❝ অনেকেই মনে করেন, আধুনিক বিজ্ঞান ও টেকনোলজির প্রবল বাতাসে দর্শনের দীপশিখা নিভে গেছে। ব্যাপারটা কি আসলেই ওরকম কিছু? ‘দীপশিখা’ শব্দটির বস্তুভিত্তি আছে। কাজেই, চিন্তা চর্চায় ‘দীপশিখা’ শব্দটি আমলে নিলে, সভ্যতা বিকাশের ঐতিহাসিক কালপর্বগুলোর ইঙ্গিত মেলে, মানুষের জ্ঞান আর সক্ষমতা বিকাশের হাজার বছরের ইতিহাস পাওয়া যায়। জ্ঞানের ইতিহাসের পথে আসে দর্শনের ইতিহাস। লিখিত ইতিহাস মানে স্মৃতির সংরক্ষণ। স্মৃতি হিসেবে যা সংরক্ষিত নয় তাকে লিখিত ইতিহাস হিসেবে পাঠ করা মুশকিল। আধুনিকতার নিরিখে স্মৃতির অস্বীকৃতি নিজেকে অস্বীকারের নামান্তর। সুতরাং, দর্শনের আলোতে আধুনিক বিজ্ঞানের সূত্রগুলো গ্রন্থিত হয়েছিল –এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। ভুললে চলবে না, দর্শন চর্চার স্বর্ণযুগে সমানতালে জারি ছিল গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও রসায়নবিদ্যার চর্চা। সেকালের দার্শনিকরা ছিলেন এক কথায় পলিম্যাথ। সুতরাং জ্ঞানের পরম্পরা হিসেবে একালেও দর্শনকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। টেকনোলজি জীবনকে সুবিধা দেয় ঠিক, কিন্তু জীবন সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের উত্তর তালাশ সে করে না। সেটা তার কাজও নয় আসলে। তবে জীবন ও জগৎ নিয়ে মানুষের প্রশ্ন শেষ হয়ে যায়নি। কাজেই, প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধানে দর্শন চর্চাও শেষ হয়নি। বরং টেকনোলজি ও বিজ্ঞানের যুগে দর্শন চর্চার রূপ কেমন হবে সেই প্রশ্ন নতুন করে সামনে আসছে। মানে আজকের দিনের জ্ঞান চর্চায় দর্শনের স্থান কোথায় ও তার ভবিষ্যৎই বা কী।
বিষয়টি নিয়ে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আলাপ করেছেন সমকালের অগ্রগণ্য ফরাসী দার্শনিক আঁলা বাদিউ। দর্শন চর্চার ঐতিহ্য আত্মস্থ করে তিনি অধিবিদ্যক চিন্তার সঙ্গে ছেদ টেনেছেন। কিন্তু নতুন জ্ঞান সৃজনের প্রক্রিয়ায় খোদ দর্শন চর্চাকে খারিজ করেননি। বাদিউর দার্শনিক চিন্তায় প্লেটো, হেগেল ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ লক্ষণীয়। দর্শন প্রশ্নে মার্কস মনে করতেন, ‘দার্শনিকরা জগতকে কেবল নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কাজ হলো জগতকে বদলানো।’ অনুরূপভাবে, বাদিউর দার্শনিক ভাবনার ভিত্তি সমাজের সদর্থক রূপান্তরের মাঝে। কাজটা অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রামের। রাজনৈতিক সংগ্রামে নতুন চিন্তা ছাড়া সমাজের সদর্থক রূপান্তর সম্ভাবিত হতে পারে কি? নতুন চিন্তার সুসংবদ্ধ রূপকে তিনি দর্শনের ‘সৃজনশীল পুনরাবৃত্তি’ হিসেবে নির্দেশ করেছেন।
