আন্তোনিও পোর্কিয়ার “স্বর” ।। ফরাসি থেকে অনুবাদ- আহমেদ সজীব

আন্তোনিও পোর্কিয়া বিষয়ে আমি প্রথম জানতে পারি কবি মজনু শাহের লিখা থেকে। তখনো জানতাম না আন্তোনিও পোর্কিয়া নিজেই বলবেন- Mon livre Voix est quasiment une biographie. Qui est quasiment à tout le monde. (আমার বই ‘স্বর’ হলো একটি জীবনী এবং প্রায় সবার জীবনী।) একজনের পক্ষে সবার জীবনী কিভাবে লিখা সম্ভব তা আমার বোধের অতীত ছিলো। কিন্তু পোর্কিয়ার স্বরের ভিতরে যতোই প্রবেশ করা যায়, ততোই বোধের জগতে প্রতিফলিত হতে থাকে আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন। আন্তোনিও পোর্কিয়ার ‘স্বর’ যেনো আমাদের নিজেদের ভালো করে দেখে নেওয়ার জন্য তৈরি করা এক আশ্চর্য আয়না বিশেষ; যেখানে যুক্তিতর্ক অর্থহীন হয়ে যায়, শুধু জীবনপ্রবাহ নামক ভঙ্গুর অথচ একমাত্র সত্য ধারাটি বয়ে চলে আপনাআপনি, আমরা যার কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করি না, আমরা শুধু মাধ্যম হয়ে অবস্থান করি মাত্র।

আন্তোনিও পোর্কিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৩ নভেম্বর ১৮৮৫ সালে, ইতালির কালাব্রিয়া শহরে। বাবা ফ্রান্সেস্কো পোর্কিয়া পেশায় একজন ধর্মযাজক ও কাঠ ব্যবসায়ী ছিলেন, মা রোজা ভেসসিও ছিলেন গৃহিণী। সাত ভাইবোনের মাঝে পোর্কিয়া ছিলেন সবার বড়ো। বোধকরি বাবা ধর্মযাজক হওয়ার কারণেই তাঁর পরিবারকে কিছুদিন পরপরই এক শহর থেকে আরেক শহরে বসতি গাড়তে হতো। পরিবারের প্রধান, আন্তোনিও পোর্কিয়ার বাবা, ফ্রান্সেস্কো পোর্কিয়া, ১৯০০ সালে মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার দুই বছর বাদে, ১৯০২ সালে তাঁরা নাপোলি থেকে জার্মানের পতাকাবাহী একটি জাহাজে করে স্থায়ীভাবে আর্হেন্তিনায় চলে আসেন। তিনি বুয়েনোস আইরেসের বন্দরে বহুদিন কেরানির কাজ করেন এবং পরে ভাই নিকোলা পোর্কিয়ার সাথে মিলিতভাবে ভিয়া বলিভারে একটি ছাপাখানা গড়ে তোলেন। দুই ভাই মিলে দিনরাত পরিশ্রম করে কয়েক বছরের ব্যবধানেই ছাপাখানাটি সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন। দুই ভাই মিলে দিনরাত পরিশ্রম করে কয়েক বছরের ব্যবধানেই ছাপাখানাটি সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন। এই সময় Federación Obrera Regional Argentina (আর্হেন্তিনার আঞ্চলিক শ্রমিক সংগঠন) এর পদের জন্য লড়াই করে এবং La Fragua নামক একটি বামপন্থি ম্যাগাজিনকে সহযোগিতা করে অবিলম্বেই পোর্কিয়া দেখিয়েছিলেন যে তাঁর একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই La Fragua মাগ্যাজিনটিতেই তাঁর Voces (স্বর) বইয়ের কিছু অংশ প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন। পোর্কিয়া লিখেন-পৃথিবীর সর্বত্র আমি বাম দিকে। কেননা আমি এই দিকে জন্মগ্রহণ করেছি।

চিন্তার মৌলিকতা এবং প্রকাশভঙ্গির অনন্যতার কারণে জীবিত অবস্থায়ই বন্ধুদের মাঝে তিনি শীর্ষস্থান লাভ করেছিলেন। কবি রবের্তো হুয়াররোস পোর্কিয়ার চিন্তাধারায় এতোটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তাঁর জগদ্বিখ্যাত কবিতার বই ÔPoesia VerticalÕ এর অনেক কবিতায়ই ছড়িয়ে আছে সেই ছাপ।

আন্তোনিও পোর্কিয়া ১৯৬৮ সালের ৯ নভেম্বর বুয়েনোস আইরেসের ভিসেন্তে লপেজে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যু কোথায়? মৃত্যু তো মূলত অনন্তের দিকে প্রবেশদ্বার মাত্র…

অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি অনুসরণ করেছি রঁজে ম্যুনিয়ে ও দ্যনিয়েল ফজরাসের করা মূল এস্পানিওল থেকে ফরাসি অনুবাদ। রঁজে ম্যুনিয়ের ভাষা অসম্ভব কাব্যময় এবং বারবার পড়বার মতো। অপরদিকে দ্যনিয়েল ফজরাসের ভাষা স্বাভাবিক বচন ভঙ্গিমায় ভরপুর, ভাষা নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন না ফজরাস, ওঁর ঝোঁক অর্থের দিকে। আমি চেষ্টা করেছি রঁজে ম্যুনিয়ে থেকে সর্বাধিক অনুবাদ করার।

আন্তোনিও পোর্কিয়ার ছোটো ফুলের বাগানের মতো তাঁর বই ‘স্বর’ও পৃথিবী নামক এই গ্রহের মানুষের জন্য একটুখানি কিন্তু অবিনশ্বর ফুলের বাগান; যে ফুলের বাগানের ঘ্রাণ শুঁকে নিয়ে সময়ে সময়ে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও কাটিয়ে দেওয়া যায়-ফুলের অন্তর্গত সৌন্দর্য বিষয়ে ভাবতে ভাবতে। লেখালেখির উঠান অনলাইনের জন্য কবি বন্ধু অজিত দাশের অনুরোধে আন্তোনিও পোর্কিয়ার প্রকাশিতব্য বই ‘স্বর’ থেকে তার নির্বাচিত কয়েকটি স্বর প্রকাশিত হলো পাঠকের উদ্দেশ্যে। আসুন, আন্তোনিও পোর্কিয়ার ‘স্বর’ শুনি…

― আহমেদ সজীব, প্যারিস, ফ্রান্স
::
.
.


