সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই: পর্ব ১০ (ওগো সাঁওতালি ছেলে) I I চয়ন মল্লিক

ওগো সাঁওতালি ছেলে,
শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত কি এলে।
ধানের ক্ষেতের পারে   শালের ছায়ার ধারে
বাঁশির সুরেতে   সুদূর দূরেতে   চলেছ হৃদয় মেলে॥
পূবদিগন্ত দিল তব দেহে নীলিমলেখা,
পীত ধড়াটিতে অরুণরেখা,
কেয়াফুলখানি   কবে তুলে আনি
দ্বারে মোর রেখে গেলে॥
আমার গানের হংসবলাকাপাঁতি
বাদল-দিনের তোমার মনের সাথি।
ঝড়ে চঞ্চল তমালবনের প্রাণে
তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি একখানে,
মেঘের ছায়ায় চলিয়াছি ছায়া ফেলে॥

অদিতি মহসিনের কণ্ঠে গানটির লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=0L9BZXFLoKw

বর্ষা যে কবিগুরুর সবচেয়ে প্রিয় ঋতু ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। গীতবিতান খুঁজলে ১২৪ টি গান পাওয়া যায় শুধু প্রকৃতি পর্যায়ের ভেতরেই। আরো নানা ভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যাবে হয়তো আরো অন্ততঃ ৫০টি গান। এই বিশেষ গানটির পেছনের গল্পটি হয়তো অনেকেরই জানা। তখন কবির বয়স ৭৮। শান্তিনিকেতনের ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানের অজুহাতে শৈলজারন্জন মজুমদার (শিক্ষক, গায়ক, এবং রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানের স্বরলিপিকার) কবির কাছে আবদার করলেন নতুন কিছু বর্ষার গানের। তৈরী হল “ওগো, সাঁওতালি ছেলে”। পরদিন এল আরো একটি নতুন গান—“বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল”। এমনি করে সে যাত্রা কবি লিখেছিলেন ১৬টি আনকোরা বর্ষার গান। (গল্পের তথ্যসূত্র- শৈলজারন্জন মজুমদার: ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’)

গানের পেছনের গল্প যা-ই হোক, এমনি করে শ্রাবণমেঘের বর্ণনা কি আর কোথাও পাওয়া যায়? এ কি সত্যি কোনো সাঁওতাল কিশোর? না কি দূর্বাদলঘনশ্যাম? না শুধুই নীল-অঞ্জন-ঘনপুঞ্জছায়া? এ কি নবীন বরষার সবুজ তরুণ রূপ, নাকি শ্যামকিশোরের কৃষ্ণঘন রূপ? সে যে-ই হোক, সে এসেছে “শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত” হয়ে কবির দ্বারে—ভেসে এসেছে কোন দূর থেকে সুদূরে—বাঁশির সুরেতে সুর মিলিয়ে ধানের ক্ষেতের উপর দিয়ে, শালবনের ধার দিয়ে। আর কবি যেন সেই দূরের সুরেই মিলিয়েছেন এই চরণের সুরটি।

গানের শুরুতেই সেই শ্যামগম্ভীরকে যেন খুব গভীর হৃদয় মিশিয়ে কবি ডাকেন ‘ওগো’ বলে। আর তাতে একটি দীর্ঘ তান যুক্ত হয়ে সম্বোধনটি আরো আন্তরিক, আরো আবেগময় হয়ে উঠেছে। শুধু কি এই একটি শব্দই এ গানের সকল রূপরস তুলে ধরেছে? কৃষ্ণবর্ণ সেই মেঘ কি আসলে শুধুই একটুকরো মেঘ? এ যেন রাইকিশোরীর মনে শ্যামচাঁদের রূপ! ভোরের প্রথম কিরণটি যেন সেই শ্যামকিশোরের অংগরাগে আনে “নীলিমলেখা”—যেন তুলি দিয়ে সূর্যদেব এঁকে দেন তার দেহবর্ণটি। ‘লেখা’ কথাটির একস্বরে স্থির হয়ে থেকে একদম শেষে গিয়ে আলতো করে নেমে আসা যেন সেই তুলিরই টান। আবার সেই অরুণরবিই তার পীতবাসে দেয় সিঁদুররেখা। বর্ষার সেই শ্যামল কিশোর রূপ যেন কবিকে ডাক দিয়ে যায় কেয়া ফুলের গন্ধে মাতাল করে —বারে বারেই।

সেই গহনঘন বাদলমেঘের সাথী হয়ে কবির গান আজ যেন পাখা মেলেছে—যেন ‘হংসবলাকাপাঁতি’র ডানায় ভর করে সে গানের সুর মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে ‘দিকদিগন্তের পানে নিঃসীম শূন্যে’—গেয়ে চলে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীত। এই অংশের সুরেও যেন পাই সেই ডানা মেলে উড়ে যাবারই আভাস। এর পরেই আসে তমালবনের প্রাণ আকুল করা উন্মাতাল ঝড়! সুরটাও যেন সেই ঝড়ের আভাসই বয়ে আনে। যেন সেই ঝোড়ো হাওয়ায় তাঁর কণ্ঠ ঢাকা পড়ে যায়, তখন গানের সুর ছাপিয়ে ওঠে সেই হাওয়ার কলতানকে। ধীরে ধীরে ঝড় থেমে যায়, থেকে যায় মেঘের ছায়া; আর কবি সেই মেঘের ছায়াতে নিজের ছায়া মিলিয়ে চলতে থাকেন অজানা কোন পথে।

কবির শেষজীবনের রচনা মিশ্র ভৈরবের এই গানটির মতো গানের সংখ্যা বোধকরি হাতে গোনা যাবে। এর সুরের নানা ওঠাপড়ায় আমি পাই কেমন এক নাম-না-জানা দুঃখ, কী এক সুগভীর বেদনা। সেই চির-অধরার সন্ধানে আমাকেও ঘুরে বেড়াতে হয় সেই চঞ্চল ঝড়ের বাতাসে, সেই মেঘের ছায়ায়, সেই “ধানের ক্ষেতের পারে… শালের ছায়ার ধারে।“ আমারও কবির মতোই মনে হয় যেন “… সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মর্মস্থল হতে একটা গম্ভীর কাতর করুণ রাগিণী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে– সকাল বেলাকার সূর্যের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে এসেছে, গাছপালারা নিস্তব্ধ হয়ে কী যেন শুনছে এবং আকাশ একটা বিশ্বব্যাপী অশ্রুর বাষ্পে যেন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে– …দূর আকাশের দিকে চাইলে মনে হয় যেন একটা অনিমেষ নীল চোখ কেবল ছল্‌ছল্‌ করে চেয়ে আছে।।“ কবির নিজের বলে যাওয়া এই কথার পর আমার আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে?

সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই: পর্ব ৯ I I চয়ন মল্লিক

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top