কালের সন্ততিঃমানবিক ইতিবৃত্তের দলিল ।। এদুয়ার্দু গ্যালিয়ানো ।। অনুবাদ- মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম

এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো (১৯৪০-২০১৫) উরুগুয়ের প্রখ্যাত লেখক কবি ও সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকার এই লেখকের মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছে অফুরান ভালোবাসা ও বিস্ময়। ভালোবাসা মানুষের প্রতি আর বিস্ময় জীবনের। জীবনকেও ভালোবেসেছেন অন্তহীন কৌতূহলে, আনন্দে আর নিবেদনে। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষের জন্য মানবতার জন্য নিবেদিত হয়েছে তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম, বক্তৃতা-ভাষণ, আন্দোলন প্রতিবাদ। নির্বাসনে থেকেছেন, মৃত্যুর পরোয়ানা পেয়েছেন একাধিকবার তবু থেমে যায়নি অদম্য এই প্রাণ ।

লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নিয়ে লিখেছেন ‘ওপেন ভেইনস অব ল্যাটিন আমেরিকা’। তিনখন্ডে লিখিত মেমোরি অব ফায়ার’ আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রামের প্রাণবন্ত ইতিহাস। শিল্প-সাহিত্য ইতিহাস যুদ্ধ প্রতিরোধ স্বৈরশাসন বর্ণবাদ নারী-স্বাধীনতা প্রভৃতির অনবদ্য কাব্যিক উপস্থাপন তাঁর ‘ মিরর’ ও ‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ বই দুটি।

‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ ৩৬৫ দিনের দিনলিপি। জগতের কত অদ্ভূত ইতিহাসের কত অনন্য বিষয় নিয়েই-না তিনি লিখেছেন কিন্তু কী আশ্চর্য সবকিছুই মনে হয় আজকের – এই সময়ের – এই জীবনের আর কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদের।

– মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম

——————

জানুয়ারি ১
আজ এই দিন

আজকের এই দিন মায়ান, ইহুদি, আরব, চীনা সহ পৃথিবীর আরো অসংখ্য মানুষের কাছে বছরের প্রথম দিন নয়। এই দিনটিকে বেছে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী রোম- আশীর্বাদ করেছে ভ্যাটিকান রোম। আর আজ সমগ্র মানবসম্প্রদায় দিনটিকে বছর থেকে বছরে উত্তরণের ক্ষণ হিসেবে উদযাপন করে।
আজ কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতে হয় মহাকাল আমাদের প্রতি সর্বদাই সদয়। সময় তার ক্ষণস্থায়ী যাত্রী এই আমাদের বিশ্বাস করিয়েছে – আজ বছরের প্রথম দিন এবং দিনটিকে ঝলমলে বিপণীর মত রঙিন আর আনন্দঘন করতে হবে।
——-

জানুয়ারি ২
পবিত্র আগুনের শিখা

১৪৯২ সালের এই দিনে গ্রানাডার পতন হয়, এবং সেইসাথে মুসলিম স্পেনেরও। স্পেনিস ইনকুইজিশন বিজয়ে গ্রানাডা ছিল শেষ রাজ্য, যেখানে মসজিদ চার্চ ও সিনাগগের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল।
সেই একই বছর আমেরিকা আবিষ্কার শুরু হয়, আমেরিকা তখনো নাম-না-জানা এক বিপুল রহস্য।
আর পরের বছরগুলোতে সুদূর সব ভূখণ্ডে জ্বলছিল লেলিহান আগুন, যার সর্বগ্রাসী শিখা গ্রাস করেছে ইহুদি মুসলমান আর আমেরিকার আদিবাসীদের তাবৎ গ্রন্থাগার।
নরকে জন্ম নেওয়া অক্ষরমালার পুরস্কার তো অগ্নিই হবে!
——–

জানুয়ারি ৩
পদব্রজে বিদ্যাভাণ্ডার

৪৭ খ্রীস্টপূর্বে, বছরের এই তৃতীয় দিনে সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়।
জুলিয়াস সিজারের নেতৃত্বে রোমান বাহিনী মিশর আক্রমণ করলে, ক্লিওপেট্রার ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো একযুদ্ধে হাজারে হাজারে প্যাপিরাস গ্রন্থ ছারখার করে দেওয়া হয় আলেক্সান্দ্রিয়াতে।
দুই সহস্রাব্দ পর আমেরিকান বাহিনী ইরাক জবরদখল করলে, জর্জ ডব্লিউ বুশের কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধে জেহাদে হাজার হাজার বই বাগদাদের গ্রন্থাগারে পুড়ে ভস্মীভূত হয়।
সমগ্র মানব-ইতিহাসে একমাত্র একজন উদ্বাস্তুই তাঁর গ্রন্থাগার যুদ্ধ ও অগ্নিকাণ্ডের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। তিনি দশম শতাব্দীর পারস্যের কাজি আবুল কাসেম ইসমাইল।
এই বিচক্ষণ অক্লান্ত পরিব্রাজক তাঁর গ্রন্থাগার সাথে নিয়েই চলতেন। এক লক্ষ সতের হাজার বইয়ের সংগ্রহ, চারশত উটের পিঠে চাপিয়ে এক মাইল দীর্ঘ ক্যারাভান নিয়ে তিনি পথে বেরিয়েছেন। ক্যারাভানের এক একটা উট তাঁর বহনকরা বইয়ের এক একটা ক্যাটালগ। পার্শিয়ান ভাষার বত্রিশটি অক্ষরের প্রতিটির জন্য সাজানো ছিল এক একটি উটের বহর।
————–

