(নয়)
এরকম মনে হয় যেন রাহুল ছিলই না রাহুলের জীবনে। গজেন্দ্রনাথ,অমৃতপ্রভা, মা শশী, তরুণী পিসি, তজো নামের সেই চাকর, খুড়ি ভানু এবং মালিনী, আইমণি, ছবির মাস্টার, নন্দা, সনাতনদের মতো অজস্র গ্রহ-নক্ষত্র, সাপ-ব্যাঙের টানা হেঁচড়ার মধ্যে আরও একটি ছায়াপথের ছায়ার নিচে বেড়ে চলছিল রাহুল।
শুনেছি ছায়াপথের অন্তর্জগত আবিষ্কার করা সহজ নয়। হাজার হাজার গ্রহ নক্ষত্র এবং সৌরজগতে ভরে থাকে ছায়াপথের পেট।এই ধরনের রহস্য আবিষ্কার করতে না পারা একটা ছায়াপথ অহরহ ছায়া ফেলে থাকে রাহুলের মাথায়। রাহুল যখনই ওপরের দিকে তাকায়, দেখতে পায় তার আকাশ অধিকার করে আছে একটা ছায়াপথ।
রাহুল ভাবে কেন তার মাথার ওপরে বাবার ছায়া?
কেন তার মাথার ওপরে ছায়াপথ?
এই ছায়াপথ অবিহনে রাহুল যে বেশি ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারত এই পৃ্থিবীতে!
এই ধরনের বিষাদলগ্ন ভাঁজে রাহুলকে বসে থাকতে দেখে বিষাদে কী জানে পথ কেটে নিয়েছিল রাহুলের হৃদয়ে আর তার অপাপ শরীর টেনে নিয়ে গিয়েছিল -নারীকে যদি নদী বলা যেতে পারে, সেই কল্লোলিত নদীর কাছে। যদি না পারি,সাধারণ নারীর কাছে।
নারীকে নদীর সঙ্গে কেন তুলনা করা হয়? নারীর সঙ্গে নদীর কোথায় মিল? নদী সব সময় বইতে থাকে। তাই আজ নদীর ঘাট ছুঁয়ে থাকা জলটা কালকে একই থাকবে না। মুহূর্তের মধ্যে পেছনের স্রোত আগের স্রোতকে ঠেলে এগিয়ে যায়। অবিরাম কেবল বয়ে চলা। থেমে না থাকা। নদীতে নামলে জল আমাদের ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না, দূরে চলে যায়। সেই একই জল আমরা আর কখনও স্পর্শ করতে পারি না, পেতে পারি না।
কিন্তু নারী? নারীর শরীরের সেই একই স্রোত‐- শরীর পার হয়ে বয়ে যেতে পারে না। সেই স্রোতের থকে সীমাবদ্ধতা। সেই স্রোতের থাকে ক্লান্তি। তাই আমাদের এই ছোট্টনায়ক, যে অদূর ভবিষ্যতে নারীকে নিয়ে অজস্র কবিতা লিখবে, সে নারীকে কখনও নদী বলেনি। নারী নারীই। সমস্ত নারীই সাধারণ।
হরেশ্বর দর্জির সেলাই করা এবং গজেন্দ্রনাথের গুঁজে দেওয়া মশারিটার নিচে মঞ্চের মতো সেই বিছানাতে ঘুমোতো রাহুলরা বার ভাইবোন। তার মধ্যে তিনজন ঘুমোত আকাশে। তারাদের মধ্যে বিছানায়। আর দুজন ঘুমোত নিজের মায়ের সঙ্গে। মঞ্চে ঘুমোত সাতজনঃ রাহুল, জিন্তু, মুকুট, অনুপ, বিভু, রিকি এবং নীপা। অনুপ, বিভু আর রিকি কাকিমা ভানুর সন্তান । রাহুল- নীপার মতো সেই উৎপাত করা দুষ্টুদের মধ্যে অনুপদের শোয়াটা কাকিমা পছন্দ করত না। কিন্তু গজেন্দ্রনাথের ইচ্ছা আদেশে রূপান্তরিত হয়েছিল যে তার নাতি নাতনিদের প্রত্যেকেই একসঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোবে।
