রামমোহনের প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি আমাদের দেশে ধর্মসংস্কার, সমাজহিত ও ব্যক্তিমানুষের উত্তরণ-প্রয়াসের সঙ্গে জড়িত। দুশো বছর আগে আমাদের এই সংস্কারবদ্ধ, অশিক্ষিত, অন্ধকার দেশে তিনি নবচেতনার দিশা আমাদের সামনে রেখেছিলেন। তাঁর জ্ঞান-কর্ম-ভক্তিসমন্বয়বাদের আদর্শ থেকে আরও কয়েকজন আলোকপিপাসু সহযাত্রীর সংযোগে বাংলায় গড়ে উঠেছিল ব্রাহ্ম ধর্মান্দোলন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল আসলে ব্যক্তির নৈতিক উন্নতি এবং সমাজের সামুহিক উন্নতি। ঈশ্বর উপাসনার এবং ঈশ্বর-ধারণার ব্যাপারে এই আলোকপিপাসু মানুষগুলির কিছু নতুন ভাবনা ছিল। ইসলামী ও খ্রিস্টীয় আদলে অমূর্ত ব্রহ্মোপসনার কিছু পদ্ধতি-প্রকরণ, উপাসনাগৃহের প্রতিষ্ঠা এবং নবব্রতী একদল উপাসক সম্প্রদায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, আচারের ছুৎমার্গ এবং বহু রকম দেবদেবী উপাসনার অযৌক্তিক জটিলতাকে পরিহার করে নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্মধারণার তিনি অন্যতম একজন প্রবক্তা। এ ব্যাপারে তাঁর সামনে প্রশস্ত ছিল আমাদের চিরায়ত ভক্তিবাদের ধারা। সে জন্য ব্রহ্মোপসনার পদ্ধতি হিসেবে ধ্যান ও মন্ত্রের পাশাপাশি গানের একটা ভূমিকা ছিল। রামমোহন ও তাঁর অনুবর্তীরা তাঁদের সাধনার অঙ্গ হিসাবে উপাসনাগৃহে, ব্যক্তিগতভাবে এবং নগরসংকীর্তনের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মসংগীত প্রচলন করেন। ব্রাহ্মদের উপাসনার মূল বিষয় ছিল উপাস্য ব্রহ্মের প্রতি অটল ভক্তি ও বিশ্বাস এবং সেই ভক্তি-বিশ্বাস ফুটে উঠেছিল গানে। ব্রাহ্মসঙ্গীত, সেই দিক থেকে বিচার করলে ব্রাহ্মসাধনার নানা স্তর ও অনুভব-উপলব্ধির প্রতীক।
অমূর্ত ব্রাহ্মসাধনার আরাধনা-সংগীতকে বলা যায় ব্রাহ্মসংগীত। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে এমনতর বিশেষ ধর্মান্দোলনের সূত্রে এই গানগুলি গড়ে উঠেছিল। এতে উপাস্যের রূপের বর্ণনা নেই, বরং তার মহিমাই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাই ব্রাহ্মসংগীতকে কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধনসংগীত বলা যায় না। কারণ ঈশ্বরের মহিমার গান সব রকম ভক্তিপথেরই তো মূল কথা। তবে উদ্ভব মুহূর্তে এবং বিকাশের পর্বে ব্রাহ্মসংগীত বাংলা গানের ক্ষেত্রে একটা খুব বড় পর্বাস্তরের সূচনা করেছিল। আঠারো শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দু-তিন দশকে বাংলা গানে সে বিষয়গত লঘুতা, নিন্মরুচি এবং সামাজিক তামসিকতার প্রতিফলন ছিল ব্রাহ্মসংগীত সেখানে গানের একটি উচ্চমান প্রতিষ্ঠা করেছিল দুদিক দিয়ে। প্রথমত গানের ভাবগত গাম্ভীর্য, সাত্ত্বিক দ্যোতনা ও শব্দবদ্ধের তৎসম প্রয়োগ এবং দ্বিতীয়ত, সুর