জানুয়ারি ৪
যে ভূমি কাছে টানে

১৬৪৩ সালের এই দিনে স্যার আইজ্যাক নিউটন জন্মগ্রহণ করেন। যতদুর জানা যায়, নিউটনের কখনোই কোনো প্রেমিকা ছিল না। ভূত ও সংক্রামক ব্যাধির ভয়ে ভীত নিউটন, কোনো রমনীয় স্পর্শ ছাড়াই আমৃত্যু ছিলেন চিরকুমার।
কিন্তু এই ভীতু মানুষটির দুর্দান্ত সাহস ছিল – মহাজাগতিক বস্তুর গতিপ্রকৃতি অনুসন্ধানে,
আলোর গঠনতত্ত্ব আবিষ্কারে,
শব্দের গতি নির্ণয়ে,
তাপের পরিবাহী ধর্ম যাচাইয়ে,
এবং অভিকর্ষ বলের অভূতপূর্ব ব্যাখ্যায়;
যে-বলে পৃথিবী আমাদের সবাইকে তার কাছে টানছে – উৎস ও পরিণতির দিকে।
————–

জানুয়ারি ৫
যে মাটি কথা বলে

জর্জ ওয়াশিংটন কারভার ঈশ্বরকে স্বপ্নে দেখলেন।
তিনি বলছেন, ‘বৎস, কিছু জানার থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস কর’
কারভার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিনাবাদাম-এর গোপন রহস্য কী?’
ঈশ্বর বললেন, ‘ বাদামকেই বরং জিজ্ঞেস কর না!’
কৃতদাসের সন্তান জর্জ তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন নিস্ফলা মৃত জমিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। যে জমিতে একসময় চরম অমানবিক পরিশ্রম করতে হত নিগ্রোদের।
প্রাচীন আলকেমিস্টদের মত তাঁরও ছিল আজব এক গবেষণাগার। সেখানে বাদাম ও মিষ্টি আলুর শত-শত রেসিপি তৈরি হত – তেল মাখন পনির সসেজ মেয়োনিজ সাবান রঙ কালি সিরাপ আঠা ট্যালকম পাউডার.. আরো কত কী!
তিনি বলতেন, ‘ গাছপালা-ই আমাকে এসব রেসিপি শিখিয়েছে। সবার সাথেই তারা কথা বলে, শুধু সেই ভাষা বোঝার নিষ্ঠা চাই’।
১৯৪৩ সালের এই দিনে আশি বছর বয়সে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার সময়েও নতুন নতুন রেসিপির কথা ভেবেছেন, উপদেশ দিয়েছেন, আর পড়িয়েছেন তাঁর অভিনব বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলাবামার এই অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘কালো’দের প্রথম পড়ার সুযোগ হয়।
———–

৬ জানুয়ারি
প্রতীক্ষায় স্বদেশ

২০০৯ সালের এই দিনে, তুরস্ক নাজিম হিকমতের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়। প্রিয়তম আর একসময়ে বিদ্রুপের পাত্র এই কবি একজন তুর্কী হিসেবে পূনরায় স্বীকৃতি পান। কিন্তু এই সুসংবাদ কবি শুনে যেতে পারেননি, পঞ্চাশ বছর আগেই ভিনদেশে নির্বাসিত হয়ে তিনি মারা যান। জীবনের অধিকাংশ সময় তাঁর নির্বাসনেই কাটে।
দেশ তাঁর প্রতীক্ষায় ছিল, কিন্তু তাঁর বই ছিল নিষিদ্ধ সেইসাথে তিনিও।
নির্বাসিত এই কবির দেশে ফেরার কী আকুল বাসনা:
এখনো আমার ঢের পূন্যকর্ম বাকি
নক্ষত্রের সাথে আমি মিশিয়াছি, তবু্
অগণন তারাদের করিনি শুমার।
কূপের গভীর থেকে তুলিয়াছি জল,
তবুও অঞ্জলি ভরে দিতে পারিনি তো।