আঁলা বাদিউর জন্ম ১৯৩৭ সালে। মরক্কোর রাবাত শহরে। পড়াশোনা করেছেন প্যারিসের Lycée Louis-Le-Grand ও বিখ্যাত ই. এন. এস. গ্র্যাজুয়েট স্কুলে (École Normale Supérieure)। লুই আলথুসের এর পাঠচক্রে যোগ দেন ১৯৬৭ সালে। এই পাঠচক্রে তিনি জাঁক লাকার ভাবনায় প্রভাবিত হন। পরে Cahiers pour l’Analyse এর সম্পাদকীয় সদস্যপদ পান। তবে ইতোমধ্যেই তিনি লাকার তত্ত্বের পাশাপাশি গণিত ও যুক্তিশাস্ত্রে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে নেন। ১৯৬৮ সালের মে মাসের ছাত্র অভ্যুত্থানে বামপন্থী মিলিট্যান্ট সংগঠন ইউ.সি.এফ.এম.এল -এ যোগ দেন। বাদিউর নিজের কথা অনুসারে এই সংগঠনটি ছিল একটি মাওবাদী সংগঠন। পরে ১৯৮৫ সালে UCFml এর কয়েকজন মাওবাদী কমরেডের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন L’Organisation Politique। ২০০৭ সালে সংগঠনটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত University of Paris 8/Vincennes-Saint Denis এ, অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে দর্শন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অধ্যপনা করেন ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। বাদিউর বাবা রেমন্ড বাদিউ ছিলেন একজন গণিতবিদ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফরাসী প্রতিরোধ পর্বের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। বাদিউর দর্শনেও এই প্রতিরোধ প্রবণতার ছাপ সুস্পষ্ট। দর্শন চর্চাকে তিনি একাডেমিক পরিসরে সীমিত করেননি। দর্শনকে তিনি বরং মানুষের প্রতিদিনকার কাজকারবার ও রাজনীতির জমিনে নিয়ে এসেছেন। তরুণ বয়স থেকেই বাদিউ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। তিনি ছিলেন ‘ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট পার্টি’র (PSU) প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। পি.এস.ইউ. আলজেরিয়ার উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৮০ এর দশকে আলথুসেরীয় ‘কাঠামোগত মার্কসবাদ’ ও লাকাপন্থী মনোবিশ্লেষণ আকর্ষণ হারায়। বাদিউ এ সময় বেশকিছু টেকনিক্যাল ও ‘বিমূর্ত’ দার্শনিক কাজ প্রকাশ করেন। এর মাঝে ‘থিওরি অফ দ্য সাবজেক্ট’ (১৯৮২) ও ‘বিং অ্যান্ড ইভেন্ট’ (১৯৮৮) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বর্তমান নিবন্ধটি নেওয়া হয়েছে ‘লাকা ডট কম’ প্রকাশিত ‘দি সিম্পটম’ অনলাইন জার্নাল থেকে। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘ফিলোসফি অ্যাজ ক্রিয়েটিভ রিপিটেশন’ শিরোনামে। ❞
আমার একজন ওস্তাদের কথা দিয়ে শুরু করা উচিত। তিনি হলেন বড় মাপের মার্কসবাদী দার্শনিক লুই আলথুসের। আলথুসের এর কাছে মার্কসবাদের জন্ম কোনো সামান্য ব্যাপার ছিল না। এটি রচিত হয়েছিল দুটো বিপ্লব ও দুটো প্রধান বৌদ্ধিক ঘটনায়। প্রথমটি একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। এই ঘটনাটা ছিল ইতিহাসের বিজ্ঞান নিয়ে মার্কসের সৃষ্টি –যার নাম ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’। দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল দার্শনিক প্রকৃতির। এটি ছিল মার্কস এবং অন্যান্যদের সৃষ্ট নতুন একটি প্রবণতা –যার নাম ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’। আমরা বলতে পারি, নতুন বিজ্ঞানের জন্ম নতুন দর্শনের সহযোগিতা ও শুদ্ধিপ্রক্রিয়া দাবী করে। গণিতের আরম্ভও একইরকমভাবে প্লেটোর দর্শন দাবী করেছিল। নিউটনিয় পদার্থবিদ্যা দাবী করেছিল কান্টের দর্শন। মোটকথা এসবকিছুর মাঝে কোনো অসুবিধা ছিল না। এই কাঠামোর মাঝে দর্শনের বিকাশ সম্পর্কে দুটো পয়েন্টের কথা বলা সম্ভব।
