কুশীলব
একজন উদ্বাস্তু মানুষ
[ একজন উদ্বাস্তু মানুষ প্রবেশ করে মঞ্চে। সঙ্গে তার পালিয়ে আসবার সময় নিয়ে আসা তৈজস। সন্ত্রস্ত চোখমুখে তাকিয়ে নেয় মঞ্চের চারদিক। আস্থা খোঁজে যেন। আবছায়া, আলো ক্রমে স্পষ্ট হয়, দেখা যায় তার ক্লান্ত,অবসন্ন মুখায়ব। একটা বোতল থেকে সামান্য জল পান করে। তারপর সমস্ত শরীর কাপড় হাতড়ে কিছু একটা খুঁজতে থাকে কিন্তু খুঁজে পায় না। ভাবতে থাকে কোথায় ফেলে এসেছে। হঠাৎ যেন মনে পড়ে। তারপর… ]
ভুলে গিয়েছিলাম! পালাতে পালাতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি আমার ঘরবাড়ি, গ্রাম, শহর, দেশ ফেলে শুধুমাত্র জীবনটাকে সঙ্গে করে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছি এইখানে। কাঁটাতারে বেঁধে হাত ঘড়িটা ছুটে গিয়েছিলো। তাই পকেটে রেখেছিলাম। সময়টাকে জানতে ইচ্ছে করে এখনো। আসলে এমন এক সময় আমাদের যখন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে একফোঁটা আশ্বাস পেতে ইচ্ছে করে, হয়তো একটু পরেই ভালো সময় আসবে! কিন্তু ঘড়িটাও গাদ্দারি করলো! নাকি পকেটটা? কে ফসকে গেলো নাকি কে কাকে উগরে দিলো? জানার ইচ্ছা হয় কিন্তু স্বস্তি পাই না! ধৈর্য নিভে গেছে! পালাতে পালাতে কাঁটাতার ডিঙাতে ডিঙাতে ঘেন্না ধরে গেছে মানুষের ইতিহাসের উপর! সীমান্ত আর প্রহরীদের কড়া চোখের ভাষা পড়তে পড়তে ঘেন্না ধরে গেছে নিজের মানুষ জন্মের উপর! ক্ষমা করবেন শুরুতেই আপনাদের বিব্রত করছি তুমুল! একটু আস্তেধীরে প্রবেশ করবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তাড়াতে তাড়াতে আমাদেরকে একেবারে পঙ্গপালের ঝাঁকের মতো ঢুকিয়ে দিয়েছে আপনাদের এই ভূমিতে! নাকি এটা আমারও ভূমি আজ? মানুষ যখন যেখানে থাকে সেটা কি তখন তার ভূমি নয়? বাজে প্রস্তাব! জানি জাতীয়তার ব্যাপারস্যাপার আছে; রাজা, রাষ্ট্র ইত্যাদির ব্যাপারস্যাপার আছে। জানি আমি। তবু মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে এইসব! আমাদের আইডি কার্ডে কী লেখা হবে আজ? ‘উদ্বাস্তু’ নাকি ‘পৃথিবীর নাগরিক’? এরকম কি হবার কথা ছিল না? নাকি এটা আমার ভুল ভাবনা? জলের রঙ এক হলেও মানুষে মানুষ মেলে না। রক্তের প্রসঙ্গ এখানে অপ্রয়োজনীয়! নাকি মানুষই একাট্টা হতে চায় না। মানুষের মধ্যে সংকোচ, দ্বিধা, দেয়াল মানুষেরই দরবারে! এইসব বিলাপ তবু অবশেষে করবার সুযোগ আপনারা দিলেন! পালাতে পালাতে একফোঁটা জল পানের জন্য নিরাপদ যায়গা খুঁজতে খুঁজতে আমি এইখানে! নিজেকে বিক্রি করে দেবো আপনাদের কারো সংসারে! তাও ভালো অন্তত আপনারা কেউ যদি কিনে নিতে চান তবে মানুষের সংসর্গে একটা মানুষ জীবন হবে! হোক না তা গোলামের! তবু আপনাদের কেউ হয়ে বাঁচবো! অন্তত উদ্বাস্তু মানুষ শিরোনামে মৃত্যু আমার হবে না।
[ জলের বোতল খুলে জল পান করে। ]
আমি একজন মানুষ! আমার কোন জাতীয়তা নেই! আমার কোন দেশ নেই! পৃথিবী আমার দেশ! নেবেন আমাকে কেউ? কেউ কি শুনতে পান? নাকি বধির সাবাই? শোনার মানুষ নেই? আমি একজন মানুষ, আজ আমার কোন ঠিকানা নেই, আমাকে কেউ ঠিকানা দেবেন?