কবি আর কখনোই দেশে ফেরেন নি!
———-

জানুয়ারি ৭
তাঁরই তো নাতনি

দাদা রাফায়েল ব্যারেটের এই কথা নাতনি সোলেদাদের ভীষণ প্রিয়ঃ
‘কল্যাণ ও মঙ্গল যদি কোথাও না থাকে, তাহলে তা আমাদের গড়ে নিতে হবে।’
রাফায়েল নিজের পছন্দে প্যারাগুয়ের নাগরিক, পেশায় বিপ্লবী, জীবন কাটিয়েছেন জেলে জেলে আর মারা যান নির্বাসনে।
১৯৭৩ সালের এই দিনে ব্রাজিলে তাঁর নাতনি ঘাতক বুলেটের ধাঁধায় পড়েন।
বিদ্রোহী নেতা ল্যান্স কর্পোরাল আনসেলমো সোলেদাদকে তাঁর দলে আনেন।
কিন্তু তিনি নিজে অপ্রাপ্তির বেদনায় – স্বপ্ন ও আশা পূরণ না-হওয়ায়, বিদ্রোহী দল থেকে সরে আসেন। এবং তার সহযোগী কমরেড যাঁরা ব্রাজিলের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন, একে একে ধরিয়ে দিতে থাকেন। এই দূর্ভাগা কমরেডদের শেষ পরিনতি অশেষ নির্যাতন আর নির্মম মৃত্যু।
তাঁর প্রেমিকা সোলেদাদকেও তিনি রেহাই দেননি।
সোলেদাদের গোপন আস্তানা দেখিয়ে দিয়ে তিনি পালিয়ে যান।
বিমানবন্দরে পৌঁছিতে-না-পৌঁছিতেই ঘাতকের রাইফেল গর্জে ওঠে এদিকে।
——–

জানুয়ারি ৮
চলে যাওয়া মানে বিদায় নয়।

ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট ১৮৭২ সালের এই দিনে ম্যানুয়েলা লিও কে মৃত্যুদন্ড দেন। তিনি তাঁর আদেশনামায় ম্যানুয়েলা কে ‘ম্যানুয়েল’ হিসেবে উল্লেখ করেন। কারণ, তাঁরমত একজন ভদ্রলোক সামান্য এক রেড ইন্ডিয়ান ‘নারী’কে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাচ্ছেন- এই প্রমাণ তিনি রাখতে চান নি।
মানুয়েলা তাঁর শহর ও দেশে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন, জবরদস্তিমূলক শ্রমের বিরুদ্ধে রেড ইন্ডিয়ানদের জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এসব যেন কিছুই না তাঁর একগুঁয়ে ঔদ্ধত্যের তুলনায়। সৈন্যদের বিস্ফারিত চোখের সামনে লেফটেন্যান্ট ভালেজ্যকে ডুয়েলে ডাকা এবং সামান্য বল্লম দিয়ে উদ্যত তরবারি পরাস্ত করার স্পর্ধা-ই যেন তাঁর মৃত্যুর অমোঘ কারণ।
চোখে কালো কাপড় না-বেঁধেই যখন তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে সটান দাঁড়ান, তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় -‘কিছু বলার আছে কী না’।
ম্যানুয়েলার সরল দৃপ্ত উত্তর :
“মানাপি।”
কিচ্ছু না।
————-

জানুয়ারি ৯
দীর্ঘ শোকগাথা থেকে মর্মভেদী সংক্ষিপ্ততা

১৭৭৬ সালের এই দিনে ফিলাডেলফিয়াতে ‘কমন সেন্স’-এর প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়। লেখক টমাস পেইন দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক অবমাননা এবং হাস্যকর রাজতন্ত্র যা গাধাকে মুকুট পরিয়ে সিংহ বানাতে চায়, সেখানে স্বাধীনতা আসলে ‘কমন সেন্সের’ বিষয়। ৪৮ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকা জলের বেগে হাওয়ার ঘূর্ণির মত সাড়া আমেরিকা ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতির মর্যাদা পায়।
১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ২৩ পৃষ্ঠার ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ রচনা করেন। বৈপ্লবিক এই ক্ষুদ্র রচনা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে শুরুর বাক্য দিয়েই- ‘ এক অদ্ভুত ভূত সারা ইউরোপ তাড়া করে ফিরছে।’ কালক্রমে এই বই বিংশশতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ বৈপ্লবিক রচনার স্বীকৃতি পায়।
২০১১ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হেসেলের ‘ Indignez- vous! বা ‘ আক্রোশের সময়’ ২৬ পৃষ্ঠায় রচিত জ্বলন্ত এক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এর দৃপ্ত অক্ষরমালা অসংখ্য শহরে প্রতিবাদের ভূমিকম্প ছড়িয়ে দিয়েছিল। দিনের পর দিন রাতের পর রাত হাজারো ক্ষুব্ধ জনতা রাজপথ দখলে রেখেছিল যুদ্ধলোলুপ আর স্বৈরাচারী ব্যাংকারদের প্রবল বিরোধিতায়।
———-

জানুয়ারি ১১
এই পথ চলাতেই আনন্দ

১৮৮৭ সালের এই দিনে আর্জেন্টিনার সাল্টায় হুয়ান কার্লোস দাবালোস জন্মগ্রহণ করেন। সাল্টায় তিনি কবি ও শিল্পীদের নতুন এক ঘরানার প্রবর্তক।
গল্প প্রচলিত আছে যে, উত্তর আর্জেন্টিনায় তিনিই প্রথম ‘T’ মডেলের -জাঁদরেল গোঁফওয়ালা- ফোর্ড গাড়ি হাঁকাতেন। তাঁর মডেল -‘T’ বাহন চলা শুরু করলেই টানা ঘর্ঘর শব্দ ও একরাশ ধোঁয়ায় চারপাশ ছেঁয়ে যেত। গদাই লস্করের চালে হেলেদুলে চলত তাঁর শখের শকট। দেখা হলে লজ্জায় কচ্ছপও তাকে রাস্তা ছেড়ে দিত!
একদিন এক প্রতিবেশী কাছে এসে বিমর্ষ মুখে বললেন, ‘ কিন্তু মশাই, এই গতিতে চললে তো পৌঁছতে পারবেন না।’
চালকের নির্বিকার উত্তর, ‘কোথাও পৌঁছতে চাই না – এই পথ চলাতেই আমার আনন্দ।’
—————

