মালায়ালাম কবিতা ।। কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না।। সুগাথাকুমারী ।। হিন্দি থেকে ভাষান্তর- অজিত দাশ


কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

এখানে ঢেঁড়স ক্ষেতের এক কোণায়
ছোট্ট মাটির ঘরে
আমি এক হতভাগা থাকি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

ঘাগড়ার পাড়ের মাঝে সালোয়ারের দুলনীতে
পায়ে লাগানো ঘুঙুরের শব্দে
কোমরে ঝকঝকে মটকা নিয়ে
নিজের চোখে অনুরাগের কাজল লাগিয়ে
জল ভরার অজুহাতে
আমি তোমার সঙ্গে কখনো দেখা করিনি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

পুকুরে স্নান করতে গিয়ে, চঞ্চল কালিন্দীর মতো
শীতল ঢেউয়ে দুলনীতে, অর্ধমগ্ন
লজ্জায়, শরমে, পলক ঝুঁকিয়ে
হাত বাড়িয়ে আঙ্গুলের ইশারায়
আমি কখনো তোমার কাছে, লুকিয়ে রাখা আমার জামা
ফিরে পাওয়ার আগ্রহ দেখাইনি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

বনের গহীনে, কদম গাছের নীচে বসে
যখন তুমি তোমার বাঁশির সুর ছড়িয়ে দাও
তখন পূর্বরাগ অসমাপ্ত রেখে
চুলায় উপচে পড়া গরম দুধ ভুলে
ঘরের সকল কাম-কাজ ছেড়ে
তড়িঘড়ি কাপড় পরে
চুল না বেঁধে, নিজের কান্না করা সন্তান ফেলে
মহিষ চরানো আমার পতির নজর ফাঁকি দিয়ে
সবকিছু ভুলে গিয়ে, দৌড়ে,
আমি গোপীদের সঙ্গে তোমাকে দেখতে যাইনি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

গোপীদের মিলিত আড্ডার উচ্ছল
যখন বন্ধ হয়ে আসে ধীরে ধীরে
আমি পলক ঝুঁকিয়ে আমার ছোট্ট মাটির ঘরে
নিজের হাজারটা কাজের মাঝে ফিরে আসি
এই জন্মের সকল বন্ধনে আটকা পড়ে থাকি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

তুমি নীল চাঁদের মতো সবার মধ্যমণি
আর তোমার চারপাশে তোমার লীলায়
মাতাল টলতে থাকা সুন্দরী গোপীরা
তোমার বাঁশির ধ্বনিতে সব হুঁশ হারিয়ে ফেলে
ঢলে পড়া গোপীরা
তখন দুষ্টমিতে ভরা তোমার বাঁশির ধ্বনি
মধ্য তালে দ্রুত বদলে যায়,
সেই লয়ে দুলে উঠা গোপীদের পা
আর পায়ের মূদ্রায় বেজে উঠা শব্দ
যেন হাসি আর কোলাহল
নাচতে থাকা গোপীদের ঘাগরার পাড়,
হাওয়ায় দুলে উঠা তাদের চুড়ি পরা হাত
ইন্দ্রধনুর মতো হয়ে দুলছে
এমন পরিস্থিতিতে, আমি আমার চুল খুলে,
চুলের ভেতর ফুল গুজে নিয়ে কখনো নাচিনি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

নৃত্যে মগ্ন ক্লান্ত হয়ে পড়া শরীর
ধুলায় ছেয়ে যাওয়া ধূসরিত অংগ
তখন হাঁপাতে হাঁপাতে
ফুলে ঢলে পড়া গাছে বুক ঝুঁকিয়ে
তোমাকে আমি লালসা ভরা দৃষ্টিতে কখনো দেখিনি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

প্রেমে পাওয়া আমার দুঃখ
কোনো কুশল দাসী
তোমার কাছে দৌড়ে গিয়ে কখনো বলেনি
মহিষ চরানো কাদার মাঝে ফুটে উঠা সাদা ফুলের দুলনীতে
দূর থেকে আসা তোমার পদধ্বনি কান পেতে
শোনার প্রতীক্ষায় কখনো ছিলাম না,
না বিস্ময় নিয়ে কখনো তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