[ হাঁটু মুড়ে কাঁদে ]
কেউ নেই। কোথাও নেই কেউ। সবাই আড়ালে আবডালে বসে থেকে মজা দেখে! খেলা দেখে! দেখে একদল মানুষের না মানুষ হয়ে যাওয়ার খেলা! দেখে এক একজন মানুষের নিজেকে বিক্রি করে দেবার জন্য আকুলতা! কিন্তু কেউ নেয় না! আশ্রয় দেয় না! আশ্রয় যেখানে হয় সেটার নাম ক্যাম্প! থানা, হাজত। কিন্তু নিজের মাটি হয় না আমাদের! অথচ আমাদের মাটি ছিল কিংবা এই মাটি আমার ভাবার অধিকার আমার থেকে ছিনতাই করে নেয় অন্য কেউ! বন্দুক যার হাতে ভূমি তার হাতে। বন্দুক যার হাতে পৃথিবী তার নিয়ন্ত্রণে! মানুষেরা গোলাম হয়ে থাকে নিয়ন্ত্রণের। আর যারা মানে না, মেনে নিতে পারে না তারা হয় বিদ্রোহী! তারা বন্দুকের মুখোমুখি বুক তুলে দাঁড়ায় আর চিৎকার দিয়ে মরে যায়! মেরে ফেলা হয় যাদের বুকের মধ্যে মেনে না নেবার শ্লোগান জন্ম নেয়। আর আমরা যারা বেঁচে থাকতে থাকতে হঠাৎ শুনতে পাই দেশ আমার নেই, মাটি আমার নেই, আমার নাম রাষ্ট্র নামের বই থেকে উধাও তখন আমরা হয়ে যাই বেওয়ারিশ!
হিসসসস! চুপ! কাউকে বলবেন না! কাউকে না! কেউ যেন টের না পায়! এই দেহ! এই বেঁচে থাকার নাম বেওয়ারিশ! যার জন্য কান্নার কেউ নেই! যার জন্য হাসার কেউ নেই! যার জন্য হাড়িতে ফোটে না গরম ভাত! যার জন্য পথের দিকে কেউ তাকিয়ে থাকে না! সেই মানুষের নাম বেওয়ারিশ! হিসসস! আস্তে আস্তে…! উচ্চ স্বরে নয়! জোরে বলা যাবে না! জোরে যদি সত্য বলা হয়, তবে সে সত্যকে বাজেয়াপ্ত করা হয়! মুছে ফেলা হয়! গুলি করা হয়! বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয় সত্যকে!
নিজেকে বিক্রি করতে চাই আমি আজকে! কিনে নিক কেউ আমাকে! একজন ক্রীতদাসের জীবন হোক আমার! তবু অন্তত মানুষের সঙ্গে জীবন কাটবে! একটা দেশে একটা ঘরে একটা জমিনে আমার জীবন কাটবে স্থির! একটা বাজার একটা জলের কল, একটা রাস্তা অন্তত থাকবে হাটার! এই কোন কিছুই না থাকার জীবন আমাকে তছনছ করে দেয় প্রতিমুহূর্তে! এমন যদি হতো আমার জন্ম থেকেই কিচ্ছু ছিল না তাও মেনে নেয়া যেতো। কিন্তু যার সব আছে অথচ হুট করে সমস্ত আমার নেই হয়ে গেলো আর আমি একজন বাস্তুহারা মানুষের মতো হাওয়ায় উড়তে উড়তে একটা পলিথিন ব্যাগের মতো ঘুরতে ঘুরতে ফিরতে ফিরতে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছুটতে লাগলাম? মেনে নিতে বাধ্য আমি শক্তি নেই বলে, কিন্তু মেনে নেয়া যায় না! নাকি উৎখাতের সূত্রে আমি নিবন্ধিত। আমাকে কে ফেলে দিয়েছে ভূমিহীন করবার চক্রান্তে? কাকে জিজ্ঞাস করবো আমি? কে দাঁড়াবে আমার পাশে? কেউ নেই! যুদ্ধের ময়দানে ঈশ্বরও নতজানু তার জানোয়ারদের হিংস্রতার শৌর্যে।