বিছানার এক প্রান্তে ঘুমোত রাহুলের দিদি নীপা এবং অন্যপ্রান্তে রাহুল। মাঝখানে রাহুল এবং নীপার চেয়ে কনিষ্ঠরা। গজেন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল রাহুল এবং নীপা শোবার জায়গা দুটো আর ওদের ওয়াড় লাগানো বালিশ দুটো। গজেন্দ্রনাথের নাতি-নাতনিদের মধ্যে ওরা দুজনেই বড় ছিল বলে ওদের দুজনকে সামান্য দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল যে দুজনকে দুই প্রান্তে শুতে হবে যাতে কেউ বিছানা থেকে নিচে গড়িয়ে না পড়ে কিংবা গড়িয়ে গিয়ে মশারিতে হাত- মুখ লেগে না থাকে। রাহুল এবং নীপার মাঝখানের জায়গাটিতে শোওয়া ভাইদের অঘোষিত নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও ‘ আমি আজ তার কাছে শোব’,’আমি আজ তার কাছে শোব না’ ও আমাকে সকালবেলা মেরেছিল’ বলে জায়গা পরিবর্তন করতে পারত। কিন্তু রাহুল এবং নীপা জায়গা বদলাতে পারত না। হর্ষ দর্জির সেলাই করা সাদা সাদা ছোট্ট ওয়াড়ের ভেতর ঢুকে থাকা বালিশের নিচে রাহুল নীপারা এক একটি বন্য স্বপ্ন রেখে ঘুমিয়ে পড়ত। আর গজেন্দ্রনাথের মন্ত্রপুত বিছানার মতো সত্যিই রাহুলদের সেই মঞ্চের মতো বিছানাটার নিদ্রার যদি কোনো দেবী থাকে, সেই দেবী সারা রাত যেন দোলা দিতে থাকত।
কিন্তু একদিন সে দোলানি বন্ধ হল।
পৈতৃক সম্পত্তি ফেলে রেখে যেখান থেকে গজেন্দ্রনাথ উঠে এসেছিল সেই জায়গা থেকে একদিন দুপুরবেলা পায়ে হেঁটে গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল তাঁর সম্পর্কীয় এক ভাইপোর স্ত্রী এবং তার কন্যা সদ্য বিধবা মালিনী । মালিনীর কাঁধে ঝুলছিল একটা কাপড়ের ব্যাগ , যার মধ্যে তার দুটো সাদা মেঘলা চাদর, দুটো সাদা পেটিকোট, তিনটি সাদা ব্লাউজ, একটি কাঠ পেন্সিল, একটি কালি ভরা পেন এবং সোভিয়েত দেশের রঙিন পৃষ্ঠায় মলাট লাগানো একটি এক্সারসাইজ বুক। পনেরো‐ষোলো বছরের একটি ঝলমল করতে থাকা মেয়ে মালিনী , কিন্তু কপালে সিঁদুর নেই , গায়ে শুধু সাদা মেখেলা চাদর এবং ব্লাউজ। মালিনীর মায়ের কপালে ছিল একটা আধুলির মতো টকটকে লাল সিঁদুরের ফোটা এবং মাথার মাঝখান পর্যন্ত দীর্ঘ সিঁদুরের সিঁথি।
মালিনীর দুধের সরের মতো গোল মুখটা এবং আটোসাটো শরীরটাকে বিধবার কাপড় সামান্যও মলিন করতে পারেনি, বরং তাকে বেশি উজ্জ্বল, বেশি সতেজ এবং আদরের পাত্রী করে তুলেছিল। বিয়ের তিন মাস পরেই তাঁর স্বামী ম্যালেরিয়া জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে একদিন মরে পড়ে থাকে। সেদিন মালিনীর স্বামীকে খাওয়ানোর জন্য মালিনীর হাতে ডাক্তারের ঔষধ ছিল না। মালিনী কেবল বাটিতে জল নিয়ে পুরনো ধুতির কাপড় ছিড়ে তার মধ্যে ভিজিয়ে স্বামীর কপালে ‘জলপটি’ দিয়েছিল। মালিনীর সেই জলপটিকে জ্বর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করেনি। একটা সময়ে সেই জ্বর নিজে নিজে চলে গেল। মালিনীর স্বামীকে একেবারে বরফ করে রেখে গেল সেই জ্বর। মালিনীর জীবনের নিয়তি এনোফেলিশ নামের সেই নারী মশাটি, যে তার স্বামীকে একদিন কামড়েছিল, সে বোধ হয় তার ডানায় ভর দিয়ে উড়ে উড়ে নেচে বেড়াচ্ছিল সেদিন। নাকি সে কারও বাড়ির বেড়ায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল? নাকি সে ইতিমধ্যে মরেছিল? সেই খবর পাওয়া যায় না। তার মৃত্যুর খবর মালিনীর স্বামীর মৃত্যুর খবরের চেয়ে কত নগণ্য! এনোফিলিস নামের সেই নারী মশাটি , যে মালিনীর কপালের সিঁদুরের ফোঁটা মুছে দিয়েছিল কাপড়ের রং বদলে দেওয়াই নয়, জীবনের রঙও বদলে দিয়েছিল, তার কোনো শাস্তির বিধান ছিল না পৃথিবীতে। মানুষের জীবনের ফাঁকে ফাঁকে এই ধরনের কত অজ্ঞাত কাল মানুষকে ধ্বংস করার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে।
লক্ষ্মী বলে আদর করে আনা মালিনীকে স্বামীর মৃত্যুর পরে কুলক্ষ্মী বলে বাড়ির লোকেরা রুক্ষ ব্যবহার করতে শুরু করল । তাঁর পেছন পেছন চাদর এবং চুলের গন্ধ শুঁকতে থাকা দেবরটাও হঠাৎ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ‘দেবর’ শব্দটি যদিও সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিতীয় বর অর্থাৎ দ্বিতীয় স্বামী শব্দটি থেকে, মালিনী নিশ্চয় জানত না তার অর্থ।
অবশেষে মালিনী মায়ের কাছে চলে এল। এক টুকরো আগুন মা কীভাবে বাড়িতে রাখে? মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিল, কাকা গজেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে তাকে রাখা হবে‐ একটি স্নেহশীল হৃদয় এবং কঠোর শাসনের ছায়ায়। সেখান থেকে রাষ্ট্রভাষা পাশ করতে পারলে হিন্দি মাস্টারনির একটা চাকরি কোনো না কোনোভাবে পেয়ে যাবে। সেই প্রস্তাব মালিনীর মনঃপূত হল। তাই প্রস্তাব নিয়ে মায়ের সঙ্গে মালিনী একদিন দুপুর বেলা গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে হাজির!