ও স্বর প্রয়োগে, তালে-শুদ্ধতা, গভীরতা ও সূক্ষ্ণ সৃজনশীলতার প্রয়োগ। ব্রাহ্মসংগীত উদ্ভবের ঠিক আগে আমাদের দেশে কবিগান, আখড়াই গান ও টপ্পা গানের প্রণয় প্রসঙ্গ কিছুটা লঘু স্বভাবের স্রষ্টা ও শ্রোতার ইতিহাস বহন করছে। গানের বেশিরভাগটাই তখন ছিল বিনোদন এবং সেই কারণেই তখন তাতে লেগেছিল নানারকম রসবিকৃতির পীড়া। একদিকে ভদ্রতর সমাজের এই বিকৃত রুচির চাপ, আর-একদিকে পশ্চিমী কালোয়ারদের তানের দাপটে বাংলা গান ছিল দ্রস্ত ও বিভ্রান্ত। ভদ্রতর সমাজের রুচিহীনতা এবং ওস্তাদদের কালোয়াতি বাংলা গানের পরিবেশকে কী অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় সংগীতবিদ অমিয়নাথ সান্যালের একটি রচনায়। তিনি লিখেছেন:
যেহেতু টপ্পা গান ও যাত্রা প্যাঁচালি প্রভৃতি গানের মধ্যে প্রেম প্রণয় মিলন বিরহ ইত্যাদি ভাবের কথা ও উদ্দীপনা আছে অতএব এগুলি অশ্লীল, এরূপ মনে করে কলিকাতার শিক্ষিত সমাজের একদল গান-বাজনার উপর নিষেধ প্রচার করে ফেলেছিলেন। শিক্ষিত ব্যক্তি ডুগি-তবলা দেখে চমকে উঠে সরে যেতেন …. ফলে গান-বাজনার চর্চার ভার পড়ল অশিক্ষিত ব্যক্তির উপর। এই কারণে শিক্ষা-প্রধান শহরগুলিতে গান-বাজনার তথা বাংলা গানের উৎকর্ষ নিরুদ্ধ হয়েছিল। ….. এ রকম উৎকৃষ্ট অবসরে, অর্থাৎ নিরালম্ব অবস্থায় ….. সঙ্গীতপিপাসু বহু ব্যক্তি – পশ্চিমা ঢ়ঙে হিন্দি বা ফারসি ভাষার গানের প্রতি লুব্ধ হয়ে চর্চা আরম্ভ করে। ফলে, যাঁরা বাস্তবিক শিক্ষিত ব্যক্তি গান-বাজনা সম্বন্ধে তাঁরা কিছু বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। … এই অবসরে একদল শিক্ষিত সঙ্গীতামোদী ব্যক্তিপ্রচার আরম্ভ করলেন যে–নামব্রাহ্ম প্রভৃতি যাবতীয় সূক্ষ্ণ ব্যাপার একমাত্র হিন্দি গানে ও তাম্বুরার মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে। অতএব একমাত্র পশ্চিমা গানই চতুর্বর্গের চাবিকাঠি সমর্পণ করতে পারে-বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গ সংগীত হতে পারে না।
ব্রহ্মসঙ্গীত এই পটভূমিকায় উদ্ভূত হয়ে বাংলা গানে একটা বহতা ধারা তৈরি করে। গানকে নিছক বিনোদনের পর্যায়ে থেকে তুলে সৃষ্টির পর্যায়ে উত্তরণের প্রয়াস ছিল এই গানে। আর একটা জিনিস দেখা যায় যে, ব্রাহ্মসঙ্গীত তার সূচনাকালের আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে ক্রমেই ভাবের দিক থেকে সাবলীল হয়ে উঠেছে। ধ্রুপদী মার্গসংগীতের কাঠামো ও রাগরাগিনীর ছকের পাশাপাশি বাংলার বাউল ও কীর্তনের আঙ্গিকও ব্রাহ্মসঙ্গীতে আরোপিত হয়েছে।