কিন্তু মেনে নিতে হবে! পৃথিবীতে আজ মেনে নেবার রাজনীতি! মেনে নেবার শিক্ষা! মেনে নেবার জন্য প্রতিটা মানুষকে ছবক দেয়া হয়। মেনে নেবার বিনোদন চারিদিকে। আর সেই মেনে নেবার সংস্কৃতির খেলনা যারা তাদের একজন আমাকে হতে হবে? কিন্তু কেন? আমার কি দোষ? কি দায় আমার? মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়া আমার অপরাধ? কেউ কেউ বলে, বন্দুক তুলে নাও মেনে না নেবার পক্ষে। কিন্তু আমি পারিনি! সবাই তো আর সব কিছু পারে না। সস্তা ভীতু এক মানুষ আমি। বেঁচে থাকার লোভে কুঁকড়ে থাকি। তবু নিস্তার নেই! আমাকেও খুঁজে খুঁড়ে বের করলো? আমার জাতিগোষ্ঠী, আমার গ্রাম, আমার শহর, আমার নদীকে চুরমার করে দিলো! আহহহহ! হায়! আমি কিছুই করতে পারি নি। যখন দাউ দাউ করে পুড়ে যাচ্ছিলো আমাদের ঘরবাড়ি, যখন মানুষের আর্তনাদে বাতাস কাঁপছিল উন্মাদের মতো! পথের কুকুর গাছের পাখিরা উধাও হয়ে গিয়েছিলো সৈনিকদের পৈশাচিক উল্লাসের শব্দে, আর মাটি কামড়ে কামড়ে এগিয়ে আসছিলো ট্যাঙ্ক, ঘাসের সবুজ পিষে আসছিলো সাঁজোয়া! উফফফ! গুলির শব্দে জীবনের কল্লোল ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো। যা শোনা গেলো তা কেবল, আর্তনাদ, আকুতি আর ক্রন্দন!
আমি তো জাতিসংঘ মানি না! মানি না দাতাদের দানে বেঁচে থাকা জীবনকে। আমার নিজের ভূমি থাকতে আমি কেন দান নেবো? কেন আমি ক্যাম্পের জীবনে সাহায্যের নামে দান খয়রাত নিয়ে বেঁচে থাকবো? যে জমিন আমার ছিল, যে মাটি আমার ছিল সেই মাটিতে ফসল ফলিয়ে আমি নিজেই নিজেকে বাঁচিয়েছি! আমি কেন আজ অন্যের দানে নিজেকে বাঁচাবো? তারচেয়ে এই শরীর, মেধা, সমস্ত বিক্রি করে দেবো একজন ক্রীতদাসের মতন! যখন আমার দেশ আমার থেকে হারিয়ে গেলো, যখন আমাকে বাস্তুহারা করে দিলো বোমারু বিমান কিংবা অন্ধ কানুন তখন তো কোন জাতিসংঘ আটকাতে আসে নি? আসে নি কেউ একজোট হয়ে আমার মাটি ফিরিয়ে দিতে? বরং বাস্তুহারা মানুষ হতেই আমাকে সংরক্ষণে তারা নেমে এলো। এটা কি কোন চক্র নয়? একটা মানুষ নিয়ে উদ্বাস্তু উদ্বাস্তু খেলা? রিলিফের লাইনে দাঁড়ানো মুখ গুলো আমার। ক্যাম্প থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়ে গুলোর শরীর আমার। গায়েব হয়ে অন্ধ রাস্তায় নেমে যাওয়া যুবকদের চোখ গুলো আমার। আমি জানি একটা নাম্বারের মধ্যে চিহ্নিত হয়ে গেছি আমি। ক্যাম্পের উদ্বাস্তু নাম্বারের ভেতরে আমার সমস্ত ইতিহাস দুমড়ে মুচড়ে জমা হয়ে আছে। আমার ঈশ্বর এখন দাতা সংস্থা! যারা আমাকে খাওয়ায় পড়ায়। যৌনতায় প্রণোদনা দেয় কিংবা নিষেধের তাবিজ লটকে দেয়। বেঁচে থাকার মতো এক অভিশাপ নিয়ে রোজ এই ঘেরাটোপের মধ্যে কতো বিচিত্র উৎকৃষ্ট নামের ভেল্কি দেখতে হয় তা কেবল আমার অন্তরের ঘৃণারা জানে আর জানে সংস্থার বিরক্ত কর্মচারীরা! যারা রোজ একই বালতিতে একই পরিমানের জল তুলে ঢেলে দেয় একই লোকের মাথায়! পৃথিবীর বুক ভারী করে কেবল প্রতি মুহূর্তে আমাদের বেঁচে থাকার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পরে। কে আমাদের ফেরাবে ঘরে? আদতে ফিরবো আমরা কেউ ঘরে? নাকি না ফিরে পাওয়া জন্মভূমির মানুষ হিসেবে এক… দুই… তিন… চার… পাঁচ… ছয়… সাত… আট… নয়… করে একদিন আমরা সবাই বাতাসের মধ্যে উড়ে যাবো দিকে দিকে?
