ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির পঠন
ভাষাসমূহের মধ্যে শক্তিমত্তার অসমতা বিদ্যমান আর সেই সাথে বাস্তবতা হলো এই যে, একজন নৃবিজ্ঞানী সাধারণত একটি নিরক্ষর জাতিগোষ্ঠীর বিষয়েই লেখেন, আর তার পাঠক হলো মূলত ইংরেজি ভাষভাষি শিক্ষিত সমাজ, এই দুটো বিষয় একত্রে একটি নির্দিষ্ট ধরণের প্রবণতাকে উৎসাহিত করে: আর তা হলো ভিনদেশীয় সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত অর্থটিকে পাঠ করবার প্রবণতা।
অনেক সামাজিক নৃবিজ্ঞানীর মতে, ঐতিসাহিক ভাবে অধিষ্ঠিত বক্তব্য জাতিতাত্ত্বিক অনুবাদের লক্ষ্যবস্তু নয় (ওটা ফোকলোরিস্ট অথবা ভাষাতত্ত্ববিদের কাজ), বরং সংস্কৃতি হচ্ছে এর লক্ষ্যবস্তু, আর সংস্কৃতিকে অনুবাদের জন্য একজন নৃবিজ্ঞানীকে অবশ্যই প্রথমে পড়তে হবে, আর তারপর অধিষ্ঠিত বক্তব্যটির আড়ালে/ ভেতরে/ বাইরে যে অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে তাকে পুনরায় খোদাই করে দিতে হবে। পুরো ব্যাপারটিকে ম্যারি ডগলাস বেশ গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন:
সেই নৃবিজ্ঞানী যদি অনুবাদ করতে গিয়ে অনুক্ত অন্তর্নিহিত অর্থের একটা পুরো ব্রহ্মান্ড বের করে নিয়ে আসেন এবং সেই ব্রহ্মান্ডকেই একটি নিয়মতান্ত্রিক দর্শন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন তবে তা হবে ঐ আদিম সংস্কৃতির প্রতি ভয়ংকর এক আক্রমণ। তো ওপরে আদিম বিশ্ব দর্শনের যে সংজ্ঞা আমি দিয়েছি তা কদাচিতই আদিম সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনার মনোযোগ আর চিন্তাভাবনার লক্ষ্যবস্তু। আদিম বিশ্ব দর্শনের ব্যাপারটি আসলে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপাঙ্গ হিসেবে উদ্ভূত। সেই হিসাবে পরোক্ষভাবে এর জন্ম, আর সেই হিসাবে ধরেই নিতে হবে যে, আদিম সংস্কৃতি তার নিজের বিষয়ে অসচেতন, তার নিজের অবস্থার বিষয়ে অ-জ্ঞান। (১৯৬৬:৯১)
সম্ভবত অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্ববিদ আর নৃবিজ্ঞানীর মধ্যে একটি পার্থক্য হলো, একজন ভাষাতাত্ত্বিক একদম তাৎক্ষণিক ভাবেই যে সমাজের মধ্যে থেকে তিনি কাজ করছেন সেই সমাজ থেকে উদ্গত খুবই নির্দিষ্ট একটি ডিসকোর্সের সম্মুখীন হন, যে ডিসকোর্সটিকে তিনি তখন টেক্সটে পরিণত করেন, অন্যদিকে একজন নৃবিজ্ঞানীকে অবশ্যই যা করতে হয় তা হলো, একটি ডিসকোর্সকে সেই ডিসকোর্সটির চর্চার পরিসরে তার অন্তর্নিহিত যে সব অর্থ রয়েছে সেই অর্থ সকলের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাংস্কৃতিক টেক্সট হিসেবে নির্মাণ করা। এভাবে সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সের নির্মাণ আর এর অনুবাদ, এই দুটো বিষয়কে একই ঘটনার দু’টি পৃথক ধাপ বলে ধরে নেয়া যায়। ডগলাস তার নিজ অনুবাদের (লেলেদের[1] মধ্যে প্যাংগোলিন[2] ধর্মাচারের অর্থ) বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন:
