গানের শ্রোতাদের মধ্যে সকলেই ভাবুক নয়। অধিকাংশ লোকই গান উপভোগ করতে চায় না, গান বুঝতে চায়। পল্লীগ্রামে এইসব লোকের জন্য বিচার, তরজা, কবি প্রভৃতি গান তৈরি হয়েছে। অতি আধুনিক কবিতার মত বিচার গানের রচয়িতারা গানের বিষয়বস্তু কথার ঘোর প্যাঁচের আড়ালে গোপন করে রাখে। তারই দু’একটা নমুনা দিই –
নদীর কূলে বট বিরিক্ষি তাহার তলে চিতা
মা পুতে সহমরণ যায় তখন জন্মে পিতা।
অথবা
গাছের উপরে লতার বসতি
তাহার উপরে ফুল
ফুলের উপরে ভ্রমর গুঞ্জরে
কালিয়া মজাইল কুল।
এই কথাগুলির মানে বলে দেই। গাছের উপরে লতার বসতি অর্থাৎ আমাদের দেহের উপরে গলা। লতার উপরে ভ্রমর গুঞ্জরে অর্থাৎ গলার উপরে নাকের দুই ছিদ্র দিয়ে আমরা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস লই।
বিচার গানের বহু অংশ এরূপ হেয়ালীর উপরে রচিত হয় বলে শ্রোতাদের মধ্যে তার ব্যাখ্যা জানার কৌতূহল জন্মে। সেই কৌতুহল মেটানর জন্য পীরের নিকটে মুরীদ হতে হয়। যেখানে সেখানে যার তার কাছে এইসব গানের ব্যাখ্যা করলে ব্যাখ্যাকারীর খুবই ক্ষতি হয়। বাউল গানের গায়কদের এই বিশ্বাস খুব দৃঢ়।
কেউ কেউ বলেন, বাউল গানে আর মুর্শিদী গানে কোনই পার্থক্য নেই। একথা ভুল। কোন জেলার কোন স্থানে হয়তো বাউল গানকে মুর্শিদী গান বলা হয়। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানে মুর্শিদী গান বলে যে এক রকমের ভাব গান আছে যা কথা বা সুর বাউল গান হ’তে একেবারেই পৃথক। বিচার গানের সুর দ্রæত তালে চলে। কিন্তু মুর্শিদী গানের অধিকাংশ সুরই বিলম্বিত লয়ের। এগুলি ভাটিয়ালী গান নামে পরিচিত। পূর্ব পাকিস্তানের নদীর গান আজ পৃথিবীর সকল দেশে আদৃত।
কুষ্টিয়া আর যশোর জেলায় বাউল বা বিচার গানের বিশেষ চর্চা দেখা যায়। এই জেলা দু’টির অতি নিকটে নবদ্বীপে একসময় নব্য ন্যায়ের উৎপত্তি হয়েছিল। তার প্রভাব নিশ্চয় বাউল গানে এসেছে।
বিচার বা বাউল গানের উদ্দেশ্য হ’ল তত্ত¡কথা প্রচার করা। এই তথ্যকথা বলতে অনেক ক্ষেত্রেই এই গানের রচয়িতারা ছোটখাটো একজন দার্শনিক বনে যান। এই গানের মাঝে মাঝে কিছুটা কবিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কাব্য করে কথা বলা এই গানের রচয়িতাদের উদ্দেশ্য নয়।
বাউলদের সঙ্গে বিচার গানের গায়কদের সামান্য পার্থক্য আছে। বাউলেরা তাদের গানের বিষয়বস্তু অনুসারে গোপন সাধনা করে বিচার গানের গায়কেরা এইসব তথ্যবস্তু নয় তার প্রতিদ্বন্ধির সঙ্গে পাল্লা দেয়।
সরহ হ’তে নাগার্জুন হয়ে বৌদ্ধ গান ও দোঁহার আলো আঁধারি পার হয়ে বৌদ্ধ তান্ত্রিক ও বৈষ্ণব সহ-জিয়ার আখড়ার ধুলী গায়ে মেখে সুফী সাধকের সংঘ লাভ করে এই গান বর্তমানকালে এসে এ যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়েও নিজস্বতা হারায়নি। বৈজ্ঞানিক যুগের এমন যে রেলগাড়ি তাও বাউলদের দেহতত্তে¡র ব্যাখ্যায় সাহায্য করেছে-
গাড়ী চলছে আজব কলে
গাড়ী চলছে আজব কলে
গাড়ীতে দিয়ে মাটি পরিপাটি
আগুন জল আর হাওয়ার বলে।
ইঞ্জিলের কলের ভিতর
মরি কি আজব লহর
কি চমৎকার নীলে
বালাখানা জ্বলছে বাতি
ভালো করছে রঙ মহলে।
বিলাতগুনা তারের কল এসে
মনিপুরের পির নালেতে
থাম্বা গড়েছে।
বিচার গানের বহু বিভাগ আছে সৃষ্টিতত্ত¡, নবীতত্ত¡, নারীতত্ত¡, যৌবনতত্ত¡ প্রভৃতি। বিচার গানের এইসব তত্ত¡ বস্তুর চাইতে এই গানের বহু বিচিত্র সুর আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। এই সুরগুলি এখনই সংগ্রহ করে রাখার প্রয়োজন। বিলম্ব হলে এগুলি লোপ পেয়ে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিগান প্রবন্ধে বলেছেন-কবিগান আগেও যেমন ছিলনা পরেও এরা থাকবেনা, সাময়িক আগাছার মতো এরা ধীরে ধীরে লোভ পাবে। তিনি হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের কবি গান শোনেননি। হরি আচার্য রূপবর মনোহর, প্রভৃতি কবি গায়কেরা যে অপূর্ব রচনা সম্ভার রেখে গেছেন তা জানলে রবীন্দ্রনাথ হয়তো তার মত বদলাতেন। পূর্ব পাকিস্তানের কবিগানে যে অপূর্ব সুরবৈচিত্র আছে তা কোনদিন লোপ পাবে না। আলপনার নক্সী যেমন দেখতে দেখতে মুছে যায় কিন্তু তার রেখাগুলি আমাদের মনে বিচিত্র হয়ে থাকে, তেমনি কবি গানের রচনা বাতাসের উপর কেউ লিখে রাখে না। শুনতে না শুনতে ফুরিয়ে যায়। তবু তার রেশ আমাদের মনে বহুক্ষণ স্থায়ী থাকে। কবিগানও মনের মানব মনের প্রকাশের একটি সুন্দর ধারা।
কুষ্টিয়া জেলায় তর্জাগানের কিছু কিছু প্রচলন আছে। কবিগানের দলে সাত-আট জন দোহার থাকে, দোহারেরা সখী সংবাদ ডাক মালশী প্রভৃতি গান গাহিয়া শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে। তর্জাগানে এই সবের বালাই নাই। তর্জাগান ছড়া সর্বস্ব। দলপতি ছাড়া কেটে তার প্রতিদ্ব›দ্বীকে আক্রমণ করে। দুই একজন দোহার মাঝে মাঝে ধুয়া গাহিয়া দলপতিকে বিরাম দেয়। বিচার গানের মতোই এই গানেরও উদ্দেশ্য তত্ত¡কথা প্রচার করা। সেই সঙ্গে মুসলমানদের নবী কাহিনী আর হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনী এসে পড়ে। তর্জা গায়কের কৃতিত্ব তার রচনাশক্তির জন্য নয় সে কতটা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে মুক্তির বান মেরে ঘায়েল করতে পারে, তার উপর। বিচার গান, কবি গান, তর্জা গান লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের জনসমাজের মনে জ্ঞান বিস্তার করে চলেছে, তাতে তাদের মন জ্ঞানমুখীন হচ্ছে। কোন একটা বিষয় নিয়ে তারা ভাবতে শিখছে। দেশে ভাবুক লোকের চাইতে এদের সংখ্যাই বেশি। সেজন্য গ্রাম দেশে আর তর্জা বিচার গানের সমঝদার অসংখ্য।
[ ঢাকা বেতার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (সম্ভবত ১৯৬৭) পূর্ব পাকিস্তানের লোক-কৃষ্টি প্রবন্ধ সংকলনে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের এ প্রবন্ধটি হয় ]