(১) কিছু ক্ষেত্রে এই বিকাশ নির্ভরশীল ছিল নতুন ফ্যাক্টের ওপর যা তাৎক্ষণিকভাবে দার্শনিক প্রকৃতির নয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টসমূহের ওপর। যেমন ধরুন, গণিতের জন্য প্লেটো, দেকার্ত ও লাইবনিজ। পদার্থবিদ্যার জন্য কান্ট, হোয়াইটহেড বা পপার। ইতিহাসের জন্য হেগেল বা মার্কস। জীববিদ্যার জন্য নিৎশে, বার্গস অথবা দেল্যুজ।
যদ্দুর অবগত আছি, আমি যথেষ্ট একমত যে, দর্শন কিছুটা অ-দার্শনিক ক্ষেত্রের ওপর নির্ভরশীল। এবং এই ক্ষেত্রগুলোকে আমি বলি দর্শনের ‘শর্তাবলী’। সহজভাবেই বলতে চাই, বিজ্ঞানের প্রগতিতে দর্শনের শর্তাবলীকে আমি সীমিত করি না। ৪ টি সম্ভাব্য ধরনের আওতায় আমি শর্তাবলীর আরও বড় সেট প্রস্তাব করি। যথা –বিজ্ঞান, রাজনীতি, শিল্পকলা ও প্রেম। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমার নিজের কাজ নির্ভর করে অসীম এর নতুন গাণিতিক ধারণার ওপর। তবে একই সঙ্গে তা নির্ভর করে বৈপ্লবিক রাজনীতির নতুন ধরনের ওপর; মালার্মে, র্যাবো, পেসোয়া, মান্দেলেস্তাম বা ওয়ালেস স্টিভেন্স এর দুর্দান্ত কবিতার ওপর; স্যামুয়েল বেকেট এর গদ্যের ওপর; প্রেমের নতুন পথের ওপর যা আবির্ভূত হয়েছে মনোবিশ্লেষণ, যৌনতা ও লিঙ্গ সংক্রান্ত সকল প্রশ্নের সম্পূর্ণ রূপান্তরের প্রেক্ষিতে।
ফলে আমার জন্য এটা বলা সম্ভব হয়, দর্শনের বিকাশ হলো দর্শনের শর্তাবলীর ভেতর পরিবর্তনে ধীরে ধীরে দর্শনের অভিযোজন। তাহলে আপনি হয়তো বলবেন, দর্শন থাকে সবসময় পিছনে! দর্শন সবসময় অ-দার্শনিক অভিনবত্বের সাথে মেলার চেষ্টা করে! এবং আমাকে বলতে হবে –ঠিক! এটা ছিল আসলে হেগেলের উপসংহার। দর্শন হলো বিচক্ষণতার পাখি। এবং বিচক্ষণতার পাখি হলো পেঁচা। কিন্তু পেঁচা ওড়ে কেবল দিনের শেষে। দর্শন হলো সেই ডিসিপ্লিন যা আসে জ্ঞানরূপ ও অভিজ্ঞতারূপ দিনের পরে, রাতের শুরুতে। এবং আমাদের সমস্যা হলো, আমাদের দর্শন বিকাশের সমস্যা মোটামুটি সমাধা হয়ে গেছে। এখানে দুটো ব্যাপার আছে। প্রথম ব্যাপার – বিজ্ঞান, রাজনীতি, শিল্পকলা অথবা প্রেমের সৃজনশীল অভিজ্ঞতার এক নতুন সকাল আসছে। আর আমরা হয়তো দর্শনের এক নতুন সন্ধ্যা পাবো। দ্বিতীয় ব্যাপার –আমাদের সভ্যতা ক্ষয়ে গেছে। যে ভবিষ্যতের কথা আমরা কল্পনা পারি তা শুধু অন্ধকার এবং এক চিরকালীন সূর্যাস্তের ভবিষ্যৎ। কাজেই, দর্শনের ভবিষ্যৎ হবে দর্শনের ধীর মৃত্যু – রাতের বেলা এর ধীর মৃত্যু। দর্শন পর্যবসিত হবে অর্থহীন, গন্তব্যহীন একটি স্বরে– যাকে আমরা স্যামুয়েল বেকেট এর সুন্দর রচনার শুরুতে পড়ি – কোম্পানি:‘অন্ধকারের মাঝে একটি স্বর কথা বলছে’।
আসলে আমরা হেগেল ও অগাস্ট কোঁতে থেকে শুরু করে নিৎশে, হাইডেগার, দেরিদা, ভিটগেনস্টাইন ও কারনাপের উল্লেখ না করেও দর্শনের সম্ভাব্য মৃত্যুর দার্শনিক ধারণা খুঁজে নিতে পারি। যেকোনো ব্যাপারে এর ধ্রুপদি রূপ অধিবিদ্যক।
