এদের কেউ দরিদ্র কৃষক, কেউ বা ভ্যান চালায়, গতর খাটা প্রান্তিক সমাজ যাকে বলে। অবিভক্ত নদীয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যেসব সাধু মহাজনের প্রভাবে বিভিন্ন আস্তানা আশ্রম গড়ে উঠেছিল তারই পরম্পরা বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার ভেড়ামারা গ্রামের রওশন ফকিরের আস্তানা। তিনি লালন ফকিরের পরম্পরায় ফকির, লোবান শাহ – কোকিল শাহ – ভোলাই শাহ – ফকির লালন; এই হলো তাঁর গুরু পরম্পরা। বেলো ফকিরানি তাঁর স্ত্রী। যদিও ফকিরি ধারায় সেটা সাধন সঙ্গী বলে, তাঁরা একে স্ত্রী বলার বা ধারণার চেয়ে আরো বেশি মহিমান্বিত করে দেখেন। দুই সন্তান বিয়ে থা করে যার যার জায়গাতে থাকেন। রওশন ফকির তিন কাঠা জায়গাতে তাঁর আস্তানা গড়ে তুলেছেন বহু বছর আগে। আস্তানার এই জায়গার মালিক ফকিরের স্ত্রী বেলো ফকিরানি। বহু বছর আগে তিন হাজার টাকায় এই জায়গাটুকু খরিদ করেছিলেন আস্তানা করার জন্য। একসময় এই আস্তানা ছিল পাটখড়ি আর ছনের খোলা বারান্দা সাথে মাটির ছোট একটা কক্ষ, পাশে পাটখড়ির বেড়া দেওয়া ছোট রান্নাঘর।
একটা সময়ে শহুরে ভক্ত মুরিদরা আসতে শুরু করে, বলা যায় নগরের মানুষের কাছে আকর্ষণ ক্ষেত্র হয়ে উঠে এসব আস্তানা ফকিরি ধারা। তাঁদের সাথে আগমন ঘটে নগরের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। আস্তানা ধীরে ধীরে ইট কংক্রিটের জায়গা হয়ে যায়। এই পরিবর্তন যে শুধু ফকিরের আস্তানায় ঘটেছে ব্যাপারটা এমন নয়। আশেপাশেও এরকম করে নগরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্রান্তিক এই গ্রামে।
রওশন ফকিরের আস্তানায় মাঝেমধ্যে যাই। ফকিরগণ রুটিরুজির জন্য সাধারণ মানুষের মতো কর্ম করেন না! তাঁরা নির্ভর করেন ভক্ত আশেকদের দক্ষিণা আর ভিক্ষার উপর। নাগরিক জীবনে ভিক্ষা বলতে আমরা যা বুঝি এটা তা নয়। এর ভাব-আচারিকতা গভীর চিন্তা ভাবনার জগতকে সামনে হাজির করে। ফকিরগণ কোন সম্পদ বা খাবার জমিয়ে রাখেন না। সাঁওতালদের মাঝে এই ব্যাপারটি এখনো কম বেশি আছে।
সকালে বা দুপুরে কোন তরকারী নাই, আস্তানায় লোকজন হাজির হয়েছেন হুট করে, বেলো ফকিরানি চলে যান পাশের জমিনে, বিভিন্ন মানুষের জমিন । তাঁর পিছে পিছে আমিও যাই দেখতে। খেতের আইলে বা মাঝে এমন কিছু শাক তুলে নিলেন যেগুলোতে কারো মালিকানা নাই, দাবী নাই। অর্থাৎ এই শাকগুলো আপনাআপনি জন্মে। গ্রামের যাদের দরকার হয় খোলা প্রান্তর ঘুরে কুড়িয়ে আনেন এই মালিকানাহীন প্রকৃতির দান। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শাক কেউই তুলেন না, এমন কি এসব যাতে পায়ের নিচে না পড়ে, মাড়িয়ে না যায় সে দিকে থাকে সতর্ক দৃষ্টি। চারজন মানুষের জন্য শাক আর ডাল দিয়ে হয়ে গেল সকালের সেবা, সাধুগণ খাবারকে সেবা বলে অভিহিত করেন।
শাক তুলে আনার ব্যাপারটা বহুবার দেখেছি, খেয়েছি। অনেক রকমের কুড়ানো শাক থাকে। উৎপাদন বাজার অর্থনীতির বাইরে একটা সমজের একবেলা আহার যোগানোর এই বিষয় আমাকে বিহ্বল করে তোলে। নগরে এক গ্লাস পানি যেখানে পয়সা দিয়ে খেতে হয় সেখানে এরকম বিষয় প্রচণ্ড ধাক্কা না দিয়ে পারে না। ধীরে ধীরে জমিনে এসব শাকের বৈচিত্র্যের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে, বলতে হবে কমে গেছে । আগে এসব জমিনের ধারে মাছের দেখা মিলত, ছোট ছোট বিভিন্ন ফলমূল হত, তা দিয়ে দিব্যি কয়েক বেলা কেটে যেত। এখন সেটা নাই। কেন কমছে জানতে চাওয়ায় যে উত্তর আসে সেটা কিছুক্ষণ আগেও স্বাভাবিক মনে হত, উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদে মানুষ ক্ষেতে প্রচুর বালাই এবং আগাছা নাশক বিষ ব্যবহার করে, নির্দিষ্ট ফসলের বাইরে জমিনে সবার উপস্থিতি শত্রু সম গণ্য করা হচ্ছে। সব কিছু বিচার হচ্ছে টাকার হিসেবে। জমিনের নিজস্বতা এখন টাকার হাতে বন্দি। মানুষ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এসব আপনা-আপনি বিপরীত মেরুতে চলে গেলো। কেউ আর দেখতে চাইছে না সমাজের প্রান্তিক মানুষের আহারের যোগান, যে প্রকৃতি আপনা-আপনি দিত সেটা উবে যাচ্ছে, খাবারের বিচিত্র উপস্থিতি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি, সেটা নাই হয়ে গেলে তাকে বিপদে পড়তেই হয় সেটা যেন বেমালুম হয়ে গেল।
এরকম একটা টিমটিমে সমাজ উৎপাদন ব্যবস্থায় এখনো মাঝেমধ্যে সাঁজের বেলায় রওশন ফকিরের আস্তানায় হাজির হন তাঁর ভাক্তগণ, কেউ কেউ ভক্ত না হলেও আসেন ভালোবাসেন বলে। এসব খেটে খাওয়া মানুষ পুরা দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে সন্ধ্যায় বসেন গানের আসরে। রওশন ফকিরের দারুণ গলা, এসব ভক্ত বাজান তবলা, বাঁশি, দোতারা, জুড়ি বা একতারা। এদের অধিকাংশ তিন চারটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন। একে অপরের কাছ থেকে দেখে দেখে রপ্ত করে ফেলেছেন এসব। শহুরেদের মতো কোন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কেউই শিখেননি। কেউ কেউ বেশ ভালো গায়। গুরুর গাওয়ার পর তাঁদের কেউ কেউ গান ধরেন। মাঝেমধ্যে চলে এসবের ভাব আলোচনা।
মানব জীবন অর্থনৈতিক উৎপাদন ভাব বিনোদন সাথে চিন্তার বিকাশের এই সহজিয়া ধারা আর কত দিন সহজ থাকবে সেটা ভবিষ্যৎ বলে দিবে , কিন্তু সেই ভবিষ্যতকে টাকার দাসত্ব মুক্ত, মোহমুক্ত আনন্দের সমাজ গড়ার বীজ ধীরে ধীরে রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে গোলকায়নের চাকচিক্যের মাঝে – এটা যে বর্তমান বাস্তবতা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না ।