আগুনের টুকরো দেখে অমৃতপ্রভার শোক জেগে উঠল। অমৃতপ্রভা এককথায় রাজি হয়ে গেল। অমৃতপ্রভাকে রাজি হতে দেখে দয়ালু গজেন্দ্রনাথেরও বাৎসল্য প্রেম উঠে উঠল। রাহুলের পিতা স্বয়ং বজালী রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির হিন্দি স্কুলটির অধ্যক্ষ। তাই মালিনীকে সবসময় বইপত্র যোগান দিতে পারবে, পড়াশোনা দেখিয়ে দিতে পারবে। মোটকথা মালিনীর একটা গতি হয়ে যাবে। এভাবে বিশারদটা পাশ করে তাকে নটখট তেরা লাল শেখানো গজেন্দ্রনাথের দায়িত্ব। আর কিছু দায়িত্ব গজেন্দ্রনাথ বাড়ির সবার উপরে অর্পণ করল– মালিনীকে ভালোবাসার দায়িত্ব।
মালিনীর মা গজেন্দ্রনাথ এবং অমৃতপ্রভার হাতে মালিনীকে সামঝে দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেল।
(১০)
রাহুলরা শোওয়া সেই মঞ্চ-বিছানাটা, যার শাল কাঠের খুঁটিগুলি ছিল মাটির মেঝেতে ডুবে গিয়ে, আর সেই জন্য কিছু ভেজা ভেজা, স্যাঁতসেতে এবং শীতল-সেসবকে এরকম মনে হত যে বাচ্চা হাতির পা! অমৃতপ্রভা সব সময় সেই ঘরের মেঝে জল দিয়ে মুছত, মাঝে মধ্যে গোবর জলেও। আর তখন দেখা গিয়েছিল জলের কিছু আঁকা-বাঁকা রেখা সেই হাতির বাচ্চার পা দিয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। যদিও জল নিম্নগামী,পৃথিবীকে ভিজিয়ে তোলার ইচ্ছায় জলও কখনও উর্ধ্বগামী হয়।
বিছানার চাদরটা উঠিয়ে দিলে রাহুল-নীপারা দেখতে পায় তোশকটাতে অনেক ম্যাপ আঁকা আছে। তারই দুই-একটি ভারতবর্ষ, বেশিরভাগই অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। ওরা ম্যাপগুলি ছুঁয়ে দেখে-একটু শক্ত শক্ত, মসৃণ কিন্তু মলিন। ঈষৎ কালো হয়ে উঠা রক্তের দাগও আছে ছোটো ছোটো দ্বীপপুঞ্জ হয়ে। সেইসব দাগের ইতিহাস রাহুলরা জানে না।
পৃথিবীর সমস্ত শিশু এই ধরনের দাগের ওপরে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়। এই ধরনের ম্যাপের ওপরে তিলতিল করে বড় হয়।
মাঝখানে উঠোনটা নিয়ে গজেন্দ্রনাথের বাড়ির চৌহদে মুখ্য ঘর চারটি। তার প্রধান ঘরটি হল রাঁধুনির ঘর এবং খাওয়া-দাওয়া করা ঘর। সেই ঘরটার বারান্দায় একটা লম্বা বেঞ্চ থাকে। বেঞ্চটার পায়া চারটা খেতের মাঠের চারা লাগানো মহিলাদের পায়ের কাফের মতো টানটান এবং স্নিগ্ধ। আর বেঞ্চের হাতদুটি ওদের মুঠো মেরে থাকা হাতের মতো, কিন্তু একটু নিচের দিকে হেলানো।
সকালের দিকে সেই বেঞ্চটাতে অনবরত রোদ বসে থাকে। তাই সেই সময়ে কোনো অতিথি এলে বা বেঞ্চটিতে কেউ বসতে চাইলে তাকে রোদ কোলে নিয়ে বসতে হবে। যেদিকে ভূটান পাহাড়, সেদিকে উত্তরের দিকে থাকে তরুণী পিসির চেয়ারটা। আর দক্ষিণ দিকে রাহুলদের পিতার আরাম চেয়ারটা, বাবা না বসলে যার আঁচ টানা কাপড়টা দুলতে থাকে। সেখানে অন্য মানুষের বসা নিষেধ।মানুষের সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে হলে বজালী রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির অধ্যক্ষ সেখানে বসে কথা বলে। সেখানে বসে খবরের কাগজ পড়ে। সেখানে চায়ের কাপ রাখতে পারা হেণ্ডেল দুটির ডানদিকের হেণ্ডেলে রাহুলের মা শশী গজেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তানকে খবরের কাগজ পড়ে থাকার সময় গরম চা দিয়ে যেতে হয়। আর সেই হেণ্ডেল দুটিতে পা দুটি মেলে দিয়ে রাহুলের পিতা দুপুরের ভাত খেয়ে এক ঘুম দিয়ে নেয়।
এই ঘরটার ভেতরের দিকে প্রায় দরজার সামনে শোবার খাট। তার ওপরে পাতা থাকে মিহি মুগা রঙের একটি পাটি। গজেন্দ্রনাথের চায়ের দোকানের জিনিস দিয়ে চা দেবার মতো অতিথি থাকলে, অতিথি সেই খাটটা বসে চা-জল খায়। খাটটার সামনে থাকে একটি ছোট বাদামি রঙের টেবিল। পাইন কাঠের নয়, পাইনের চেয়েও মসৃণ, মিহি টেবিলের শরীরটা। পায়া চারটা সাত আট বছরের এবং চুড়ি না পরা মেয়েদের হাতের মতো ক্ষীণ এবং মসৃণ। টেবিলটা দেখলেই ভাল লেগে যায়। এত পাতলা যে ছোট ছেলে -মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করার মতো আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেউ করে না। টেবিলকে আবার কীসের আদর?