আমি এখানে আমার বক্তৃতা থামিয়ে দিতে পারি এবং পাঙ্ক স্টাইলের কোনো গায়কের মতো মাথার চুল খাড়া করে বলতে পারি –কোনো ভবিষ্যৎ নেই! তারপর আমরা সবাই সর্বাত্মক ধ্বংসকামিতার মদ পান করবো। কিন্তু এখানে ছোট ছোট কিছু অসুবিধা রয়ে যায়।
প্রথমটি হলো, দীর্ঘদিন ধরেই দর্শনের সমাপ্তি তত্ত্বের একটি আদর্শ দার্শনিক ধারণা আছে। তাছাড়া এটি প্রায়ই একটি ইতিবাচক ধারণা। হেগেলের কাছে দর্শন তার সমাপ্তিতে উপনীত। কারণ পরম জ্ঞান কী তা শেষপর্যন্ত দর্শনই বুঝতে পারে। মার্কসের কাছে দর্শন হলো জগতের ব্যাখ্যা। এবং সেই একই জগতের বাস্তব রূপান্তর দ্বারা দর্শন প্রতিস্থাপিত হতে পারে। নিৎশে মনে করেন পুরানো দর্শনের নেতিবাচক অমূর্তায়ন ধ্বংস করতে হবে। প্রাণের সত্যকার মুক্তি ও যা কিছু অস্তিত্বমান তার জন্যে বড় এক ‘হ্যাঁ’! নিশ্চিত করতে হবে। এবং বিশ্লেষণাত্মক চলতি ঘরানার জন্য অধিবিদ্যক কথাসমূহকে – যেগুলো একেবারেই অর্থহীন –সুস্পষ্ট প্রস্তাবনার অনুকূলে এবং আধুনিক যুক্তির প্যারাডাইমের আওতায় বাহাসের জন্য পুনর্নির্মিত হতে হবে।
এই সকল ক্ষেত্রে আমরা দেখবো, সাধারণভাবে দর্শনের এবং বিশেষভাবে অধিবিদ্যার মৃত্যু সংক্রান্ত বড় আকারের ঘোষণা খুব সম্ভবত দর্শনের নিজের মাঝেই একটি নতুন পন্থা কিংবা একটি নতুন লক্ষ্য সূচিত করার ভাষিক উপায়। বলার সেরা উপায় হলো এটা বলা যে, দর্শন শেষ হয়ে গেছে, দর্শন মৃত। আর আমি নতুন এক দার্শনিক। কাজেই, আমি একদম নতুন কিছু শুরুর প্রস্তাব করি – দর্শন নয়, কিন্তু চিন্তা করা! দর্শন নয়, কিন্তু প্রাণের সম্ভাবনা! দর্শন নয়, কিন্তু একটি নতুন যৌক্তিক ভাষা! আসলে, পুরানো দর্শন নয়, বরং আমার নিজস্ব নতুন দর্শনের প্রস্তাব করি।
কাজেই এখানে একটি সম্ভাব্যতা আছে। আর তা হলো, দর্শনের বিকাশ অবশ্যই সর্বদা পুনরুত্থান আকারে হবে। জরাজীর্ণ মানুষের মতোই পুরানো দর্শন মৃত। কিন্তু এই মৃত্যু আসলে এক নতুন মানুষের, এক নতুন দার্শনিকের জন্ম। আপনি যেহেতু জানেন, আমরা কল্পনা করতে পারি এমন মহত্তম পরিবর্তনের মাঝে, পুনরুত্থান ও অমরত্বের মাঝে ঘনিষ্ঠ একটি সম্পর্ক আছে –মৃত্যু থেকে জীবনে পরিবর্তন। আর আমরা যখন পরিত্রাণের আনন্দে থাকি, আমরা ভাবতে পারি এমন পরিবর্তনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি থাকে সবচেয়ে বেশি।
অধিবিদ্যার সমাপ্তি চিত্রের পুনরাবৃত্তি ও চিন্তার নতুন আরম্ভের পরস্পর সম্পর্কিত পুনরাবৃত্তিমূলক চিত্র হয়তো ওই ধরনের দর্শনের মৌলিক গতিহীনতার লক্ষণ। হয়তো ধারাবাহিকতা, জন্ম ও মৃত্যুর নাটকীয় যুগলরূপে দর্শনের পুনরাবৃত্তিমূলক স্বভাব রক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না।
এই বিন্দুতে এসে আমরা লুই আলথুসের এর কাজের দিকে ফিরতে পারি। কারণ আলথুসের দর্শন চর্চায় বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করতেন। একই সঙ্গে খুব অদ্ভুত কিছু মানতেন যাকে বলা যায় দর্শনের কোনো ইতিহাস নেই, দর্শন সবসময় একই জিনিস। এক্ষেত্রে দর্শনের বিকাশ প্রশ্নের সমস্যা সহজ ব্যাপার –দর্শনের ভবিষ্যৎ হলো তার অতীত।