জানুয়ারি ১২
শুধুই অবিরাম ছুটে চলা

২০০৭ সাল। জানুয়ারির ১২ তারিখ সকালে বেলা। ওয়াশিংটন ডিসির জনবহুল এক সাবওয়ে স্টেশনে খুব মন দিয়ে একজন বেহালা বাজাচ্ছেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে শিল্পী একমনে বাজিয়ে চলছেন ফ্রানৎস শুবাটের সিম্ফনি আর ধ্রুপদীসব রাগ-রাগিনী। শিল্পীকে দেখতে আশেপাশের মুখ-চেনা বালকের মতোই মনে হয়।
হাজারো মানুষ তাঁকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেলেন, বেহালার সুর তাঁদের আটকাতে পারে নি। জনাসাতেক কৌতূহলী মন মুহূর্তের জন্যে শুধু থেমেছিল। উদ্দাম উল্লাস বা হাততালির উৎসাহ দেওয়ার কেউ ছিল না সেদিন! কয়েকজন শিশু যদিও-বা দাঁড়াতে চেয়েছিল, মায়েরা তাদের টেনে-হিঁচড়ে সাথে নিয়ে ছুটলেন।
কেউ সেদিন চিন্তাই করতে পারেন নি – এই বেহালাবাদক স্বয়ং সুরসম্রাট জোশুয়া বেল- সংগীতপ্রতিভার অনন্য বিস্ময়!
দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট অভিনব এই উদ্যোগের মাধ্যমে জানতে চেয়েছে, ‘ সুন্দরকে আমরা সত্যিই কী ভালোবাসি, সময় দিয়ে উপভোগ করি?’
————-

জানুয়ারি ১৩
পাতালের দুনিয়া

২০১০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প হাইতির একটা বড় অংশ গ্রাস করে নেয়। সেইসাথে কেড়ে নেয় দুই লক্ষের অধিক মানুষের প্রাণ।
পরদিন অর্থাৎ জানুয়ারির ১৩ তারিখ, আমেরিকায় প্যাট রবার্টসন নামের এক টেলিভিশন বক্তা এই ভূমিকম্পের অভূতপূর্ব ব্যাখ্যা দেন। পরমাত্মার স্বঘোষিত এই পয়গম্বর দাবি করেন- ‘এর জন্য নিগ্রোরাই দায়ী, তাঁদের ‘স্বাধীনতা’-ই এই ভূমিকম্পের কারণ। ফরাসি দাসত্ব থেকে শয়তান তাঁদের মুক্ত করেছিল, আর এখন তার মূল্য সুদে-আসলে তুলে নিচ্ছে।’
————-

জানুয়ারি ১৪
হাইতির কুসংস্কার

হাইতির ভূমিকম্প দেশটির ট্র্যাজিক পরিনতির চূড়ান্ত। মাথার উপর ছাদ নাই, খাবার নাই, সুপেয় পানি নাই, সেইসাথে ঔপনিবেশিক উদগ্র লোভ আর দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে দেশটি সত্যিই আজ বিধ্বস্ত নিঃস্ব।
এদিকে বিতাড়িত দাস-ব্যবসায়ীরা সবকিছুর জন্যে, পূর্বে যেমন করেছেন – এখনো তেমনি, “ভুদু” র ঘাড়েই দোষ চাপাচ্ছেন। তাঁদের কাছে ‘Voodoo’ আফ্রিকান কুসংস্কার, ব্লাক ম্যাজিক, অন্ধমায়া আর শয়তানের ভোজবাজি ছাড়া কিছুই নয়।
যদিও ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসীর অভাব নেই, তবুও তাঁরা সন্তুপুরুষের নখ ও জিব্রাইলের ডানার পালক আরো মানুষের কাছে পৌঁছাতে চায়। তাই দরকার হাইতি থেকে ‘ভুদু’র নির্বাসন। চেষ্টা চলেছে ১৮৪৫, ১৮৬০, ১৮৯৬, ১৯১৫, ও ১৯৪২ সালে
এবং এখনো চলছে।
সাম্প্রতিক যুদ্ধ ঐশী বাণীর সাথে অন্ধ সংস্কারের।
কুসংস্কারের সাথে যাঁরা লড়ছেন তাঁরা প্যাট রবার্টসনের দেশের নাগরিক- যে দেশের ভবনে ১৩ তলা বলে কোনো তলা নেই, বিমানে ১৩ নম্বর সারি নেই, এবং যে দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে ঈশ্বর সাত দিনে দুনিয়া বানিয়েছেন!
———–