ফুলের সঙ্গে একটা ফুলদানি ছাড়া সেই টেবিলের ওপরে অন্য কোনো জিনিস রাখাটা ন্যায়সঙ্গত না হলেও কে ভাবে সে কথা, টেবিলটার ওপরে যত অমানুষিক অত্যাচার। গজেন্দ্রনাথের বরফি বা লবঙ্গের সঙ্গে গরম চায়ের কাপ, যারা আবার কাপে খায় না তাঁদের জন্য কাঁসার গ্লাসে এনে তজো অতিথির সামনে তার ওপরে রেখে গিয়েছিল। গরম লাগলেও টেবিলটা আহা উহু করতে পারত না। কিছু অতিথি প্লেটে ঢেলে নিয়ে চা খেত। তখন টেবিলের ওপরে গরম চা পড়ত এবং প্লেটের নিচের গোলাকার জলীয় চায়ের দাগ বসে যেত।
ঘরটার ভেতরে এখানে সেখানে দুই একটা চেয়ার থাকলেও ওদের নির্দিষ্ট কোনো স্থান ছিল না। ওরা ছিল ভ্রাম্যমাণ। যখন তখন ওদের যেখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত।এদিকের ওদিকের বেড়ায় ঢেলান দিয়ে প্রায় পনেরোটি কাঠের পিড়ি রাখা ছিল। রাহুলের পিতাকে বাদ দিয়ে বাড়ির প্রত্যেকেই মাটিতে পিঁড়ি পেতে ভাত খাওয়ার নিয়ম ছিল।
রাহুলের পিতা ভাত খাবার জন্য ব্যবহার করত ধোঁয়া রঙের রেক্সিনে মোড়া একটি তিন ফুট দুই ফুটের টেবিল। তাঁর এক বিশাল উদর ছিল, হয়তো সেই জন্যই এই ব্যবস্থা তিনি করে নিয়েছিলেন। আর বরপুত্রের প্রতি অপত্য স্নেহের জন্য নয়, রুক্ষ এবং জটিল প্রকৃ্তির ছেলেকে অসন্তুষ্ট করে ঘরটাতে অশান্তি সৃষ্টি না করতে চাওয়ার জন্য গজেন্দ্রনাথ তার ক্ষেত্রে নীতি-নিয়ম শিথিল করেছি। আর মা অমৃতপ্রভা তো ছেলে বরুণকে ভয়ই করত-কীভাবে মুখে মুখে এবং সামান্য অজুহাতে ঝগড়া করতে পারে ছেলে! মা-ছেলের ঝগড়া লাগলে সমগ্র ঘরটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। রাহুলরা ভয়ে কাঁপতে থাকে। একনাগাড়ে দুই তিন ঘন্টা ধরে চলে সেই ঝগড়া। অমৃতপ্রভা পিড়িতে মাথা কূটতে থাকে। তখন যেন আগুনটা আরও বেশি করে জ্বলে উঠে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা সেই আগুন অমৃতপ্রভা কোনোমতে নেভাতে পারে না। গজেন্দ্রনাথও ঠোঁট চাটতে চাটতে চলে যায়। সেই আগুন কেবল ছেলেই নেভাতে পারে। মাত্র এক সারি বাক্য বললেই হলো। তারপর আগুন শেষ। গজেন্দ্রনাথও সেই বাক্যকে ভয় করেছিল। ভবিষ্যতে রাহুলরা যখন বড় হয়ে উঠবে, বাবার সেই বাক্যবাণে ওরা ধরাশায়ী হয়ে হয়ে রক্তহীন হয়ে পড়বে- যে কথা ভবিষ্যতের জন্য থাকুক পাঠক।