যদি বলা হয়, লুই আলথুসের ছিলেন ‘ফিলোসফিয়া পেরেনিস’এর পুরানো স্কলাস্টিক ধারণার শেষ রক্ষক বা একই [জিনিসের]নিখাদ পুনরাবৃত্তি হিসেবে দর্শনের রক্ষক, কিংবা নিৎশের স্টাইলে অপরিবর্তিত [জিনিসের]চিরকালীন প্রত্যাবর্তন হিসেবে দর্শনের শেষ রক্ষক, তাহলে তা প্রায় একটা কৌতুকের মতোই শোনাবে।
কিন্তু এই ‘অপরিবর্তিত’ জিনিসটা কী? অপরিবর্তিত জিনিসের অভিন্নতা কী – যা দর্শনের অনৈতিহাসিক নিয়তিতে প্রত্যাবর্তন করে? এই প্রশ্নের পেছনে স্বাভাবিকভাবেই আমরা দর্শনের সত্যকার প্রকৃতি সম্পর্কে একটা পুরানো আলাপ খুঁজি। এখানে মোটামুটি দুটো প্রধান প্রবণতা আছে। প্রথম প্রবণতা হলো, দর্শন মূলত আত্মবাচক জ্ঞান। তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে সত্যের জ্ঞান। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মূল্যবোধের জ্ঞান। আমাদের জানা ও জ্ঞানের স্থানান্তর সংগঠিত করতে হয়। দর্শনের উপযুক্ত রূপ হলো ওই ধরনের বিদ্যালয়। কান্ট, হেগেল, হুসেরল, হাইডেগার এবং আরও অনেকের মতো একজন দার্শনিক একজন প্রোফেসর। আপনি যখন ‘প্রোফেসর বাদিউ’ নামে আমাকে শনাক্ত করেন, আমি নিজেও তখন এই কাতারে থাকি।
দ্বিতীয় সম্ভাব্যতা হলো, দর্শন আসলে কোনো জ্ঞান নয়। মানে দর্শন না তাত্ত্বিক, না ব্যাবহারিক। এটি থাকে বিষয়ীর সরাসরি রূপান্তরে। এটা একধরনের র্যাডিকেল রূপান্তর। জীবনের সম্পূর্ণ একটি পরিবর্তন। ফলস্বরুপ এটি ধর্মের খুবই কাছাকাছি। তবে একচেটিয়াভাবে যৌক্তিক উপায়ে। প্রেমের খুব কাছাকাছি। তবে তা বাসনার প্রবল সমর্থন ব্যতিরেকে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণে খুব ঘনিষ্ঠ। তবে কেন্দ্রায়িত সংগঠনের বাধ্য বাধকতা ছাড়াই। শৈল্পিক সৃষ্টির সম্ভাবনার খুব কাছে। কিন্তু শিল্পকলার মূর্তরূপের উপায় ছাড়া। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের খুব কাছে। কিন্তু গণিতের রীতিপদ্ধতি এবং পদার্থবিদ্যার পরখি ও টেকনিক্যাল উপায়গুলো ছাড়া। কারণ এই দ্বিতীয় প্রবণতার দর্শন কোনো বিদ্যালয়, শেখা, স্থানান্তর ও প্রোফেসরদের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপার নয়। এটি যেকোনো জন থেকে প্রত্যেকের একটি মুক্ত পরিচিতি। অ্যাথেন্সের রাস্তায় যুবকদের কাছে সক্রাতেসের কথা বলার মতো। প্রিন্সেস এলিজাবেথের কাছে দেকার্তের চিঠি লেখার মতো। জ্যা জ্যাক রুশোর কৈফিয়তনামা লেখার মতো। নিৎশে অথবা সার্ত্রের নাটক বা উপন্যাসের মতো। অথবা যদি নিজের কাজ সম্পর্কে মুগ্ধতা নিয়ে কথা বলার জন্য আমাকে মাফ করেন, আমার নিজের নাটক ও উপন্যাসের মতো।
পার্থক্য হলো, দর্শন আর জ্ঞান নয় বা জ্ঞানের জ্ঞান নয়। এ এক সক্রিয়তা। কেউ হয়তো বলতে পারে, যা দর্শনকে শনাক্ত করে তা কোনো ডিসকোর্সের নিয়ম নয়। কিন্তু একটি সক্রিয়তার অনন্যতা। এ হলো সেই কাজ, সক্রাতেসের শত্রুরা যাকে বলতো ‘যুবকদের বিপথগামী করা’। আর আপনি জানেন, একারণে সক্রাতেসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ‘যুবকদের বিপথগামী করা’ তাহলে দার্শনিক সক্রিয়তার জন্য একেবারে খারাপ নাম নয়। তবে আপনি যদি ‘বিপথগামী’ শব্দটাকে যথাযথ বুঝে থাকেন। এখানে ‘বিপথগামী’ মানে যে কোনো প্রতিষ্ঠিত মতের কাছে অন্ধ দাসত্ব প্রত্যাখ্যান করার সম্ভাব্যতা শিক্ষা