ইসমত চুগতাই এর গল্প : সমাজবীক্ষণের অনন্য পাঠ // নূর সালমা জুলি

“–ঘটনা, চরিত্র, বিষয়–অবলম্বন যা-ই হোক, তাকে একটি নিজেস্ব জীবন বোধিতে, একটি দর্শনে, একটি স্বগত-ভাবলোকে পৌঁছে দেওয়াই ছোটগল্পের কাজ।” (ছোটগল্পের সীমারেখা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়) এমন কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করেছেন ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১)। বিশ শতকের ভারতীয় উর্দু সাহিত্যের প্রথিতযশা কথাকার তিনি। আলো-অন্ধকারের জীবন এবং তার বাস্তবতাকে এক সূক্ষ্ন-পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে এবং অনুভবভেদ্য ভাষায় উপস্থাপন করেন। সমাজের অনভিপ্রেত সত্যের উপর আলো ফেলেন। এক অর্থে মিতবাক্ এই গল্পকার। কম বলে বেশি বোঝানোর এক সক্ষমতা তাঁর করায়ত্ত। তাঁর কলম নর-নারীর সর্ম্পকের জটিল সমীকরণ শ্রেণি সংকটের স্বরূপ এবং ব্যক্তির মনের গহিনের কথামালার রূপায়ণে যথেষ্ট পারঙ্গম।

উর্দু সাহিত্যের সমঝদার সফিকুন্নবী সামাদী বাংলাভাষী পাঠকের জন্য ইসমত চুগতাই:নির্বাচিত গল্প শিরোনামে ইসমত চুগতাইয়ের গল্প অনুবাদ করেছেন। এই গ্রন্থে মোট ষোলোটি বিভিন্ন বিষয়ের গল্প রয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিমানুষ জায়গা পেয়েছে এখানে। নারীর জীবনকে বহুকৌণিক দিক থেকে দেখার প্রয়াসে গল্পগুলো বিশেষ হয়ে উঠেছে। এই তরজমা গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘লেপ’। ভূমিকা অংশের মাধ্যমে জানা যায় বহুল আলোচিত ও বির্তকিত লেখা এটি। ইসমত চুগতাই অনেকটা মজলিসি ঢং-এ আয়োজন করে পাঠককে সামনে বসিয়ে যেন স্মৃতিচারণ করেছেন এই গল্পে। লেপকে কেন্দ্র করে গল্প শুরু হলেও আদতে এটা লেপকেন্দ্রিক বিষয়ের গল্প নয়। এখানে আছে নারীর যৌন চেতনা আর বঞ্চনা এবং শোষণের কথা। অর্থ ও ক্ষমতা শোষণের হাতিয়ার যেমন যৌনতাও তেমন। উত্তম পুরুষে বর্ণিত এই গল্পে বেগম জানের অতৃপ্ত যৌনকাক্সক্ষার স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে। কথকের মায়ের পাতানো বোন এই বেগম জান। কিছুদিনের জন্য অল্পবয়সি কথককে এখানে রেখে যায় তার মা। নবাবের স্ত্রী বেগম জান। স্বামীর সঙ্গে তার কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয় না। কারণ এই পুণ্যবান নবাব সমকামী। পুণ্যবান এই কারণে তিনি সমাজের জন্য অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন।

বেগম জানের ছিল চুলকানির অসুখ। বেচারীর এমন চুলকানি হত যে হাজার তেল এবং উবটান মালিশ করা হত, কিন্তু চুলকানি থেকেই যেত… ডাক্তার-হেকিম বলত কিছুই নেই। শরীর একদম পয়-পরিষ্কার। হ্যাঁ, চামড়ার ভেতরে কোনো অসুখ থাকলে থাকতে পারে…।

আসলেই চামড়ার ভেতরের অসুখের আখ্যান ‘লেপ’ গল্পটি। রব্বোর মালিশের হাত বেগম জানের শরীরে অবাধে নীরব প্রশ্রয়ে কিংবা আদিষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শীতের রাতে বেগম জানের গায়ের লেপ হাতির মতো নড়াচড়া করে, ফুলে উঠে। রব্বো ছেলের সাথে দেখা করতে গেলে বিপদে পড়ে কথক। কেননা বেগম জানের বিছানার পাশে তার বিছানা। তার পাজরের হাড় গুনতে হাত চালান বেগম জান।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আসছে। আমাকে এক অজানা ভয়ের আতঙ্ক ঘিরে ফেলে। বেগম জান তার গভীর গভীর চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি কাঁদতে শুরু করি। মাটির খেলনার মতো সে আমাকে চেপে ধরে। তাঁর উষ্ণ শরীরের স্পর্শে আমার বমি আসতে শুরু করে। কিন্তু তার মাথায় যেন ভূত সওয়ার হয়েছে।
. . .
কিছুক্ষণ পর সে নিরস্ত হয়, অসহায় হয়ে শুয়ে পড়ে। তার চেহারা ফিকে এবং অনুজ্জ¦ল হয়ে পড়ে। বড় বড় নিশ্বাস নিতে শুরু করে সে। আমার মনে হয়, সে মরে যাচ্ছে …

এই উপস্থাপনা বেগম জানের জন্য পাঠকের মনে মিশ্র অনুভব তৈরি করে। অতৃপ্ত যৌনকাক্সক্ষায় কাতর একজন মানুষের অসহায় রূপ আামাদের মনকে বিগলিত করে। শেষের দিকে লেখকের বর্ণনায় এভাবে ধরা পড়ে বেগম জানের যৌনতৃপ্তির প্রয়াস :

বেগম জানের লেপ অন্ধকারে আবার হাতির মতো দুলছে। . . . লেপের ভেতর হাতি ওঠে আবার বসে যায়…। . . . হাতি আবার গড়াগড়ি দেয় …। . . . লেপ আবার ফুলে উঠতে শুরু করে।

মানুষের যৌনাচারের এমন পরিশীলিত এবং পরিমিত রূপায়ণ প্রশংসার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে। গল্পের শরীর গাঁথতে খুব সচেতনতার প্রকাশ দেখিয়েছেন গল্পকার। শব্দচয়নে প্রখর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ গল্পটিকে তথাকথিত অশ্লীল ধারণার ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। এর বুননে এবং বিন্যাসে যে উচ্চমার্গের শৈল্পিক বোধের প্রকাশ ঘটেছে তা অনন্য। তারপরও এই গল্পের জন্য তাঁকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। যদিও তাঁর উপর আরোপিত অভিযোগ থেকে রেহাই পান তিনি।

গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘লাজুক লতা’য় নারীর গার্হস্থ্যজীবনকে তুলে আনা হয়েছে। সন্তান জন্মদানকে নারীর অন্যতম কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। ঠিক আছে এটা। কিন্তু যখন এটাই বিচারের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াই তখন তো প্রশ্ন উঠেই। এই গল্পে একই সমান্তরালে সমাজের দুটো ভিন্ন স্তরের নারীর জীবনের বিশেষ দিকটি অর্থাৎ সন্তান জন্মদানের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের বধূ কথকের ভাবি যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন “ভাবিজানকে সাবানের বুদ্বুদের মতো তুলোর ফুলের ওপর রাখতে শুরু করা হয়। কাছে দাঁড়িয়ে হাঁচি দেবার বা নাক ঝাড়ারও অনুমতি নেই কারো। পাছে বুদ্বুদ ভেঙে যায়।” বুদ্বুদ ভেঙেই যায়। ফলে যে অসহায়তা সৃষ্টি হয় তার রূপায়ণ লেখকের বর্ণনা থেকে:

তৃতীয় বার তো ব্যাপারটা স্পষ্ট চোখে পড়বার মতো ছিল। ওষধ খেতে খেতে ভাবিজানের বেহাল দশা হয়। রং ফিকে হয়ে যায়। ভাইজানের সন্ধ্যা হতে থাকে রাত বারটায়। . . . ভাবিজান মশারির ভেতরে পড়ে পড়ে ভাইজানের দ্বিতীয় বিবাহের বাজনা শুনতে থাকে।

কীভাবে যেন সমাজের আঁতের কথা টেনে বের করেন। এই মুনশিয়ানার তারিফ করতে শব্দ কম পড়ে যায়। তো এবার সন্তান জন্মদানের সময় আসে এই মেয়েটির জীবনে। তাকে শাশুড়ির ইচ্ছায় দিল্লি থেকে আলীগড় যেতে হচ্ছে বাচ্চা জন্ম দিতে। তুফান মেইলে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। এক কুমারী মেয়ের মা হতে দেখে এই উচ্চবিত্ত পরিবারটি তাদের রির্জাভ কামরার দরজার পাশে। পথের নারীটির অবহেলিত জীবনের দিকটি গল্পে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তার সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া কথকের ভাবিজানের মনে অদ্ভুত ভাবের জন্ম দেয়। গল্পের শেষ লাইনটা এমন, “আমাদের রানি যে অসম্ভব বিস্ময়কর ধরনের সন্তান-প্রসব দেখে তার আতঙ্কে গর্ভপাত ঘটে যায়।” এবং তার আগে বলা হয় “ভাবিজানের আতঙ্কিত চেহারায় ভাইজানের দ্বিতীয় বিবাহের বাজনা হেমন্ত (পাতা ঝরার ঋতু) বর্ষাতে থাকে :”। আসলে অর্থনৈতিক বিন্যাস যা-ই হোক নারীর নড়বড়ে অবস্থানই নির্দেশ করে গল্পটি। এবং নারীর অবস্থান নির্ণয়ের মাপকাঠিতে সভ্যতার কোনো আলো যে প্রবেশ করেনি এ ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। নারীর সামাজিক জীবনের দিকটি সূক্ষ¥ পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে উপস্থাপনের প্রয়াস এই গ্রন্থের বেশিরভাগ গল্পে লক্ষ করা যায়।