এই মূল ঘরটার গায়ে লেগে থাকা ঘরটাই রাহুলদের মা-বাবা থাকার ঘর। সেখানেও দুটো বিছানা রয়েছে। তারই একটি প্রকাণ্ড পালং। বিহারী মহিলার চুড়ি পরা হাতের মতো নক্সা কাটা তার চারটি পায়া। রাহুলরা জানে সেটা বাবার বিছানা। সেটার মাথার দিকে একটি ছোট পার্টিশন। পার্টিশনের ওপারে একটি তিনফুটের বিছানা। তার ওপরে টান করে বিছানো একটি তোষক। তোষকের ওপরে একটি সাধারণ বিছানার চাদর। রাহুলরা জানে সেই বিছানা মায়ের। মায়ের মতোই বিষণ্ণ।
গজেন্দ্রনাথের বেলের নিচের চায়ের দোকানে থাকা দীর্ঘ ডেস্কের মতো একটি ডেস্ক সেই পার্টিশনের গায়ে লেগে থাকে,যার ওপরে থাকে দুটো টিনের ট্রাংক। একটি বড়, বড়টার পিঠে উঠে থাকে অন্য একটি ছোট ট্রাংক-যেভাবে দাদার পিঠে উঠে থাকে ভাই।
রাহুলদের মা-বাবার সেই ঘরটার দরজা দুটি এবং জানালা তিনটি। তারই একটি দরজা ভেতর এবং বাইরে থেকে কাঠ মেরে ফিক্সড করে রাখা আছে। জানালা তিনটির তিনটিই সবসময় বন্ধ থাকে। স্বাস্থ্যসচেতন পিতা কেন সেই জানালাগুলি খোলেন না রাহুলরা জানে না। তাই ঘরটা সব সময় অন্ধকার থাকে। কেবল একটি কাঁচের ভেন্টিলেটর দিয়ে ওপর থেকে আলো আসে। আলার ছটাটা আলো নয়-একটা যেন নেমে আসা বিকেল।
বাদামি রঙের সেই ভাল লাগা টেবিলটার সমগোত্রীয় অন্য একটি ছোটো টেবিল থাকে বাবার পালংটার কাছে। কিন্তু সেটার রং বাদামি নয়। সাধারণ কাঠের রং। আর পায়া চারটিও কোনো ছোট মেয়ের হাত পায়ের মতো নয়। একটি সবুজ রঙের টেবিল ক্লথ তার ওপরে পেতে রাখা আছে,যার চার কোণে মা শশী ফুলের আকৃ্তির চারটি ফুল এবং পাতা বিছিয়ে রাখে। কিন্তু তার দুটো ফুল-পাতা বেড়ার গায়ে লেগে থাকা বলে অদৃশ্য হয়ে থাকে।
সেই টেবিলটাতে স্তূপাকৃতি হয়ে থাকে অনেক রহস্যময় জিনিস । রাহুলরা চিনে না বলে সেই সমস্ত জিনিস রহস্যময় হয়েই রইল।চিনতে পারলে সেই সমস্ত জিনিস, পড়তে পারত যদি সেইসব হিন্দি অক্ষর, কী জানি হয়তো তা সাধারণ হয়ে পড়ত।
কখনও বা রাহুল নীপারা মনে মনে সেইসব জিনিস স্পর্শ করে দেখে। কিছু পরিচিত জিনিসও থাকেঃ বড় মুখের সবুজ রঙের ভেসিলিনের বোতল, বসন্ত মালতী নামের বডি লোশন, নিভিয়া ক্রিম, কিছু হোমিও ঔষধের বোতল, কিছু টেবলয়েট, একটা মধুর বোতল, একটি হিন্দি অভিধান, একটি ছোট কাঁচি, চিরুণি, নানা ধরনের কাগজ, এনভেলোপ, এনভেলোপের ভেতরে চিঠি, খুচরো পয়সা ইত্যাদি। গজেন্দ্রনাথের ঘরগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিপাটি ঘর হল এটি। তার থেকে সুন্দর গন্ধ বেরোতে থাকে। শালগ্রাম থাকা ঠাকুরঘরটার ফুল-তুলসি-চন্দন এবং ধূপ ধোঁয়ার গন্ধের চেয়ে সুন্দর, বুকের ভেতর টেনে নিতে চাওয়া এক ধরনের গন্ধ। আর শুয়ে পড়তে চাওয়ার মতো একটি মনের মতো বিছানা, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করা সাদা ও দুটো বালিশের সঙ্গে বাবার পালঙটা, যেখানে রাহুলরা শোওয়া তো দূরের কথা , বসাও নিষেধ। সেখানে ছিল পরিপাটি।
বাবার অজ্ঞাতে কখনও রাহুল-নীপাদের সেই ঘরে প্রবেশ করতে দেখলে মা বলত, কেন ঢুকেছিস? ওই ঘরে ঢুকবি না।’ অপরাধ করে ধরা পড়া মতো ওরা ম্লান মুখে বেরিয়ে আসে। ওরা জানে মা-বাবার শোবার ঘর। কিন্তু তাদের মনে হয় যেন সেখানে আর কেউ বাস করে। এরকম মনে যে ঘরটির অন্ধকার কোণগুলিতে, আলনা এবং ট্রাঙ্কদুটির পেছন দিকে পালঙে্র নিচে যেন কেউ লুকিয়ে রয়েছে! ওরা যেন শুনতে পায় তাদের কিচির-মিচির শব্দ!
বাকি থাকা ঘরটা ছিল নতুন ঘর। অন্য তিনটি ঘরের চেয়ে আপেক্ষিক নতুন হওয়ার জন্য একে নতুন ঘর বলা হত। গজেন্দ্রনাথের অন্য ছেলে নিরোদ অর্থাৎ রাহুলের কাকা এবং কাকিমা থাকার জন্য ঘরটা তৈরি করা হয়েছিল। কাকা গুয়াহাটিতে রেলওয়েতে চাকরি করে। তিনি মালিগাঁও কোয়ার্টারে থাকেন। প্রতি শনিবার বিকেলে এসে সোমবার সকালে চলে যান। স্ত্রী ভানু এবং ছয় বছর থেকে পাঁচমাস বয়সের তিন ছেলে এবং এক মেয়ে গজেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে থাকে। কখনও বা তিনি দুই তিন সপ্তাহ পরে আসেন।
ভানু সাহসী মহিলা। স্বামী না থাকলেও তিনি ঘরটিতে বুকের দুধ পান করা শিশুটিকে নিয়ে একা থাকতে পারেন। গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে এত সাপের রাজত্ব,তথাপি তার ভয়-ডর নেই। তিনি নতুন ঘরে অন্য কেউ থাকাটা পছন্দ করেন না। আর নিজেও অন্য বাড়িতে থাকবে না। এক বিদ্রোহিনীর মতো তিনি যেন স্বাধীন হয়ে থাকার জন্য পরাধীনতার আশ্রয় গ্রহণ করেন।
