গ্রন্থালোচনা ।। ‘ঐনা আষাঢ়ের পানি বইছে শতধারে’ ।। মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম

‘ঐনা আষাঢ়ের পানি বইছে শতধারে’:
নিত্য যে নদী বহে বাঙলার শ্যামলপ্রান্তরে মাঠ-ঘাট তেপান্তর পেরিয়ে অনাদিকালের পুরাণ থেকে পৌরজীবনের তটে তটে, সে-নদী আশীর্বাদের সে-নদী অভিশাপের। চির বহমান সেই নদী আমাদের সংগ্রামের আমাদের বিজয়ের চিরন্তন রূপক। অভিশাপ মারী-মড়ক বন্যা-প্লাবনের বিরুদ্ধে দর্পিত বিজয়ের একনিষ্ঠ মানবিক সাফল্যের স্বারক এই নদী। যুগে যুগে কালে কালে ঘর ভেঙেছে নদী, বাস্তুহারা অনিকেত করেছে, অসহায় দিশেহারা করেছে তবু পরাজিত করে নি, দমাতে পারে নি অদম্য মানুষকে । বিপরীতে নদী দিয়েছেও প্রচুর – শস্য সভ্যতা নৌকা-বিলাস বৃন্দাবন অফুরান জীবন আর অনিঃশেষ মনীষা।

‘আষাঢ় মাসেতে নদীর কুলে কুলে পানি’:
আকিমুন রহমান নদীর রূপকে মানুষের সেই সংগ্রামের কথা বিজয়ের কথা বলেছেন অভিনব শৈল্পিক সুষমায়। জীবনকে তুলে এনেছেন বাঙলার চিরায়ত মহুয়া-মলুয়ার লৌকিক আখ্যান থেকে বর্তমানে। দেখিয়েছেন মানুষের নিদারুণ অসহায়ত্ব প্রকৃতির হাতে, আধিব্যাধি মড়কের হাতে। এখানে পুরাণ-প্রাচীন-বিজ্ঞান-বর্তমান সমান অসহায় সমান নিরুপায়। তবু মানুষই জিতে যায়। জয়ী হয় মানবিক হৃদ্যতা।
আষাঢ়-শ্রাবনের ভরা নদীতে বর্তমান ভেসে যায় দূর অতীতে যেখানে আজ – “শাওন মাইস্যা রাইত! আসমানে মেঘের ডাকাডাকির কোনো কমাকমতি নাই! একেকটা বিজলি আতকা আতকা খাজলা দিয়া দিয়া ওঠে; আর তার এট্টু বাদেই দুনিয়ারে কাঁপাইয়া-লড়াইয়া আসমানের দেওয়ায় গর্জানী দেয়! তার অল্প পরেই কিনা তেজী ঢল নামতে শুরু করে! এই এক ছোলা ঢল নামা শেষ হয়, অমনেই বিজলির চিলকানি আর দেওয়ার দমগমানি নাইম্মা আহে! হেইরবাদে আবার ঝমঝমাইয়া-চলবলাইয়া ঢল নামা শুরু করে। এমনই চলতাছে, চলতাছেই!”
এমন ভরা বর্ষার নদীতে ভেসে চলে অসহায় এক নারী – মৃতপ্রায় । আর কুলের কুঁড়েঘরে নির্জনে রাতজাগে অন্য এক নারী আর তার সঙ্গী – যুগল অসহায় – বিকলাঙ্গ দম্পতি – বুচি বিবি পচা মিয়া। পরাবাস্তব শেয়াল তাদের ডেকে আনে নদীর কিনারে নারীকে বাঁচাতে। ” হোনো গো মনিষ্যি! জলদি কইরা গাঙের ধারে আহো! অক্ষণ আহো! অরে মনিষ্যি! জলে দেহো আদম সন্তান ভাইস্যা যায়! আহো আহো! ত্বরা কইরা আহো! হের দম আর বেশি খোন নাই! তোলো হেরে! অরে মনিষ্যি!”