ধর্মাচারটির অর্থ প্রকাশে সক্ষম কোন ধর্মতত্ত্ব বা দর্শণ বিষয়ক কোন বই “লেলে”-দের নেই। “লেলে”-দের অতগুলো শব্দ দিয়েও আধিবিদ্যাগত আভাসগুলো আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি, আর এই বিষয়ে তাদের মুনি-ঋষিদের মধ্যকার কথোপকথনেও আমি কখনো আড়ি পাতিনি…এই ধর্মাচার কিংবা অন্য যে কোন ধর্মাচারের শুদ্ধ অর্থ কোনটি তার কি কোন প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে? এই ধর্মাচারের অর্থ হতে পারে বিভিন্ন মাত্রার আর বিভিন্ন ধরণের। কিন্তু আমার কাছে সেই অর্থটিই যুক্তিযুক্ত যা একটি প্যাটার্নের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে, যেখানে অকাট্য ভাবেই প্রমাণ করা যায় যে, এই প্যাটার্নের অংশগুলো একে অপরের সাথে নিয়ত সম্পর্কিত। পুরো সমাজের একক কোন ব্যক্তির এই সম্পূর্ণ প্যাটার্নটা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরী নয়, কথা বলার ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্বের কি সব প্যাটার্ন ব্যবহৃত হচ্ছে সে বিষয়ে যেমন বক্তার সচেতন থাকার প্রয়োজন পরে না, এই বিষয়টিও ঠিক তেমন। (১৯৬৬: ১৭৩-৭৪)
আমি কোন এক জায়গাতে (আসাদ ১৯৮৩) বলেছি যে, প্রাচীন ইতিহাসে সমৃদ্ধ যে ধর্মাচার, তার চর্চার একটি বৈশিষ্ট্যগত রীতিই হলো ভিনদেশীয় ঐ আচার-ব্যবহারের মধ্যে অন্তর্নিহিত অর্থ আরোপণ করা, যদিও ঐ ধর্মের প্রতিনিধিদের কাছে সেই অর্থের স্বীকৃতি আছে কি নেই তাও এ ক্ষেত্রে গ্রাহ্য করা হয় না। এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির কথার মধ্যে ব্যবহৃত ভাষাতত্ত্বের প্যাটার্নের প্রসঙ্গ টেনে যে তুলনাটি করা হয়েছে তা যথাযথ নয়, কারণ ভাষাতত্ত্বের প্যাটার্নগুলো আদতে কোন অর্থ নয় যাকে অনুবাদ করা যায়, বরং ওগুলো হচ্ছে কতগুলো বিধি যাদেরকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা যায়। ঐ প্যাটার্ন সমূহ কিভাবে সৃষ্টি করা যায় তা স্থানীয় অধিবাসীরা জানেন, যদিওবা তাদের পক্ষে সেই জ্ঞানকে একদম স্পষ্ট করে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। এই ধরণের সামাজিক জ্ঞানকে ভাষায় প্রকাশ করতে না পারার এই আপাত অক্ষমতা একদম অকাট্যরূপে অ-জ্ঞান অর্থের বিষয়টিকে প্রমাণ করে না (তুলনার জন্য দ্রষ্টব্য: ডামেট ১৯৮১)। অ-চেতন অর্থের ধারণাটি অবদমনমূলক অ-চেতনা-তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত, যেমন ফ্রয়েডের তত্ত্বে বলা হয়, এমনো হতে পারে যে একজন মানুষ অ-চেতন অবস্থাতেই কোনকিছু জেনে থাকতে পারেন।
তাই “সাংস্কৃতিক অনুবাদ” এর ক্ষেত্রে অ-চেতন অর্থের বিষয়টি সনাক্ত করার যে কাজ, তাকে ভাষাতত্ত্ববিদ নয়, বরং মনঃসমীক্ষকের কাজের সাথে তুলনা করাই শ্রেয়। বস্তুত, বৃটিশ নৃবিজ্ঞানীরাও কখনো কখনো তাদের কাজকে এই সূত্র মেনেই উপস্থাপন করেছেন। আর এভাবে ইভান-প্রিটচার্ডের ছাত্র ডেভিড পোকক লেখেন:
সংক্ষেপে বলতে গেলে, সামাজিক-নৃবিজ্ঞানীর কাজটিকে একটি অতি জটিল ধরণের অনুবাদকর্ম বলে গণ্য করা যায় যার মধ্যে লেখক ও অনুবাদক একত্রে কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে তুলনাটি আরো যথাযথ হবে, যদি একজন মনঃসমীক্ষক ও তার সাবজেক্টের মধ্যকার যে সম্পর্ক তার সাথে পুরো বিষয়টিকে তুলনা করা হয়। সাবজেক্টের ব্যক্তিগত ভাষার যে ব্যাকরণ তা শেখার জন্যে একজন বিশ্লেষক সেই সাবজেক্টের ব্যক্তিগত জগতের মধ্যে প্রবেশ করেন। এই অবস্থা থেকে এই বিশ্লেষণ যদি আর সামনের দিকে না এগোয় তবে এই বোঝাপরা একে অপরকে খুব ভাল ভাবে জানা দুই ব্যক্তির মধ্যকার বোঝাপরার চেয়ে বেশি কিছু নয়।