আমার দারিদ্র্যও সম্পূর্ণ নয় : সেখানে আমি নিজেই নেই।
.
সবকিছুতে প্রবেশের মধ্য দিয়েই আমি সবকিছুর থেকে বাইরে বের হয়ে যাই।
.
যা আমরা জীবন দিয়ে পরিশোধ করি, তা কখনো মূল্যবান নয়।
.
কোনোকিছু, যতোক্ষণ না পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা হলো কোলাহল, একবার পরিপূর্ণ হয়ে গেলে, তা নীরবতা।
.
মানুষ যখন বিলাপ করে না, তখন তাকে অস্তিত্বহীন মনে হয়।
.
যদি তোমার নিজের পথে হাঁটো, সকলেই বলবে তুমি ভুল পথে আছো।
.
কান্নার চেয়েও কাউকে কান্না করতে দেখে আমরা অধিক অশ্রুসিক্ত হই।
.
পূরণ করার মধ্য দিয়ে আমরা শূন্যতাকে অনুভব করি।
.
পরিপূর্ণ আলোর কাছে, সামান্য একটি ছায়াও নই আমরা।
.
শত বছর এক মুহূর্তের ভিতর ফুরিয়ে যায়। যেভাবে এক মুহূর্ত এক মুহূর্তের ভিতর ফুরিয়ে যায়।
.
আমি যে পাহাড় গড়ে তুলেছি তা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমার কাছে বালির দানা চেয়েছে।
.
যখন আমরা অসম্ভবকে ভালোবাসি না, তখন আমরা কোনোকিছুকেই ভালোবাসি না।
.
সবকিছুই অন্ধকারের অংশমাত্র, এমনকি আলো নিজেও।
.
নিজের ভালোর মাঝে যে আরও ভালো খুঁজে বেড়ায়, সে নিজের ভালোকে হারায়।
.
সত্য, যখন তা সামান্য সত্য, তখন প্রায় সম্পূর্ণ সত্য, আর যখন তা বড়ো কোনো সত্য, তখন প্রায় একটি সম্পূর্ণ সন্দেহ।
.
সমস্ত অসীমের চেয়েও, তিন-চারটি নিষ্পাপ অভ্যাস আমার ওপর বেশি ক্ষমতা রাখে।
.
আমার সময়ের টুকরোগুলো অনন্তকালের সঙ্গে খেলা করে।
.
মিথ্যে বলতে ক্লান্ত মানুষ যেকোনো সত্যে আত্মহত্যা করে।
.
তোমার দুঃখগুলো পৃথিবীর মধ্যে ঢেলে দাও, দেখবে, তুমি তোমার দুঃখের জন্য অনুশোচনা করছো।
.
তুমি নিজেকে পরিশুদ্ধ করো, নিজেকে পরিশুদ্ধ করো… সাবধান! হয়তো তোমার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
.
তোমার নীরব দুঃখগুলো যেনো আমার কথা না শুনতে পায়, তাই আমি নিচু স্বরে কথা বলি।
.
মানুষের দুঃখ আরও বড়ো হয়ে ওঠে যখন সে নিজেকে দুঃখের ভিতর ডুবিয়ে দেয়।
.
সবকিছুর ওজন করেছি, আমি জানি দীর্ঘশ্বাসের কোনো ওজন হয় না।
.
সবকিছুর ওজন করেছি, আমি জানি দীর্ঘশ্বাসের কোনো ওজন হয় না।
.
আমাকে জড়িয়ে রাখা কোনো শিকলকে ভাঙতে গেলে মনে হয় যে, আমিই ফুরিয়ে যাচ্ছি।
.
মানবতা এখন আর গন্তব্য জানে না, কেননা কেউই তার জন্য অপেক্ষা করে নেই : এমনকি ঈশ্বরও নয়।
.
চোখের জল রাখার জন্য যারা ফুলদানি খুঁজে পাওনা, তারা কেঁদো না।
.
চোখের জল রাখার জন্য যারা ফুলদানি খুঁজে পাওনা, তারা কেঁদো না।
.
যা কিছু আমি জীবনে বয়ে চলি তা থেকে মুক্ত হতে, আমি জীবন বয়ে চলি।
.
প্রায় সবকিছুই আমি এইভাবে অতিক্রম করি, সময়ের মধ্য দিয়ে, যা সেতুর মতো সবকিছুর ওপর দিয়ে বয়ে চলে।
.
মৃত্যুকে জানতে আমরা জীবন ব্যয় করি।
.
যে সমুদ্রে তুমি একফোঁটা জল রাখো, দেখোও একফোঁটা জল।
.
কেউ হওয়া মানে একা কেউ হওয়া।
কেউ হওয়া হলো নিঃসঙ্গতা।
.
সবসময় আমরা তাই অনুভব করতে পারি যা কেবল একবার ঘটে, যা সবসময় ঘটে তাই নয়।
.
ফুলেরও, সুগন্ধি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ম্লান হয়ে যেতে হয় খানিক

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top