দেওয়া। যুবকদের বিপথগামী করা মানে সকল সামাজিক নিয়ম সম্পর্কে তাদের মন পরিবর্তনের কিছু উপায় প্রদান করা। বিপথগামী করা মানে নকলের বিকল্প আলাপ ও যৌক্তিক বিচারে অগ্রসর হওয়া। এমন কি, বাধ্যতার জন্য বিকল্প বিদ্রোহ হলেও। অবশ্য তা যদি নীতির প্রশ্নও হয়। তবে এই বিদ্রোহ স্বতঃস্ফূর্ত নয় বা উগ্র নয়। যেহেতু এটি নীতি ও যৌক্তিক বিচারের একটি ফলাফল। বড় মাপের যোদ্ধা ও কবি আর্তুর র্যাবোর কবিতায় আমরা ‘যৌক্তিক বিদ্রোহ’ এর অদ্ভুত অভিব্যক্তি খুঁজে পাই। ‘যৌক্তিক বিদ্রোহ’ সম্ভবত দার্শনিক সক্রিয়তার ভালো একটি সংজ্ঞা। বন্ধুরা, এটি দৈবক্রমে হয়নি। তুখোড় দার্শনিক জ্যাক রন্সিয়া সত্তর দশকের দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাগাজিন বের করেন। একদম সঠিকভাবেই তার শিরোনাম ছিল ‘যৌক্তিক বিদ্রোহ’।
কিন্তু দর্শনের সারমর্ম যদি সক্রিয় কিছু হয় তাহলে আলথুসের এর কাছে দর্শনের বাস্তব ইতিহাস কেন বিদ্যমান নয় তার একটা ভালো বোঝাপড়া আমরা করতে পারি। আলথুসের নিজে তাঁর কাজে এটা বলার প্রস্তাব করেছিলেন যে, দর্শনের কার্যাবলী হলো মতামতের মাঝে বিভাগের পরিচয় প্রদান করা। এবং আরও সঠিকভাবে, মতামতের মাঝে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পর্কে বা আরও সাধারণভাবে তাত্ত্বিক কাজকারবারের মাঝে বিভাগ চেনানো। কোন ধরনের বিভাগ? শেষ পর্যন্ত বিভাগ হলো বস্তুবাদ ও ভাববাদের মাঝে বিভাগ। যেহেতু তিনি একজন মার্কসবাদী, আলথুসের ভেবেছিলেন, বস্তুবাদ হলো তাত্ত্বিক কাজকারবারের জন্য বৈপ্লবিক কাঠামো। এবং ভাববাদ রক্ষণশীল কাঠামো। কাজেই তাঁর চূড়ান্ত সংজ্ঞা ছিল – তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে দর্শন হলো রাজনৈতিক সংগ্রামের মতো।
তবে মার্কসীয় উপসংহার ছাড়াই আমরা দুটো বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে পারি –
(১) দার্শনিক ক্রিয়া সবসময় জ্ঞান ও মতের মাঝে, সঠিক মত ও ভুয়া মতের মাঝে, সত্য ও মিথ্যার মাঝে, ভালো ও মন্দের মাঝে, বিচক্ষণতা ও পাগলামির মাঝে এবং আরও অনেক কিছুর মাঝে সিদ্ধান্ত, বিভাজন ও পরিষ্কার বিশিষ্টতা আকারে হয়।
(২) দার্শনিক সক্রিয়তার সর্বদাই একটি নিয়মগত মাত্রা আছে। বিভাগ একটি উচ্চক্রমও বটে। মার্কসবাদী পরিমণ্ডলে বস্তুবাদ ভালো শব্দ। ভাববাদ খারাপ শব্দ। কিন্তু আরও সাধারণভাবে সবসময় দেখা যায় যে, অভিজ্ঞতা অথবা ধারণার বিভাগ আসলে আরোপ করার কাজ। আর সেটা সম্ভবত তরুণদের ক্ষেত্রে। ফলে এটাও এক নতুন উচ্চক্রম। এবং নেতিবাচকভাবে, এই কাজের ফল হলো প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি অথবা পুরানো উচ্চক্রমের প্রত্যাগতি।
ফলে, আমাদের দর্শনে কার্যকরভাবে অবৈচিত্রমূলক কিছু একটা আছে। এক অপ্রতিরোধ্য পুনরাবৃত্তির মতো কিছু, অথবা একই [জিনিসের] চির প্রত্যাবর্তনের মতো। এই ম্যাট্রিক্সের একটা সারসংক্ষেপ আমরা করতে পারি – এটি ‘ম্যাট্রিক্স’ সিনেমার রহস্য সিরিজের সাথে অসম্পর্কিত নয়।