একটা স্বপ্নের পুকুরের জলে আমরা সবাই রঙিন মাছের পোণা ছেড়েছিলাম। যেই পুকুরের মাছ আমাদের ধ্যান! দিনে দিনে সেইসব মাছেরা বড় হতে লাগলো। ঠিক যেমন আমাদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠে সেরকম মাছ গুলো বড় হতে লাগলো। প্রতি রাতের অন্ধকারে কিংবা জোছনার আলোর মধ্যে তারা জলের বুকে ঘাই মারে। সেই শব্দ জানান দেয় আমাদের মাছেরা বেড়ে উঠছে। প্রতিটা গ্রামে আমাদের এমন রঙিন মাছের পুকুর আছে। যেই মাছেদেরকে আমরা লালন পালন করি ঠিক যেন আমাদের পালিত প্রাণের মতন। তারপর যখন মাছেদের খুব বয়স হয় তখন তাদেরকে ছেড়ে দেই ঘুমদীঘির জলে। যে দীঘি কয়েকটা গ্রামের মোহনায়। যার জলের রঙ শান্ত শীতল নিস্তরঙ্গ। সেখানে বুড়ো মাছেদের নির্বিবাদ জীবন। আহা! সেই জলের দিকে তাকালে মাছদের দেখা যায় সাঁৎরাতে যেন প্রশান্তির শেষ বেলা! কিন্তু আমাদের পুকুরের জলে মাছেদের বেড়ে ওঠা দিন গুলোর মধ্যে একদিন আমরা সবাই দেখলাম একদল উড়ে লোক এলো। তারা বলল, এই পুকুর তাদের! এই জল তাদের! এই মাছের অধিকার তাদের! আমরা তাদের বললাম, পুকুরের জলে যেই ছায়া সেটা আমাদের! জলের গন্ধ আমাদের! মাছেদের রঙ আমাদের! ওরা বলল, আমাদের সব কিছু এখন ওদের হাতের মুঠোয়! ওদের পেশিতে বারুদ আর কোমরে শানানো মৃত্যু! আমরা ওদের বললাম, ফিরে যেতে ওদের গুহায়! কিন্তু ওরা নারাজ! দুনিয়া দখল করেই ওদের শান্তি! তাই হয়তো একদিন ভোরে ওদের একটা বিরাট দঙ্গল নেমে এলো তুলকালাম করতে আমাদের গ্রামে! তারা ঘিরে ধরল আমাদের রঙিন স্বপ্নের মাছের পুকুর! তারপর ওদের খাঁচায় বন্দি একদল দানবের খাঁচা খুলে দিতেই তারা হামলে নেমে এলো জমিনে! বিরাট বিরাট জাল ছুঁড়ে তারা পুকুরের জল থেকে তুলে নিয়ে গেলো রঙিন মাছের ঝাঁক! হাততালি দিতে লাগলো সেই উন্মাদ মানুষের দল! আর আমরা জড় সন্ত্রস্ত হয়ে দেখলাম, জালের মধ্যে বন্দি মাছ গুলোর মুখ চোখ আমাদের, আমাদের সন্তান, বন্ধু, পিতা-মাতা, শত্রুদের মুখের আদলে। আমরা টের পেলাম মৃত্যুই অবশ্যম্ভাবী! পালাতে না পারলে এই বেঁচে থাকার শেষ পরিণতি ক্ষমাহীন রক্তাক্ত মৃত্যুর হাতে পতিত হওয়া! হায়! আমাদের ঘুমদীঘির জলে তারা বিষ ঢেলে দিলো। আমাদের বয়সী শেকড়, আমাদের প্রাজ্ঞ ভরসার থান; সকল আদি মৎস্যরা মরে ভেসে উঠতে লাগলো। আর অন্যরা পালাবার চেষ্টায় লাফিয়ে উঠতে লাগলো ডাঙায়, যেন নদীর সন্ধানে তারা লাফিয়ে উঠছে জমিনে! সেই নদী বেয়ে সমুদ্রে মিশে যাবে তারা তাদের প্রাণ নিয়ে! কিন্তু নদী সমুদ্র তো অনেক দূরের ব্যাপার! পুকুরে যে জন্মেছে, তার দৌড় বড়জোর দীঘি পর্যন্ত! নদী আর সমুদ্র তার কাছে স্বপ্নযাত্রা! পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সকল পৌঁছানো সীমাবদ্ধে পৌঁছায়।