জানুয়ারি ১৫
জুতা

বার্লিনে বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গকে হত্যা করা হয় ১৯১৯ সালের এই দিনে।
উপুর্যুপরি বন্দুকের আঘাতে থেতলে দিয়ে তাঁকে নর্দমায় ফেলে রাখা হয়। অত্যাচারের এক পর্যায়ে তাঁর পা থেকে একপাটি জুতা খসে পড়ে। কেউ একজন জুতাটি তুলতে চেয়েছিল কিন্তু তাঁর হাত থেকেও পড়ে যায় নর্দমায়, কাদায়।
রোজা সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন সেই পৃথিবীর জন্য- যেখানে স্বাধীনতার নামে বিচার বিপর্যস্ত হবে না, কিংবা বিচারের নামে স্বাধীনতা।
প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ এই শ্লোগান ব্যানারে-প্লাকার্ডে তুলে ধরেন, এবং অবধারিতভাবেই ‘জুতা’র মতো ধূলায় গড়ায়।
———–

জানুয়ারি ১৬
আইন-এ-সুরা

১৯২০ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ‘ভলস্টিড’ (মদ্য বিরোধী) আইন অনুমোদন করে। নিষিদ্ধকরণই যে প্রচারণার অন্যতম উপায় তা এই আইনের মাধ্যমে আবারো নিশ্চিত হল।
গোটা আমেরিকা শরাব শূন্য করার বিধিমালা প্রশংসার দাবী রাখে, যার কারণে নাটকীয়ভাবে অ্যালকোহল উৎপাদন ও বিপণন বেড়ে যায়! আর ‘আল কাপন’ তার অনুসারীদের নিয়ে যথেচ্ছা উপার্জন, ও নির্মমসব হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সুযোগ পায়!
১৯৩৩ সালে জেনারেল স্মেডলে বাটলার তিন তিনটা মহাদেশে সামরিক বীরত্ব দেখিয়ে দেশে ফেরেন। পুরস্কার হিসেবে পান সম্মানজনক ষোলটি সামরিক বেসামরিক পদক। এই জেনারেল সেদিন সগর্বে স্বীকার করেন- তার বাহিনীর সাফল্যের পেছনে আছে শিকাগোতে আল কাপনের দৃষ্টান্ত, বীরত্ব!
———–

জানুয়ারি ১৭
ঈশ্বরকে তিনি শাস্তি দিলেন

১৯১৮ সালে, বিপ্লবের উত্তাল সময়ে, মস্কোর এক আদালতে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। আনাতোলি লুনাচারস্কি সেই বিচারসভার প্রধান বিচারপতি।
আসামির কাঠগড়ায় চেয়ারে রাখা হয় এক কপি পবিত্র বাইবেল।
বিজ্ঞ প্রসিকিউটরের মতে, ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত, ঈশ্বর অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। তোপের মুখে আসামি পক্ষের উকিল যুক্তি দেখান, এই আদালতে দাঁড়ানোর মত মানসিক ভারসাম্য তাঁর মক্কেলের নেই। তাই…
কিন্তু মহামান্য আদালত শেষপর্যন্ত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
আজকের এই দিনে খুব ভোর বেলা, স্বর্গের দিকে তাক করে পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়!
———–

জানুয়ারি ১৮
পবিত্রতায় পানি

স্পেনে হলি ইনকুইজিশনের সময় যেসব স্পেনীয় নিয়মিত গোসল করতেন, তাঁদের মুসলমান হিসেবে সন্দেহ করা হত।
ইসলামে পানির গুরুত্ব মূলত মোহাম্মাদের পক্ষ থেকেই এসেছে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মরুভূমির বুকে তাঁর জন্ম, তৃষ্ণার দুনিয়ায় তিনি জলের ধারার ধর্ম প্রচার করেন।
তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর নির্দেশনা এই যে- পরম মুক্তির লক্ষ্যে দৈনিক পাঁচবার মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রার্থনা করতে হবে। আর প্রত্যেকবার প্রার্থনার আগে পানি দিয়ে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে।’
‘পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ’, তিনি বলতেন।
———–

জানুয়ারি ১৯
নতুন যুগের জন্ম হল

১৭৩৬ সালের এই দিনে জেমস ওয়াট জন্মগ্রহণ করেন। বলা হয়, যদিও তিনি প্রথম বাস্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন নি; তবু্ও নিজের সামান্য ওয়ার্কশপে বসে যন্ত্রটিকে অসামান্য নিপুণ আর কার্যক্ষম করেন।
ওয়াটের প্রতিভার স্বাক্ষর এই যন্ত্র পরবর্তীতে শিল্পবিপ্লবের জন্ম দেয়। বাস্পীয় ইঞ্জিনের হাত ধরে আসে নতুন নতুন সব দানবীয় যন্ত্র। আর আজন্ম কৃষিজীবী মানুষ পরিনত হয় উৎপাদক শ্রমিকে।
স্টিম ইঞ্জিনের রথে চড়ে তৎকালীন ‘বর্তমান’ নিমিষেই হয়ে যায় ‘ভবিষ্যত’, আর ‘অতীত’ হারিয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে।
———–

