‘কিছু কিছু নাম জানি যার অর্থের কোনো স্থিরতা নেই
কিম্বা এমনই অর্থবহ যে নদীর ঢেউয়ের ওপর দিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে সে পার হয়ে যায় নদী
গাছের সবুজের মধ্যে সে মিশে যেতে পারে। পারে
সবুজ পতাকার ভেতর সূর্যের স্থায়ী লাল রং বিছিয়ে দিতে।
আবদুল আলীম -যেন ধানের জমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস
যেন মেঘনার মাঝির ঘাম মুছে ফেলা ঠান্ডা শরীরের ওপর
অস্তগামী আলোর শেষ রশ্মি। ‘ (আল মাহমুদ)
‘আপনি বিদেশী ভাষায় কোনো গান জানেন?’ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক ও অনুষ্ঠান ঘোষক শহীদুল ইসলামের একটি জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে আব্দুল আলীম বলেছিলেন ‘না, আমি জানি না, তবে চেষ্টা করলে হয়ত গাইতে পারতাম। কিন্তু গাই নি। কেননা, আমি জানি যে, আমি গেছি বাংলাদেশের গান গাইতে। আমি বাংলাদেশের গান গাইতে গাইতে বাংলাদেশের গানকে তুলে ধরেছি যাতে আমাদের গানকে দিয়েই (তারা) তাদের খুশি করতে পারি। গান গাওয়ার সময় যখন সেখানে ভাটিয়ালীর টান দিয়েছি একটা, হয়ত ক্ল্যাপ দিতেই থাকে, তখন আর ক্ল্যাপ থামে না। ’
বস্তুত, একজন শিল্পী, তিনি সংগীত চর্চা করুন কিম্বা কাব্য চর্চাই করুন, প্রথম শর্তেই যে বিষয়টি অনিবার্য সেটি হলো- তার নিজ দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। এই শ্রদ্ধাবোধের ওপর ভর করেই যখন তার কর্ম প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে তখন সঙ্গত কারণেই সেই কর্মে উৎকর্ষ অর্জনের সম্ভাবনাটিও প্রকট হবে। অবশ্য সেই কর্মের ওপর প্রকৃত ভালো লাগার অনুভবটিও এক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠা হবে বাঞ্ছনীয়। অর্থ্যাৎ স্ব-কর্ম এবং দেশাত্মবোধের ওপর সীমাহীন অনুরাগের সৃষ্টি সঙ্গত কারণেই একজন শিল্পীর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে শিল্পীর আত্মসামর্থ্য অথবা সক্ষমতার ওপর বিশ্বাস স্থাপনও হয়ে উঠবে জরুরী। তিনি যে কাজটি করতে আগ্রহী হবেন সেই কাজের ওপর তার সফল হবার সম্ভাবনা কতটুকু সেই বোধের অনুধাবন এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সুর ও ছন্দের বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জনে এ্যারিস্টটল মনে করেন, ‘ দুটি বিষয় আমাদের সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে: কি সাধন করা যায় এবং কি সাধন করা উচিত। সমস্ত প্রকার মানুষেরই কতর্ব্য হচ্ছে সম্ভব এবং উচিতকে অর্জন করার চেষ্টা করা।’ ১
রবীন্দ্র, নজরুল, ভাটিয়ালী, বাউল, মরমী, মারফতি ও আধুনিকসহ সব ধরনের গানই গাইতেন আব্দুল আলীম। তবে ভাটিয়ালি গানই ছিল তার অধিক পছন্দের। ভাটি অঞ্চলের এই শিল্পীর জন্ম ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার তালিবপুর গ্রাম। মূলত ময়মনসিংহ ও সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাটিয়ালি গানের উৎপত্তি ঘটে যা পরবর্তীতে ঢাকা ও ঢাকার পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে বিস্তার লাভ করে। সাতচল্লিশ এর দেশভাগের পর আব্দুল আলীম মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার নেপথ্যে যে কারণ রয়েছে সেটি তার পুত্র অধ্যাপক জহির আলীমের সাথে কথোপকথনে জানা যায়। তিনি বলেন, দেশভাগের সময় আমার বাবারা যেখানে থাকতেন সেখানে কাজের সুবিধা ততটা ছিল না। তাই আমার চাচার পরামর্শে বাবারা ঢাকায় আসেন। তারা ভেবেছিলেন এখানে আসলে হয়ত ভালো থাকতে পারবেন।’
সে সময় স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার পাশ্ববর্তী ভাটি অঞ্চলের গান এবং সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহ তার নরম মনকে প্রভাবিত করে। ‘ভাটিয়ালি গানের সুর প্রধানত করুণ। গায়ক কয়েকটি শব্দ পরপর উচ্চারণ করে স্বরটি ধরে দীর্ঘ টান দেন। সুরের এই লহর বা টান উচ্চগ্রামে শুরু হয়, শেষে খাদে নেমে আসে। প্রলম্বিত এই টানের স্থিতি গায়কের দম ও মর্জির উপর নির্ভর করে। ২’ আব্দুল আলিমের ভাটিয়ালি গানের সুরের এই দীর্ঘ প্রলম্বিত সুমিষ্ট টান প্রকৃত অর্থেই অভাবনীয়। মূলত এই সুরের ওপর ভর করেই অগণিত ভক্তদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যখন তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, পল্লী গানই তার মননের প্রকৃত ঠিকানা, ভাটির মানুষের পাশে থেকেই তার পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার উৎকর্ষ সাধন, তখন তিনি সেই ঠিকানাতেই অবস্থান করলেন। পল্লী মানুষের জন্য গাইলেন জীবনের শেষ সময় অবধি। ১৯২৫ সালের পর এই অঞ্চলে ভাটিয়ালি গানের যে সূচনা সেটির বিপুল জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে আব্বাস উদ্দীন, শচীন দেববর্মন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, নীনা হামিদের পাশাপাশি আবদুল আলীমের অবদান অপরিসীম। ৩