(!) বিশ্লেষণের এই প্রক্রিয়া ততোটাই বৈজ্ঞানিক পক্রিয়ায় পরিণত হয় যে, এর মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ বোঝাপরার ব্যক্তিগত ভাষাটি একটি সর্বজনীন ভাষায় পরিণত হয়, এ ক্ষেত্রে সেই সর্বজনীন ভাষাটি হলো মনোবিদদের ভাষা, তা সে ভাষা সর্বসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে যতোটা বিশেষায়িতই হোক না কেন। কিন্তু অনুবাদের এই ঘটনাটি সাবজেক্টের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোন বিকৃতি ঘটায় না, আর সাধারণত এই অনুবাদকে সে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা বলে মেনে নেয়। একই ভাবে, প্রফেসর ইভান-প্রিটচার্ডের কাজের ভেতর এনইউআর রাজনৈতিক জীবনের যে মডেলটি পাওয়া যায় তা একটি বৈজ্ঞানিক মডেল, যা তার সহযোগী সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট অর্থপূর্ণ, আর সেই অর্থ তারা করতে পারে সমাজবিজ্ঞানী হবার দরুন, আর এই মডেলটি একটি কার্যকর মডেল, কারণ এই মডেলটি এনইউআর গোষ্ঠীর মানুষের কাছে এমন কিছু আদর্শ পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য যেখানে ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সমাজে বসবাসকারী মানুষ হিসেবে তারা নিজেদের ব্যাপারে আগ্রহী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, বিজ্ঞানীদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে একটি ভাষা নির্মাণের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা ঐ বিশেষ বৈজ্ঞানিক নীতির দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি স্বতন্ত্র সহজাত ঘটনাক্ষেত্রের বিষয়ে নির্দিষ্ট একদল মানুষকে একে অপরের সাথে যোগাযোগের সক্ষমতা প্রদান করে। তাদের বিজ্ঞান হচ্ছে তাদের সহজাত বিচারবুদ্ধি, তাদের মধ্যে প্রচলিত অর্থের সর্বজনীনতা। তাদের নিজেদের মধ্যে প্রচলিত অর্থের সর্বজনীননতাকে আরো বিস্তীর্ণ জনগোষ্ঠীর নিকট সর্বজনীন করে তুলতে আবারো যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হলো, অনুবাদ। এ পর্যায়ে সামাজিক-নৃবিজ্ঞান কিংবা সাধারণ সমাজবিজ্ঞানের পরিস্থিতিও তেমন ভিন্ন নয়। এ ক্ষেত্রে পার্থক্যটা এখানেই যে, সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে ততোখানি বস্তুনিষ্ঠ উপায়েই পাঠ করা হয় যেন এর মধ্যে তাদের আত্মনিষ্ঠ অর্থকে আমলে আনা হয়। আর ঐ সমাজবিজ্ঞানী যাদের নিয়ে কাজ করছেন তারা যেন তাদের বিষয়ে তিনি যে সামাজিক উপলব্ধি নিজের মধ্যে ধারণ করেন সেই উপলব্ধির অংশীদার হতে পারে। (১৯৬১:৮৮-৮৯)
আমি এখানে এই অসাধারণ প্যাসেজটির পুরোটাই উদ্ধৃত করেছি, কারণ, আমি মনে করি এটি খুব স্বচ্ছভাবে এমন একটি অবস্থাকে তুলে ধরেছে যা ব্যপকভাবে বহু নৃবিজ্ঞানীর নিকট গ্রহণযোগ্য, যারা অন্যথায় নিজেদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সব কর্মকান্ডে জড়িত বলে ধরে নিতো। এটি উদ্ধৃত করার আরো একটি কারণ হলো এখানে বিজ্ঞানী হিসেবে মনোসমীক্ষকের ধারণার পরবর্তী প্রসঙ্গেই “লেখক ও অনুবাদক”-এর একত্রে কাজ করার যে ধরণ তা বেশ পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠেছে: বিশ্লেষকের মতো নৃতাত্ত্বিক-অনুবাদকই যদি সাবজেক্টের অর্থ নিরূপণের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন, তখন, সেই নৃতাত্ত্বিক-অনুবাদকই সেই সাবজেক্টের আসল রচয়িতায় পরিণত হন। এই বিচারে “সাংস্কৃতিক-অনুবাদ” হলো অন্তর্নিহিত অর্থ নির্ধারণের বিষয়- যে অর্থ স্থানীয় ব্যক্তি তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বস্তুত স্বীকার করে নেন সেই অর্থ নয়, এমনকি সেই অর্থও নয় যা স্থানীয় শ্রোতাবর্গ অবধারিত ভাবেই মেনে নেন, বরং সেই অর্থ যা ঐ বক্তা একটি আদর্শ পরিস্থিতিতে কোন বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞের সাথে ভাগাভাগি করে নেবার সুপ্ত ক্ষমতা রাখেন: উদাহরণস্বরূপ ঐ বক্তা যখন গেলনারকে বলেন যে, ঈশ্বরের কথাই আসলে জনগণের কথা, তখন তিনি তার ঐতিহ্যবাহী ডিসকোর্সের একদম সত্যিকারের অর্থটি, তার সংস্কৃতির অপরিহার্য অর্থটি উচ্চারণ করেন। আসল সত্যটি হলো, একজন সাংস্কৃতিক-অনুবাদককে এই বিষয়টি খুব একটা চিন্তিত করে তোলেনা যে, “ঐ আদর্শ পরিস্থিতিতে” তিনি আর মুসলিম বারবার নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তিটির মতন থাকেননা বরং অনেকটা প্রফেসর গেলনারের মতন হয়ে ওঠেন।
“অন্তর্নিহিত” অথবা “অ-চেতন” অর্থের ধারণার মধ্য দিয়ে সাবজেক্টের জন্য অর্থ তৈরী, সেই অর্থ সমূহকে অনুমোদন দেয়ার এই ক্ষমতা, বিশ্লেষক-বিশ্লিষ্টের মধ্যকার যে সম্পর্ক সে বিষয়ক আলোচনায় অবশ্যই আলোচিত হয়। আমার জানা মতে, একজন সাংস্কৃতিক-অনুবাদক যে কাজ করেন সে বিষয়ের ক্ষেত্রে এই আলোচনা বিবেচনায় আনা হয় না। একজন নৃতাত্ত্বিকের বেলায় অবশ্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, একজন নৃবিজ্ঞানী কিন্তু সমাজের অন্যান্য সেই সব সদস্য যাদের সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সকে তিনি উন্মোচিত করেন তাদের ওপর তার নিজের অনুবাদকে চাপিয়ে দেননা, এ কারণে তার নৃকুলবিদ্যা, বিশ্লেষকের কেস স্টাডির মতন কর্তৃত্বপরায়ণ নয়। বিশ্লেষকের কেস স্টাডিতে দেখা যায় বিশ্লিষ্ট নিজে থেকেই অথবা তার ওপরে যার কর্তৃত্ব আছে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রোগী হিসেবে সাহায্য লাভের আশায় বিশ্লেষকের কাছে এসেছেন। উল্টোদিকে একজন নৃবিজ্ঞানী নিজে থেকেই যে সমাজকে তিনি পাঠ করতে চান সেই সমাজের কাছে চলে যান, তিনি নিজেকে পথপ্রদর্শক নন বরং একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করেন, এবং ঐ সংস্কৃতিকে গ্রন্থভুক্ত করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য জোগাড় করা হয়ে গেলেই তিনি নিজেকে ঐ সমাজ থেকে গুটিয়ে নেন। না তিনি নিজে ঐ সমাজকে অসুস্থ মনে করেন, না ঐ সমাজের সদস্যরা নিজেদেরকে অসুস্থ বলে মনে করেন: কোন সমাজ কখনই কোন নৃবিজ্ঞানীর কর্তৃত্বাধীন নয়।