নদীর কুলে এসে তারা বলে, ” অই দেহো, তারে পিঠে নিয়া এক কুম্ভীরে ভাইস্যা যায়! অরে কুম্ভীর! অরে জলের সন্তান! মাটির কন্যারে মাটির ঘাটে নামান্তি দেও! তারে এই ঘাটে সোপর্দ কইরা দেও রে!”
মাটির কন্যা নিরাপদে মাটির ঘাটে ফিরে আসে।

‘কেবা তোমার মাতা কইন্যা কেবা তোমার পিতা’:
জলে-ভাসা কন্যা সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু বিস্মরণ তাকে পেয়ে বসে। কিছুই মনে আসে না তার, কিছুই মনে পড়ে না – অতীত স্মৃতি বা জীবন। তার কথায় ,” নো পাস্ট লাইফ টু লুক ব্যাক এ্যাট, নাথিং টু রিমেমবার! আমার পেছনে কিছু নেই! কিচ্ছু ছিলো না যেনো কখনো! কোনো ফ্যামিলি! যেনো সেটা ছিলো না কোনোদিন! বাবা অথবা মা! বা সিবলিংস! বা অন্য কেউ! প্রেমিক বা স্পাউস! যেনো কোনোজন ছিলো না! অ্যাজ ইফ আই হ্যাভনট হ্যাড আ লাইফ বিফোর দিস! যেনো কিচ্ছু নেই আমার! অ্যান্ড আই ফিল ডিসগ্যাসটেড! ইট ফিলস আনবেয়ারেবলি সফোকেটিং! ওহ!”

‘সন্ধ্যাবেলা অতিথ আইল ভিন্ন দেশে বাড়ী’:
ভেসে আসা তরুণী এই নারীকে টুন্ডা টেমরা দম্পতি ঠিক বুঝতে পারে না, বুঝতে পারে না তার ভাষা ভাবভঙ্গি। কিন্তু মানবিক দরদে ঠিকই কাছে টানে – যেন কত জনমের সুহৃদ। –

“এইমত আমরা এই কন্যারে পাইলাম! গহন কালা ঢলের রাইতে, ঠাটার আওয়াজের তলে আর বিজলি-ঝিলিকের ঘেরের ভিতরে যহন পুরা দুনিয়া! তেমন কালে নিকি দয়ালে, আমাগো হস্তে সইপ্পা দিলো, এই আমানত! যাগো নিজেগো দেহেরই কোনো ঠিকঠিকুন্তী নাই! বেঙ্কা-তেরা, অবলা-লুলা আমরা দুই জোন! এমুন দোনোজোনের আর কট্টুক খ্যামতা আছে! কট্টুক সাধ্যি আছে! হেরা আরেকটা জানেরে রক্ষা দেওনের কে! তয় মালিকের ইচ্ছার উপরে আর কতা কী! বান্দাগো তো কিছুই কওনের নাই!
তাইলে আইচ্ছা! নিলাম আমরা এই কন্যার ভার!”

‘কি কর কি কর কইন্যা কি কর বসিয়া’:
‘কইন্যার’ ভার নিয়ে দেখে কন্যার কিছুতেই মন নেই, মনোযোগ নেই। ঠায় বসে থাকে নদীর ধারে, অপলক তাকিয়ে দেখে নদীর জল, নদীর ঢেউ আর খুঁজে বেড়ায় নিজের পরিচয়, সত্তা। পচা-বুচি দম্পতি বুঝে উঠতে পারে না তাকে, বোঝে না তার ভাবগতিক। তাই নদীর শরণ নিতে বলে তাকে। নদীই বলে দেবে জন্ম-ইতিহাস, খুলে দেবে জীবনের খেরোখাতাঃ –
“তারপর স্লোলি, গ্রাজুয়েলি কী যে হতে থাকে! এই নদীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কী যে হতে থাকে আমার! আনবিলিভেবল! অ্যান্ড আই কান্ট এক্সপ্লেইন! বাট ইট হ্যাপেনড! সে যেনো সত্যিই অনেক অনেক কিছু বলে যেতে চাচ্ছে! লটস অফ থিংস আর দেয়ার! শী লাভস টু শেয়ার উইথ মী!”