যাই হোক, গায়কী অধ্যায়ের নানা পথ পেরিয়ে শিল্প সম্পর্কে তার যে আত্মগত অন্বেষা তারই জ্যোতির্ময় বহিঃপ্রকাশ পল্লীসংগীতের ওপর তার একনিষ্ঠ সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত। শিল্প সম্পর্কে এমন স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে হয়ত মৃন্ময় এই শিল্পীকে পল্লীর অগণিত মানুষ কখনই পেতো না। পারতো না নিজেদের মানুষ হিসেবে মনে করতে আব্দুল আলীমকে। দার্শনিক গুয়োর মতে, শিল্প আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম চেতনা, সৌন্দর্যের গভীরতম অনুভূতি এবং মহত্তম চিন্তাকে জাগ্রত করে। শিল্প মানুষকে ব্যক্তিগত জীবন থেকে বিশ্বজীবনে উত্তীর্ণ করে।’৪ শিল্প সম্পর্কে এমন প্রগাঢ় অনুভূতি অর্জনের কারণেই বিদেশী সঙ্গীত তো নয়ই, নির্দিষ্ট একটি দেশীয় সংগীতকেই বেছে নিয়েছিলেন আব্দুল আলীম। চূড়ান্ত অর্থে, তার এই ব্যক্তিগত ভালোলাগার ওপর অকৃত্রিম সাধনার অবিচল যাত্রা তাকে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বসংগীতের সীমানায় পৌঁছতে সহায়তা করেছে। চীনের এক সংগীত অনুষ্ঠানে তার সংগীত পরিবেশনের পারঙ্গমতা সম্পর্কে শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের উপলব্ধি , ‘ দেখেছি তাকে চীনের সেই পিপলস হলে , বিরাট হলে তাঁকে গান গাইতে। তার সঙ্গে গিয়েছি আমি ১৯৬৬ সালে। তিনি স্টেজে এলেন একটি চাষীর মতো কাপড় পড়ে লুঙ্গি এবং মাথায় গামছা বেঁধে স্টেজে এলেন, সামনের সারিতে বসে আছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-হেন-লাই আবদুল আলীম তাঁর সুরের জাদু ছড়িয়ে দিলেন সবার মাঝে। দেখে আমি বুঝলাম। কী বুঝলো চীনারা বাংলা গানের কিন্তু বুঝলো আবদুল আলীমের কণ্ঠমাধুর্য। শুধু বাংলাদেশের গান দিয়েই বাংলা পল্লী সংগীত গেয়েই বিদেশীদের মন জয় করেছিলেন। দেখেছি ডারবানে বা বাকুতে, জনসমদ্র বিরাট স্টেজে লক্ষ লক্ষ লোক। সেখানে- তারা বুঝলেন কণ্ঠের যাদু, সেই যাদু দিয়ে দেশে-বিদেশে মানুষের মন তিনি জয় করেছিলেন। ’ ৫
তবে পথটি কিন্তু মোটেও সহজ ছিলো না। আলীম শৈশবে যে গ্রামে থাকতেন সেখানে গান শোনারই কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পাশের বাড়ীর চাচার বাসায় একদিন হঠাৎই কলের গানের সুরে আকৃষ্ট হয়েই পরবর্তীতে নিরন্তর চর্চা করেছিলেন লাজুক কিশোর আলীম।কোনো ধরনের তালিম ছাড়াই শুধুমাত্র শুনে শুনেই সুরকে ধরতে পারা নিঃসন্দেহে প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ। সে কারণেই বোধহয় তালিবপুর গ্রামের জনমানবহীন খোলা প্রান্তরে গিয়ে চর্চা করেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার এ আগ্রহ ও সাবলীল মুগ্ধ কণ্ঠস্বরই মূলত আকৃষ্ট করেছিল এলাকাবাসীকে। বাধ্য হয়েই তারা কিশোর আলীমের বড় ভাইকে অনুরোধ করেছিলেন গানের তালিম নেবার। অতঃপর বড় ভাই শেখ হাবীব আলীর প্রচেষ্টায় ওস্তাদ গোলাম আলীর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে কিশোর আলীম তার কণ্ঠকে করেছিল আরো সুললিত, সুসংহত। তৎকালীন কলকাতা পৌরসভার মেয়র তারই গ্রামের সৈয়দ বদরুজ্জোহা চৌধুরীকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন আলীম ওই কিশোর বয়সেই। অতঃপর সেই মেয়রই তার গ্রামের সন্তান আব্দুল আলীমের প্রতিভা বিকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার বাড়ীতে রেখেই গান শিখিয়েছিলেন। ৬ ফলতঃ অল্প বয়সেই কলকাতা আলিয়া মাদরাসা মাঠে শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন আলীম। ‘সদা মন চায় মদিনা যাবো ’ গানটি শেরেবাংলাকে এতটাই বিমোহিত করেছিল যে, পোশাক কিনে দেবার পাশাপাশি পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি আলীমকে।
তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি আব্দুল আলীমকে। ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা দ্বারা জায়গা করে নিতে করতে সক্ষম হয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মনোজগতে। ওস্তাদ হিসেবে পেয়েছিলেন বেদারউদ্দিন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরীকে। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সের স্বল্প জীবনে রেকর্ড করেছিলেন প্রায় পাঁচশত গান। ৭ যার মধ্যে অন্যতম পরের জায়গা পরের জমি, সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি, নাইয়ারে নায়েব বাদাম তুইলা, সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখি, মেঘনার কূলে ঘর বাধিলাম, এই যে দুনিয়া, দোল দোল দোলনি, দুয়ারে আইসাছে পালকি, মনে বড় আশা ছিলো যাব মদিনায়, দুখিনীর পরানের বন্ধুরে, যে কইরাছে সেই জানে, তোমারও লাগিয়ারে, পথ চিনিয়া যাইও আমার বাড়ী ও পথের ভাই, সব সখিরে পার করিতেসহ অসংখ্য গান। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশে তিনি গান করেছেন। এছাড়াও পাকিস্তান শাসনামলে প্রায় একশত উর্দু ছায়াছবিতেও তিনি গান গেয়েছিলেন (পুত্র আজগর আলীমের তথ্যানুযায়ী)। এবং লোকমুখে শোনা যায়, তার অসংখ্য গানের রেকর্ড এখনো পাকিস্তান বেতারে সংরক্ষিত রয়েছে।
আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও আব্দুল আলীম সংগীত চর্চা চালিয়েছিলেন অব্যাহত গতিতে। অর্থ উপার্জনের মোহ হয়ত তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি বলেই এই সংকটটি গভীরভাবে অনুভূত হয়নি। আর করলেও সেটির বহিঃপ্রকাশ তার মতো অন্তঃপ্রাণ শিল্পীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথবা এ ধরনের শিল্পীর পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না। নইলে আব্বাস উদ্দিন যখন তাকে রেডিওতে চাকরি দেয়ার কথা বলেছিলেন তখন তার প্রত্যুত্তরটি ছিল এমন-‘স্যার, দিলে তো উপকার হয়, এখন তো একটু অভাবে আছি, কষ্টে আছি খুব। এখন তো রেডিওতে গান গ্ইা। দশটা করে টাকা দেয়। সারাদিন গান গেয়ে দশটা করে টাকা দেয়। তারপরে চাকরি দিলেন আমাকে। ’মূলত রেডিও ইন্টারভিউতে উপস্থাপক শহিদুল ইসলামের কাছে যখন