কিছুই করিনি আমি অন্যায়! কারো কাঁচা ধানে দেই নি মই! কেন তবে আমার উপরে এমন হামলা? আমার জমিন ভিটা বাড়ি সংসার কেন তছনছ? কার কাছে ফরিয়াদ করবো আমি? কে আছে শোনার? বিচার কে দেবে? নাকি এ এক প্রহসন যা ঘটে বারবার? চাই না… চাই না বিচার আমি। চাই শুধু ঘরে ফিরে যেতে। চাই আমার আঙিনায় ফিরে যেতে! আমার নিজের খাটে ঘুমাতে। এদেশে আমারে সবাই এমনভাবে চেয়ে চেয়ে দেখে যেন আমি চিড়িয়া এক। তারা আমারে এমন চোখে দেখে যেন আমি মানুষ না! আমি কি তবে কোন অন্য প্রাণী? আমার জন্ম পরিচয় কি তবে? হায় দুনিয়ার মানুষ! আমাকে নাও! নাও আমাকে! একজন মানুষ হিসাবে আমাকে তোমরা তোমাদের মধ্যে নাও। সীমান্ত, জাতী, রাষ্ট্র, রঙ, চেহারার সিল মোহর বাদ দিয়ে আমাকে তোমরা নাও একজন মানুষ হিসাবে! আমার শরীরে যেই রক্ত সেই রক্ত তোমার শরীরে কিন্তু কেন আমাকে অন্য নামে ডাকো? মানুষ কেন না-মানুষ হয়?
যেদিন রাত্রে সৈনিকেরা হামলে পড়ে, যেই রাত্রে সৈনিকদের সাথে গাদ্দারের দল হামলে পড়ে আর আমাদের সবকিছু লুট করে খুন করে নির্বিবাদে। পালাতে পালাতে নিজেকে আবিষ্কার করি এক পুকুরের জলে। যেন আমি এক মাছ, ঘুমদীঘির জলে যেন আমি বুড়ো মাছেদের মতো আধমরা নরম শান্ত ভাবে ডুবে থাকি। পাতার শব্দ হলেও কেঁপে উঠি যেন সৈনিকেরা বন্দুক হাতে আসে, পাখির ডানার শব্দ হলেও আঁতকে উঠি যেন গাদ্দারের দল কাটারি হাতে দৌড়ে আসে সেই ভয়ে। অন্ধকার যখন গাড় হয়ে আসে। নিকষ রাত্রি যখন প্রশ্রয় দেয় পথে নামবার, তখন ধীরে এক গুই সাপের মতন আমরা পিলপিল করে জল থেকে ডাঙায় হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের মনে পড়ে জিয়ল বুড়ির কথা। সেও কি মরে গেছে বন্দুকের গুলিতে? নাকি কাটারির এক কোপে দুইভাগ হয়ে গেছে তার কুঁজো শরীর? যেই জিয়ল গাছের তলায় তার ঘর, যেই জিয়ল গাছের ডালে করে এক ঝড়ের রাত্রে জিয়ল বুড়ি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আমাদের গ্রামে এসে থামে। সেই হাজার বছর বয়সী জিয়ল বৃক্ষ কি জিন্দা আছে? নাকি তাকে আগুনে কয়লা করে দিয়েছে সৈনিকেরা? যেই জিয়লের ডাল ভেঙে বুড়ি আমাদের হাতে দিতো আর বলতো পুতে দিতে। গাছ থেকে গাছের জন্ম নেয়ার গল্প সে আমাদের বলতো! যেমন মানুষ থেকে মানুষের জন্ম হয়! বুড়ি বলতো, ‘জিয়ল গাছের কাঠ হয় না কিন্তু জিয়ল গাছে সবুজ হয়! আর সবুজ বাঁচায়!’ হায় হায়! সেই বুড়ি যে হাজার হাজার জিয়লের ডাল পুতে এক জিয়ল থেকে হাজার জিয়লে সমগ্র গ্রাম ঢেকে দিয়েছিল সেই বুড়ি কি জিন্দা নাকি সেও হতভাগ্যদের দলে? মানুষ মানুষকে কেন হত্যা করে? কেন মানুষ মানুষের থেকে গ্রাম ছিনিয় নেয়, পুকুর ছিনিয়ে নেয়, বাগান ছিনিয়ে নেয়, সন্তান ছিনিয়ে নেয়, রোদ বৃষ্টি শীত ছিনিয়ে নেয়? আঙ্গিনার আহ্লাদ ছিনিয়ে নেয়? মানুষ কি জানে না, যারা ছিনিয়ে নেয় তাদেরও ছিনতাই হয়ে যেতে পারে ভূমি, ঘর, মাটি! জিয়ল বুড়িকে লোকে বলতো, ডাইনি! কিন্তু এ কেমন ডাইনি? যার জীবন যায় সবুজে সবুজ করতে দুনিয়া! যার কাছে গেলেই একটা জিয়লের ডাল ভেঙে ধরায় দিয়ে বলে, ‘যা বাড়িত যাবার পথে কোন এক ফাকা জমিনে পুইতা দিস!’ আহা সে কিভাবে ডাইনি হয়? যার হাত গ্রামকে সবুজ বানায়, যে মাটিকে সরেস বানায়, সে কেন ডাইনি হয়? মানুষ কেন দানবের মতন জমিন থেকে অন্য মানুষকে উচ্ছেদ করে? মানুষ কেন মানুষকে বলে, ‘তোমার মাটি এইটা না!’ মাটি আসলে কার? মাটির বাসিন্দা কারা? মাটির জন্ম কার জন্যে? মাটির মালিক কে? রঙে আর মাপে কি মানুষ? নাকি মানুষ শব্দের মধ্যে এক পিশাচ, এক দৈত্য, এক দানো থাকে যে অন্য মানুষকে ডাইনি-দানব বলে উচ্ছেদ করে? সংখ্যালঘু করে রাখতে চায়! তারপর একদিন কিছু মানুষের আকাঙ্ক্ষা হয় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের! তাই কি সে নিজেকে আসল আর অন্যরে নকল বলে ঠেলে দেয় উচ্ছেদের হাড়িকাঠে?
রাষ্ট্র তো প্রাণহীন এক কাঠামো। তবু কেন তার এতো ক্ষুধা? কেন সে নিজেকে বড় থেকে ক্রমশ বড় করতে চায়? কেন সে আধিপত্যে সমস্তকে দখল নিতে চায়? নাকি রাষ্ট্র যারা চালায় এইসব তাদের নিশানা? তাদের চোয়াল চায় তাজা তাজা মানুষ খেতে? সীমান্ত বাড়াতে বাড়াতে পুরো পৃথিবীটা গিলে খেতে চায়? এই ক্ষুধার শেষ কোথায়? আস্ত পৃথিবীটার সব মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়লে তখন কি হবে? কে খাবে কাকে? মুক্তির নামে শৃঙ্খলের একটা পদ্ধতি থেকে আরেকটা শৃঙ্খলের পদ্ধতিতে এই যাতায়াত? নাকি জন্ম কেবল ভাসমান হবার সূচনা? কে দেবে উত্তর হে? কোথায় কে আছে যে আমাকে কিনে নিতে চায়? কিনে নেবে কে? যে জীবন গোলামের, শৃঙ্খলের, ভূমিহীনের; সে জীবন নগদ অর্থে বিক্রি হয়ে যাওয়া লাভজনক! নেবেন কেউ? আমাকে কিনে? রাজার পতন করে যেই রাজা আসে সেও একই সন্ত্রাসের হাত ও হাতিয়ার! সে-ও সেই বন্দুকের নল উঁচিয়ে সমগ্র জাতীকে কুর্নিশ করায়! হায়! এই যদি হয় মানুষের পৃথিবীর নিয়ম সেইখানে কে হবে ত্রাতা? কারা আসল হৃদয়ের কারবারি? মুক্তি নামক একটা ললিপপ চুষতে চুষতে আমাদের সমস্ত লুট হয়ে যায়! স্বপ্নের দোহাই দিয়ে নেতা আসে নেতা উড়ে যায়! কিন্তু কে আসল মানুষ? অন্তরে কার বিষ নাই ছোবল দেবার? নাকি ফণাতোলা সাপের দিকেই আমরা বোকার মতো বারবার ফিরে যাই! কেউ বলে দেশ নাই, কেউ বলে আছে! কেউ বলে দেশ ফিরে পাবো, কেউ বলে ক্যাম্পে থেকে যেতে! সবার বলা শেষ হলে টের পাই আমার কোন অদলবদল নাই! আমি উদ্বাস্তু, ক্যাম্প আমার শেষ আশ্রয়!