দর্শন হলো নতুন নিয়মতান্ত্রিক বিভাগ প্রস্তাব করে সকল তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা পুনর্গঠনের কাজ, যা প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধিক রাজত্বকে পিছনে ঠেলে দেয় এবং প্রচলিত মূল্যবোধ ছাড়িয়ে নতুন মূল্যবোধের সমর্থন করে। এসবকিছুর রূপ, প্রত্যেকের কাছে আরও কম বা বেশি মুক্ত ঠিকানা। তবে প্রথমত ও প্রধানত তরুণদের কাছে। কেননা দার্শনিক সঠিকভাবে জানেন যে, তরুণদের তাদের নিজেদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবং তরুণরা প্রায়ই যৌক্তিক বিদ্রোহের ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক থাকে।
এই সবকিছু ব্যাখ্যা করে যে, কিছু অর্থে দর্শন কেন সর্বদা একই থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, প্রত্যেক দার্শনিক মনে করেন যে তার কাজ সম্পূর্ণরূপে নতুন। কেবল মানুষই এভাবে চিন্তা করে। দর্শনের অনেক ইতিহাসবিদ চূড়ান্তরূপে আলাদা হওয়ার সাথে পরিচয় করিয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কান্টের পরে ধ্রুপদি অধিবিদ্যা নিয়ে বলা ছিল অসম্ভব। অথবা, ভিটগেনস্টাইনের পরে এটা ভুলে যাওয়া আর সম্ভব ছিল না যে, ভাষার অধ্যয়ন দর্শনের শাঁসমূল। কাজেই আমাদের একটা যৌক্তিক, বিচারমূলক, ও ভাষাতাত্ত্বিক বাঁক নিতে হবে। কিন্তু দর্শনে আসলে কিছুই অপরিবর্তনীয় নয়। চূড়ান্ত বাঁক নেয়া বলে কিছু নেই। আজকের দিনের অনেক দার্শনিকের কাছে প্লেটো অথবা লাইবনিজ, হাইডেগার অথবা ভিটগেনস্টাইনের মাঝে থাকা একই রকম কিছু বিষয় হাইডেগার অথবা ভিটগেনস্টাইনের চাইতে আরও চিত্তাকর্ষক ও সক্রিয় হতে পারে। এর কারণ তাদের নিজস্ব ম্যাট্রিক্স বহুলাংশে প্লেটো অথবা লাইবনিজের ম্যাট্রিক্সের অনুরূপ। বাস্তব ঘটনা হলো, দর্শনে স্পিনোজার সঙ্গে দেল্যুজ, দেকার্ত ও হেগেলের সঙ্গে সার্ত্রে, অ্যারিস্টটল ও বার্গস’র সঙ্গে মার্লেপন্টি, প্লেটো ও হেগেলের সঙ্গে আমি নিজে, স্লাভয় জিজেক কান্ট ও শেলিংয়ের সঙ্গে …আর হয়তো, প্রায় তিন হাজার বছর ধরে সবার সঙ্গে সবাই আছে।
তবে রীতিগতভাবে দার্শনিক ভূমিকা যদি অপরিবর্তিত থাকে, এবং সেই অপরিবর্তন যদি প্রত্যাবর্তন করে, তাহলে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের পরিবর্তন আমাদের এলেমে নিতে হবে। যেহেতু কিছু শর্তাবলীর অধীনে ক্রিয়া স্থান নেয়। যখন একজন দার্শনিক তার সময়ের অভিজ্ঞতার জন্য নতুন বিভাগ অথবা নতুন উচ্চক্রম প্রস্তাব করেন, তার কারণ এক নতুন বৌদ্ধিক সৃষ্টি, এক নতুন সত্য আবির্ভূত হওয়া। কেননা, আমাদের আসলে দার্শনিকের চোখে দর্শনের বাস্তব শর্তাবলীতে নতুন ঘটনার পরিণতি অনুমান করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ –সংখ্যা ও পরিমাপের উত্তর-পিথাগোরিয় ধারণা এবং জ্যামিতির শর্তাবলীর অধীনে প্লেটো সংবেদনযোগ্যতা ও বুদ্ধিযোগ্যতার মাঝে বিভাগ প্রস্তাব করেছিলেন। হেগেল, ইতিহাস ও হয়ে ওঠাকে পরিচিত করেছেন পরম ধারণার মাঝে। তার কারণ ছিল ফরাসী বিপ্লবের দুর্দান্ত অভিনবত্ব। গ্রীক ট্রাজেডি ও রিচার্ড ভাগনার এর আবিষ্কারে, সাংগীতিক নাটকীয়তার অনুভব প্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া দর্শনের মাঝে নিৎশে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিকশিত করেন। এবং আমাদের অভিজ্ঞতায় দেরিদা, কঠোর অধিবিদ্যক বিরোধের ধ্রুপদি দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর করেন অংশত নারী প্রশ্নের ক্রমবৃদ্ধিমান ও অপ্রতিরোধ্য গুরুত্বের কারণে।