তিনি একথা বলছিলেন তখনই বেশ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, এই কথাগুলি উচ্চারণ করতেই কতটা বেগ পেতে হয়েছিল আব্দুল আলিমকে। বাস্তবে এর সবগুলো কথা তিনি আব্বাস উদ্দিনকে বলতে পেরেছিলেন কিনা কিম্বা বলতে গিয়ে কতটা গলদর্ঘম হতে হয়েছিল তাকে তা তার সেই কথোপকথন থেকে স্পষ্টই অনুমান করা যায়। মূলত একজন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তিনি শিল্পী অথবা সাধারণই হোক না কেন, ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের কথা উপস্থাপনে বিব্রতবোধ করেন। পক্ষান্তরে এ ধরনের ব্যক্তিত্ব নিজের শিল্পচর্চার পথকে অব্যাহত রাখতে উপেক্ষা করেন সকল বাধা। ‘বাবা আসলে সংগীতের ওপর যতটা মনোযোগ দিয়েছিলেন শরীরের প্রতি ততটা মনোযোগ দিতে পারেন নি। পেট ব্যথাকে দিনের পর দিন উপেক্ষা করে চেষ্টা করেছিলেন স্বাভাবিক জীবন যাপনের। অর্থনৈতিক সংকট এক্ষেত্রে একটা বড় কারণ ছিল। আর যখন জানতে পারলেন, পরিবারের আমরা সবাই যখন জানতে পারলাম বাবা লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত তখন তো কিছুই করা গেল না। ’ শিল্পী আবদুল আলীমের অকাল মৃত্যুর কারণ এভাবেই বর্ণনা করেন সংগীত কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জহির আলিম।
সাংসারিক জীবনে স্ত্রী জমিলা আলিমের অকুণ্ঠ সহযোগীতা এবং উৎসাহ না পেলে হয়ত আব্দুল আলীমের সংগীত চর্চার পথটি এতটা মসৃণ হতো না। তাছাড়া জমিলা আলিমও সঙ্গীতকে ভালোবাসতেন। আব্দুল আলীমের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘প্রেমে মরা জলে ডোবে না ’ তিনি তার স্ত্রীর কণ্ঠেই প্রথম শুনেছিলেন। এবং স্ত্রীর অনুরোধেই তিনি এ গানটি গেয়ে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন। ব্যস্ত শিল্পী হয়েও স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি আব্দুল আলিমের প্রীতিপূর্ণ দরদই বোধহয় কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় নি। সাংসারিক দায় পালনে তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাবার এই দায় সম্পর্কে সংগীত শিল্পী পুত্র আজগর আলীমের অভিব্যক্তি এমন, ‘আসলে শিল্পী আব্দুল আলীম, আমি বলবো একরকম এবং আমার বাবা আব্দুল আলীম আর একরকম। কারণ, আসলে আমরা যেটুকু জানি যে, মানে, শিল্পীরা সাধারণত উদাসীন হয়। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে থাকে, মানে বাড়ীর দিকে অত খেয়াল থাকে না, সংসারের দিকে। কিন্তু আমার বাবা কিন্তু উলটো ছিলেন, একেবারে। তিনি যেখানেই যেতেন গান করতে, গান করতেন কিন্তু আমরা যে ছিলাম তার সন্তান, এই সাত ভাই বোন আমরা, উনি কিন্তু আমাদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন, এবং গান শেষ হওয়ার পরে উনি বাড়ীর দিকে আগে চলে আসতেন, যে আমার ছেলেমেয়েরা কি করছে, পড়ালেখা করছে না কি কোথায় আছে? মানে এই যে একটা বাবা হিসেবে সন্তানদের প্রতি যে একটা দায়িত্ব কর্তব্য, এইটা মানে অতুলনীয় ছিলো। এবং আমরা কি খাবো, খেয়েছি কি না, মানে এসে সবসময় উনি এগুলি জিজ্ঞেস করতেন। ’ ৮ চারবোন তিনভাইসহ সাত সন্তানের ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠা তার এই দায়বোধের প্রতিফলন বলেই ধরে নেয়া যায়। সন্তানরা মন দিয়ে পড়াশুনা করবে এটি ছিল শিক্ষানুরাগী আব্দুল আলিমের একান্ত অভিপ্রায়। তাছাড়া শিক্ষানুরাগী এমন মননের অধিকারী না হলে তার পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না সংগীত কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে সেই সময়ে অধ্যাপনা করার। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা শিল্পীদের উন্নয়নের জন্য তার যে বিকেন্দ্রীভূত চিন্তা সেটিও নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ‘বস্তুত উচ্চ শিক্ষা না থাকলেও পাকিস্তান শাসনামলে বাবাকে ঢাকা সংগীত কলেজে সংগীত শিক্ষক হিসেবে নির্বাচনের মূল কারণ ছিল তার সংগীতের ওপর সহজাত জ্ঞান। গানের ব্যাকরণ তিনি এত সহজেই রপ্ত করতে পারতেন যা অবাক করতো সেই সময়ের শিল্পীদের ‘ সে সময় বাবার পাশাপাশি আরো কয়েকজন শিল্পীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ তাদের সংগীত কলেজে অধ্যাপনার জন্য নির্বাচন করেন। সংগীত কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পাবার কারণ হিসেবে জানান অধ্যাপক জহির আলিম। সংগীত কলেজে প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে আবদুল আলীম শেষ সময় অবধি যুক্ত ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে সুনাম যেমন কুড়িয়েছিলেন তেমনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অপরিমেয় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ‘ বাবা বাইরে কোথাও গান গাইতে গেলেই তার ছাত্ররা বিমানবন্দরে গিয়ে বিদায় জানাতো এবং ফেরার সময় অভ্যর্থনা জানাতো বর্তমানে যা বিরল। আর বাবাও বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। আমার এখনো মনে আছে, বাবা চীন থেকে তার ছাত্রদের জন্য ফুল নিয়ে এসছিলেন।’ বলে জানান অধ্যাপক জহির আলীম।