নতুন ঘরেও বস্তায় সেলাই করা একটা পার্টিশন ছিল যা ঘরটিকে দুটো ভাগে ভাগ করেছিল । ওই ভাগে একটা খাট ছিল। খাটের নিচে থাকে গজেন্দ্রনাথের বাগানের ছয়টি নারকেল গাছের নারকেলগুলি। মাসিকের সময় রাহুলের মা শশীকে এসে তিন দিন ওখানে শুতে হত। রাহুলের কাকিমা ভানুকেও মাঝে মধ্যে সেই খাটে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতে দেখা যেত । সেই খাটে অমৃতপ্রভার শোবার দিন অনেকদিন আগেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অমৃতপ্রভার ফাগুনের রক্তরাঙ্গা দিনগুলিও ছিল সেই খাটটাই । সেই খাটেই জন্ম হয়েছিল রাহুলের। রাহুলেরই নয়, এক এক করে শশী এবং ভানুর জীবিত আর মৃত মিলিয়ে বারোটি সন্তানের ওতেই জন্ম হয়েছিল। শান্তি নামের নার্সটি মাথায় ধরে টেনে বের করে এনেছিল ওদের অন্ধকার থেকে আলোতে। ওরা জন্মানো সেই দিনগুলিতে কেরোসিনের প্রদীপের আলোতে অমৃতপ্রভা শান্তিকে সাহায্য করেছিল। কারণ এইসব ছেলেমেয়ে কারোরই সূর্যের আলোতে জন্ম হয়নি। প্রত্যেকেই জন্মেছিল কেরোসিনের প্রদীপের আলো চোখে নিয়ে। এখনও সেই খাটটিতে সেই কেরোসিন, সেই কাঁচা রক্ত, প্রসব যন্ত্রণা এবং চোখের জলের গন্ধ লেগে আছে ।
গজেন্দ্রনাথের ঘরে আর কোথাও অন্য কোনো খাট ছিল না। মা রেখে যাবার পরে সারাটা দিন মালিনী যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বা বসেছিল, মনে হচ্ছিল যেন একটা সাদা ডালিয়া ফুল ফুটে আছে। প্রত্যেকেই এসে সেই ডালিয়া ফুলটাকে দেখছিল। কিন্তু গোধূলি হওয়ার পরে হঠাৎ অমৃতপ্রভার যেন সম্বিত ফিরে এল– ডালিয়া ফুল থাকবে কোথায়? কোথায় ঘুমাবে মালিনী?
অমৃতপ্রভা রশিটা টেনে দিল। রশিটার অন্য প্রান্তে থাকা ঘন্টাটা গজেন্দ্রনাথের চায়ের দোকানের রন্ধনশালায় বেজে উঠল। এই রশিটা তখন টানা হয় যখন গজেন্দ্রনাথের চায়ের দোকানে থাকা কোনো একজন চাকরের ঘরের কাজে প্রয়োজন হয়। বা অতিথি এলে, যার জন্য প্রয়োজন হয় গজেন্দ্রনাথের লবঙ্গ বা বরফির।
তজো অমৃতপ্রভার কাছে দৌড়ে এল। জিজ্ঞেস করল –’কিছু চাই?’
‘কী হল?’ গজেন্দ্রনাথ অমৃতপ্রভাকে জিজ্ঞেস করল।
‘মালিনী কোথায় শোবে?’
‘ কেন, রাহুলদের বিছানায়! আমি জায়গা করে দেব। তুই কেবল একটা বালিশ বের করে রাখবি!’
হাতির বাচ্চা ভরে থাকা বিছানাটাতে রাতের শোবার সময় রাহুল দেখল তার বালিশের কাছে অন্য একটি নতুন বালিশ এবং কিছুটা জায়গা খালি পড়ে আছে।
রাহুলের ঘুম না আসা পর্যন্ত সেই বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাকল নীরবতা।
একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (৪র্থ পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদঃ বাসুদেব দাস