জানুয়ারি ২০
সর্প দেবতা

আজ- ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোতে – তৃতীয় আর্চবিশপ সম্মেলনের মাধ্যমে- চার্চের দেয়ালে, বেদীতে সাপের ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য স্থাপন নিষিদ্ধ হয়।
সর্পমূর্তি ঘাতক যাজকেরা লক্ষ্য করছিলেন যে, ভয় দেখানোর এইসব শয়তানি অনুষঙ্গ এখানে কোনো কাজেই আসছে না।
সাপের পারলৌকিক ভীতি রেড ইন্ডিয়ানদের একদমই নেই। আর প্যাগানরা তো দেবতা জ্ঞানে সর্প পূজা করে।
আদমকে প্রলুব্ধ করার ঘটনায়, বাইবেলের উপাখ্যান বরাবরই সাপের নিন্দামন্দ করে আসছে। কিন্তু আমেরিকা সাপের অভয়ারণ্য। বাইবেলের পাপী সাপ এখানে বৃষ্টি ও শস্যের প্রতীক। আর জলজ সাপের আদি নিবাস আকাশের উর্বরা মেঘ। পঙ্খিরাজ সাপ ‘কোয়াটজাকোটল’ তাঁদের অন্যতম দেবতা, জলের ঘূর্ণিতে চেপে যিনি স্বর্গে চলে যান।
———–

জানুয়ারি ২১
পদতলে জলের সিঁড়ি

১৭৭৯ সালে জীবনের শেষ অভিযানে, ইংরেজ অভিযাত্রী জেমস কুক হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলেন।
তিনি দেখলেন দুর্বোধ্য আর বিপদজনক বিনোদন হিসেবে ‘কেয়ালাকেকুয়া’-বাসীরা উত্তাল ঢেউয়ে চেপে জলের বুকে ছুটছে।
তাহলে, আমরা যাকে আজ ‘সার্ফিং’ বলি, তার প্রথম দর্শক কী জেমস কুক? হয়তো! আবার হয়তো এটা তাঁদের কাছে নিছক ‘সার্ফিং’-ই নয়, হতে পারে সমুদ্রজীবনের গভীরতর গোপন তাৎপর্য আছে এই ঢেউয়ের খেলায়।
দ্বীপের আদিবাসীদের দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীর সকল প্রাণের উৎস ‘পানি’ তাঁদের পবিত্রতম দেবতা। কিন্তু তাঁরা এই দেবতাকে হাঁটু গেঁড়ে প্রথামাফিক পূজা করতে পছন্দ করে না। দেবতার সাথে তাঁরা প্রাণের খেলায় মাতে – কল্লোলে কল্লোলে চকিতে চলিতে!
তিন সপ্তাহ পর এই ঢেউ-সওয়ারীরা জেমস কুক কে হত্যা করে।
মহানুভব এই অভিযাত্রী ইতোমধ্যে ব্রিটিশ রাজকে উপহার দেন বৃহৎ ‘অস্ট্রেলিয়া’; কিন্তু হায়! তাঁকে এবার উপহারশূন্য রিক্ত নিস্প্রাণ ফিরতে হয় এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে – চিরতরে!
———–

জানুয়ারি ২২
পলায়নপর সাম্রাজ্য

১৮০৮ সালে জানুয়ারির এই দিনে, বিপর্যস্ত রাজকীয় পুর্তগীজ নৌবহর ব্রাজিলের উপকূলে এসে পৌঁছে- খাদ্যপানীয়শূন্য ক্লান্ত। লিসবন থেকে ছেড়ে আসার পর দীর্ঘ দুইমাস কেটে গেছে সমুদ্রে সমুদ্রে।
পুরো ইউরোপ তখন তছনছ করে দিচ্ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।সীমান্তে তাঁর আক্রমণের রুদ্রমূর্তি দেখে পুর্তগীজ রাজদরবার স্থানান্তরে ছুটলো, দূর ক্রান্তীয় উপনিবেশে।
মহারানী মারিয়া রাজকীয় এই যাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন; তাঁর পেছনে চলছেন রাজ্যের যত যুবরাজ, ব্যারোন, ডিউক, অভিজাত, ঊন-অভিজাত, শাসক, উপশাসক ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রত্যেকই তাঁরা বাহারি পরচুলা আর মহার্ঘ সাজপোশাকে আপাদমস্তক আবৃত। এইসব সাজপোশাক পরে ‘রিও ডি জেনেরিও’ কার্নিভালের একান্ত নিজস্ব সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়!
রাজকীয় লটবহর ত্রস্ত চলতে গিয়ে পায়ে-পায়ে হোঁচট খাচ্ছে; হোঁচট খাচ্ছে পাদ্রী মশাই, সেনানায়ক, রাজকর্মচারী, দর্জিবাবু, ডাক্তার সাহেব, বিচারপতি, নাপিত, কেরানি, মুচি, মালি.. কে নয়!
এই অবস্থায় রানী মারিয়া স্বভাবতই তাঁর রাজকীয় মেজাজে নেই, এইসব অদ্ভূতুরে মানুষের ভিড়ে রানীর কন্ঠে একমাত্র রাজকীয় স্বর, ‘ এতো দ্রুত চলছো কেন? আমরা কী পালিয়ে যাচ্ছি?’
———–