যাই হোক, সমসময়ে শিল্পী থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, যারাই সংসারী হয়ে সৃজনশীল চর্চায় ব্যাপৃত থাকার আগ্রহ পোষণ করবেন তাদের ক্ষেত্রে আব্দুল আলীম হতে পারেন উদাহরণ। আর বোহেমিয়ান হয়ে জীবনকে যাপন করার ইচ্ছে থাকলে সেটি ভিন্ন কথা। তবে সাংসারিক জীবনের মধ্যে দিয়ে যে বাস্তব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে অর্জন করা যায় সেটি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে কি? পক্ষান্তরে এই অভিজ্ঞতা যে সৃজনের ক্ষেত্রে যে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে তা সহজেই অনুমেয়। এমন অভিজ্ঞতাগুলোই আলীমের মতো শিল্পীদের মননকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে বলে ধারণা করা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, শিল্পী আব্দুল আলিমের প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে কি? মোটা দাগে বললে, একজন প্রকৃত শিল্পীর মূল্যায়ন নিরূপিত হয় তার কর্মের ব্যাপ্তির মাধ্যমে। সাধারণ পাঠক অথবা শ্রোতা সেই শিল্পীকে কতখানি ধারণ করলো সেই বিষয়ের উপরে। সেটি বিবেচনা করলে বোধহয় এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, শিল্পী হিসেবে আব্দুল আলীম অবশ্যই সার্থক। অন্তত হাজার বছর পরেও যে তার গানগুলি টিকে থাকবে তা বলা যায়। তবে আনুষ্ঠানিক আবহে শিল্পীর জন্য কিছু নির্মিত হলে সেটি তার প্রসারকে বেগবান করতে পারে। যদিও সেটি সেই শিল্পীর ধ্রুপদী হবার ক্ষেত্রে এটি কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নয়। তবে নিশ্চিতভাবে সেই দায়টি সম্পন্ন করার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম অথবা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কিছুটা নির্ভার হতে পারে। এই মূল্যায়ন যখন কিছুটা হলেও সাধিত হবে তখন পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরাও উৎসাহ পাবে, এগুবে রাষ্ট্রিক সংস্কৃতি। ‘সহজ ভাষায় বলা যায়, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার গতিপথ খুঁজে পায় সেদেশের জনগণের সংস্কৃতি থেকে । ৯
সংগীত বিষয়ক পত্রিকা সরগমের সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ‘আব্দুল আলিমের উপর বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কাজ হলেও বলার মতো কোনো কাজ আমরা করতে পারিনি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে তার কর্মের উপর কাজ করা উচিত বলেই অকুণ্ঠচিত্তে জানান তিনি। কণ্ঠশিল্পীএবং আব্দুল আলীমের মেয়ে নুরজাহান আলীমের কণ্ঠে বাবার কীর্তি নিয়ে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ঝরে বিশেষ ক্ষোভ, ‘আব্দুল আলীমের গান অনেকেই করতে চায় এবং করেও। কিন্তু প্রথম কথাটা হচ্ছে যে, বাবার নাম অনেকে বলে না, অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও, মানে, যারা গান করছে তারাও কিন্তু সেই মূল যে শিল্পী তার নামটা দেয় না।এটা খুব কষ্টের। একটা বিষয় আমি জানি না কেন এ বিষয়গুলো, আসলে, বারবারই আমরা, বিভিন্ন মাধ্যমে কিন্তু উঠে আসছে। কিন্তু তারপরও তারা এগুলো খেয়াল করছে না। কিন্তু আমার বিশেষভাবে অনুরোধ থাকবে,তারা, যারাই আব্দুল আলীমের গান করবে, তারা অবশ্যই বাবার নামটা যদি একটু উল্লেখ করে,তাহলে এটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য,এটা খুবই ভালো। কারণ তারা জানতে পারবে যে, এটা আসলে আব্দুল আলীমেরই গান। ১০ সাবিনা ইয়াসমিনের মতে, ‘ তার মতো শিল্পী এ দেশে কখনও আসেনি এবং আর আসবে বলেও মনে হয় না। দুঃখ একটাই, তার গান বিটিভি ছাড়া (তাও একটি কি দুটি গান) আর কোথাও কোনো ভিডিং নাই। নাই তাঁর গাওয়া গানের কোনো আর্কাইভ। নাই তাকে নিয়ে লেখা কোনো বিশেষ নিবন্ধ বা কোনো বই। ফলে আজকের প্রজন্মের খুব বেশি মানুষ তাঁকে তেমনভাবে চিনতে পারলো না। এই দেশে তাঁর তেমন কোনো মূল্যায়নই হয় নি। ’ ১১
যাই হোক, সার্বিক প্রেক্ষিত বিবেচনায়, একজন শিল্পী হিসেবে যে ধরনের নিষ্ঠা, বিশিষ্টতা ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের সমন্বয় প্রয়োজন তা অবলীলায় আব্দুল আলিমের জীবনরেখায় খুঁজে পাওয়া যায়। তার এই জীবনালেখ্য যদি বর্তমান শিল্পীদের অতিমাত্রিক আত্মসিদ্ধিগত চিন্তার পরিবর্তন ঘটিয়ে শিল্পের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনে সুযোগ সৃষ্টি করে তবে শিল্পও তার প্রকৃত পথ খুঁজে পাবে। একটি বিষয় শিল্প মাধ্যমের সকল পর্যায়ের শিল্পীদের উপলব্ধির দুয়ারে স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, তার সৃজনশীল চর্চার নেপথ্যে মানসিক প্রশান্তির বিষয়টি কতটা নিবিড়ভাবে জড়িত? যদি তা আত্মসন্তুষ্টিকে ডিঙিয়ে প্রচার সর্বস্ব হয়ে ওঠে তবে শিল্প ও শিল্পী উভয়ের জন্যই তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে আব্দুল আলীমের মতো শিল্পীরাই হতে পারেন অনুসরণীয় যারা বৈষয়িক অর্জনের প্রাধান্যকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেন সৃষ্টির মাঝে আত্মসন্তুষ্টির।
আব্দুল আলিম সম্পর্কে এই যে অল্প বিস্তর ধারণা প্রাপ্তি সেটির কৃতিত্ব অবশ্যম্ভাবীরূপে শহিদুল ইসলামের। বাংলাদেশ বেতারের এই উপস্থাপনা শিল্পী যে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটিয়ে একেবারে আব্দুল আলীমের মনোজগতের কিনার থেকে অজ্স্র কথা বের করে নিয়ে এসেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। তার কণ্ঠের মিষ্টতা ও বিনয়ী ভাবের পাশাপাশি আকাশের মতো উদার আন্তরিকতা বিমুগ্ধ হয়ে শুনতে বাধ্য করেছে সাক্ষাৎকারটি। সাক্ষাৎকারটি না শুনলে নিশ্চিতভাবেই আব্দুল আলীম সম্পর্কে কিছু কথা লিখবার বিষয়টি হয়ে উঠতো অত্যন্ত দুঃসাধ্য ।
