‘কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে’: এক দৃপ্ত উচ্চারণ// নূর সালমা জুলি

‘Somebody Blew Up America'(২০০১) কবিতাটির রচয়িতা আমিরি বারাকা (১৯৩৯-২০১৪)। যার বাংলা অনুবাদ ‘কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে'(২০২১)এই শিরোনামে করেছেন মাজহার জীবন। আমিরি বারাকা আফ্রিকান-আমেরিকান কবি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া এই কবি প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং নাটকও লিখেছেন এবং কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বেশ সংঘাতপূর্ণ এবং বৈচিত্র্যময় ছিল তাঁর জীবন। আজীবন শোষিত মানুষের হয়ে কথা বলেছেন।

“Black art কবিতায় তিনি কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আফ্রিকান-আমেরিকানের কণ্ঠস্বর হয়ে উচ্চারণ করেন—

We want a black poem. And a
Black World
Let the world be a Black Poem
And Let All Black People Speak This Poem
Silently
Or LOUD”

এই কবি ২০০১ সালের ৯/১১এ আমেরিকার ট্রেড সেন্টারে হামলা নিয়ে ঘটনার উনিশ দিন পর তার বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে’ লেখেন। ডকুমেন্টারি ধারার দীর্ঘ এই কবিতাটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। রচনার— “প্রায় এক বছর পর ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এটি প্রথমবার নিউ জার্সির ওয়াটারলুতে প্রায় ২ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে Geraldine R. Dodge Poetry Festival-এ আবৃত্তি করেন। তারপর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্পেন, পর্তুগাল, আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও আবৃত্তি হয়। এটি অনুবাদও হয় নানা ভাষায়। অবশ্য শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা কবিকে আমেরিকার নানা জায়গায় কবিতাটি আবৃত্তি করতে বাধা দেয়।”

এখন দেখার বিষয় কী আছে কবিতার মধ্যে। কবিতাটা শুরু হয়েছে এভাবে :

“কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে
ওরা বলে কিছু সন্ত্রাসী,
আফগানিস্তানের
কিছু বর্বর
‘আ-রব’ ঘটনাটা ঘটিয়েছে;
আমাদের আমেরিকার সন্ত্রাসী না ওরা
. . .
তারা বলে(কারা বলে?)
. . .
কারা ওয়াল স্ট্রিট থেকে কামাই করে
কারা খোজা করে প্রথম থেকেই
তোমাদের করেছে নপুংসক
. . .
কারা একমাত্র বিশালতম
কারা সবচেয়ে সুন্দর
কারা যিশুকে তাদের মতো করে সৃষ্টি করে
. . .
কারা পোর্তো রিকো চুরি করেছে
কারা চুরি করেছে ইন্ডিজ, ফিলিপাইন, ম্যানহাটন
অস্ট্রেলিয়া আর হেব্রিজ
কারা চীনাদের আফিমে বাধ্য করেছিল
. . .
কারা এই শহরের মালিক
কারা বাতাসের মালিক
কারা পানির মালিক
. . .
কারা গ্রানাডা দখল করেছে
কারা বর্ণবৈষম্য নীতি দিয়ে অর্থ কামিয়েছে
কারা আইরিশদের উপনিবেশ রেখেছে
কারা চিলি আর তারপর নিকারাগুয়া উৎখাত করেছে
. . .
কারা কঙ্গোতে মানুষের হাত কেটে নিয়েছিল
কারা আবিষ্কার করেছে এইডস
কারা ইন্ডিয়ানদের কম্বলে
জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছিল
‘ট্রেইল অব টিয়ার’, এর কথা কাদের চিন্তায় এসেছিল
. . .
কারা জানত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বোমা মারা হবে
কারা টুইন টাওয়ারের চার হাজার ইজরায়েলি শ্রমিককে
ওইদিন ঘরে থাকতে বলেছিল
কেন শ্যারন দূরে ছিল?
কারা? কারা? কারা?”