সহস্র বুনো ফুলের একসঙ্গে দুলে উঠা
আর সেই সাদা ফুলের মাদকতা
ছলকে থাকা শীতল নীল আকাশে
ঠিক এমনই তোমার নীল বক্ষে
নিজের মাথা গুজে কখনো আমি দাঁড়াইনি
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

বসন্তের মতো তুমি আস…
বসন্তের মতো তুমি আস…

——

বাঁশরীর সুর বসন্তের মত আসে আমার দিকে
আমাকে তোমার ভেতর বিলীন করে
যেন তুমি আর আমি অভিন্ন
আমার ভাঙ্গা কুটিরের দরজা বন্ধ করে
এমন আনন্দে ভাব-বিভোর যে
আমার চোখ খুশির অশ্রুতে ভিজে উঠেছে
এই খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার আগে
তোমাকেই আমার হৃদয়ে রেখে পূজা করেছি আমি
তারপরও
কানাইয়া, তুমি আমাকে জান না…

সারা গোকূল কাঁদছে
সারা গোকূল কাঁদছে
কানাইয়া তুমি মথুরা যাচ্ছ
তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য
ঘাসের তৈরি রথে
নিষ্ঠুর এবং নির্মম যেন এসে পৌঁছেছে
আমার মুখে কোনো শব্দ নেই, চুপচাপ নিশ্চল
শুন্য হয়ে বসে আছি বারান্দায়
রথের চাকার গর্জন
আর ঘোড়ার খুঁড়ের শব্দ যখন কানে আসলো
আমি মুখ তুলে তাকালাম
পতাকা লাগানো রথ, তাতে বিরাট রাজ্য-চিহ্ন
প্রফুল্লিত তুমি, পূর্ণচন্দ্রের মতো দীপ্তমান রথে বসে আছ
হাত বাড়িয়ে ক্রন্দনরত গোপীরা তোমার পেছনে পেছনে চলছে
লাফিয়ে লাফিয়ে পুরো গ্রাম চলছে রথের পেছন পেছন
অশ্রুতে ভেজা তোমার অলৌকিক চোখ
তাদের দুঃখে লাল হয়ে আছে
তুমি পেছন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছ তাদের দিকে

একটা পাথরের মতো আমি
নিশ্চুপ, নিশ্চল সেখানে দাঁড়িয়ে
তুমি আমাকে জান না কানাইয়া, কিন্তু
তারপরও এক মূহুর্তের জন্য তোমার রথ আমার
ছোট্ট মাটির ঘরের সামনে থেমেছিল
অশ্রুসজল তোমার দৃষ্টি আমার দিকে পড়েছিল
করুনায় নিবিড় হয়ে যাওয়া তোমার মন
আমাকে দেখে তোমার ঠোঁটে জেগে উঠা স্মিত হাসি

কানাইয়া… আমাকে জান তুমি, কানাইয়া…?
আমাকে কি জান তুমি কানাইয়া…?
আমাকে কি জান…?

…….
[শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে ‘কানহা, তুম মুঝে নেহি জানতে…’ শিরোনামে হিন্দিতে সুগাথাকুমারীর এই কবিতাটি মালায়ালাম থেকে অনুবাদ করেছেন হিন্দি ও ইংরজী ভাষার তরুণ সাহিত্যতিক রাজস্থানের বেজি জেসন।]
——-
সুগাথাকুমারী (১৯৩৪-২০২০) সুপরিচিত মালায়ালাম কবি ও অ্যাক্টিভিস্ট। দক্ষিণ ভারতের নারীবাদী ও পরিবেশবাদী আন্দোলনের অন্যতম একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা। তাঁর বাবা মা দুজনেই ছিলেন সংস্কৃত ভাষার পন্ডিত, কবি ও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মুথুছিপ্পিকাল’,‘পাথিরাপুক্কাল’, ‘কৃষ্ণাকবিতাকাল’, ‘রাত্রিমযহা’ এবং ‘মানালিযুথু’।
জীবদ্দশায় সাহিত্য কৃতির জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কারের ছাড়াও কেরালা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার সহ আরও ১১ টি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top