‘যৌবন’ গল্পটিতে সমাজের নিন্মবর্গের জীবনের চিত্র রয়েছে। যেখানে জন্নু যে অনেকটা কমবুদ্ধি সম্পন্ন বা বিশেষ চাহিদাপ্রাপ্ত অল্পবয়সি মেয়ে। অনেক ভাইবোন মিলে টেনেটুনে চলা সংসার তাদের। এই সংসারে বেড়াতে আসে শবরাতী ভাই। চলেও যায়। জন্নুর শরীরে মাতৃত্বের চিহ্ন। শেষটা এমন :

রাতের বেলা বাবার গালি আর মেরে ফেলবার হুমকি শুনে পেটের সাথে হাঁটু শক্ত করে চেপে ধরে উপুড় হয়ে খাটের উপর পড়ে থাকে সে। কিন্ত অত্যন্ত বিস্মিত হয় যে বাবা তার সাথে সাথে শবরাতী ভাইকেও হাঁসিয়া দিয়া কেটে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। বৈশাখ মাসে তো তার বিয়ে হবে, জন্নু লাল দোপাট্টা পরে সেখানে… তার গলা ধরে আসে।

গলা পাঠকেরও ধরে আসে। নারীর প্রতি এই নির্মমতা সমাজের আরেক বাস্তবতা। মানুষের মনের জটিল এবং বিচিত্র ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে ‘বিষ’ গল্পে। পিতার একমাত্র কন্যা, সুন্দরী শিক্ষিতা মিসেস নোমান। গল্পের শুরুতেই তার মৃত্যুসংবাদ রয়েছে। অধিক সংখ্যক ঘুমের ওষুধ খাওয়ার জন্য তার মৃত্যু ঘটেছে। এরপর ফ্লাশব্যাকে তার জীবনকথা এসেছে। যেখানে তার স্বামী মিস্টার নোমানের প্রসঙ্গ আছে, আছে আরেকটা বেগমের প্রসঙ্গ। যে মিস্টার নোমানের বাল্যকালের বাগদত্তা। তাকে পরিত্যাগ করে সামাজিক প্রতিষ্ঠার লোভে লক্ষপতির কন্যাকে বিয়ে করেন। নিঃসন্তান মিসেস নোমান নারী উন্নয়নে কাজ করে। স্কুলশিক্ষিকা কুমারী আয়েশা বেগমকে মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করে। তার হবু স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে বলে তার মধ্যে কুণ্ঠা বোধ কাজ করে না উপরন্তু এটা নিয়ে মশকরা করে। একদিন রেগে গিয়ে আয়েশা বেগম মিসেস নোমানকে নির্বোধ বলে এবং ১৬/১৭ বছরের ইরফানকে সামনে এনে দাঁড় করায়। বলে, “‘আমার মরহুমা বোনের স্মৃতি। . . .’” এবং

মিসেস নোমানের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়। তার সামনে বিশ বছর আগের নোমান সাহেব দাঁড়িয়ে . . .।
. . .
লোকে কানাঘুষা করে, আয়েশা বেগম মিসেস নোমানকে বিষ খাইয়ে দিয়েছেন।

‘বিষ’ গল্পে এই বিষ প্রদানের বয়ান আমাদের অভিভুত করে। ইরফান নামক বিষটি ঘুমের ওষধের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আপাত জয়িতা মিসেস নোমানকে পরাজয়ের স্বাদ এনে দেয়। গল্পে টুইস্ট সৃষ্টিতে অদ্বিতীয় ইসমত চুগতাই। এবং ব্যক্তিমানুষের মনের গহিনে আলো ফেলে দেখান এক দুর্জ্যরে রহস্যময়তায় ঘেরা অন্ধকারকে। অন্যদিকে ‘লোকমা’ গল্পে আরেক সমস্যা চিহ্নিত করেন। কে.ই.এম. হাসপাতালের নার্স সরলা। তেত্রিশ বছরের কুমারী এই নারী পুরো বস্তির লোকের আপনার জন। কিন্তু “কোনো কুমারী কন্যা বসে থাকলে সে ধরিত্রীর বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং ধরিত্রীর এই যন্ত্রণার পাপের অংশীদার হয় সকলেই। অন্তত সরলা বেনের জন্য জীবন উৎসর্গ করা মানুষদের এরকমই বিশ্বাস। তার পুণ্য এবং সংযম প্রশংসনীয়, কিন্তু পুণ্যেরও সীমা আছে।” তো সরলা বেনের জীবনে একজন আসলো অদ্ভুতভাবে। এক বাস যাত্রী যে তাকে প্রতিদিন বসার যায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাকে ইম্প্রেস করার জন্য বস্তির মেয়েরা সরলা বেনেকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পাঠায়। সরলা বেনের এই সাজগোজ নিয়ে কোনো উৎসাহ নেই। এবং তাঁর সরল অনুভব সমাজের বুকে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। লেখকের ভাষায় :

