হয় সব কাজে ন্যূনতম রসদ ব্যবহার হয়।
স্থাপত্যকলায় খুব চালু কথা হলো, বেশি দেয়াল বা পিলার ব্যবহার দুর্বল কাজের চিহ্ন। এভাবে আরও কিছু বিষয় কাজ করে। লাকাতঁ-ভ্যাসেল সবকিছুতেই নেহাতই না হলে নয় টাইপের আগ্রহের চিহ্ন রেখেছেন। তাদের শুরুর দিকের কাজ ছিল ফ্রান্সে ১৯৯৩ সালে, আর ২০১১ সালে প্যারিসের ১৭ তলা বিল্ডিং যেটা ৯৬ ইউনিটের সোশ্যাল হাউজিং ছিল, অনেক মানুষ যেখানে একসঙ্গে বসবাস করেন সেই জায়গা হতে হবে সরল, সহজে চলাচলযোগ্য। রিনোভেশনের সময় কংক্রিট ফ্যাসাদ সরিয়ে ফেলেন, হাঁটার জায়গা প্রশস্ত করেন প্রতিটা ইউনিটের আকার বাড়ান।
এটাতে বেশ আলোড়ন তৈরি হলে ২০১৭ সালে বখদোর কাজটি শুরু হয়। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, একল ন্যাশনালে সুপেরিয়র দো আর্কিটেকচার দো নাঁতে‘র রিনোভেশন, একই জায়গাতে রিনোভেশনের পর যে খোলামেলা জায়গা বের হয় তা কর্তৃপক্ষ আশা করেনি বা তাদের চাহিদা ছিল না। যেখানে স্থাপত্যকলাবিদ তৈরি ও চর্চা হয়, সে প্রতিষ্ঠানকে আশাতীতভাবে রিনোভেশন করে তারা নিজেদের নির্মিত আদর্শকে আরও মহান করে তোলেন।
ভ্যাসেল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কাজের ক্ষেত্রে তিনি নন্দনতত্ত্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করেন না, তার মনোযোগ থাকে এর পরিবেশবান্ধব অবস্থান এবং বহূরৈখিক ব্যবহারবিধির ওপর। মার্কিন স্থপতি ফ্রাঙ্ক গেরীর কাজ যতটা স্থাপত্যকলা ততটাই স্কাল্পচার। এমনতর কাজের জন্য যেমন নন্দনতত্ত্বের ঘনঘটা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বড় বাজেট। অন্য দিকে নাইজারের মত ছোট দেশে আরবান প্লানিংয়ে কাজ করে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন লাকাতঁ-ভ্যাসেল। মূলত ছোট একটা গ্রামে কিছু ডুয়েলিং প্লেস করেছেন, যেখানে কিছু মানুষ বসবাস করবে সুপেয় পানি পাবে এ রকম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জিনিস। এখানে যা রপ্ত করেছেন তাহলো কাজ করার রসদহীন জনপদে কাজ করা, অর্থের জোগান একেবারে অপর্যাপ্ত ক্ষেত্রবিশেষে নাইও বলা যায়; এ রকম পরিস্থিতি তাদের আসলে কাজের বৈচিত্র্য বাড়াতে সক্রিয় করে তুলেছে।
ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সের রিনোভেটিভ স্থাপনার সংখ্যা বেশি বলা যায়, আর এটাই বড় একটা সুযোগ করে দিয়েছে তাদের। সাধারণত স্থাপত্যকলা বললে অবচেতনে নতুন কিছু গড়ে ওঠার যে মনোভাব থাকে, একে আরও বিস্তৃত করেছেন এই জুটি। কোন স্থাপনাকে পরিবর্তন বা সংস্কার বা অন্য আরও কোনো উদ্দেশ্যে ভেঙে ফেলাকে ভ্যাসেল অপরাধ মনে করেন। ফেলে দেওয়া বা ভাঙা নয় বরং সংযোগ করা জরুরি কাজ মনে করেন। ১৯৮৭ সালে প্যারিসে যৌথভাবে কাজ শুরু করার পর তাদের করে দেখাতে হয়েছে কীভাবে স্থাপনাকে বহুবিধ কাজে লাগানো যায় এবং ভবিষ্যতেও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্ভাবনাও জারি রাখা যায়।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে তারা অনেক ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ইনস্টিটিউট পাবলিক স্পেস এবং আরবান প্লানিং করে চলেছেন। তাদের কাজ সামাজিক স্থিতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবেশ এবং জায়গার উৎকৃষ্ট ব্যবহারের নজির।
২০১৯ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লাকাতঁ বলেন, তিনি সিনেমাটোগ্রাফি থেকে তার কাজের উৎসাহ পান। একজন পরিচালক অনেকগুলো ছোট ছোট দৃশ্য জোড়া দেন, এসব দৃশ্যগুলো একটা অবস্থান তৈরি করে, বক্তব্য তৈরি করে; এ দৃশ্যগুলোর আলাদা করে কোনো অবস্থান তৈরি হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত একজন এগুলোকে সম্পাদনা করে একই সুতায় গাঁথেন। এই যে গাঁথাগাঁথির কাজ এর মাঝে কিছু জায়গা থেকে যায় প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন করার জন্য; পরিপূর্ণ বিন্যাস সব সময় জায়গা কেন্দ্রিক এটাই স্থপতির কাজ।