সাধারণভাবে সাক্ষাৎকার মূলত দুজন ব্যক্তির কথোপকথন, যেখানে অন্তরঙ্গভাবে দুজনের ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে একজনের জীবন, দর্শন ও কর্মের উপর বিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্য থাকে। সেক্ষেত্রে যিনি সাক্ষাৎগ্রহীতা হবেন তার দায়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হবে। তার প্রজ্ঞা ও প্রত্যুৎপন্নমতিতার ওপর ভিত্তি করেই প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হবে। দেশলাইয়ের কাঠি হয়ে তিনি সেই বিশেষ ব্যক্তির মননে আগুন জ্বালাবেন যা বিস্ফোরিত হয়ে সর্বোচ্চ তথ্য, আবেগ, অনুভূতির প্রসব ঘটাবে। শহীদুল ইসলাম সে কাজটিই করেছেন সাক্ষাকারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কথা বলেছেন খুবই কম। কিন্তু যা বলেছেন তা থেকে রিটার্ণ এসেছে প্রচুর। প্রশ্নের ভাঁজে প্রশ্ন তৈরি করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন আব্দুল আলীমের মর্মলোকের অতলে থাকা অজস্র অভিজ্ঞতাকে। নিজেকে যেন সাক্ষাৎকারের পুরো সময়টুকু লীন করে দিয়েছেন আব্দুল আলীমের মানসের সাথে।
যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো- নিজেকে জাহির করবার ন্যূনতম তাড়না তার মধ্যে লক্ষিত হয় নি। পরোক্ষভাবে এটিই তার জ্ঞানের গভীরতা এবং শক্তিমান ব্যক্তিত্বকে উপস্থাপন করেছে। সাক্ষাৎকারগ্রহীতা যদি কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ করে নিজেই অতিরিক্ত কথোপকথন করে নিজেকে জাহিরের চেষ্টা করেন তবে তা হবে অত্যন্ত অশোভনীয়। সন্দেহাতীতভাবেই এতে দর্শক ও শ্রোতা উভয়ই বোধ করেন চরম বিরক্তি। এবং এতে করে একটি মূল্যবান সময়েরই কালক্ষেপন হয়। একইসাথে সমসময়ে প্রশ্নকেন্দ্রিক সাক্ষাৎকারগুলোতে যা লেখকের মেইলে পাঠানো হয় হয়ত তাতে কিছুটা ইতিবাচকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে উঠে অত্যন্ত দুঃসাধ্য। ‘পেয়ারার সুবাস’গ্রন্থটিতে মাকের্জের দীর্ঘ সাহিত্য জীবন বর্ণনায় যে গতি ও ধারবাহিকতা লক্ষ করা যায়, ১২ অথবা সক্রেটিসের কারাকক্ষে সক্রেটিস ও ক্রিটোর কথোপকথন ১৩ পাঠকের মনোজগতে একটি কথার পর আরেকটি কথা শোনার ওপর যে তীব্র মাত্রার আগ্রহ সৃষ্টি করেতা সন্দেহাতীতভাবেই একটি ধ্রুপদী অধ্যায়। দর্শনগত দিক থেকে কথোপকথনদুটির সাথে আব্দুল আলিম ও শহিদুল ইসলামের সাক্ষাৎকারটির সাযুজ্য খুঁজতে যাওয়াটা নিরর্থক। ১৪ তবে আবেগ ও গতির অনুসন্ধানে এ সাক্ষাৎকারটি যে সে ধরনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পেরেছে তা দৃঢ়ভাবেই ব্যক্ত করা যায়। মূলত এ সাক্ষাৎকারটি আমাদের লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে একটি অপ্রতুল সৃষ্টি হয়ে থাকবে।
পাঠকবৃন্দের সুবিধার্থে সাক্ষাৎকারটি সংযুক্ত হলো।১৫
আব্দুল আলিমকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তবে আজকে আমরা তার সাথে খানিকটা অন্তরঙ্গ আলোকে আলাপ আলোচনা করবো। আচ্ছা আলিম ভাই, আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়, কালিপুর গ্রামে।
তো আপনি কখন থেকে সংগীত চর্চা শুরু করলেন?
আমার যতদূর সম্ভব, আমার যখন নয় কিম্বা দশ বছর বয়স তখন আমার এক চাচা কলকাতা থেকে একটা কলের গান কিনে নিয়ে গেলেন। তখন তো আমরা গ্রামোফোন বুঝতাম না, কলের গানই বুঝতাম। তা সকালে প্রায় তখন নটা বাজে তখন আমি পান্তা ভাত খাচ্ছিলাম বাড়ীতে বসেই, গ্রামের বাড়ি তো আমার জন্ম সেখানে মা পান্তা ভাত দিছে সে পান্তা ভাত খাচ্ছি। হঠাৎ! আমার কানে একটা সুন্দর আওয়াজ আসলো, গানের আওয়াজ। ভাত রেখেই আমি সে বাড়িতে, পাশের বাড়িতে গেলাম আমার চাচার বাসায়। সেখানে দেখছি, গান হচ্ছে তখন এদিক ওদিক তাকাই কোনখানে মানুষ আছে কিছুই বুঝতে পারি না ও গোলমতো একটা রেকর্ড ওই এখন যে রেকর্ড দেখি সেই রেকর্ড ওই ওই রেকর্ড ঘুরছে আমার প্রথম তখন আমি দেখলাম। এবং সেই গানটি আমার যতদূর মনে পড়ে গানটা আমি পরে আমি একটু অনুভব করে শিখে নিছি শেষ পর্যন্ত এ গানটির কথা হলো ‘সদা মন চাহে মদিনা যাবো।Õ
এই গান শুনেই আপনি প্রথম প্রেরণা পেলেন যে আপনি গান শিখবেন নাকি?
আমি প্রেরণা পেলাম এবং আমি গান শুনে পাগল হয়ে গেলাম। ওই গান শুনে । এই গান শুনেই।
আচ্ছা এই গানটি কার কণ্ঠে রেকর্ড ছিল আপনার মনে আছে?
এই গানটির রেকর্ড ছিল কে মল্লিক।
আলিম ভাই, তো, এরপরে আপনি গান চর্চা শুরু করলেন কীভাবে?
চর্চা, তখনো আরম্ভ করিনি। তখনো আমি কলের গানই শুনতাম। শুনে শুনে কিছু গান আমি শিখলাম। শেখার পরে তাল এবং লয় ওই রেকর্ডে যেমন বাজতো ঠিক ওই লয়ও বুঝে গেলাম এবং তালও বুঝে গেলাম। শুনে শুইেন। আমার, মানে, মাথায় গুজে গেল ওই জিনিসটা। তারপরে ওই গ্রামের ভিতর ওই গান আমি গাইতাম না, গাইতাম মাঠে যেখানে কোনো লোকজন নাই। শরম লাগতো আমার খুব। খুব লজ্জা লাগতো। তারপরে একদিন গ্রামের কতগুলি লোক এসে আমার ভাইকে ধরলো যে আলিমকে তোমরা গান শেখাও। তার গলাটা এত মিষ্টি। তারপর আমার ভাই টাকার লোভ দেখায়, গান গাওয়াতে চেষ্টা করে তা আমি শেষ পর্যন্ত টাকা ভাই দিলো আমি গানও গাইলাম। সে একজন ভদ্রলোক ছিলেন। গোলাম আলী নাম ছিল তার, সেই ভদ্রলোক একটা হারমোনিয়াম নিয়ে আসলো। আমার গান গাওয়ালো, গাওয়ার পর গান শুনে মানুষ খুব প্রশংসা করতে লাগলো, খুব তারিফ করতে লাগলো। তারপর আমার লজ্জাও ভেঙে গেল। তখন থেকেই ওই ওস্তাদ বললাম ওনাকে, গোলাম আলী সাহেবকে। উনি আমারে গান শেখাতে লাগলেন।
উনি শেখানো শুরু করলেন। উনি কি আপনার গ্রামেরই লোক?