বাণিজ্যের দুনিয়ায় সব কেনাবেচা হয়! মানুষও পণ্য আজ! কে দেবে পাল্টা উত্তর? গোলাম বিক্রি হয় আজ শ্রমিকের নামে! গোলাম পয়দা করা হয়, জন্ম দেয়া হয় এক মেরুদণ্ডহীন মানব সম্প্রদায়ের! যাদের সকল কিছু মেনে নেয়া ছাড়া অন্য কোন উত্তর দেবার উপায় নেই! আমি সেই সম্প্রদায়ের একজন! কিনে নিন আমার আত্মা! আমার দেহের সমস্ত মালামাল! সার্কাসের পশুর মতো আমাকেও দানাপানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাই আজ লাভজনক! আমার চেহারা বিক্রি করা, আমার দুঃখ কষ্ট সুখ বিক্রি করাই আজ লাভের! এ এক অদ্ভুত প্রজাতি হে মানুষ! যাদেরকে মানুষরাই বেচেকিনে, পেলেপুষে কারবার চালায়! দুঃখ নেবেন? হাসি নেবেন, কান্না নেবেন উদ্বাস্তুর? সার্কাসের খাঁচায় বন্দি আমি আজ, দর্শনার্থীরা এসে দেখে যায়! নজরানা দিয়ে যায়, আশ্বাস রেখে যায়! গবেষণা করে ডিগ্রি নেয় আমার অন্তরের আহাজারির উপর! কিন্তু কোথায় দুঃখ তো কমে না আমার? আসল হাসি তো ফোটে না আমার চোখেমুখে! বিক্রি হতে হতে এই বেঁচে থাকা ক্লান্তিকর লাগে! মনে হয় নিজের হাতেই নিজের শেষ সর্বনাশ করে ফেলি! কিন্তু ঘুমের মধ্যে যেই স্বপ্ন দেখি আমি রোজ, সেই স্বপ্নের পিপাসায় বেঁচে থাকি! দেশ ফিরে পাবার স্বপ্নে লাফ দিয়ে পড়ি না মৃত্যুর গুহায়! আমি না পাই, আমার সন্তান জমিন ফিরে পাবে, আমার সন্তান না পাক তার সন্তান দেশ ফিরে পাবে! এই এক কিম্ভূত লোভে পড়ে নৌকা বেয়ে যাই! হায় হায় দর্শকগণ, অন্তরের গোপন সত্য জানিয়ে আপনাদের বিব্রত করায় আমি দুঃখিত! তার থেকে ভালো, আমার আরজ শুনে সাড়া দেন কেউ, আমাকে কিনে নিয়ে যান! ক্যাম্পের কাঁটাতার থেকে মুক্তি দিয়ে অন্তত আপনার ঘরের একজন গোলাম হিসেবে মানুষ নামের চিহ্ন আমাকে দান করুণ!
…ঘুম দীঘির জলে জীবনের শেষ আয়ু কাটাবার স্বপ্ন দেখে বুড়ো মাছগুলো! পাতা ঘেরা আমার সবুজ দেশে আমি জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবার লোভে এখনো জীবিত আছি। আপনাদের সহৃদয় আশ্রয় শিবির থেকে ফাঁক গলে বেরিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে মাথা ঠুকে খুঁজে যাচ্ছি একটু মাটি যেখানে বসলে নিজের মনে হয়, আপন মনে হয় চারদিক, কিন্তু মানুষের স্রোতে সাঁৎরে পালাতে পালাতে একজন মানুষের ডাক পেলাম না যে আমাকে বলে, ‘তুমি আমাদের কেউ! এই মাটি আমার-তোমার-আমাদের!’ কে আমাকে ফেরাবে বলুন? কেবল মিটিং করে করে, ছবি তুলে তুলে আমাদের নিয়ে এক অদ্ভুত সংযাত্রার কাহনে মাতাল মহাজনেরা! বুলেটের বিক্রির জন্য আমাদের ভূমিহীন হওয়া? নাকি পৃথিবী একদিন একটা আস্ত উদ্বাস্তু শিবির হয়ে শেষ হবে?