ব্রাহ্মসঙ্গীতের সূচনা করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৫ সালে তিনি ‘আত্মীয় সভা’ নামে একটি সমাবেশের প্রবর্তন করেন এবং সেখানে গায়করূপে যোগ দেন রামমোহনের শিক্ষক কালী মির্জা। ব্রাহ্মসঙ্গীতের সূচনা প্রকৃতপক্ষে এই আত্মীয় সভায়। কারণ তখনও ব্রাহ্মসভা বা ব্রাহ্মমন্দির কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার প্রতিষ্ঠা হল ১৮২৫ সালে এবং সেই সময় থেকেই ব্রাহ্মোসনায় সংগীতকে প্রাধান্য দেওয়া হল। এ ব্যাপারে রামমোহন নিজেই হলেন পথিকৃত এবং রচনা করলেন বেশ কিছু ব্রাহ্মসংগীত। নিরাকার ঈশ্বরকে নিয়ে ভক্তিমূলক কোনও গান রচনার ধারা বাংলা গানে আগে ছিল না। উপাস্যকে নিয়ে সরল-সহজ লিরিক রচনা শেকালে সম্ভব ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল আরও অন্তত এক যুগের গান রচনার ধারা ও অনেক গীতিকারের সংযোগ। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ-ব্রাহ্মসংগীত বিবর্তনের ইতিহাসে এই দুই ব্যক্তি দুই মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জাত গীতিকার এবং তাঁর ছিল সুদীর্ঘ সাংগীতিক ঐতিহ্য। গান রচনায় তাঁর অনায়াস সাবলীলতা তাই রামমোহনের ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। কিন্তু রামমোহনের রচিত গানের বাণী এবং রাগরূপের সাংগীতিক বিন্যাসে পরিণতবোধ ও সৃষ্টিপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। সে সময় রামমোহন গান রচনা শুরু করেন, উনিশ শতকের সেই সূচনাকালে, বাংলা গানের বাণী যথেষ্ট শীতল ও কবিত্বপূর্ণ হওয়ার অবকাশ ছিল না। অন্যদিকে বাংলার ধর্মসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর-ধারণার বিপরীত-সাকারের বদলে নিরাকার-দৈত্যের বদলে অদ্বৈত ধারণা নিয়ে তাঁকে গান লিখতে হয়েছিল, যা তত্ত্ব হিসাবে অভিনব ও বিষয় হিসাবে জটিল। ব্যাপারটি সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা ব্যবহার করতে পারি তাঁর একটি গান, যথা:
ভয় করিলে যাঁরে
না থাকে অন্যের ভয়
যাঁহাতে করি প্রীতি
জগতের প্রিয় হয়।
জড়মাত্র ছিলে, জ্ঞান যে দিল তোমায়-
সকল ইন্দ্রিয় দিল তোমার সহায়।
কিন্তু তুমি তোলো তাঁরে
এতো ভালো নয়।
গানের এমনতর বিষয় ও তথ্য বাঙালি শ্রোতা আগে কখনও শোনেনি। এর বিষয়গত তত্ত্বময়তা ও চিন্তার গভীরতা প্রকাশের জন্য রামমোহন বেছে নিয়েছিলেন প্রধানত ভারী চালের ধ্রুপদ। এ-জাতীয় গান পূজাব্যাধি থেকে বিশ্বাসী ও নিষ্ঠাবান দীক্ষিত গায়কের কন্ঠে উদ্গীত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত দীক্ষিত শ্রোতাদের বিশ্বাসী হৃদয়ের গভীরে। এমন গান হাটে-মাঠে-বাজারে বা খেয়ানৌকার মাঝির গলায় জনপ্রিয় হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু এ গান অন্যের মনে যেমন জাগিয়ে দিত বিশ্বাস ও ভক্তি তেমনই নতুন নতুন গীতিকারের মনে জাগিয়ে দিত গান রচনার সাহস ও প্রেরণা। বাংলার ব্রাহ্মসংগীতের চলমান ইতিহাসে পরবর্তী প্রজন্মের যত পদাতিক নির্ভীকভাবে পদক্ষেপ করেছেন তাঁদের প্রাথমিক উৎস রামমোহনের গান। কথাটি ভালোভাবে বোঝার জন্য রামমোহনের আর একটি গান এই প্রসঙ্গে আমরা দেখব:
ভাব সেই একে
জলে স্থলে শূন্যে যে সমানভাবে থাকে
যে রচিল এ সংসার
আদি অস্ত নাহি যার
সে জানে সকল, কেহ নাহি জানে তাকে
খুব সহজভাবে দেখলে বোঝা যায় রামমোহনের এই গানে যতটা তত্ত¡ আছে ততটা কবিত্ব নেই। কিন্তু গানের মধ্যে ভাবনার প্রাঞ্জল অভিব্যক্তি এবং উপাস্য সম্পর্কে চিন্তার স্পষ্টতা এই গানে একটা অন্য সৌন্দর্য এনেছে। এই গানের পাশে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর’ গানটিকে রেখে আলাদা করে শুনলে বোঝা যায় ব্রাহ্মসংগীত পেরিয়ে এসেছে উচ্চবচ কত অনুভবের স্তর ও প্রকাশভঙ্গির অনন্যতা।
রামমোহন দীর্ঘদিন মার্গসঙ্গীতের চর্চা করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কৃষ্ণানন্দ ব্যাসদেবের ‘সংগীতরাগকল্পদ্রুম’ গীতি-সংকলনে রামমোহনের গানগুলি আমরা দেখতে পাই। অনেকে মনে করেন যে, রামমোহনের গান বুঝি সবই ধ্রুপদাঙ্গ। কিন্তু গানগুলি সমীক্ষা করলে দেখা যায়, তাতে ধ্রুপদের সুনির্দিষ্ট চারতুক (স্থায়ী-অন্তরা সঞ্চারী-আভোগ) বেশি নেই। সংগীততাত্ত্বিক সুকুমার রায় তাঁর ভারতীয় সংগীত: ইতিহাস ও পদ্ধতি (পৃষ্ঠা ১৩২) বইতে লিখেছেন:
[রামমোহন] গানগুলোর কয়েকটি ধ্রুপদজাতীয়। অন্যান্য গান আড়া, তেগুট, সৎ, ত্রিতাল টিমা একতাল প্রভৃতি তালে প্রচলিত রাগগান। ধ্রুপদী ভংগীর কয়েকটি গান রাগ ইমন-কল্যাণ, সুরট প্রভৃতি চৌতালে রাগ কেদারার গান ধামারে, তেমনি আড়া তালে সিন্ধু, ভৈরবী বড়ুয়া, পিলু প্রভৃতি টপ্পাভংগীর প্রয়োগ প্রমাণিত করে।
ধ্রুপদাঙ্গতাই হোক বা অন্য বন্দীশেরেই হোক, রামমোহনের গানে নিঃসন্দেহে আধুনিককালে উচ্চসঙ্গীতের দিশারী তাঁর গান ভাবগাম্ভীর্য ও বিন্যাসে নতুন যুগের নতুন গানের বুনিয়াদ তৈরি করেছিল।
কিন্তু রামমোহনের গান সম্পর্কে আমরা যে যথেষ্ট তথ্যগতভাবে সচেতন এমন মনে হয় না। তাঁর সংগীতপ্রাণ জীবনটিকে আমরা তেমন করে কেউ অনুধাবন করিনি। ‘মনে কর শেষের সে দিন ভয়ংকর’ রামমোহন রচিত একটি গানের এমনতর উচ্চারণ নিয়ে অনেকে তাঁকে উপহাস করেন। অথচ লক্ষ করলে দেখা যায় নির্বেদাত্মক সংগীত ও বৈরাগ্যবিধর গান রচনার পাশাপাশি তাঁর লেখা শান্তরসম্পদ গানও কিছু কম নেই। তাঁর আগে বাংলা গানে কীর্তন গানের যে-বিচিত্র ও বহুমুখী উদ্ভাস ঘটেছিল এবং রামপ্রসাদী সুরে কালীকীর্তনের যে-সহজ সরল ভক্তিপ্রবাহ বাঙালিচিত্তকে দ্রুব করেছিল সে তুলনায় রামমোহনের গান ততটা দেশব্যাপী প্রচার ও প্রসারতা পায়নি। পায়নি যে তার কারণ রামমোহনের গানের বিষয়গাম্ভীর্য ও রাগরাগিনির সূক্ষ্ণতা সাধারণ বর্গের গায়কের কন্ঠধার্য হতে পারে না। ব্রাহ্ম উপাসনার উন্নত ও সাত্ত্বিক বেদি থেকে সাধারণ ভক্তিমান শ্রোতাদের রুচির সমতলে তাঁর গান কখনও অবতরণ করতে পারেনি। গানে জনপ্রিয়তার সেটা একটা প্রধান শর্ত।