একারণেই আমরা শেষ পর্যন্ত সৃজনশীল পুনরাবৃত্তির কথা বলতে পারি। ইশারা রূপে অপরিবর্তনীয় কিছু একটা রয়েছে – যেমন, বিভাগের ইশারা। কিছু ঘটনার চাপ ও তাদের ফলাফলের সাথে দার্শনিক ইশারার কিছু দিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কাজেই, আমাদের একটি [দার্শনিক]আঙ্গিক এবং একটি সার্বিক আঙ্গিকের পরিবর্তনশীল রূপ রয়েছে। একারণেই দার্শনিকদের মাঝে ব্যপক পার্থক্য ও সহিংস সংঘাত থাকা সত্ত্বেও আমরা পরিষ্কারভাবে দর্শন ও দার্শনিকদের স্বীকৃত করি। কান্ট বলেছেন, দর্শনের ইতিহাস ছিল একটা যুদ্ধের ময়দান। আসলেই তা-ই! কিন্তু দর্শনের ইতিহাস একই ক্ষেত্রে একই যুদ্ধের পুনরাবৃত্তিও বটে। সাংগীতিক চিত্র সম্ভবত সাহায্য করতে পারে। দর্শনের বিকাশ, বিষয় ও বৈচিত্রের ধ্রুপদি আঙ্গিকে। পুনরাবৃত্তি, বিষয়, চির নতুনত্ব ও বৈচিত্রে।
কিন্তু বিষয় ও বৈচিত্র উভয় আসে রাজনীতি, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও প্রেমে কিছু ঘটনাবলীর পরে। ঘটনাবলী একই বিষয়ের জন্য নতুন বৈচিত্রের প্রয়োজনীয়তা প্রদান করে। সুতরাং আমরা দার্শনিকরা, এক নতুন সত্যের বাস্তবিক হয়ে ওঠা দিনের পরে, রাতের বেলা কাজ করছি। কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স এর সুন্দর একটি কবিতা, ‘ম্যান ক্যারিং থিং’ এর কথা মনে পড়ছে। স্টিভেন্স লিখেছেন –‘আমরা অবশ্যই সারা রাত ধরে চিন্তার ভেতর দিয়ে যাই’। হায় হায়! এই হলো দর্শন ও দার্শনিকের ভবিতব্য। স্টিভেন্স আরও বলছেন, ‘যতক্ষণ না ঠাণ্ডার ভেতর উজ্জ্বল সুস্পষ্টতা থির হয়ে দাঁড়ায়’। হ্যাঁ, আমরা আশা ও বিশ্বাস করি, একদিন ‘উজ্জ্বল সুস্পষ্টতা’ থির হয়ে দাঁড়াবে।
ধারণার উজ্জ্বল সুস্পষ্টতা দাঁড়াবে আকাশের একটি ধ্রুব তারার মতো – ‘ঠান্ডায় থির’ হয়ে। এটা হবে দর্শনের শেষ পর্যায় – পরম ধারণা, সম্পূর্ণ প্রকাশ…কিন্তু তা কখনোই ঘটবে না। পক্ষান্তরে, জীবন্ত সত্যের দিবালোকে যখন কিছু ঘটে, তখন আমাদের দার্শনিক সক্রিয়তার পুনরাবৃত্তি ও নতুন বৈচিত্র সৃষ্টি করতে হবে।
কাজেই, দর্শনের অতীতের মতো দর্শনের ভবিষ্যৎ হলো সৃজনশীল পুনরাবৃত্তি। আমাদের অবশ্যই সারা রাত ধরে চিন্তার ভেতর দিয়ে যেতে হবে চিরতরে।
দার্শনিক আসলে কেজো লোক। যেহেতু সত্যের সকাল পর্যবেক্ষণ করা নিয়ে তার কাজ আছে। এবং পুরানো মতের বিরুদ্ধে এই নতুন সত্য ব্যাখ্যার কাজ আছে। যদি ‘আমরা অবশ্যই সারারাত ধরে চিন্তার ভেতর দিয়ে যাই’, তার কারণ আমরা অবশ্যই সঠিকভাবে তরুণদের বিপথগামী করি। যখন আমরা অনুভব করি, সত্য-ঘটনা আমাদের সাধারণ জীবনের ধারাবাহিকতায় বাধা তৈরি করে, তখন অন্যদের কাছে আমাদের বলতে হবে, ‘জেগে উঠুন! নতুন চিন্তা ও কাজের সময় এসেছে!’ কিন্তু তার জন্য অবশ্যই আমাদের নিজেদের জেগে থাকতে হবে। আমরা দার্শনিকরা ঘুমানোর জন্য অনুমোদিত নই। দার্শনিক আসলে এক গরিব নৈশ প্রহরী।