কবিতার শেষটুকু মূল থেকে—

“Who is the ruler of Hell? Who
is the most powerful

Who you know ever Seen God?

But everybody seen The Devil

Like an Owl exploding In your
life in your brain in your self
Like an Owl who know the devil
All night, all day if you listen,
Like an Owl Exploding in fire.
We hear the questions rise In
terrible fleme like the whistle of a crazy dog

Like the acid vomit of the fire of Hell
Who and Who and WHo who who whoooo and Whooooooooooooooooooooo!”

এমন তীব্র আবেগে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের কথা ছড়িয়ে আছে কবিতাটির ছত্রে ছত্রে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম, কালো-সাদার লড়াই, উপনিবেশের সঙ্কট, রাজনৈতিক হত্যার সাথে ৯/১১ এ আমেরিকার ট্রেড সেন্টারে হামলা নিয়ে লেখা এই কবিতা। এখানে— “আমেরিকার ট্রেড সেন্টারে হামলা নিয়ে মূলধারার প্রচারণার বিপরীতে বারাকা এই কাউন্টার ডিসকোর্স দাঁড় করান। কবিতাটির মূল উদ্দেশ্য নিহত ও আহতদের জন্য বিলাপ কিংবা দুষ্কৃতিকারীদের বিচারের দাবি নয়, বরং এটি সাম্রাজ্যবাদ ও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ—যাকে এ ঘটনার মূল কারণ হিসেবে কবি মনে করেছেন। এ কবিতায় দাসত্ব, উপনিবেশ ও নয়া-উপনিবেশবাদের প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসের কারণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।”


আমিরি বারাকা

বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মতো একটি ব্যাপার রয়েছে এই কবিতায়। আর এক্ষেত্রে অনুবাদক মাজহার জীবন বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। কবিতার অনুবাদের পাশাপাশি লেখক এবং কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ দীর্ঘ এক আলোচনা করেছেন ‘ভূমিকা’ অংশে। এছাড়া এই কবিতায় উল্লেখিত ব্যক্তি, ঘটনা, আন্দোলন এসব নিয়ে ‘টীকা’ অংশে বিস্তারিত আলোচনা পাঠকের জানার জগৎকে সমৃদ্ধ করবে এবং কবিতার রসাস্বাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনুবাদক এই শ্রমসাধ্য কাজটি অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন। মূল কবিতায় ব্যবহৃত এসব পরিচিত বা স্বল্প পরিচিত বিষয়কে সংখ্যা দ্বারা শনাক্ত করে টীকায় বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। যেমন :

‘কারা রেভলিউশনের জন্তু
কারা ৬৬৬’—এখানে রেভলিউশনের জন্তু এবং ৬৬৬ এর ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া হয়েছে :

“বাইবেলের রেভলিউশনে তিনটি জন্তুর কথা বারবার ও ৬৬৬টি জন্তুর কথা একবার উল্লেখ আছে। তারা ঈশ্বরের কাজের বিরোধিতা করেছে। এখানে শয়তান, ষড়যন্ত্রকারী রাজনৈতিক নেতাদের এসব জন্তুর সাথে তুলনা করা হয়েছে।”

সবমিলিয়ে বলা যায় ‘কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে’ আমিরি বারাকার এক দৃপ্ত উচ্চারণ। এই উচ্চারণ সত্য অনুসন্ধানের। এই উচ্চারণ মানবতার জন্য। এই উচ্চারণ মুক্তিকামী মানুষের। এই কবিতায় নিপীড়িত আর শোষিত মানুষের উপর কাল থেকে কালান্তরে বয়ে চলা ক্ষমতাবানদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছেন কালো মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার এক কবি আমিরি বারাকা।

কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে: আমিরি বারাকা
অনুবাদ: মাজহার জীবন
প্রকাশক: লেখলেখির উঠান প্রকাশন
প্রকাশকাল: ২০২০
পরিবেশক: বাতিঘর

 

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top