গ্রামেরই লোক।
আচ্ছা, উনি আপনার জীবনের প্রথম ওস্তাদ।
জি¦।
তারপরে আর এমন কোনো আপনার ওস্তাদ আছে কি যাদের কাছে আপনি গান শিখেছেন?
আছে। তবে এই গান শোনার পরে গ্রামে থিয়েটার হতো। হয়ত জায়গায় জায়গায় আমাকে নিয়ে যেত। অনেক মেডেল দিত। অনেক অনেক জায়গাতে। মেডেলও পেতাম। খুব আনন্দ পেতাম তখন। তারপরে উৎসাহ বেড়ে গেল তখন। তারপরে আমি, ওই আমার ওস্তাদ গোলাম আলী সাহেব তিনি কলকাতা নিয়ে গেলেন। নিয়ে যাওয়ার পরে গ্রামোফোন কোম্পানিতে একদিন বেড়াতে নিয়ে গেলেন। তখন ওই কে মল্লিক সাহেবের দেখা পেলাম। ওখানে। তখন নজরুল ইসলাম ভাল ছিলেন।
তার সাথে আপনার পরিচয় হলো।
পরিচয় সেদিন হলো না। তারপরে আমি আলিয়া মাদ্রাসায় গেলাম একদিন একে ফজলুল হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনি আসবেন। বক্তৃতা হবে। সেখানে আমার ভাইয়ের সঙ্গে গেলাম। তারপর আমার ভাই গোপনে গোপনে আমার নাম একটা লিস্ট লিখে দিয়ে আসলো যে এ একটা গান গাইবে। তা আমি তো ভয়ে গান গাইতে পারছি না। আমার কেমন লাগছে সেখানে কলকাতার মতো জায়গায় প্রথম গিয়েছি। তারপরে যাই হোক আমাকে ডাকলো যে এবারে গান গাইবে আব্দুল আলিম। আমি গান আরম্ভ হওয়ার পরেই দেখি হক সাহেব পেছনে এসে বসেছেন। সে গানটা আমি গাচ্ছি। সদা মন চাই মদিনা যাবো। এই গান শুনে তিনি খুব অঝোর ধারায় কাঁদছেন। এবং বললো আমার বাড়ি তুমি দেখা করতে যাবে। তোমারে আমি পোশাক তৈরি করে দিব। তখন উনি যেখানেই ফাংশন করতেন কলকতার মধ্যে খিজিরপুর, আলিপুর – গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন আমার বাসায়। তারপরে ভাইকে নিয়ে আমি যেতাম সেখানে। একদিন গিয়ে দেখলাম সোহরাওয়ার্দী সাহেবও সঙ্গে। আমার গান শুনে উনি খুব খুশি হলেন। এবং পাবলিক আমাকে টাকা দেয়। মোটরগাড়িতে চড়ে আসি। আমার খুব আনন্দ পায়। টাকা নিয়ে এসে বাড়িতে এটা ওটা কিনে খাই। রাস্তাঘাটে তখন ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায়।
আচ্ছা তখন আপনার বয়স কত হবে?
তখন বয়স হবে দশ থেকে এগারো।
তো এভাবেই আপনার গান চর্চা শুরু হয়। এরপর আপনার জীবনের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড কি?
তখন আমার গ্রামোফোন প্রথম রেকর্ড, এক ভদ্রলোকের হুগলী বাড়ি। এম সুলতান তার নাম। তিনি ঢাকাতেই বর্তমানে আছেন। বুড়া হয়ে গেছেন। খুব ভালো নামকরাও কবি ছিলেন তিনি, লেখক। তিনি আমাকে গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়ে গেলেন। কলকাতায় এক আর এক জায়গায়। সেখানে গিয়ে দেখি বিকেলে বসে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব। তা তিনি একটা গান লিখছেন। হঠাৎ এম সুলতান সাহেব উনাকে বললেন – কাজীদা একটি ছেলেকে নিয়ে এসছি। একটু গান শুনুন।
আমি যখন বসে আছি তখন বললো, তুমি গাও। তখন আমি ওনারই লেখা, কাজী সাহেবরই লেখা একটা গান আব্বাসউদ্দীন সাহেবের রেকর্ড ছিল উত্তর পুরান পাপ দরিয়ায়। এ গানটি গেয়ে শোনালাম। উনি খুব খুশী হলেন। তারপরে গ্রামোফোন কোম্পানির ট্রেনার যিনি ছিলেন তাকে বললেন যে, এ ছেলেটির দুটি গান গ্রামোফোনে রেকর্ড করো। সে গান দুটি ছিলো- তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো সঙ্গে লইয়ে যাই মোদের সাথে মেষ চারণে ময়দানের ভয় নাই আর একটি হলো আফতাবে বসলো পাঠে আধার আসে ছেয়ে চল ফিরে যাই মা হালিমা আছে রে পথ চেয়ে।
আচ্ছা এই গানের রেকর্ড আপনার কাছে আছে?
ছিল, কিন্তু রেকর্ডটা ভেঙে ফেলেছে।
আপনি ঢাকা বেতারের সাথে জড়িত হলেন কীভাবে?
এরপরে তো আমি কলকাতায় রেকর্ড করি। তারপরে বাড়ি ফিরে যাই। তখন দেশ ভাগ হয়ে গেল। তারপর আমার ভাই দেশে গেলেন। ভাই বললেন চলো ঢাকায় যাই।
আলীম ভাই, আপনি ঢাকায় এসে কি কারো কাছে গান শিখেছেন?
খান সাহেব আমাকে তিন চার বছর গান শেখালেন।
আর কারো কাছে আপনি গান শিখেছেন কি?
তারপর শিখেছি। অ্যা, তবে তার আগেই মরুহুম আব্বাস উদ্দিন সাহেব আমার গান শুনলেন সাদেকুর রহমান সাহেবের বাড়িতে। শুনেই বললেন যে, তোমাকে আমি চাকরি দিব
পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে।
পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে। বললাম স্যার, দিলে তো উপকার হয় এখন তো একটু অভাবে আছি, কষ্টে আছি খুব। এখন তো রেডিওতে গান গাই। দশটা করে টাকা দেয়। সারাদিন গান গেয়ে দশটা করে টাকা দেয়। তারপরে চাকরি দিলেন আমাকে। তিন বছর চাকরি করার পরে বললেন তুমি ক্ল্যাসিক্যাল গান শেখো, উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখো। তখন আমাকে, দুজন শিল্পীকে মোহাম্মদ হোসেন খসরু সাহেব ছিলেন, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু তার কাছে আমি তিন বছর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা করলাম। করার পর তিনি ইন্তেকাল করলেন। তারপর আর শিখলাম না। কিন্তু সেই রাগরাগিনী আমি এখনো পর্যন্ত বাড়িতে কিছু কিছু রেওয়াজ করি।
আপনি তো পল্লীগীতিতে যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছেন দেশে বিদেশে। সর্বত্রই আপনার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। আপনি পল্লীগীতি ছাড়া অন্য কোনো গান গান না কেন?