‘দারুণ আকাল্যা জ্বর হাড়ে লাগ্যা আছে’:
নদী তাঁর কাছে সব শেয়ার করে সব খুলে বলে – কেন সে আজ এই প্রত্যন্ত বিরান জনশূন্য প্রান্তরে – কেন সে অসহায় দিন গুনছে একা একা এই নদীর ধারে। নদী তাঁকে মনে করিয়ে দেয় দুনিয়াজোড়া এক ‘আকাল্যা’ জ্বরের কথা – ভয়াবহ মাড়ির কথা! –
” ওহ গড! লুক লুক! দ্যাটস অ্যান এ্যাপিডেমিক! ওহ! অল হেল হ্যাজ ব্রোকেন লুজ! জ্বরে পুড়তে পুড়তে, শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে সমস্ত দেশের লোকে মরছে! নিজ অ্যাপার্টমেন্টের লিফটের মুখে পড়ে মরছে! সিঁড়িতে থুবড়ে পড়ে মরছে! অ্যাম্বুলেন্সে যেতে যেতে মরছে! হাসপাতালের বেডে শুয়ে মরছে! রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে মরছে! এবং রুমের ভেতরে নিজের বেডে শুয়ে শুয়ে তো মরছেই!”

নিজের ঘরেই সে মরতে বসেছিল দেশজুড়ে মানুষের মতো, বিশ্বজুড়ে মানবের মতো নিরুপায়! কিন্তু নদীই তাঁকে ভাসিয়ে আনল এই অজানায় এই অতীতে। এখানে এসেও দেখে ‘ওলা বিবি’ আর ‘মা শীতলা’ তাদের স্বরূপ দেখিয়ে গেছে সদ্যই। তল্লাটে শুধু পচা-বুচি বেঁচে আছে অপূর্ণাঙ্গ বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে। নদীতে নৌকা নেই, গ্রামে মানুষ নেই, জেলে পাড়া বিরান প্রান্তর – শূন্য। বাঙলার বুকে ধূধূ মরুভূমি, রিক্ত হাহাকার!

‘না দিব না দিব পরাণ আরও দেখি শুনি’:
বন্যা-প্লাবন দুর্যোগের মতো আধিব্যাধি মাড়ি-মানুষকে নাজেহাল পর্যদুস্ত করে যায় কালে কালে দেশে দেশে। তবু মানুষ হেরে যাওয়ার পাত্র নয়, দমে যাওয়ার সৃষ্টি নয়। হারতে হারতে সে উঠে দাঁড়ায়, মোকাবেলা করে দুর্যোগের দুঃসময়ের! আর বেঁচে ওঠে দৃঢ়প্রত্যয়ে, হেসে ওঠে জীবনের অনাবিল আনন্দে। অন্তহীন প্রতিকূলতা কাটিয়ে হেসে ওঠার এই চ্ছল চ্ছল ধ্বনি নিয়ে নিরবধি বয়ে চলে যে নদী, তারই ছবি এঁকেছেন আকিমুন রহমান তাঁর নিপুণ শিল্পীর তুলিতে।

‘সাক্ষী হও চন্দ্র সূর্য্য সাক্ষী হওরে তারা’:
‘নিত্য যে নদী বহে’, তা-তে অবগাহন করে স্নাত ও আপ্লুত হবে পাঠক! খরস্রোতা পাহাড়ি নদী এ নয়, এ একান্তই বাঙলার দুকূলপ্লাবী নিরন্তর বহমান জলধারা – উপলখণ্ডের বাধায় এর গতি দ্বিধাগ্রস্ত নয়, কিংবা শীর্ণধারায় শুধু অস্তিত্বই বয়ে চলা নয়। দিগন্তপ্লাবী অমেয় জলের স্নিগ্ধধারায় বহে এ নদী। অন্তহীন দরদে বুকে বয়ে বেড়ায় উর্বরা মানবিক পলি; ইতিহাসের ঐতিহ্যের মানুষের সমাজের স্বপ্নের সংগ্রামের অশেষ ফসলের প্রাণশক্তি এই পলি।
ভীষণ দূষণের নর্দমার এই জনপদে স্বচ্ছতোয়া জল আর আন্তরিক দরদের পাললিল উৎসার সত্যিই বিস্মিত করে।ভাষাভঙ্গির এমন নিপুণ অন্তর্ভেদী শিল্প আর চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশের মায়াবী আলোর যুগপৎ উপস্থাপন পাঠককে বিমোহিত করে।
রাশিরাশি নর্দমা আর খালের এই সাহিত্য-জগতে, আকিমুন রহমান দিগন্তবিস্তৃত বহমান মেঘনা – অবগাহনের জলবতী ধারা!

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top