না না! ভুল হচ্ছে! ক্ষমা করবেন আমাকে! একজন উদ্বাস্তুর জবানে এইসব বাক্য মানায় না, আপনাদের কাছে বরং আমার পুরোটা বেঁচে থাকা বন্ধক আজ জীবনের করুণায়! কিন্তু আমি স্বপ্ন কেন দেখি? এটা কি আমার ব্যক্তিগত অন্যায়! যেই লোভে বেঁচে থাকি রোজ? নাকি নিজেকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজেই আমি আমাকে বাঁচাই! যেরকম পৃথিবীর আড়ৎদারেরা লাভবান! ক্ষমা করবেন আমার ধৃষ্টতায়। তবে এটাও চরম সত্য যে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়; একটা তুমুল শঙ্খে ফুঁৎকার দিয়ে তুলাকালাম আর্তনাদ তুলে সব চুরমার করে দেই! সভ্যতা ছাই করে, মানুষের নামচিহ্ন মুছে দেই! তারপর দেখি, কে কাকে উদ্বাস্তু করে? কারা দুনিয়ার দখল নেয়! পৃথিবীটা কার করতলে যায় দেখতে ইচ্ছা হয় মানুষহীন হলে! আমরা জানি আমাদের ঈর্ষা করবার সুযোগ নেই কাউকে! উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষের প্রতিযোগিতা থাকতে নেই, ভালোমন্দ থাকতে নেই বাইরের মুক্ত দুনিয়ার বাসিন্দাদের মতো। তারা শুধু বেঁচে থাকা বয়ে যাবে একটা নম্বর প্লেটের আবডালে! আমাদের মার্সিয়া কতদূর পৌঁছায় পৃথিবীর? আশ্বাসে আশ্বাসে বিচিত্র প্রলোভনে কান ঝালাপালা হতে হতে পচেগলে অসাড় হয়ে গেছে! তবু নিজেকে বাঁচাবার জন্য, সতেজ রাখবার জন্য, স্বপ্নটাকে জিয়িয়ে রাখবার জন্য পাখি হই, মেঘ হয়ে ভেসে যাই কাঁটাতার- পাসপোর্ট- পাহারাদার- নিষিদ্ধতা টপকে আমার জন্মভূমিতে! যেইখানে কান পাতলে শোনা যায় বকুল গাছটা থেকে লক্ষ লক্ষ বকুলেরা সৌরভ নিয়ে খসে গেছে! তাদের কথা, গান কারোর কি মনে নেই? কেবলই বকুল গাছটা কাঁদে! ফেরাতে চায় সে তার সন্তানদের বৃন্তে বৃন্তে পুনরায়! হে দর্শকগণ আপনারা বলুন, মানুষের দেশ আসলে কোনটা? সীমান্ত কি? রাজার দেশ কি তবে মানুষের দেশ? নাকি রাজা হবার জন্যে মানুষ তাড়িয়ে- খেদিয়ে দেশ তৈরি করা হয়? বলুন আপনারাই, আমরা কি ফিরে পাবো আমাদের জন্মভূমির ঘ্রাণ? নাকি উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষেরা কেবল বুড়ো হবে জন্মভূমির ঐ বকুল গাছের মতো শোকের গলায় মালা দিতে দিতে! তাদের গল্প যৌবন থেকে বার্ধক্যে কিংবা তাদের উদ্বাস্তু সন্তানে পৌঁছে কার্তুজ হবে জন্মভূমি উদ্ধারে? বলুন আপনারাই বৃদ্ধ মাছেরা কি তাদের ঘুমদীঘি ফিরে পাবে? সেইখানে সাঁৎরাতে সাঁৎরাতে মহাঘুমে নিমজ্জিত হতে পারবে? নাকি এইখানে তাদের হাড়ের জঞ্জালে অনুদানের পাহাড় জেগে উঠবে! জিয়লের পাতা ঝরে নতুন নতুন পাতা গজাচ্ছে বারবার! আর আমি অপেক্ষায় আছি মিথ্যের মতো, একদিন আমার মাটিতে দাঁড়িয়ে নতুন পাতার মুখোমুখি হবার লোভে! ক্যাম্পে আমাদের একজন কবি চিৎকার দিয়ে বলেছিল, ‘পৃথিবী আমার দেশ, সমস্ত পৃথিবীটাই আজ আমাদের!’ কিন্তু হে দর্শকগণ, আপনারাই বলুন, একজন উদ্বাস্তুর কাছে এও কি এক চমৎকার মিথ্যা নয়?
[ আচমকা গলায় ঝোলানো শঙ্খে ফুঁৎকার দিয়ে সব তছনছ করে দেবে। আলোর কাঁপনে ধ্বসে যাবে দৃশ্য ]
সমাপ্ত