‘মেয়ে হওয়াই কি যথেষ্ট নয়? এক লোকমায় এত আচার, চাটনি, মোরব্বা কেন প্রয়োজন?’ তার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে।
আর তারপর সেই লোকমাকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর ঘষামাজা!

সত্যিই তাই। এভাবে বিদ্রুপের কষা হানেন ইসমত তাঁর গল্পে। সাজগোজ করা সরলা বেনেকে ঐ বাসযাত্রী চিনতে পারে না। শেষের এই চমকটাই আরেক ভাবনার বিষয়।

‘কাফির’ গল্পে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের দুজনের মন দেওয়া-নেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু গল্পটি হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বার্নিং ইস্যু সাম্প্রদায়িকতার এক বিমর্ষ বয়ান। যার মধ্যে এমন সত্য উঠে এসেছে:

‘. . . আমরা গোলাম পুষ্কর, আমাদের কোনো জিনিস আমাদের বলার যোগ্য নয়। আমরা সমাজের সম্পত্তি। সমাজ যেমন চায় তেমন ব্যবহার করতে পারে আমাদের সাথে। আমরা চাইলেও কিছু করতে পারি না।’

এভাবে জীবনের মুর্তিমান সত্যের উদ্ভাসন ঘটান এই লিখিয়ে।

বেশ দীর্ঘ গল্প ‘শরীরের সুগন্ধ’। নবাব পরিবারের অন্দরমহলের আখ্যান এটি। কীভাবে বাঁদিরা রক্ষিতা হয় নবাবি খান্দানের পুরুষদের সেই অন্ধকারে আচ্ছাদিত আলো ঝলমলে জীবনের গল্প আমাদের অনুভূতিকে অসাড় করে দেয়। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের জন্ম হয় যেন। এই পরিবারের ছম্মন মিয়া বাঁদি হালিমাকে ভালোবেসে ফেলে। এবং এই কারণে:

ছম্মন মিয়া এখন এক সরু গলিতে একটা ছোট সাধারণ বাড়িতে থাকে। কোনো এক স্কুলে ব্যাট-বল খেলা শেখায়। কলেজেও যায়। প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে পুরনো ঘষামাজা পাতলুন এবং কুর্তা পরে সাইকেল চালিয়ে তাকে আসতে-যেতে দেখা যায়। সাইকেলের ক্যারিয়ারে সওদাপাতির মাঝে কখনো কখনো শরবতী রঙের চোখের এক বাচ্চাকে বসা দেখা যায়। সে তো বহিষ্কৃত খানদান থেকে! এত পড়ালেখা করে হারাল। ঘরে এনে রেখেছে এক বাঁদিকে। কে জানে, বাঁদিকে বিয়ে করেছে কি না। হায় আল্লাহ! এ কেমন খারাপ দিন এল!

নারীর প্রতি অবমাননা চিরন্তন ব্যাপার তা সে নবাব বাড়ি হোক কিংবা সাধারণ কোনো বাড়ি। ‘কুমারী’ গল্পে চলচ্চিত্র শিল্পী মদন বারবার ব্যবহৃত হয় পুরুষের দ্বারা কিংবা নিজেকে ব্যবহার হতে দেয়। ভালোবেসে ঘরও বাঁধতে চায়। সন্তানের মাও হয় তবু শেষ অব্দি সে কুমারিই থেকে যায়। জীবনযুদ্ধে অনেকটা ক্ষত-বিক্ষত মদনের চলচ্চিত্র শিল্পী সুন্দরের প্রতি ভালোবাসার তীব্রতা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারে না। তার ছোট্ট স্বপ্নটা বাস্তবের মুখ দেখে না। এই গল্পটা একজন কথক উপস্থাপন করে। সে বলে :

