একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (১৯তম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

(৫১)

সেই সময়ে দুