বাস্তব থেকে অতি বাস্তবের পথে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাব্য নির্মাণ //  তৈমুর খান

 ষাটের দশকের ব্যতিক্রমী কবি ও চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত(১৯৪৪-২০২১)-কে বাংলার কবিতা পাঠকেরা তেমনভাবে চিনতেই পারবেন না। অথচ বাংলা কবিতায় এক অমোঘ উচ্চারণ ও ভিন্ন ধারার পথপ্রদর্শক হিসেবে তিনি বিরাজমান। পঞ্চাশ দশকের বিশেষ করে শক্তি-সুনীলের সর্বব্যাপী প্রভাবকে যখন কেউ এড়িয়ে যেতে পারছেন না, তখন ভিন্ন পথের সন্ধানী কবিদের মধ্যে অন্যতম হলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সমসাময়িক আরও কয়েকজন ব্যতিক্রমী কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: উৎপলকুমার বসু, সামসের আনোয়ার, ভাস্কর চক্রবর্তী, সুব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ। সেই সময় তাঁরা নিজস্ব ভাষা ও কথন ভঙ্গির দ্বারা স্ব স্ব মহিমায় পাঠকের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা এবং ‘কৃত্তিবাসে’ও পঞ্চাশের কবিদের পাশাপাশি কবিতা লিখেও নিজেদের অবস্থানটি সর্বদা আলাদা করতে পেরেছিলেন। এই নিজস্ব পথের সন্ধানেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবিতা থেকে সিনেমায় পদার্পণ করেছিলেন। আমরা জানি সেই সময় সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক বিরাজ করছেন। তাঁদের পথে না গিয়ে নিজেই পথ অনুসন্ধান করেছিলেন তিনি। সুতরাং সিনেমাতেও আনতে পেরেছিলেন নতুন ভাষা। বদল করতে পেরেছিলেন নারী-পুরুষের জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েনের অঙ্ক। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সম্পর্কেও সাহস সঞ্চার ঘটেছিল। পুরনো মূল্যবোধ নীতি-নৈতিকতায় পরিবর্তন এসেছিল। অর্থাৎ সবমিলিয়ে বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের কাছে সময়ই নায়ক হয়ে উঠেছিল। সময়ের চলন-বলন, স্ফূর্তি-আমেজ তাঁর সৃষ্টিতে গভীরভাবে ছায়া ফেলেছিল।

      বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর কাব্য নির্মাণের পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ আলাদা। এক গাল্পিক চালের সঙ্গে প্রবহমান কথন ভঙ্গির প্রক্রিয়া। বাক্য বিন্যাসে সিঁড়ির মতো ক্রমশ পরিণতির দিকে অগ্রসর হওয়া। পাঠ করতে করতে মনে হবে যেন কোনো কল্পবিজ্ঞানের পথে রহস্য-রোমাঞ্চ নিয়ে এগিয়ে চলেছি। সচল ও সবাক চিত্রকল্পগুলি যেন কাল্পনিক হয়েও বাস্তবতায় পর্যবসিত। ফরাসি চিত্রকর আঁদ্রে ব্রেতোঁ একবার বলেছিলেন  “The imaginary is what tends to become real.” অর্থাৎ কাল্পনিক বিষয়েরও ঝোঁক বাস্তবতার দিকে। কবির শৈল্পিক মুক্তিও এভাবেই এসেছে। পশুপাখি, গাছপালা, জানালা-দরজা সকলের মধ্যেই যেন প্রাণসঞ্চার ঘটেছে। তারা ইঙ্গিত করছে, কথা বলছে, আবার নড়ন চড়নও। সিনেমাতেও এই দৃশ্য দেখা যাবে। ক্যামেরাম্যান অথবা শিল্পী, ছবি তুলছেন অথবা আঁকছেন। কিন্তু সেই ছবি বা চিত্রকল্পগুলি সবই জীবন্ত। আর এই কারণেই এগুলি বাস্তবাতীত হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিশাল এক বোধের ও উপলব্ধির জগতে আমাদের পৌঁছে দিয়েছে। এটাকেই কবি বলেছেন ‘এক্সটেন্ডেড রিয়ালিটি’। আমরা স্বাভাবিকভাবেই জাদুবাস্তবের উপস্থিতি উপলব্ধি করেছি। বস্তুগুলি বাস্তবিকই উত্তেজনায় সাড়া দিয়েছে। তাদের ক্রিয়া জগতে মেতে উঠেছে। কখনো আবার সেগুলি সুরিয়ালিজমেরও উদাহরণ। সেগুলির মধ্যে স্বপ্নচারিতায় এক গভীর স্বয়ংক্রিয়তা দেখা গেছে। কবিতার পাশাপাশি সিনেমাতেও এর প্রভাব পড়েছে। ‘কালি ও কলম’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছেন: “আমার জীবনে যদি কবিতা না আসত, তা সত্ত্বেও ছবি করতাম তবে সেগুলো কেমন দেখতে হতো আমি জানি না। আমাকে কবিতা অ্যালার্ট করেছে এভাবে ভাবতে।”( মে,২০১৭)

            কবিতা এবং সিনেমা দুটি ধারা-ই পরিপূরক হয়ে উঠেছে কবির হাতে। দুই সৃষ্টিতেই ধারণ করেছে চিত্রলিপি, দৃশ্য ও বোধের অদ্ভুত রূপান্তর। কোথাও যথেচ্ছাচার থাকলেও সেখানে কবির সাহসের বার্তাও আছে। সর্বত্রই তিনি মুক্ত এক জীবনাকাঙ্ক্ষারই পরিচয় দিতে চেয়েছেন। ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ড একবার বলেছিলেন:

“Art finds her own perfection within, and not outside of, herself.

She is not to be judged by any external standard of resemblance.”

 অর্থাৎ শিল্প তার নিজস্ব পূর্ণতা খুঁজে পায় নিজেই। তার বাইরেও নয়, নিজেকে কোনো বাহ্যিক মানের সাদৃশ্য দ্বারা তাকে বিচার করাও উচিত নয়।  শিল্প সিদ্ধির এই পর্যায়টি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ভালো করে জানতেন। তাই জীবনে যেমন ভাবনা এসেছে, মানুষ যেমন ভাবতে পারে, তিনি সেইসব ভাবনাকেই ধারণ করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক কিংবা প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্যেরও সমন্বয় দান করেছেন। নিজের যে ‘আমি’টিকে আজীবন বহন করে চলেছেন, তাকে পথও চেনাতে চেয়েছেন। প্রথম কাব্য ‘গভীর এরিয়েলে’ বলেছেন:

 “আমি কত দ্রুত যাবো, আমি কোন দিকে যাবো—

 দারুণ চিৎকারে দীপ্ত ছুটে আসে কৈশোরের বেলা।”

    এই কৈশোরই তাঁর ব্যক্তিউৎসের নিভৃতিতে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে স্বপ্নের শরীর সন্ধানে। অসুখে পতিত কবি বলেছেন:

 “হে প্রভু আবার জানালা খুলেছি আকাশ খুলেছি”

 কবির প্রভু সেই একই প্রভু, যার বিশাল ব্যাপ্তি, বিস্ময়ের চূড়ান্ত অবয়বে বিরাজ করেছেন।

        ‘কফিন কিংবা স্যুটকেস’ কাব্যে কবির প্রথম জীবনের শিক্ষকতার প্রসঙ্গ এসেছে। তারপর সিনেমা। প্রশ্ন এবং উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে এক কৌতূহলোদ্দীপক অভিযাপন। রুল-পেন্সিল কাঁটাকম্পাস থেকে ছোট্ট রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বুট পরে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এলেন আর এক জীবনের সন্ধানে। যে জীবনকে তিনি  ছায়াছবিতে তুলে আনলেন।  ব্যক্তিজীবনের প্রাত্যহিক থেকে, দারিদ্র্য থেকে, ভাঙন থেকে নিজেকে আরও ভাঙতে চাইলেন। সত্তর দশকের প্রেমের ঘ্রাণ মুকুলিত হল কবিতায়:

“খসখসে শাড়ির শব্দ বহুদূর থেকে ভেসে আসছে হাওয়ায়

 ঘুমের ভেতর ঘুমন্ত রোদ্দুর

 তার ভেতর সে

 তার ভেতর তার নবীন পায়ের পাতা”

 জীর্ণ সময়ের বাতাবরণে অপেক্ষাতুর হৃদয়ের মোচড় পাক খেলো। কিন্তু সেই সময়ের রোমান্টিক হাতছানিও বাদ দিতে পারলেন না। চালকলের ডানপাশে দেখলেন মানুষ ও অমানুষ ঘুমিয়ে আছে। পদ্যলেখা লোক হতে না চেয়েই বরং বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ানোকেই শ্রেয় মনে করলেন। বিপ্লবী চেতনার ডাক শুনতে পেলেন। তবু শায়ার গন্ধ, নেলপালিশের নরম নখ, পেচ্ছাপের জ্বালা-যন্ত্রণা, স্বপ্নছেঁড়া জলতৃষ্ণা, শালপাতায় ভাগ করে ভাত খাওয়া সব ভিড় করে এল। পরকীয়া, সমকাম, রুটি-মাখন, রান্নাঘরের ঝাঁঝরি সবাই যেন সময়ের ইতিহাস লিখেছে। তারপর বারুদ আর রক্তের গন্ধও।

     ‘হিমযুগ’ কাব্যে আমরা পেলাম মাগুর মাছকে। কবি বললেন:

 “সারারাত সাঁতার কাটে সেই মাগুরমাছ,

 রান্নাঘরের কোনায় নোংরা নালার পাশে

                              ছোট্ট এক ডেকচির ভেতর

 মাগুর মাছ আঁতকে ওঠে এক-একবার আর

                                       ঘুমিয়ে পড়ে আবার।”

 অদ্ভুত সুন্দর মাগুরমাছের চোখ। চোখে স্বপ্ন। দুঃখরা বুদবুদ তোলে। কিন্তু শান্ত সুন্দর বউয়ের দ্বারা কাটা পড়ে যায় মাগুরমাছ। কিন্তু ঘরময় মাগুর মাছের গন্ধ। সারারাত শিস দেয় আর সেই সুন্দরী বউকেই খুঁজে চলে মাগুর মাছেরা। মাগুরমাছেরা মরে না। ওদের স্বপ্নও মরে না। মাগুর আসলেই মানবচরিত্রের রূপক। পরকীয়া প্রেমাসক্ত পুরুষ। এমনই মানবচরিত্রের রূপক হল: লাল পিঁপড়ে, কেন্নো, টিকটিকি, কাঠঠোকরা, গাধা, কেঁচো, খচ্চর, বাঘ প্রভৃতি। আশ্চর্য সুন্দর বিশাল একটি বাঘকে মানুষের মধ্যেই দেখতে পেয়েছেন। তেমনি অন্য গ্রহে লাফ দিয়ে উঠে গড়ে তুলবেন স্বাধীন এবং আশ্চর্য এক খচ্চরপৃথিবী। ব্যঙ্গের চাবুক এখানেও। কবি তো শুধু কেঁচো জন্মের অভিজ্ঞতার কথাই লিখে চলেন। প্রাণীগুলি একে একে মানুষের মুখ হয়ে ওঠে। আবার প্রেসার কুকারের বাঁশিও আমাদের জীবনের বাঁশি হয়ে বাজে। আমাদের জন্মও হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকে। সাদা কাপড়ের উপর নদী ফুটে ওঠে। মুখে হাত চেপে হুহু ছুটে আসে বাড়ি। পাহাড় তো কবির কাছে ‘কাজের পাহাড়’। মেটাফোর অলংকারগুলি ম্যাজিক রিয়ালিজমের মতো আমাদের আশ্চর্য করে দেয়। ‘রোবটের গান’ কাব্যে বলেছেন:

 “কেউ থাকে না এখানে

 ছড়িয়ে ছিটিয়ে,

 কাছে দূরে কেউ থাকে না

 সকালবেলা

 দরজা খুলে যায়

 রাত্রিবেলা

 বন্ধ হয়ে যায় দরজা

 আরো অনেক পরে,

 দরজা ভেঙে

 ঘরে ঢোকে মৃত মানুষ,

 শুয়ে থাকে

 মৃত মানুষের পাশে।”

   কবিতার নাম ‘এই ঘর’। ঘরভর্তি রহস্য রোমাঞ্চ। শূন্য, ফাঁকা।তবুও অদ্ভুতভাবে দরজা খোলা এবং দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া। মৃত মানুষের ঘরে প্রবেশ করা, মৃত মানুষের পাশে শোয়া— স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে চলে। জাদুবাস্তবের ক্রিয়ায়, সুরিয়ালিজমের স্বয়ংক্রিয়তায় এসব সম্ভব। সম্ভব অসম্ভবের সব সীমারেখা মুছে গেছে ‘ভোম্বলের আশ্চর্য কাহিনী ও অন্যান্য কাহিনী’তেও। বাস্তবতাকে অতিবাস্তবতায় পৌঁছে দিয়েছেন কবি। যদিও মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলির উদয় হয়েছে, কিন্তু চরিত্রগুলির রূপান্তর ও অতিলৌকিকতার পর্যটনে তা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। প্রাত্যহিকের নানা কচকচানি থেকে দৈন্য ও তামসের নিগূঢ় পর্যায়গুলি উন্মোচিত হয়। তবু উত্তরণ ঘটে এক আশ্চর্যের পরিণতিতে।

         ‘ছাতাকাহিনী’তেও বাক্ সমাবেশ নির্মিতির অনন্যতা চোখে পড়ার মতো। শব্দ আরও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। উপমায় বুদ্ধিদীপ্তির প্রখরতা আরও সূক্ষ্মতা পেয়েছে। কবি লালুবাবুর মুখে বসিয়েছিলেন এই কথা ক’টি:

 “মনুমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন লালুবাবু

 লালুবাবু বন-বন ক’রে ঘোরাচ্ছেন তাঁর হারপুন

 আর চিৎকার ক’রে বলছেন

 কবিতা কবিতার জন্য সিনেমা সিনেমার জন্য

 মেয়েমানুষ পুরুষমানুষের জন্য

 মেয়েমানুষে ক্লান্ত হয়ে গেলে….

                                              ধুলো

 বছরের পর বছর

 বছরের পর বছর

 বছরের পর বছর

 বন্ধুকের ওপর জমিয়ে রাখার জন্য।”

       বন্দুক দামি হলেও, শাসন এবং গর্জন করলেও, তার ওপরে জমে থাকা ধুলো কোনো কাজে লাগে না। মর্যাদাহীন এই ধুলো পুরুষ-বন্দুকের উপর আস্তরণ ফেলে মাত্র।

 দাম্পত্য পরকীয়ার ছায়ায় মানবজীবনের রসায়নগুলিও কাব্যকুশলীর হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

 গল্পের সুরে কবি তা উল্লেখ করেছেন:

 “ননীর বৌ ছিলো ননীর কাছে।

  ফণীর বৌ ছিলো ফণীর কাছে।

 ননী ফণীকে চিনতো না,

 ফণী ননীকে চিনতো না।

                                 একদিন

 ননীর সঙ্গে আলাপ হলো ফণীর

 ফণীর সঙ্গে আলাপ হলো ননীর।

 ননী আর ননীর বৌ এলো

 ফণী আর ফণীর বৌ-এর বাড়ি,

 ফণী আর ফণী আর বৌ গেলো

 ননী আর ননীর বৌ-এর বাড়ি।

 জমা হতে লাগলো মন-খারাপ

 জমা হতে লাগলো মন-খারাপ।”

 এই মন-খারাপ একজোড়া দাম্পত্য জীবনকে নরকের দিকে ঠেলে দিল। তারা একে অন্যের বউয়ের প্রেমে পড়ল। শুরু হল পরকীয়া। দাম্পত্যের দূরত্ব বাড়তে লাগল। স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছেদের মুখে পৌঁছে গেল। এভাবেই গল্পগুলি ঢুকে গেল জীবনের প্রচ্ছদে। সংসারের বিশ্বস্ত ছায়ায়। কবি যেন কবিতায় সিনেমা নামালেন। আমাদের মনের কাছে বসিয়ে দিলেন ক্যামেরা। সময়কে জেগে থাকতে বললেন। প্রতিটি ঘর হয়ে গেল হলঘর। কবিতা পড়তে পড়তে আমরাও সিনেমা দেখতে শিখলাম। এই কাব্যেই আরও দেখতে পেলাম: ছাতা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। একটা ছাতার কাঁধে হাত রেখে চলেছে আর একটা ছাতা। দাঁত কিড়মিড় করা ছাতা। টুঁটি চেপে ধরা ছাতাকে আমরা দেখলাম। আয়নাকে দেখলাম হাত বের করে থাপ্পড় মারতে। হাতি মার্কা কাগজের হাতিও জ্যান্ত হয়ে উঠল। চারটি দেয়ালের গল্পেও দেয়ালের দাঁড়িয়ে থাকা, দেখা, জ্বলে ওঠা, ছিটকে যাওয়া দেখতে পেলাম। যা সিনেমায় সম্ভব তা কবিতাতেও সম্ভব হয়ে উঠল।

      ‘উঁকি মারে নীল আর্মস্ট্রং’ কাব্যের কাহিনিগুলিতেও মানবরসায়ন আদিম স্তর থেকে উঠে এসেছে। রূপকাত্মক ব্যঞ্জনায় বিশ্লেষণ করেছে মানুষের প্রবৃত্তিকে। স্ত্রীকে হত্যা করে স্বামী যখন মর্গে নিয়ে গেল, তখন স্বামীর ও স্বামীর পিতার অথবা পুরুষ মানুষের ভাবনা কেমন হতে পারে সে কথা কবি লিখলেন:

“বোসপুকুরে স্বামীর ঘর থেকে তোমাকে যখন মর্গে নিয়ে গেল

বেলা, তখন তোমার সাতাশ বছর

                          কমতে কমতে পৌঁছেছে সতেরোতে

 শান্ত পৃথিবী অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ফুটেছে তোমার শরীরে।

 তোমার মেয়েকে কোলে নিয়ে হরিপদ’র তখনো লোভ যায়নি,

 ভাবছে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলার আগেই

 শেষবার কেন নেয়নি ওই শরীর। হরিপদর আশি বছরের বাবা

 নিমাই মল্লিক ভাবছে একই কথা, ছেলের বউ বেলার কচি শরীর।” (অন্য মহাকাশ)

 এই একটা নারীর শরীর যেন সমগ্র পুরুষের একটা বসন্তের পৃথিবী। শুধু ভোগসুখ চরিতার্থ করাই পুরুষ জীবনের সার্থকতা। খুব সামান্যের মধ্যেও অসামান্যকে কবি তুলে আনলেন। বাইরে শুধু দৃশ্য নয়, ভেতরের মননকে জারিত করলেন। আমাদের কথা ফুরিয়ে গেলেও ভেতরের কথা যেন শেষ হতে চায় না। শব্দের কাছেও নৈঃশাব্দ্যিক অভিলাষ জেগে ওঠে। ‘গড়বেতা’ একটি স্থানের নাম হলেও ইতিহাসে একটি রাজনৈতিক হত্যার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কবি সেই রূপকেরই বর্ণনা দিলেন এইভাবে:

 “তোমার মুখ থেকে একটা সাপ বেরিয়ে এসেছিল কাল

 তোমার মুখ থেকে আরো একটা সাপ

                                            বেরিয়ে এসেছে আজ,

 নবীন অফিস থেকে ফোন করেছিল

 তার পাশে যে মেয়েটি বসে, সেই ইনা, যাকে সে বিয়ে

 করবে আজ বাদে কাল, মুখ থেকে বিশাল একটা সাপ

 বের করে দেখিয়েছে তাকে।”

        আমাদের প্রণয় এক সর্পবিন্যাসের সম্পর্কে আলোকিত। কিন্তু পরিবেশ বৈপরীত্যের অসামঞ্জস্যে বিপন্ন। তাই মৃত্যুময় ছোবলের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে গড়বেতা। মৃত্যুর পর শরীরগুলি কোন্ দলের হবে এই প্রশ্নেই সমাপ্তি ঘটে কবিতার। প্রতিটি কবিতার মধ্যেই রূপকাত্মক ম্যাজিক রিয়ালিজমকে প্রশ্রয় দিয়েছেন কবি। কবিতা থেকে সিনেমায় কিংবা সিনেমা থেকে কবিতায় এক স্বয়ংক্রিয় চলাচল হয়ে উঠেছে। বিখ্যাত আমেরিকান-স্প্যানিশ লেখিকা ইসাবেল অ্যাঞ্জেলিকা এলেন্ডে তাঁর একটি লেখায় বলেছেন: “Life is very mysterious and there are many things we don’t know. And there are elements of magic realism in every culture, everywhere. It’s just accepting that we don’t know everything and everything is possible.”

 অর্থাৎ জীবন খুব রহস্যময় এবং অনেক কিছুই রয়েছে যা আমরা জানি না। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই, যেকোনো জায়গায় জাদু বাস্তবতার উপাদান রয়েছে। শুধু এটিই কেবল মেনে নিচ্ছি যে, আমরা সবকিছু জানি না এবং সবকিছুই সম্ভব।

 এই বিশ্বাস থেকেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর কবিতা এবং সিনেমার পথে যাত্রা করেছেন। বাইরে থেকে যা দেখি, যা বুঝি, ভেতর থেকে আর এক দেখা, আর এক বোঝা চলতে থাকে। ‘তারও পরে…’ নামে একটি কবিতায় এই প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করলেন কবি:

” ‘শরীরই শুধু? অন্য কিছু নয়?

 শরীর শুধু শুরু শুরু, বর্ণপরিচয়…

 তারও পরে আরো আছে,

                           আরও অনেক কিছু

 একটি তারা ধাওয়া করছে

                           অন্য তারার পিছু,

 বলো না এখন সেসব কথা,

 বলো না গাছের গল্প’—

 বালিশ ঘুমায়

               চৌকি ঘুমায়

                    প্রতুল অল্প অল্প।”

 প্রসঙ্গত  কবিতায় উত্তেজনা বা কামস্পর্শে প্রতুলের ভেজা ভেজা, ঘামগন্ধ, জানালা বন্ধ, দ্রুত শ্বাস পড়া শুরু হলে ‘প্রতুলিনীর’ নিচের সংলাপটুকু আমরা বুঝতে পারছি। শরীরের চাহিদা মিটলেও আকাশ-মহাকাশ, তারা-নক্ষত্র, চৌকি-বালিশ সবার কথা এসে গেছে। আমাদের কখন মুখ দিয়ে সাপ বের হচ্ছে, কখন পিঠে ডানা গজাচ্ছে, কখন আমরা লম্বা হয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছি, কখন আমরা বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছি আর ফুল ফোটাচ্ছি। কখন আমাদের শরীর নৌকা হয়ে ভাসছে। কখন আমরা কাক হয়ে উড়ে যাচ্ছি। রহস্যময় জীবনের কাছে আমাদের এই বহু জন্ম বহু রূপান্তর ঘুরপাক খাচ্ছে। বাস্তব থেকে অতি বাস্তবের পথে এভাবেই আমাদের চলাচল।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top