. . . কিন্তু এখন পর্যন্ত যখন আমি এই শেষ পঙ্ক্তিগুলো লিখছি, মদন কুমারী। তার বিয়ের কলি এখনো ফোটেনি। চেম্বুরে বাংলো নেবার স্বপ্ন এখনো সাকার হয়নি। সেই সুন্দর বাংলো, যেখানে মদন বেগম হয়ে বসে, বাচ্চারা চারিদিকে ঘিরে আছে।

মদনরা সাবঅল্টার্ন। তাদের ভাষা নেই। তারা বলতে পারে না। নিম্নবর্গের চেয়েও যদি কিছু থাকে সেখানে তাদের অবস্থান। বারবার সমাজ শুধু একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটায়–নারীর প্রতি খড়গহস্ত হওয়া। অবাক লাগে, ক্লান্তি আসে না সমাজের এতে!
‘দুটো হাত’ গল্পটি মেথরানি পরিবারের। রাম অবতার যুদ্ধক্ষেত্রে ময়লা সাফ করতে গিয়েছে। ঘরে তার স্ত্রী গৌরী। এখানে রত্তী রাম আসে। সে সম্পর্কে গৌরীর দেবর। রত্তীর নাবালক স্ত্রী বাপের বাড়িতেই আছে। তিন বছর পর রাম অবতার ঘরে ফিরে। তখন তার ছেলের বয়স এক বছর। গ্রামের লোকেরা রাম অবতারকে এই হিসেব বোঝাতে উঠেপড়ে লাগে। রাম অবতার বুঝতে চায় না। কিংবা নিজের মতো করে বুঝে নেয়। এই গল্পের পরিসমাপ্তিতে শিশুর আগমনকে এক মহিমান্বিত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। হয়তো এভাবে জীবনের জন্য জীবনকে জিতিয়ে দেন ইসমত চুগতাই।
‘আলোক লতা’ গল্পটিতে ব্যক্তিমানুষের জটিল মনস্তত্বের প্রসঙ্গ এসেছে। কথকের শুজায়ত মামা পঞ্চাশ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করেন প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর অবশ্য। কিন্তু বিয়ে করেন ষোলো বছরের রুকসানা বেগমকে। গরিব ঘরের এই মেয়েটির রূপের বর্ণনায় লেখক বলছেন :

রুকসানা বেগমকে কেউ দেখলে দেখতেই থাকে, যেন প্রথম দিনের কোমল লাজুক চাঁদ কেউ নামিয়ে নিয়ে এসেছে। চেহারা দেখতে থাকো, কিন্তু মন ভরে না। ওজন করো তো পঞ্চম ফুলের পর ষষ্ঠ ফুল উঠবে না। রং এমন, যেন কাঁচা সোনা। শরীরে হাড়ের নামগন্ধও নেই। যেন ময়দার গোলায় মাখন মাখিয়ে রেখেছে।

এই মেয়েটি দু-তিন বছরের মধ্যে ভালো খাওয়া-দাওয়া পেয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে। যে সৌন্দর্য সন্তানের জন্মদানের পরেও জ্ঞান হয় না। বয়স এক জায়গায় আটকে যায়। তার সৌন্দর্য আর অল্প বয়স শুজায়ত মামাকে এক সময় মুগ্ধ করলেও এখন তিনি ‘জ্বলে কয়লা হয়ে যান।’ মামা নিজেকে মামির সমকক্ষ করে তোলার জন্য ইউনানি শাস্ত্রের সকল চূর্ণ, কামবর্ধক ভস্ম, তৈল ব্যবহার করেও চিরস্থায়ী সমাধান পান না। এদিকে মামি মানে রুকসানা বেগমের উপর মানসিক, শারীরিক টর্চার নেমে আসে। ঘি, মাংস, ডিম, দুধ একেবারে বন্ধ। এতে তার সৌন্দর্য আরও স্নিগ্ধতায় ভরে যায়। “আগে তাকে যে দেখতো তার লালা বেরিয়ে আসত, এখন তাকে দেখলেই তার পায়ে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে হয়। . . . তাকে আরো অল্পবয়সী এবং কুমারী মনে হয়।” এখানেই শেষ নয় রুকসানা যেন “চন্দনের মতো সুগন্ধ ছড়ায়।” তার সৌন্দর্যের এই বাড়বাড়ন্তকে লেখক আলোকলতার সাথে তুলনা করেছেন। বটবৃক্ষরূপী শুজায়ত শুকোতে থাকে আর আলোকলতারূপী রুকসানা জীবন্ত হতে থাকে। এসময় শুজায়তের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি বোনদের নামে লিখে যায়। সব হারিয়ে নিঃস্ব রুকসানা বেগমকে দেখে শোক করতে আসা মানুষেরা মরহুমের সৌভাগ্যে ঈর্ষা করতে থাকে। লেখক বলছেন, “মামি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, যেন প্রকৃতির সবচেয়ে কুশলী শিল্পী তার অতুলনীয় কলম দিয়ে কোনো শিল্পকর্ম সৃজন করে সাজিয়ে দিয়েছে।” প্রকৃতি প্রদত্ত মেয়েটির এই সৌন্দর্য তার জীবনকে দুর্বিষহ করে দিয়েছে। আবার ‘পাথর’ গল্পে সৌন্দর্যহীনতার জন্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষের এসব অদ্ভুত মনস্তত্ত¡ কিংবা সামাজিক অস্থির অনুভবকে রূপায়িত করতে বেশ সিদ্ধহস্ত লেখক। ‘পাথর’ গল্পে কনভেন্টে পড়া পনেরো বছরের শাহনাজ চার সন্তানের মা হয়। আর তার সৌন্দর্য তলানিতে গিয়ে ঠেকে। মাংসের স্ত‚প হয়ে যায়। তখন তার স্বামী ক্ষীণকায়া শবনমের জন্য উন্মাদ হয়। প্রথম সংসার ভেঙে যায়। শবনমের সাথে বিয়ের কয়েক বছর পর দেখা যায় শবনমও মাংসের স্ত‚পে পরিণত হয়েছে। এবং তার স্বামী এক মিশরীয় নর্তকীর আকর্ষণে আটকে ফেলে নিজেকে। অথচ স্বামী সম্পর্কে লেখক বলছেন :

