ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া,
নিশীথ রাতের বাঁশি বাজে — শান্ত হও গো শান্ত হও॥
আমি প্রদীপশিখা তোমার লাগি ভয়ে ভয়ে একা জাগি,
মনের কথা কানে কানে মৃদু মৃদু কও॥
তোমার দূরের গাথা তোমার বনের বাণী
ঘরের কোণে দেহো আনি।
আমার কিছু কথা আছে ভোরের বেলার তারার কাছে,
সেই কথাটি তোমার কানে চুপিচুপি লও॥
কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানটি: https://www.youtube.com/watch?v=k4dOnJXRAak
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বসন্ত” নাটকে দীপশিখা’র গান এটি। নাটকের প্রথম দিকেই গানটি আছে। যখন মাধবী, চাঁপা, করবীরা ঋতুরাজের অপেক্ষায় ব্যাকুল, যখন বসন্তের পথ চেয়ে বেণুবন চঞ্চল, তখন অতি কোমল, মৃদু আলোর শিখা আপন মনে গেয়ে চলে এই গান। কিন্তু সে কি বসন্তের উদ্দেশ্যে? না। সে আছে এই উতল হাওয়ারই পথ চেয়ে। তবু যখন ঋতুরাজের আগমনী খবর নিয়ে দিকে দিকে দোলা লাগিয়ে দখিন হাওয়া আসে, তখন “বাইরের বেণুবন উতলা হয়ে” উঠলেও দীপশিখাটি থাকে শঙ্কিত। তার মনে ভয় নিভে যাবার। তার শঙ্কা যদি মনের কথা জানাবার আগেই সে ফুরিয়ে যায়, তবে তো সেই কথাটি তার সনে বলা হবে না।
ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া,
নিশীথ রাতের বাঁশি বাজে — শান্ত হও গো শান্ত হও॥
তারার র্স থেকে তাই সে শুরু করে তার আকুল অনুরোধ। চড়ার সুরে গিয়ে গানটি ধরার পিছনে কারণ হিসেবে আমি শুধু আকুলতা নয়, পাই মৃদু প্রদীপশিখাটির তার প্রিয় উতল হাওয়ার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাও। সে যে পড়ে আছে ঘরের কোণে; উতলা দখিনা বাতাসকে কাছে ডাকতে চাইলে কণ্ঠ তো জোরে ছাড়তেই হবে! তবু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই জোর যেন রূপ নেয় এক ব্যাকুল মিনতিতে। সুরটিও তাই আস্তে আস্তে নামতে থাকে—শুদ্ধ ন ছুঁয়ে, ধ-তে নেমে সে মিনতি এসে থামে প-তে। সেখানেই খানিক দাঁড়িয়ে যেন সে উতল হাওয়ার গতি রুদ্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে, তারপর কড়ি মধ্যম-এর উপর পা ফেলে যেন নত করে মাথা—নামে মুদারার স-তে। “উতল হাওয়া” র ঝাপটায় সে ওঠে কেঁপে, গ থেকে প-এর মীড়ের দোলাতেও পাই সেই হঠাৎ কাঁপন।
স্থায়ীর প্রথম ছত্রের আকুলতা বয়ে চলে পরের অংশটুকুতেও। মুদারার স, প আর কড়ি হ্ম-এর মধ্যে সুরের বিচরণে মনে হয় যেন সত্যি তো, নিশীথরাতের বাঁশি’র তো এর চেয়ে বেশী চড়ায় বাজবার কথাই নয়! আর সেই বাঁশিটি শোনবার জন্যই যেন দীপশিখা’র করজোড়ে অনুরোধ দখিন হাওয়ার কাছে—”শান্ত হও গো, শান্ত হও”। গানের প্রথম দুই ছত্রেই সুরের বিন্যাসে চারবার “ওগো” আর “গো” শব্দটি বলা হয় যা দিয়ে আমরা শুধু আমাদের সবচেয়ে আপনার জনটিকেই সম্বোধন করি। উতল হাওয়া যে প্রদীপশিখার আপনার চেয়েও আপন, সে আর বুঝতে বাকী থাকে না।
আমি প্রদীপশিখা তোমার লাগি ভয়ে ভয়ে একা জাগি,
মনের কথা কানে কানে মৃদু মৃদু কও॥