আমি গাইতাম, সব গানই গাইতাম। রবীন্দ্র সংগীতও গাইতাম, নজরুল ইসলামের গানও গাইতাম, ভাটিয়ালী গানও গাইতাম, বাউল গানও গাইতাম। কিন্তু হঠাৎ এই গানের সুরে যেন আমাকে পাগল করে ফেললো। আর যখন ঢাকায় প্রথম আসলাম, তখন দেখছি যে,শুনছি রেডিওতে মহফেল সাহেবের একটা গান সকালে উনি গাচ্ছেন, আর তার সঙ্গে বাঁশের বাঁশী বাজছে। সেই গান শুনে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম হঠাৎ রাস্তায়। দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার এত ভাল লাগলো যে, আমি এই গানই শিখবো আর কোনো গান শিখবো না।
ভাল শিল্পী হতে গেলে কি করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
ভাল শিল্পী হতে হলে প্রথমে গলা ভাল হতে হবে। গলা ভাল না হলে তার কিছুই হবে না। প্রথম গলা তারপর সেই গলাকে তৈরি করতে হলে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখতে হবে এবং তার সুর বুঝতে হবে। এবং সেই রাগ রাগিনীর উপরে কিছু রেওয়াজও করতে হবে। অর্থাৎ গলার কারুকার্য কিছু তৈরি হয় তাহলে তার গাইতে একটু ফ্রি হয়। যেন অসুবিধা বোধ করে না।
ইদানীং আমরা লক্ষ করছি যে, তেমন কোনো শিল্পীও যেন তৈরি হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
তৈরি হচ্ছে না তবে আমিও অনেক চেষ্টা করি সেরকম গলাও হয়ত দু’একটা পাই। কিন্তু কেন যে হচ্ছে না। সেটা আমার যেন মনে হয় যে তারা দু’চারমাস গান শেখার পরে হঠাৎ একটা বিদেশী সংগীত কানে আসলে এটা যেন অবহেলা করে। এবং তারা বলে যে পল্লীগীতি তো একই সুর। এ তো শেখা হয়ে গেছে। আর কি শিখবো।
আসলে আপনার মতে পল্লীগীতি কি একই রকম সুর?
একই রকম সুর না। আমি বলতে গেলে সুর বোধহয় হাজার রকমের আছে। বাংলাদেশের পল্লী সংস্কৃতিতে। কিন্তু সেই সুর আমরা গাইতে চেষ্টা করি নি। একই রকমের সুরে ফেলি, কোনো রকমে চালাই। কিন্তু আমার মনে হয়, সেই সুর যদি ঠিক পরিস্কারভাবে তুলি আমরা সেই গানে নিশ্চয়ই সেই নতুনত্ব একেক গানের পর একেক গান। একঘেয়েমিও লাগবে না।
আপনার মতে, আমাদের সেই পল্লী সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে কি করা দরকার। কি করলে আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটবে?
এখন আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার যে, যে সব দেশের আমাদের সম্পদ পড়ে আছে এগুলি সব সংগ্রহ করে রাখা, আমাদের একটা নিজস্ব জায়গায় যেমন রেডিও অফিস আছে এখানে। এবং যে সব শিল্পীরা ভাল ভাল শিল্পী গ্রামে পড়ে আছে, ভাল ভাল গলা, তারা ভাল ভাল গানও জানে। ভাল ভাল লিখতেও জানে। তাদের একটা বিহিত করা উচিত। মহকুমায় মহকুমায় জেলায় জেলায় যদি গান শেখার স্কুল সেখানে যদি তাদের নিয়ে এসে গান শেখানোর ব্যবস্থা করা হয় যদি আমাদের সরকার করেন আমার মনে হয় বহু শিল্পী আমাদের জন্ম হবে এই বাংলাদেশে।
আচ্ছা, আলীম ভাই, আপনি তো বিদেশেও গিয়েছিলেন।
জি¦।
গান গাইতে গিয়েছিলেন, কোন কোন দেশে গিয়েছিলেন?
রাশিয়া গিয়েছি, চায়না গিয়েছি আর বর্মা গিয়েছি।
ওসব দেশে নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
ওরা নিজেদের সংস্কৃতি প্রথম ওরা ভালো করে রাখবার সবসময় চেষ্টা করে। বিদেশে হয়ত তাদের দেশকে একটু খুশি করার জন্য কিছুটা। নিজেদের সংগীতকে শ্রেষ্ঠ স্থান পাওয়া জন্য সবসময় চেষ্টা করেন।
আপনি বিদেশী ভাষায় কোন গান জানেন?
না, আমি জানি না, তবে চেষ্টা করলে হয়ত গাইতে পারতাম। কিন্তু গাইনি। কেননা আমি জানি যে, আমি গেছি বাংলাদেশের গান গাইতে। আমি বাংলাদেশের গান গাইতে গাইতে বাংলাদেশের গানকে তুলে ধরেছি যাতে আমাদের গানকে দিয়েই তাদের খুশি করতে পারি। গান গাওয়ার সময় যখন সেখানে ভাটিয়ালীর টান দিয়েছি একটা হয়ত ক্ল্যাপ দিতেই থাকে তখন আর ক্ল্যাপ থামে না।
আপনি যখন ঢাকায় এলেন । এখানে আপনি প্রথম কোন গানটা রেকর্ড করলেন।
এখানে বাংলাদেশে রেকর্ড করি ১৯৬০ সালে। কয়েক খানা গান করেছিলাম। তার মধ্যে প্রথম গান করেছিলাম প্রেমের মরা জলা ডোবে না।
তাহলে আপনার স্ত্রীও আপনাকে প্রেরণা দিতেন?
দিত এবং সে কিছু গান সে জানতো। আমার বউ কিছু গান জানতো। যেমন আমার প্রথম রেকর্ড প্রেমে মরা জলা ডোবে না। আমি বউয়ের কাছ থেকে গানটি শিখেছিলাম। আমার বউ এ গান গেয়েছিল সেসময়। আমার খুব ভালো লাগলো হঠাৎ।
প্রেমের মরা জলে ডোবে না, এ গানটা আপনি আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে শিখেছেন?
জি¦। সে গাচ্ছিল হঠাৎ। আমি বললাম গানটা লিখে দাও তো। তখন গানটা লিখে দিলো সম্পূর্ণ। তারপর জায়গায় জায়গায় যখন গাইতে লাগলাম তখন মানুষ প্রশংসা করতে লাগলো। এবং বললো এটা মারফতি গান। এটা তুমি গাইবা।
আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি আপনার স্ত্রীর গান প্রথম রেকর্ড করতে পেরেছিলেন বাংলাদেশে। আলীম ভাই, আপনার ক ছেলেমেয়ে?