হ্যান্ডসাম এবং নিপীড়িত! সূর্যদেবের মতো সুন্দর এবং রোমান্টিক, মধু-ভরা চোখের ভাইয়া পাথরের মতো অটল… এক অমর শহিদের রূপ সাজিয়ে বসে হাসছে।

এই পাথররূপী স্বামী আসলে সংস্কারাছন্ন ধারণার প্রতীক। যে ধারণায় নারী নিয়ন্ত্রিত হয় তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে। মানবেতর এই অনুভব সমাজের আরেক সত্য। যেখানে নারীর রূপ কিংবা রূপহীনতা তার অবস্থানকে নির্দেশ করে। খুব গভীরতলসঞ্চারী এই ভাবনা। লেখক সমাজের অন্তরালে বয়ে চলা এক অন্ধকার স্রোতঃস্বিনী প্রবহমানতাকে উপস্থাপন করেছেন এসব গল্পে। ঠিক এরকম মানে নারীর প্রতি অবহেলার আরেকটি গল্প ‘সোনার ডিম’। পরপর তিন কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে জমীলন। স্বামী বুন্দু মিয়া এই আঘাত মানে পরপর তিন কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়। তার ভাবনা লেখকের প্রেক্ষণবিন্দুতে ফুঠে ওঠে :

একটা নয়, তিন-তিনটা মেয়ে, বিধ্বস্ত বুকের ওপর তিনটা পাহাড়… তিন বরযাত্রী… তিন জামাইয়ের শত নখরা… তিন যৌতুকের তিন হাজার আতঙ্ক যেন তিন দীর্ঘ নাগিনী লকলকে জিভ বের করে তার গর্দানের দিকে এগিয়ে আসছে। থেকে থেকে এক চাপা ইচ্ছা ফণা তোলে, একবার প্রাণ শক্ত করে এই তিন নাগিনির গলা টিপে দেবে।

কিন্তু গল্পের পরিণতিটা অন্যরকম। বুন্দু মিয়া একটা লড়াই করে নিজের সাথে এবং জিতে যায়। তৃতীয় কন্যার নাম রাখে রহমত। কিন্তু এই পরিণতিতে শুভবোধের জয়ের ইঙ্গিত থাকলেও লেখক জমীলনকে দিয়ে গল্পে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করায় :

গাই বিয়োলে কেউ জিজ্ঞাসা করে না, ছেলে হয়েছে না মেয়ে হয়েছে, সকলে দুধ দোহাতে লেগে যায়। মুরগি ডিম দিলে তাকে আদর করে খাবার খাওয়ায়। যখন নারী গর্ভবতী হয় তখন সকলে কেন তাকে সোনার ডিম দেয়ার ফরমায়েশ করে? আর যদি সে সোনার ডিম দিতে না পারে তাহলে … তাহলে বাড়িতে মউত কেন আসে, আশা-আকাক্সক্ষার জানাজা কেন বের হয় আর দুনিয়া কেন অসহায় হয়ে যায়?