জানুয়ারি ২৩
সভ্যতার মাতৃদেবী

১৯০১ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার ইন্তেকালের পর, লন্ডনে এক মহা আড়ম্বরপূর্ণ শোক শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
এমন আয়োজন সম্পন্ন করা চাট্টিখানি কথা নয়!
যাঁর নামে ইতিহাসে একটা যুগের নামকরণ হয়েছে, তাঁর বিদায়যাত্রা তো যেনতেন রকম হতে পারে না!
সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর স্বামীর শোকযাপনের জন্যে তিনি কালো পোশাক পড়েছেন, তাঁকে তাই নারীর সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলির সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তিও বলা হয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক ও বিংশ শতাব্দীর মহীয়সী নারী ‘ভিক্টোরিয়া’ নিজের দেশকে শিখিয়েছেন আদবকেতা আর ‘চিন’কে ধরিয়েছেন আফিম।
তাঁর সাম্রাজ্যের পাঠশালায় যে-বই সুরীতি সুসমাচার শিক্ষা দিত, তা ছিল অবশ্যপাঠ্য নন্দিত।
লেডি গগের ১৮৬৩ সালের বই ‘বুক অব এটিকেট’ সেই সময়ে তেমনি কিছু সুসমাচার শিক্ষা দিত। উদাহরণ হিসেবে – “লাইব্রেরীর বইয়ের তাকে পাশাপাশি ‘লেখক’ ও ‘লেখিকা’র বই রাখার বেহায়াপনা সহ্য করা হবে না। যেসব লেখক লেখিকা আইনানুগ স্বামীস্ত্রী – যেমন রবার্ট ব্রাউনিং ও এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং – কেবল তাঁদের বই-ই পাশাপাশি রাখা যেতে পারে।”
———–

জানুয়ারি ২৪
সভ্যতার পিতৃদেব

১৯৬৫ সালের এই দিনে উইনস্টন চার্চিল মৃত্যুবরণ করেন।
১৯১৯ সালে ব্রিটিশ এয়ার কাউন্সিলে সভাপতিত্বকালে, তিনি তাঁর যুদ্ধকলা বিদ্যার বহুলব্যবহৃত ‘শিক্ষা’ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।
‘গ্যাস ব্যবহার করে মানুষকে শুধু যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আমার বিবেচনায় এইসব অসভ্যদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত-গ্যাস ব্যবহারই উৎকৃষ্ট পন্থা । এতে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়.. আর মোক্ষম ত্রাসও সৃষ্টি করা যায়।’
এবং ১৯৩৭ সালে, প্যালেস্টাইন রয়েল কমিশনে বক্তৃতায়, মানবতার ইতিহাসে বহুশ্রুত তাঁর বিখ্যাত বয়ান পেশ করেন, ‘ আমি মনে করি না আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ার কালো মানুষদের প্রতি খুব বেশি অন্যায় করা হয়েছে… বস্তুত, একটি উন্নততর ও শক্তিশালী জাতি ওদের দখল নিয়েছে।’
———–

জানুয়ারি ২৫
ধাপ্পাবাজির অধিকার

নিকারাগুয়ার মানুষ জানুয়ারির এই সময় হাসিঠাট্টা রঙ্গতামাসার মধ্যে দিয়ে ‘গুয়েগুয়েনসে’ উদযাপন করে। উৎসবের এই দিনে রাস্তাঘাট ময়দান স্টেশন পরিনত হয় বাহারি এক রঙ্গমঞ্চে। আমুদে দুষ্টুর দল মজার মজার গপ্পো বলে, গীত গেয়ে, নাচের নানা মুদ্রা দেখিয়ে, অদ্ভূতুরে সব সঙ সেজে সুপ্ত শিল্প-প্রতিভার প্রকাশ ঘটায়।
‘গুয়েগুয়েনসে’ উত্তর আমেরিকার পথনাটকের আদিপুরুষ।
উপনিবেশিক শাসনের শুরুতে তিনি ধাপ্পাবাজির রঙ্গভরা এই মন্ত্র শেখাতে ভালোবাসতেন- ‘তুমি যদি কষে মার লাগাতে না পার তো বেঁধে ফেল আর বাঁধতে না পারলে বন্দী কর।’
শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে ‘গুয়েগুয়েনসে’ তার বাক্যের ভেল্কি দেখিয়ে আসছে। তার বোকাস্য বোকা আর মিচকে শয়তানি ভরা বাগড়াম্বর বাক্যের ভান্ড দেখে, ঈর্ষায় জ্বলে মরে নচ্ছার-পাজি-গোঁয়ার ‘শয়তান’।
———–