আমার চার মেয়ে তিন ছেলে।
এদের কাউকে আপনি গান শিখিয়েছেন।
আমি শিখাইনি। তবে আমি যখন বাড়িতে থাকি না তখন তিনচারজন নিজে নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজে নিজেই গান শুরু করে বাড়িতে। আমি ঘর থেকে শুনতে পাই।
কোন ধরনের গান আপনার পছন্দের?
আমার ভাল লাগে ভাটিয়ালি গান। আমাদের দেশ তো নদীমাতৃক দেশ। মাঝিরা যখন গান গায় তখন সেই ভাটিয়ালি গানের সুরে আমার অন্তর যেন পাগল হয়ে যায়। সেই টান আর সেই সুর। আর যখন পাল তুলে যায় যখন সেই গান শুনতে শুনতে। এজন্য ভাটিয়ালি গানটা আমার সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত লাগে।
আপনার এমন কোনো ঘটনা মনে পড়ে কি যা আপনার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে?
সিলেট লাইনে এক গ্রামে গান গাইতে গেছিলাম। সেখানে হয়ত আমার নাম শুনে বহু লোক এসছে। যে জায়গাটা ঘেরাও করেছে বিশেষ করে যেখানে গান বাজনা হবে , হয়ত সে জায়গা ভরে গেছে। তখন বাইরে দুই তিন হাজার লোক দাঁড়িয়ে টিকেট চাচ্ছে এবং দিচ্ছে না। জায়গা নাই কোথায় বসাবো। আমি যখন আর আমি যখন দু’একটা গান আরম্ভ করলাম। হয়ত রুপালী নদীরে গানটা শুরু করেছি এমন সময় বাইরের লোকগুলো সেই বাউন্ডারীর বেড়া ভেঙে মারপিট শুরু করলো। কেন জায়গা দেবে না কেন টিকেট দেবে না। আমরা তো টাকা নিয়ে এসছি। এই দেখেশুনে হয়ত আমি সেখান থেকে হারমোনিয়াম ছেড়ে দিয়ে দৌড়।
আপনি ওই গান রেখে টেখে—-
সব ছেড়ে পলাইছি। কে চিনবে আব্দুল আলীম। কার মাথায় কোন লাঠিটা কিভাবে পড়বে। আমার মাথায়ও দু’একটা পড়ে যাবে।
প্রেমের মরা জলে ডোবে না এই গানের পর আপনি কোন গানটি রেকর্ড করলেন?
এরপরে গান রেকর্ড করলাম তিনি আমার এক ওস্তাদ। অ্যা, বাবু কানাইলাল শীল। তিনি আমাকে চার পাঁচ বছর গান শিখিয়েছিলেন। তার গানের ভাবধারা আবার অন্যরকম। আলাদা। এবং তার ভাবধারায় আমি যেন তারপর থেকে আমি বেশি নাম করলাম এই বাংলাদেশে।
মানে কানাইলাল শীলের ভাবধারায় গান গেয়ে আপনি আরো বেশী নাম করলেন বলে আপনি মনে করেন। তো কোন গানটা আপনি গাইলেন ওনার প্রথম?
প্রথম গান গাইলাম ভাটি গানে ভাইটাল সুরে।
আলীম ভাই, এই বাংলার আলো বাতাসে মধ্যে যে পল্লীসংগীত ছড়িয়ে আছে এগুলোকে একদম অবিকলভাবে মানে অকৃত্রিমভাবে যদি তুলে ধরতে হয় তাহলে শিল্পীদের কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সেটা হলো এই দেশে এই বাংলাদেশের এই গানের কথা তার সুর তার সঙ্গে একবারে মিশে যেতে হবে।
আলীম ভাই আপনার শিল্পী জীবন এবং আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ করতে পেরে আপনার সাথে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। আমাদের পক্ষ থেকে এবং শ্রোতাদের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র:
১। সুর এবং ছন্দের বিষয়ে, এ্যারিস্টটল, পলিটিকস, টি, এ. সিনক্লেয়ারের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর, সরদার ফজলুল করিম, মাওলা ব্রাদাস, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০০৯, পৃষ্ঠা, ৩২৬।
২। ঢাকা বিভাগের লোক সঙ্গীত, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, লোকসঙ্গীত, সম্পাদক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ডিসেম্বর ২০০৭, পৃষ্ঠা নং ১৪৩।
৩। গোলাম মুরশিদ, বাংলা গানের ইতিহাস, প্রথমা প্রকাশন, মার্চ, ২০২২. পৃষ্ঠা নং ২০৮-২১৩
৪। শিল্পের স্বরূপের সূচি, লেভ তলস্তয় এবং তাঁর হোয়াট ইজ আর্ট, লেভ তলস্তয়, অনুবাদক, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, তন্ময় প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা, ২০০৬, তৃতীয় অধ্যায়, পৃষ্ঠা, ২১২।
৫। আবদুল আলীম, বাংলা লোকসংগীতের অমর কণ্ঠশিল্পী, আবদুল আলীম ফাউণ্ডেশন, প্রকাশকাল, সেপ্টেম্বর, ২০১৬, পুষ্ঠা নং ১৫৪-১৫৫
৬। আবদুল আলীম,সাঈদ আহমেদ, বাংলাদেশ সুর সুরস্রষ্টারা, সাহিত্য প্রকাশ, পুরানা পল্টন ঢাকা,ফেব্রুয়ারি, ২০০৩পৃষ্ঠা ৮৩-৮৫।
৭। আব্দুল আলীম: কিংবদন্তী তুল্য অমর লোকসঙ্গীত শিল্পী, মনোজিৎকুমার দাস, পেজ ফোর নিউজ, ২৮ জুলাই, ২০২২।
৮। ফোক সংগীতের কিংবদন্তী আব্দুল আলীমের স্মরণে পুত্র আজগর আলীমের স্মৃতিচারণ, Panavision Tv, July, 28, 2016.
৯। রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বহিঃপ্রভাব, সিরাজুল ইসলাম, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ডিসেম্বর ২০০৭, পৃষ্ঠা নং ১৫২।
১০। আব্দুল আলীমের গান কভার করলে আমাদের অনুমতি লাগবে-নুরজাহান আলীম, Newsg Lifestyle, Oct 31, 2019.
১১। আবদুল আলীম, বাংলা লোকসংগীতের অমর কণ্ঠশিল্পী, আবদুল আলীম ফাউণ্ডেশন, প্রকাশকাল, সেপ্টেম্বর, ২০১৬, পৃষ্ঠা নং-১৫৬।
১২। ক্রিটো, প্লেটোর সংলাপ, সরদার ফজলুল করিম অনূদিত,প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি, ১৯৭৩, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
১৩। পেয়ারার সুবাস, গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, অনুবাদ ও ভূমিকা খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।
১৪। শিল্পী আবদুল আলীমের পুত্র অধ্যাপক জহির আলীম এবং সরগম সম্পাদকের সঙ্গে কথোপকথনে প্রাপ্ত তথ্য।
15. A rare interview with legendary ABDUL ALIM, Jan 26, 2021, Atique.