এমন প্রশ্নে কুসংস্কারের নিদ্রায় আচ্ছন্ন সমাজের কোথাও ধাক্কা লাগে হয়তো। শিল্পের বিচারে এমন উপস্থাপনা নান্দনিক হোক বা না হোক সমাজবীক্ষণের এই পাঠ আমাদের চেতনায় ঘা দেয়, বোধের ঘরে অনুরণন তোলে। ইসমত খুব সচেতনভাবে জীবনের এসব দিককে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর কলমের আঁচড়ে। পরের গল্প ‘গেদা’। এখানেও মাতৃত্বের দায় নিতে হয় অল্পবয়সি বিধবা গেদাকে। যার পিতার দায়িত্ব নেওয়ার কথা সে ছেড়ে যায় বা পরিবার তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। একা মাতৃত্বের দায় নিয়ে এক অপাঙ্কতেও জীবনের পিচ্ছিল পথে হাঁটার চেষ্টা করে গেদা। সন্তানের জন্মের পাপ কেবল নারীরই। এই একচোখা নীতি একশ বছর আগের সমাজে যেমন ছিল তেমন আজও আছে। মাঝখান থেকে শুধু আধুনিক হওয়ার বাগাড়ম্বর গোচরীভূত হয়েছে। অথচ বাতির নিচে অন্ধকার এখনও বিরাজমান। ‘অন্ধকার’ গল্পেও আরেক অন্ধকারের অনুষঙ্গ এসেছে। কথকের হাত ধরে দুজন নারীর কথা উঠে আসে। দেহপসারিনী একজন আরেকজন কথকের বোন। দেহপসারিনী ভিক্ষার জন্য ছুটছে। তার কাপড়ের পুঁটলি থেকে বের হওয়া লাল শুকনো দুটো পা কথককে বিষাদগ্রস্ত করে। ভাবে, “কেবল আমিই কেন এমন সংবেদনশীল!” এক সকালে কথকের বোন সফিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার দেখে বলে পেটে বাচ্চা মরে গেছে। বোনকে সে স্কুলে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিল। বোনের এই অন্ধকারের গল্প তাকে আরও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। ‘শাদি’ গল্পটি মন দেওয়া-নেওয়ার যতটা তার চেয়ে বেশি মন ভাঙার বলা যায়। এখানেও নূর তার পছন্দের কিংবা তাকে যে পছন্দ করত তার কাছে আসে। এবং উদাস ভঙ্গিতে দেড়মাস আগে বিয়ে করেছে তাকে এ খবর দেয়। ইসমত প্রণয়ঘটিত ব্যাপারগুলোর মধ্যে এমন বাস্তবতার ছবি আঁকেন যে বিস্মিত হতে হয়, তখন রোমান্টিক আবেগে থরথর কম্পমান পূর্ণিমার আলো সূর্যের তীব্র শিখায় পরিণত হয়ে যায়।

এই গ্রন্থের শেষ গল্প ‘আপন রক্ত’। এখানে নবাব পরিবারের অন্দরমহলের প্রসঙ্গ এসেছে অনেকটা ‘শরীরের সুগন্ধ’ গল্পের মতো। বাঁদিদের ব্যবহৃত হওয়া, বেগমদের বিষয়, বাগানবাড়ি, হারেম এসবের মধ্যে এই গল্পে অদ্ভুত এক দ্ব›েদ্বর উপস্থাপনা আছে। নবাব বেগমের সঙ্গে নবাব বাহাদুরের দ্বন্দ¦ বাধে বাঁদি ছম্মীকে নিয়ে। নবাব বেগম ছম্মীর মধ্যে আপন রক্ত অনুভব করে। তাকে শাহজাদিদের মতো করে তৈরি করে। কিন্তু একদিন নবাব বাহাদুরের এই বাঁদির উপর চোখ পড়ে। তার জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ঠিক করে নিকাহ করবে। ছম্মীকে নবাব বাহাদুরের হাত থেকে বাঁচাতে নবাব বেগম কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। খাবারে বিষ মিশিয়ে ছম্মীকে খাওয়ায়। বিয়ের সাজে জীবনের লীলা সাঙ্গ করে ছম্মী। নবাবদের অন্দরমহলের এমন রিরংসা, বিবমিষা আর অন্ধকারের মধ্যে ফল্গুধারার মতো মমতার মিশেলে ভরা জীবনের রূপায়ণ আমাদের অভিভূত করে। ইসমত চুগতাই এর দেখার দৃষ্টির প্রশংসা না করে পারা যায় না।