২০১৭ সালে সোশ্যাল হাউসের রেনোভেশনের সময় ভ্যাসেলের কিছু কথা তাদের যৌথ চিন্তাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। সোশ্যাল হাউসটিতে ৫৩০ ইউনিট ছিল। বলা যায় এটা বিশাল কোন গ্রামের মতো। একজন করেও যদি থাকেন তাহলে এতে ৫৩০ জন মানুষের যৌথ বসবাস। তারা কাজ পাওয়ার পর লোকজনকে সেখান থেকে সরিয়ে দেননি; সমস্যা হিসেবে একে না দেখে সম্ভাবনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে আরও বেশি কিছু করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্থাপনাটি ভেঙে দেওয়া হলো না, কারণ যেসব মানুষ ওতে বসবাস করে তাদের সঙ্গে স্থাপনাটির একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই সংযোগ সম্পর্ক বুঝতে পারা জরুরি।
সাধারণত স্থপতিদের অফিসগুলো বেশ নান্দনিক এবং জাঁকালো হয় কিন্তু এই জুটির অফিস তেমনটা নয়। তারা পেশা জীবনের শুরুতে নাইজারের দারিদ্র্য এবং জীবনযাপনের জরুরি রহস্য স্থাপত্যকলায় চর্চা করেছিলেন সেটাকে নিজেদের জীবনের বাস্তব করেছিলেন। খুবই সাদামাটা আর আড়ম্বরহীন একটা অফিস। তাদের কোন কোন রিনোভেশনে অনেক ক্রিটিক যেমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, এত কম হস্তক্ষেপ এরা করেছেন আদৌ একে লাকাতঁ-ভ্যাসেলের কাজ বলা যাবে কিনা। এমন প্রভাব আসলে তারা নিজেদের অফিসে করে চিন্তার সততা দেখিয়েছেন।
ডুয়েলিং বা বসবাস জিনিসটা বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ; আক্ষরিকভাবে দেখলে হয়তো মনে হবে যে ঘর-বাড়িতে আমরা থাকি। আদতে তা নয়, বসবাস বৈচিত্র্যপূর্ণ গভীর তাৎপর্যময় আর দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন একটা ব্যাপার। আধুনিক যুগের পেটের মাঝে স্থাপত্যকলা যখন বিষয় হিসেবে জায়গা করে নেয় বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে মার্কিন দেশে লো কার্বুজুয়ার হাতে যে স্থাপত্যকলার যাত্রা সেটা হলো ইউরোপ থেকে আমেরিকাকে আলাদা করা। রোমান গথিক স্থাপত্য কলার দিন শেষ করে শিল্প বিপ্লব পরবর্তী মার্কিন দেশের পুঁজির যে সমূহ বিকাশ, লোহা-রড-কাচ-সিমেন্টের মতো আরও জিনিসের সহজ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হলো। পূর্বের স্থাপনা+কলা উভয় শুধু যারা সমূহ বিত্তের মালিক তাদের সার্ভ করেছে। আমেরিকার হাত ধরে সেটা কমন স্পেসে আসে বা থার্ড প্লেস পর্যন্ত আসে। জাপানের আরাতা ইসোজাকি, ভারতের বালকৃষ্ণ দোশী যেমন এর সুক্ষ্নতর বিস্তারে আগ্রহী হন, সে চিন্তাধারায় লাকাতঁ-ভ্যাসেল দর্শনীয় এবং কার্যকর আরেকটি পালক সংযোজন করলেন।
জায়গার ব্যবস্থাপনা বিন্যাস, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ এসব কথা স্থপতিদের কাজে হরহামেশাই থাকে এবং কাজের সীমাবদ্ধতার জন্য ক্লায়েন্ট কেন্দ্রিক ঝামেলা খুব পরিচিত সংকট বলা যায়। একজন স্থপতির কাজ যেমন আর্ট তেমনি ডুয়েলিং প্লেসও, কিন্তু এ প্রশ্ন এখন হরহামেশা হাজির যে আর্ট বলে যেটার চর্চা আমরা আধুনিক যুগে করতে দেখছি সেটা সবার জন্য সমানভাবে আয়ত্তে আসছে কিনা। ভ্যাসেল এ ক্ষেত্রে খুব সাহসী এবং নির্মম জবাব দিয়েছেন। তিনি কাজের নন্দনতত্ত্ব খুঁজে বেড়ান না, বাসের জায়গা তৈরি করতে চান।
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যেখানে ঘরহীন আহারহীন, সেই সব মানুষদের জন্য নন্দনতত্ত্ব পরে আগে খাবার-বাসস্থান। যেহেতু অধিকাংশই দরিদ্র জনপদের মানুষ কমবেশি জায়গার ব্যবস্থাপনা সংকটে ভোগেন, যা জীবনকে আরও আঁটসাঁট করে তোলে। সেখানে এ জুটির পদক্ষেপ বাস্তব জরুরি।
আধুনিক স্থাপত্য কলার যে আলংকারিক দিক সেটা কি শেষ হতে শুরু করেছে লাকাতঁ-ভ্যাসেলের হাতে! এ প্রশ্ন আসতে শুরু করেছে, তবে এর উত্তর আরও পরে হয়তো স্পষ্ট হবে। তা হলেও ভবিষ্যৎ দুনিয়ার জন্য এটা দারুণ একটা সম্ভাবনা এবং পরিবেশক প্রকৃতির সুন্দর গ্রহণযোগ্য একটা নিশ্চয়তা তৈরি করেছেন তারা।