ব্রাহ্মসংগীত নামটি রামমোহনের দেওয়া। এ জাতীয় গানের রচনা থেকে গাইবার রীতিনীতি সবই রামমোহনের পরিকল্পিত। ব্রাহ্মপসানোর জন্য পরিকল্পিত হলেও তাঁর রচিত গান কোনও বিশেষ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তাঁর গান ছিল তাঁর ধর্মসম্বন্ধীয় মতবাদের মত উদার ও সার্বজনীন। বিশ্বব্যাপী যে-অখণ্ড বিশালকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আপন ভক্তচিত্তে তাকেই তিনি রূপ দিয়েছিলেন গানে। কবি বা গীতিকাররূপে রামমোহন নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণীর প্রতিভা ছিলেন না কিন্তু তাঁর রচিত ব্রাহ্মসংগীত আধুনিক বাঙালির বিশেষ ভক্তিচেতনার পথিকৃত। তাঁর সমসময়ে তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মসংগীত রচনায় যাঁরা সহযোগী ছিলেন তাঁদের নাম কৃষ্ণমোহন মজুমদার, নীলমণি ঘোষ, নীলরতন হালদার, গৌরমোহন সরকার, কালীনাথ রায়, নিমাইচরণ মিত্র, ভৈরবচন্দ্র দত্ত প্রমূখ। তাঁর গানের প্রভাবে অনেক গায়ক ও সঙ্গীতকার ব্রাহ্মসংগীত রচনায় এগিয়ে আসেন। তখনকার দিনে গরানহাটা অঞ্চলে গোবিন্দমালা ছিলেন উৎকৃষ্ট আখড়াই গায়ক। তাঁকে রামমোহন আত্মীয় সভায় ব্রাহ্মসংগীত গাইবার জন্য নিযুক্ত করেন। পরে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হলে বিশিষ্ট গুণী ও কলাবস্তু গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী রামমোহনকে ব্রাহ্মসংগীত শুনিয়ে পরিতৃপ্ত করতেন। শোনা যায় যে, স্বয়ং নিধুবাবু ব্রাহ্মসংগীতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি ব্রাহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। নিধুবাবুর রচিত ‘গীতরত্ন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে তার পুত্র জয়গোপাল গুপ্ত একটি বিবরণে লিখেছেন:
ব্রাহ্মসমাজের পূর্ব উপাচার্য উচ্ছাবানন্দ বিদ্যাবাগীস মহোদয় একদিবস রামনিধিবাবুকে আদেশ করিলেন-মহাশয় একটি ব্রাহ্মসংগীত রচনা করিয়া শ্রবণ করাইতে হইবে। সেই অনুরোধে বাবু তৎক্ষণাৎ কিঞ্চিৎ মৌন থাকিয়া এই গীত রচনা করিয়া শুনাইলেন, যথা-রাগ বেহাগ, তাল আড়া:
পরম ব্রাহ্ম তৎপরাতর পরমেশ্বর
নিরঞ্জন নিরাময় নির্বিশেষ সদাশ্রয়
আপনা আপনি হেতু বিভু বিশ্বধর।
সমুদয় পঞ্চকোষ জ্ঞানাঞ্জন যথাবাস
প্রপ্রঞ্চুভূতাবিকারা
অন্নময় প্রণাময় মানুষ বিজ্ঞানময়
শেষেতো আনন্দময় প্রাপ্ত সিদ্ধ নর।।