জানুয়ারি ২৬
বলিভিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা

২০০৯ সালের এই দিনে, ইভো মোরালেসের নতুন সংবিধান সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।
অনন্য এই দিনের পূর্বে, বলিভিয়ান রেড ইন্ডিয়ানদের ভূমির কোনো অধিকার ছিল না; তাঁরা ছিল নিজভূমে নিঃস্ব মজুর, অনিকেত, অসহায়।
১৮২৫ সালের প্রথম সংবিধানে মাত্র তিন/চার শতাংশ মানুষ নাগরিকত্বের সুবিধা পায়। বাকিরা আদিবাসী, নারী, বিত্তহীন, ও মূর্খ আমজনতা – কোনো দলে ওদের জায়গা নেই – ভোটাধিকার নেই।
বহু বিদেশি সাংবাদিকের মতে, ‘বলিভিয়া শাসন করা দুঃসাধ্য অকল্পনীয়। উন্মাদ ছাড়া কে পারে এ-দেশ শাসন করতে!’। বলিভিয়া তাঁদের কাছে অন্ধকার জগতের নাম। আর কেনই-বা হবে না, যেখানে গতকাল পর্যন্ত এ-দেশ নিজেই ছিল অন্ধ বিবেকহীন বর্বর ।
———–

জানুয়ারি ২৭
শুনি পৃথিবীর ভাষা

১৭৫৬ সালের এই দিনে ভোল‌ফগ্যাং‌ আমাডেয়ুস মোৎসার্ট জন্মগ্রহণ করেন।
শতশত বছর পর মানুষ আজও তাঁর সুরে বিভোর আত্মহারা; অন্তহীন বিস্ময় নিয়ে তাঁরা ভালোবাসে এই সঙ্গীত – এই অপার্থিব সুধা।
মোৎসার্ট শুনলে নিমিষেই কান্না ভুলে নিশ্চুপ ঘুমিয়ে পড়ে অবুঝ শিশুটিও – দেশে দেশে কালে কালে।
নবাগত শিশুকে সুরে সুরে স্বাগত জানিয়ে মোৎসার্ট বলে, ‘ এই হল তোমার নতুন ভুবন, আর এ-সঙ্গীত এ-ভুবনেরই আপন ভাষা।’
———–

জানুয়ারি ২৮
মনের জানালা খুলে

ছাপাখানা আবিষ্কারের বহু আগে শার্লামেন নকলনবিশদের বিরাট এক সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, ‘আচেঁ’তে যাঁরা ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার উপহার দেন।
শার্লামেন বিদ্যা প্রসারের জন্য কী-না করেছেন!
কিন্তু নিজে তিনি পড়ালেখা জানতেন না।
৮১৪ সালের এই দিনে তিনি মারা যান।
সেদিনও তিনি নিরক্ষর।
———–

জানুয়ারি ২৯
স্বল্পবাক সর্ববাক

আজ।
১৯৬০ সাল।
আন্তন চেখভের জন্ম।
মনে হয় তাঁর লেখায় কথা নেই।
কথা ছাড়া লেখা নেই।
তিনি চেখভ।
গুরু।
———–

জানুয়ারি ৩০
ক্ষমতার উৎক্ষেপণ

১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির সর্বেসর্বা কত্তা হয়ে ওঠেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশাল জনসমুদ্রে এই প্রভুর মোলায়েম তর্জনগর্জন –
‘আজ আমি এক নতুন যুগের, সোনালী স্বপ্নের সেই সত্যযুগের প্রতিষ্ঠা করলাম;
ভায়েরা আমার, তোমরা আজ জাগ্রত হও, জাগো, জার্মানি জাগো – আর্যজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এখনই নিদ্রাভঙ্গ কর – জাগ্রত হও – দেশের জন্য যুদ্ধ কর – জাগো – জাগতে হবে’
এর প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে আগুনে ফানুসে চার্চে মন্দিরে গানে কেত্তনে বাজতে থাকে – বাজতে থাকে।
আর জার্মানি জাগতে থাকে নাৎসিবাহিনী জাগতে থাকে। জেগে উঠে ভুলে যায় মাত্র পাঁচবছর আগে গোহারা হেরেছিল নাৎসি দল, পেয়েছিল মহার্ঘ তিন শতাংশ ভোট!
রাজনীতিতে হিটলারের এই অলিম্পিক উল্লম্ফন সত্যিই দেখার মতো। হিটলার যতো উঠছে, জার্মানির আয় কর্মসংস্থান মুদ্রামূল্য ততই নামছে। নামতে নামতে একদম তলানিতে যখন দেশের অর্থনীতি পুঁজিপাতি, তখন বেহাল বেহেড সরকার লেলিয়ে দেয় অশুভ শক্তি ‘গেস্টাপো’। এ অদৃশ্য শক্তি তাড়া করে ফেরে, গুম করে ফেলে ইহুদি কমিউনিস্ট সমকামী যাযাবর দূর্বল আর যাঁরা চিন্তা করে, তাঁদের।
———–

জানুয়ারি ৩১
হাওয়ায় হাওয়ায়

আজ আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি সুরকার ‘আতাওয়ালপা শুপানকি’ জন্মগ্রহণ করেন।
গিটার ঘোড়া আর তিনি – জীবনে তাঁরা তিনজন।
আর হ্যা, সুরেলা বাতাস ধরলে চারজন।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top