প্রদীপের আলোকশিখাটি অন্তরায় এসেও দূরের দখিনা বাতাসকে কাছে পেতে সচেষ্ট। সুরটি বাঁধা আবার সেই তারার র্স-তেই। অনেকটা যেন মাটির পৃথিবীর সুদূর আকাশকে ডেকে কথা বলা। সে চাইছে উতল হাওয়া তাকে চিনে নিক, কাছে আসুক। সুর তখন ঘুরে বেড়ায় তারার র্স থেকে মুদারার ধ-এর মধ্যে। সেই অপেক্ষায় মিশে আছে ভয়, যে ভয়ের প্রকাশটি সুসংযত ভাবে পাই কড়ি হ্ম-এর প্রাধান্যে। আবার পরক্ষণেই সে ভয় কাটিয়ে উঠে সজোরে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে দীপশিখা। এই সুদূরকে কাছে ডাকা, প্রতীক্ষার শঙ্কা সব যেন মিলেমিশে গেছে এই ছত্রের সুরে। আর যখন সে নিজে কোমল হয়েও কানে কানে শুনতে চায় উন্মাতাল উতল বাতাসের মনের কথা, সুরটি শুরুই হয় মুদারা থেকে যার আসাযাওয়া বাঁধা পড়েছে গ-থেকে ন-এর ভেতর। এই চারটি শব্দে যেন কবি পুরে দিয়েছেন দীপশিখার মনের যত আবেগ, যত ভালোবাসা।
শেষ তিনটি শব্দের ব্যঞ্জনা আবার অন্যরকম। প্রদীপশিখা নিজে যেমন মৃদু, উতলা বাতাসও তাকে তেমনি করে অনুভব করুক, এইটুকুই তার চাওয়া। তাই “মৃদু মৃদু” শুধু গ আর ম তে বাঁধা হলেও তাতেই তার কোমলভাবটি সুপ্রকাশিত। এরপর “কও” শব্দটিকে যেভাবে গাওয়া হয়, তাতে প্রথমে গ-থেকে প ছুঁয়ে আসা একটি লম্বা মীড় নামে র-তে, তারপর আবার সেই র-থেকেই উঠে যায় ন-তে। সুরের এই ওঠানামায় আমরা বারবার পাই বিরহিনী দীপশখার ব্যাকুল হৃদয়ের আকুতি, তার প্রেমময় আকাঙ্ক্ষা।
তোমার দূরের গাথা তোমার বনের বাণী
ঘরের কোণে দেহো আনি।
সঞ্চারীতে শিখাটি যেন ভেঙে পড়ছে ক্লান্তিতে, তাই সুরও যেন নেমে আসে মুদারায়, আসাযাওয়া করে মূলতঃ স-থেকে প-এর ভেতর। তার মধ্যেই দু’একবার ন আর ধ-এর ছোঁয়া আমায় দেয় দমকা বাতাসে প্রদীপ নেভার আভাস। তবু তার ভেতরেই সে জেনে নিতে চায় উতল হাওয়ার সারাদিনের কথা, সব কাজের গল্প।
আমার কিছু কথা আছে ভোরের বেলার তারার কাছে,
সেই কথাটি তোমার কানে চুপিচুপি লও॥
আভোগে এসেও আবার প্রদীপশিখা ফিরে যায় প্রথম অন্তরার তারার সুরে। কিন্তু এইখানে এসে আমি কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়ি। দীপশিখা তার মনের কথা কার জন্যে রেখে যাচ্ছে? উদ্দাম দখিন হাওয়া, নাকি সুদূরের উজ্জ্বল তারা? আমার কেমন মনে হয় উতলা দখিন হাওয়াকেই সে ভালোবাসে। অসময়ে হোক, অধীর হোক, তবু সে তো আসে নিবু নিবু শিখাটির কাছে—ফিরে ফিরে। কিন্তু ভোরের তারা তো চিরসুদূর। তাকে তো ঘরের কোণের দীপশিখা কখনো পাবেই না।
তাই, দখিন হাওয়ার দামালপনায় নিভে যাবার আগে শেষ-না-হওয়া মনের কথাটি সে কার কাছে রেখে গেল তার খবরটি সে জানিয়ে যায় প্রেমিকপুরুষটিকে! যদি তার প্রিয় একান্তে তার কাছে, তার ঘরের কোণে আসবার আগেই সে নিভে যায়, ভোরের তারাটি তো থাকবে বেঁচে অনন্তকাল। সেই তারাটির কাছেই তাই দীপশিখাটি জানিয়ে গেল তার সকল কথা। অন্ততঃ সেই কথাটি যেন উতল হাওয়া শুনে নেয়, যেন জানতে পায় প্রদীপশিখার আকুলতা, তাই তারার সুরের আশ্রয়। নইলে যে সুদূরের বীণায় সুর বাজবে না, আর সে সুর না বাজলে ক্ষণে ক্ষণে বকুলবনে দোল দিয়ে যাওয়া উতল হাওয়াটিরও অজানাই থেকে যাবে মাটির ঘরের কোণে রাখা মাটির প্রদীপের নিভন্ত শিখাটির আত্মনিবেদন।
“বসন্ত” নাটকের গান বলে’ গীতবিতানেও যে এ গানটি প্রকৃতি পর্যায়ের বসন্তের গানের তালিকাতেই পাওয়া যাবে সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে কবি’র ৬১ বছর বয়সে লেখা ইমনাশ্রিত এই গানটি প্রকৃতিতে না থেকে প্রেম পর্যায়ে থাকলেও এর ভাবে, এর ব্যঞ্জনায় কোন পরিবর্তন হতো বলে তো মনে হয় না।
সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই: পর্ব ৮ I I চয়ন মল্লিক