ইসমত চুগতাই আয়োজন করে গল্প বলেন। তাঁর গল্প বলার মধ্যে বিশেষ প্রস্তুতি লক্ষ করা যায়। কী বলবেন আর কীভাবে বলবেন এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন তিনি। নিজ সমাজ, ব্যক্তিমানুষ আর চারপাশের জীবনকে বহুকৌণিক দিক থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সমাজের উচ্চবর্গ থেকে নিম্নবর্গ সবক্ষেত্রেই সমানভাবে আলো ফেলেছেন। জীবনের গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সমাজভাবনা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তির মনের দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তা। আলো ফেলেছেন আচরিত জীবনের প্রথাগত বিশ্বাসগুলোর অন্ধকার দিকের উপর। প্রশ্ন তুলেছেন কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে থাকা অন্ধবিশ্বাসের উপর। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, যৌনতা, নারীর প্রতি অবমাননা এমন সব বিষয়ে উপস্থাপনা ঘটছে গল্পগুলোতে। এসবের মধ্যে দিয়ে লেখকের উদার মানবতাবাদী এবং সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ স্পষ্ট। গল্পের ফর্ম নিয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন লেখক। বেশিরভাগ গল্পে পরিণতিতে মোঁপাসাসুলভ চমৎকারিত্বের প্রকাশ আছে। আর গল্পের কাঠামোতে অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাতে বেশ পছন্দ লেখকের এমনটা বলা যায়। সবসময় গল্প বলার জন্য একজন ন্যারেটরকে বেছে নেন তিনি। বেশিরভাগ ন্যারেটর উত্তমপুরুষ। তবে অন্ধকারের বয়ানে কিংবা যৌনতার মতো বিষয়ের উপস্থাপনায় বেশ সংযমী এই লেখক। তাঁর মিতবাক্ প্রবণতা গল্পের নান্দনিক পরিচর্যায় এক বিশেষ কৌশল। ভাষা ব্যবহারেও তথা শব্দচয়নে সচেতনতা প্রতিকায়িত ব্যাপার উপস্থাপনাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে।

ইসমত চুগতাই এর গল্পের অনুবাদক সফিকুন্নবী সামাদী উর্দু সাহিত্যে সমঝদার। গ্রন্থের ভূমিকা অংশে বলেন :

সাহিত্যের অনুবাদ কেবল শব্দ, বাক্য বা অনুচ্ছেদের অনুবাদ নয়। অনুবাদ সকল সময়েই সংস্কৃতির অনুবাদ। উৎস-ভাষার (source language) সংস্কৃতিকে অনুবাদ করতে হয় লক্ষ্য-ভাষার (target language)। এই গ্রন্থের ক্ষেত্রে দুটো সংস্কৃতিকে বাংলায় অনুবাদ করতে হয়েছে। কারণ, ইসমতের গল্পে ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতির পাশাপাশি রয়েছে উত্তরপ্রদেশের সংস্কৃতি। উর্দু শব্দের সঙ্গে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের উপভাষার শব্দ। এ এক দুরূহ যাত্রা।

এই দুরূহ যাত্রায় বেশ সফলভাবে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে পথ হেঁটেছেন অনুবাদক। ফলে মূলের নির্যাস ছড়িয়ে পড়েছে গ্রন্থের পরতে পরতে। অনুবাদকের মনীষা আর রসবোধের মিশেলে এই অনুবাদ নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য। উর্দু সাহিত্যের ‘ইসমত আপা’ তাঁর সমকালীন সাহিত্যশিল্পী যেমন সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দর, রাজেন্দর সিং বেদী–এদের সহযাত্রী ছিলেন। কাউকে অনুসরণ করেননি, নিজের শৈলীতে ছিলেন স্বতন্ত্র। তবে মান্টোর বুদ্ধিদীপ্ত মানসপ্রতিমা গল্প বলার ক্ষেত্রে যেটা পরিলক্ষিত হয় ইসমতের লেখাতে তাঁর ছায়া কখনো কখনো চোখে পড়ে। ইসমত তাঁর লেখায় নারীকে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছেন কিন্তু তাঁর দৃষ্টির সামগ্রিকতায় সমাজ উঠে এসেছে বহুমুখীভাবে। সাম্প্রদায়িকতা থেকে কুসংস্কার, প্রেম থেকে গার্হস্থ্যজীবন, নিম্নবর্ণ থেকে নবাব বাড়ির অন্দরমহল–সবদিকেই সমান দক্ষতায় আলো ফেলেছেন। সাথে মুসলিম সংস্কৃতি এবং উত্তরপ্রদেশের বনেদি জীবনের ছবিটিও আঁকতে ভোলেননি। তাঁর সূ² এবং গভীরতলসঞ্চারী পর্যবেক্ষণে সমাজের যে ছবি ফুটে উঠেছে তা আজকের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক। তাই তাঁকে পাঠ করা অনিবার্য। তাঁর সমাজবীক্ষণ এক ভিন্ন স্বাদের আস্বাদান এনে দেবে এবং বোধের ক্ষেত্রে অনুরণন তুলবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top