বিদ্যবাগীশ মহোদয় এই গীত শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং কহিলেন, বাবু তুমি সাধু, তোমার অসাধারণ ক্ষমতা দৃষ্টি আমরা চমকিত হইয়াছি, কারণ এই প্রকার গীত কখন রচনা করেন নাই, তাহাতে হঠাৎ এমন রচনা শুনা যায় নাই, যাহা হউক, এই গীত দেওয়ানজীকে অর্থাৎ রামমোহন রায় মহাশয়কে দেখাইয়া ব্রাহ্মসমাজে গান করাইব- এই কথাবার্তার পর কোন বিশেষ রোগাক্রান্ত হইয়া এতস্ময়াময় সংসার পরিহার করত ব্রাহ্মলোকে যাত্রা করিলেন, এ কারণ অনুমিত হইতেছে ও গীত সমাজের গীতে ভুক্ত হয় নাই, অপ্রকাশ রহিয়াছে।
নিধুবাবু স্বভাবত প্রণয়মূলক টপ্পা গান রচনা দক্ষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছিল স্বাভাবিক সাংগীতিক প্রতিভা সেই জন্য কখনও ব্রাহ্মসংগীত না লিখেও কত অনায়াসে এই গানটি তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে রচনা করেছিলেন। গানটির আঁটোসাঁটো শব্দবিন্যাস ক্রিয়াপথহীনতা এবং ধ্রুপদী লক্ষণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গানের মধ্যে ব্যবহৃত ‘পরম ব্রাহ্ম’, ‘নিরঞ্জন’, ‘জ্ঞানাঞ্জন’, ‘পরাৎপর’, ‘বিভু’ প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে নিধুবাবু রামমোহনের ব্রাহ্মসংগীতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন কারণ শব্দগুলি রামমোহনের গানে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলা ভক্তিমূলক গানের ইতিহাসে রামমোহনের গীতি রচনার প্রয়াস একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিল যা আদি ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজকে আশ্রয় করে ক্রমে নানান বিস্তারে বহু রকমের ভক্তিগীতিকে সম্ভাষিত করেছিল। সংগীততাত্ত্বিক রাজ্যেশ্বর মিত্র ‘প্রসঙ্গ বাংলা গান’ বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠায় মন্তব্য করেছেন:
রামমোহন যে সংগীত রচনা করেছিলেন সাহিত্যের দিক থেকে তার সার্থকতা বেশি নয়, কিন্তু সমাজে তিনি একটি বিশেষ সংগীত চিন্তা আনতে পেরেছিলেন, এটাই তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব। ব্রাহ্মসংগীতের প্রতি বাংলার জনসাধারণ আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তার কারণ এই যে তাঁরা সঙ্গীতে এমন একটা বস্তুর সন্ধান পেলেন যা তাঁদের চিত্রকে এক মহান ভাবে উদ্বুদ্ধ করল। বাংলা গানে এর ফলে ঋজুতার যে বিশেষ অভাব ছিল, সেটি ব্রাহ্মসংগীতের প্রভাবে অনেক পরিমাণে দূর হলো। রামমোহন ধ্রুপদের মধ্য দিয়ে এই চিন্তার উদ্রেক করেননি, ধ্রুপদ ভেঙে ব্রাহ্মসংগীত আরো কিছুকাল পরে সংঘটিত হয়। তিনি প্রচলিত রীতিকেই গ্রহণ করেছিলেন।
