ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহের মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। গোলাম ফারুক খান

বিদায়, হে দীর্ঘ দেবদারু
বড় বিষণ্ণ এই ভোর! আর কয়েকদিন পরেই তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হবার কথা ছিল। কিন্তু জীবৎকালে তা আর হলো না। খবর পেলাম কয়েক ঘণ্টা আগেই নাকি ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ চলে গেছেন। আমি নিজেও অসুস্থ। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই এই নিদারুণ দুঃসংবাদ শুনে আরো কাতর হয়ে পড়েছি।
তাঁকে কখনো চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি। সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতৈক্যও নেই। তাঁর ইতিহাস ও সাহিত্যব্যাখ্যার দার্শনিক অন্তঃস্রোত সবসময় যে ধরতে পেরেছি তাও নয়। তবু গত কয়েক দশক ধরে সুযোগ পেলেই তাঁর নতুন লেখা খুঁজে ফিরেছি। অনেক দূর থেকেই তাঁর চিন্তার রশ্মিতে স্নাত হয়েছি, উদ্দীপ্ত হয়েছি, কখনো-বা ক্ষুব্ধ হয়েছি, তবে প্রতিবারই তাঁর কাছ থেকে কিছু না কিছু নতুন ভাবনার স্ফুলিঙ্গ পেয়েছি। তাই শুধু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে এই ঋণ শোধ করা যাবে না।
ইতিহাসচর্চায় মৌলিক অবদানের জন্য রণজিৎ গুহ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান। সেটি বড় কথা নয়, বাঙালি বিদ্বানদের মধ্যে আরো অনেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন। একাধিক বাঙালি ইতিমধ্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে রণজিৎ গুহের বিশিষ্টতা এইখানে যে তিনি ইতিহাসচর্চার একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন; দীক্ষা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে একটি মেধাবী ঐতিহাসিক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন। তাঁর কাজ উপমহাদেশের ইতিহাসকে বোঝার একটি নতুন বীক্ষণ উপহার দিয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও ইতিহাস-অনুসন্ধানে রেখাপাত করেছে। আবার তাঁর চিন্তার প্রভাব ইতিহাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে কালচারাল স্টাডিজ, সাহিত্যতত্ত্ব এবং সমাজ-বিশ্লেষণের অঙ্গনেও প্রসারিত হয়েছে। তিনি নিজ স্বাতন্ত্র‍্যে সমুজ্জ্বল এবং এই সময়ের বিদ্যাজগতে তাঁর প্রভাব বহুমাত্রিক। অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন: ‘রণজিৎ গুহ বিশ শতকের সবচেয়ে সৃজনশীল ভারতীয় ঐতিহাসিক।’
রণজিৎ গুহের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৩শে মে, বাখরগঞ্জ জেলার সিদ্ধকাটি গ্রামে। ১৯৩৪ সালে এগারো বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে এসে কলকাতার স্কুলে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে যান। ১৯৪৬ সালে ইতিহাসে এম এ পাশ করে কিছুদিন ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা এবং বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত সেনা-অভিযানের পর পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শিথিল হয়ে আসে। ১৯৫৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। এই পর্যায়েই ইতিহাস নিয়ে তাঁর গবেষণা শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে একটি ফেলোশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটিতে যান এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিষয়ে ‘আ রুল অব প্রপার্টি ইন বেঙ্গল’ নামের বিখ্যাত গবেষণাপত্রটি লেখেন। পরবর্তী দুই দশক সাসেক্স ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করে ১৯৮০ সালে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে অবসর নেন। ১৯৯৯ সালে স্ত্রী মেখঠিল্ড গুহকে নিয়ে চলে আসেন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার শহরতলি পুর্কের্সডর্ফে। সেখানেই কাটছিল তাঁর নির্জন সাধনার জীবন। সে জীবন এতই ধ্যানমগ্ন, এতই নিঃশব্দ যে মাঝেমাঝে অনেকের মনে হয়েছে তিনি লোকান্তরিত এবং বিস্মৃত।
রণজিৎ গুহের মূল পরিচয় তিনি তিনি নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ্যার উদ্ভাবক এবং কৃষক-চৈতন্যের ঐতিহাসিক। কমিউনিস্ট চিন্তক আন্তোনিও গ্রামশির ‘সাবঅলটার্ন শ্রেণিসমূহ’ নিয়ে আলোচনার রেশ টেনে তিনি ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ নামে আলোচনার সূত্রপাত করেন। তাঁর শুরুর কথা ছিল, উপমহাদেশে নানা ঘরানার ইতিহাসচর্চা উচ্চবর্গীয় পক্ষপাতে দুষ্ট এবং এই পক্ষপাত থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করতে হবে। নিম্নবর্গের মানুষের চেতনা, সংস্কৃতি, বিদ্রোহ ইত্যাদি স্বয়ংশাসিত এবং এই চেতনা ও সংস্কৃতির স্বরূপ বোঝা দরকার। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিন, জ্ঞান পাণ্ডে এবং এরকম আরো কিছু মেধাবী তরুণ ঐতিহাসিককে সংগঠিত করে তিনি গড়ে তোলেন সাবঅলটার্ন ঐতিহাসিক গোষ্ঠী। ১৯৮২ সাল থেকেই তাঁর সম্পাদনায় বেরোতে থাকে ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ নামের প্রবন্ধ-সংকলন। এটি বিশ্বপরিসরে সাড়া ফেলে। অবশ্য পরে ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’-এর তত্ত্ব ও গতিধারা বদলে যায়। পুরোনো কেউ কেউ দল ছেড়ে চলে যান, আবার নতুন অনেকে যোগ দেন। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। এক পর্যায়ে গুহ নিজেও সম্পাদনার দায়িত্ব শিষ্যদের হাতে ছেড়ে দিয়ে অবসর নেন।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় রণজিৎ গুহের দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই ‘এলিমেন্টারি অ্যাসপেক্টস অব পেজান্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া।’ এ বইয়ে তিনি বিদ্রোহে কৃষকদের চেতনার স্বরূপ, তাদের জনসমাবেশের ধরন, ভৌগোলিক পরিধি, নেতৃত্ব-কাঠামো ইত্যাদির মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কৃষক-বিদ্রোহের পেছনে যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস নয়, বরং দীর্ঘদিনের সচেতন পরিকল্পনা এবং লাভ-ক্ষতির হিসাব থাকে সেটিই গুহের মূল প্রতিপাদ্য। তবে এ নিয়ে তাঁর শিষ্যদের বক্তব্য ভিন্ন এবং বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক এখনো চলছে।
এর পর তাঁর ইংরেজি বই ‘ডমিনান্স উইদাউট হেজেমনি’ (১৯৯৭), ‘হিস্ট্রি অ্যাট দ্য লিমিট অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ (২০০২) এবং ‘দ্য স্মল ভয়েস অব হিস্ট্রি’ (২০০৯) প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে তিনি ইতিহাস-গবেষণা ছেড়ে পুর্কের্সডর্ফের নিভৃত আবাসে মন দেন ভাষাতত্ত্ব, দর্শন আর সাহিত্যের নিবিড় পাঠে। ইংরেজি সাহিত্য এবং ইতিহাসের বই, বিশেষ করে এডওয়ার্ড গিবনের ‘হিস্ট্রি অব দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ তরুণ বয়সে বারবার পড়ে তিনি অসাধারণ ইংরেজি আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর ইংরেজি রচনাশৈলী সব মহলেই দারুণ সমাদৃত। তবু তিনি ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়ে দেন যে, আর ইংরেজি নয়, বাকি জীবনে যা লিখবেন তার সবই বাংলায়। খুব ভালো করে পড়েছিলেন জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের দর্শন। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। ঠাকুরদা যোগেশচন্দ্র গুহের প্রযত্নে সংস্কৃত ভাষাও শেখা হয়েছিল। এসব জ্ঞানের রসায়নে লেখা হলো ‘কবির নাম ও সর্বনাম’ (২০০৯), ‘ছয় ঋতুর গান’ (২০০৯), ‘দয়া — রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা’ (২০১০), ‘তিন আমির কথা’ (২০১১), ‘প্রেম না প্রতারণা’ (২০১৩) এবং ‘রচনাসংগ্রহ’ (দুই খণ্ড) (২০১৯)।
আমরা জানি, চিন্তার ক্ষেত্রে রামমোহন-বিদ্যাসাগর যে আধুনিকতার পত্তন করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল যুক্তি। সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে রামমোহন দৃঢ়ভাবে যুক্তিকে অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু রণজিৎ গুহ বলেছেন, রামমোহনের চিন্তার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা ছিল — দয়া। যুক্তির শানিত অস্ত্রে সহমরণ প্রথার সমর্থকদের ছিন্নভিন্ন করার পরও ‘দ্বিতীয় সম্বাদ’ নামের রচনায় রামমোহন হঠাৎ দয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সহমরণ প্রথার শিকার নারীদের সম্পর্কে বলেন: ‘দুঃখ এই যে, এই পর্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনী, তাহাদিগকে প্রত্যক্ষ দেখিয়াও কিঞ্চিৎ দয়া আপনকারদের উপস্থিতি হয় না, যাহাতে বন্ধনপূর্বক দাহ হইতে রক্ষা পায়।’ রণজিৎ গুহের মতে এখানে যুক্তি ছাপিয়ে উঠছে যে বেদনা, তার আবেদন অনুভূতির কাছে। ২০০২ সালে গুজরাটের নিষ্ঠুরতার পর আমাদের চিন্তার ইতিহাস থেকে দয়া এবং হৃদয়বৃত্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার ভাবনা তাঁর মনে জেগেছিল।
এই পর্যায়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন, এমনকি পঞ্চাশের দশকের তিন কবি শঙখ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসুকে নিয়েও লিখেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘শেষ তর্পণ’ নামের প্রবন্ধের শেষ কথাগুলো তার প্রজ্ঞার ছটায় দ্যুতিময়: ‘সব যুদ্ধই শেষ হয়। শেষ হয় না কেবল বিলাপ ও অভিশাপের পাকে পাকে জড়ানো অনুশোচনার নিষ্ঠুর ও আত্মঘাতী শোধ-প্রতিশোধের হিসাব-নিকাশ।’
পুরোনো একটি যুগ প্রায় শেষ হলো। একে একে চলে গেছেন মেধায়-মননে দীর্ঘকায় অনেক বাঙালি। আমাদের মতো খর্বকায় বাঙালির ভিড়ে শেষ যে কয়েকজন দীর্ঘ দেবদারু ছিলেন রণজিৎ গুহ তাঁদের একজন। কিন্তু কালের অমোঘ বিধান কে-ইবা জয় করতে পারে! আমাদের যাবতীয় শুভকামনা সত্ত্বেও তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। তবু হয়তো এখন গর্ব করে বলা যাবে, আমরা রণজিৎ গুহের শতাব্দীর বাঙালি।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top