কিন্তু প্রথম দেখাতেই এই যুক্তিটিকে যতোটা তর্কাতীত মনে হয় ব্যাপারটা আসলে ততোটা তর্কাতীত নয়। একজন নৃতাত্ত্বিক কর্তৃক কোন নির্দিষ্ট সংস্কৃতির উপস্থাপন অথবা অনুবাদ নিশ্চিত ভাবেই একটি টেক্সচুয়াল নির্মান, সংস্কৃতির ঐ প্রতিরূপ সাধারণত ঐ সংস্কৃতির মানুষের আপত্তির সম্মুখীন হয়না, আর একটি “বিজ্ঞানসম্মত টেক্সট” হিসেবে তা শেষ পর্যন্ত এর সাথে সম্পর্কিত অক্ষরজ্ঞানহীন সমাজের ঐতিহাসিক স্মৃতি সম্ভারের সম্ভাব্য উপাদানে পরিণত হয়। আধুনিক ও আধুনিকায়নমুখী সমাজ গুলোতে, লোকজস্মৃতি অপেক্ষা লিপিবদ্ধ নথিসমূহের—ঐ সমাজসমূহের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রভাবিত করার বেশ বড় একটি ক্ষমতা রয়েছে। এমন কি ঐ লোকস্মৃতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও ঐ লিপিবদ্ধ নথি সমূহের রয়েছে। নৃবিজ্ঞানীর মনোগ্রাফ হয়তো আবারো ফিরে আসতে পারে, কোন “দূর্বল” তৃতীয় বিশ্বের ভাষায় পুনরায় অনূদিত হতে পারে। তাই শেষ বিচারে, নৃতাত্ত্বিকের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং তার নৃবিদ্যার যে সামাজিক কর্তৃত্ব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই কর্তৃত্ব শিল্প-পুঁজিবাদী সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি সমূহের মাঝে খোদিত হয়ে আছে, সেই শক্তিসমূহ প্রতিনিয়ত তৃতীয় বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন সমাজসমূহের অর্থগুলোকে একটি নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করে। তার মানে এই নয় যে, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ করা হচ্ছেনা। কিন্তু “প্রতিরোধ” নিজেই কর্তৃত্বপূর্ণ শক্তির উপস্থিতির প্রমাণ।
আমি জোর দিয়েই বলতে চাই যে, সংস্কৃতিসমূহের সংস্কারের ক্ষেত্রে নৃকুলবিদ্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে না। এই প্রসঙ্গে নৃকুলবিদ্যার প্রভাবকে সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক অন্যান্য ফর্মগুলোর প্রভাবের সাথে তুলনা করা যায়না—যেমন প্রভাব থাকার দরুন পশ্চিমে তৈরী হওয়া টেলিভিশন ফিল্মগুলো তৃতীয় বিশ্বে বিক্রি হয়। (নৃবিজ্ঞানীরা যে টেলিভিশনের ক্ষমতার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তার প্রমাণ হলো বৃটেনে এই মাধ্যমকে উদ্দেশ্য করেই বানানো নৃতাত্ত্বিক চলচ্চিত্রের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা।) বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বাধ্যবাধকতার প্রভাবের সাথে তুলনা করলে নৃকুলবিদ্যার প্রভাব বেশ সীমিতই। আমার কথা হলো “সাংস্কৃতিক অনুবাদ”এর প্রক্রিয়া আসলে পেশাদারী, জাতীয়, আন্তর্জাতিক ক্ষমতার শর্তসমূহের সাথে জড়িত। আর এই সব শর্তের মধ্যে একটি শর্ত হলো, অধস্তন সমাজগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থসমূহ উদ্ঘাটনের কর্তৃত্ব নৃকুলবিদদেরই রয়েছে। তাই যদি হয়, তবে, অনুসন্ধানের জন্য কৌতূহল উদ্দীপক প্রশ্ন এটা নয় যে, তারা অন্য সংস্কৃতির প্রতি কি আপেক্ষিকতাবাদী হবে না যুক্তিবাদী হবে, সমালোচনা প্রবণ হবে না দানশীল হবে আর হলে কতোখানি হবে, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো সাংস্কৃতিক অনুবাদের প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক চর্চা হিসেবে ক্ষমতার বিষয়টি কিভাবে ঢুকে পড়ে।
[1] কংগোর কাসাই নদীর পশ্চিম পাড়ে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী।
[2] লেলেদের মধ্যে প্রচলিত একটি বিশেষ ধর্মাচার।