রামমোহনের গ্রাম্য সংগীত রচনার প্রয়াস বাংলার শিক্ষিত হিন্দু সমাজে ভক্তিগীতি রচনার একটি প্রেরণাগত ভূমিকা নিয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করে, আরাধনার অনুসঙ্গে ব্রাহ্মসংগীত শুনে এবং ব্রাহ্মদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মসংগীতের নানা বৈচিত্রপূর্ণ রূপায়ণ দেখে এক নতুন শ্রোতৃসমাজ গড়ে উঠে যাদের রসগ্রাহীতায় বাংলা ভক্তিসংগীতের সমুন্নতি ঘটতে থাকে। ব্রাহ্মসমাজ তাদের ভক্তিসাধনার ক্ষেত্রে সংগীতকে প্রধান স্থান দেওয়ার ফলে, বৃহত্তর হিন্দু সমাজেও ধীরে ধীরে ভক্তিসংগীত সম্পর্কে আকর্ষণ রোধ করতে লাগলেন এবং নিজেরাও গান রচনায় এগিয়ে এলেন। ব্রাহ্মরাও তাঁদের উপাসনায় ব্রাহ্মগীতিকারদের পাশে পাশে অব্রাহ্ম গীতিকারদের গানকে স্থান দিয়েছিলেন।
আদি ব্রাহ্মসমাজের সূচনা থেকেই সংগীতকে আরাধনার অংশ হিসাবে ভাবা হয়েছিল। রামমোহনের বেশির ভাগ গানই অবশ্য ‘মনঃশিক্ষা’ বা ‘বৈরাগ্য’ পর্যায়ের। এগুলি খাঁটি ব্রাহ্মসংগীত নয় কিন্তু ভক্তিগীতি। বস্তুত রামমোহনের কালে এবং রামমোহনের কাছে ভক্তিগীতি ছিল ব্যক্তিগত চিত্তনিবিষ্টতার একটি বাহন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একজন ব্রাহ্মভক্ত লিখেছিলেন: তাঁহার সময় বেদবাক্যে ঈশ্বরের স্তুতিপাঠ হইত, গায়ত্রী মন্ত্রে তাঁহার ধ্যান হইত এবং বৈরাগ্যসূচক সংগীতে তাঁহার প্রতি নির্ভয়ের নির্ভরের ভাব বর্ষিত করা হইত। অনেকে অনুমান করেন খ্রিস্টানদের Church Music – এর দ্বারা রামমোহন প্রভাবিত হয়ে ব্রাহ্মমন্দিরে ব্রাহ্মসংগীতের প্রচলন করেছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রজীবনীতে (প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা ২৬) উল্লেখ করেছেন:
বর্তমান যুগে রাজা রামমোহন রায় ধর্মমন্দিরে সংঘ-উপাসনার প্রবর্তক, মন্দিরে উচ্চাঙ্গের তাল মান লয় সংযোগে গানের প্রবর্তন তিনি করেন। রাজার আরন্ধ কার্য দেবেন্দ্রনাথের দ্বারা উজ্জীবিত হয়। তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে উৎকৃষ্ট সংগীতের ব্যবস্থা করেন। গ্রাম্যসংগীত তিনি স্বয়ং রচনা করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গুণেন্দ্রনাথ নানা রকম হিন্দি গান হইতে সুর আহরণ করিয়া বা হিন্দি ভাঙ্গিয়া ব্রাহ্মসঙ্গীত রচনায় প্রবৃত্ত হন। রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে ভগবদ্বিষয়ক সংগীত রচনায় আদর্শ তাঁহার স্থাপন করিয়া গিয়েছিলেন।
এ মন্তব্য থেকে আমরা দুটি তথ্য পাই প্রথমত আদি ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে পরবর্তী ব্রাহ্মসমাজের নানা তাত্তি¡ক মতবিরোধ ঘটলেও উপাসনার ক্ষেত্রে ভক্তিগীতি গায়নের অনিবার্য ভূমিকা বিষয়ে কোনো মতদ্বৈত ছিল না। দ্বিতীয়ত রামমোহনের সাংঘাতিক প্রয়াস ঠাকুরবাড়ির সাংঘাতিক পরস্পরম করার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল। বাংলার ভক্তিগীতি সাহিত্যের আধুনিক পর্বের ইতিহাস রচনায় এই সূত্র দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উৎসঃ পশ্চিমবঙ্গ, রামমোহন সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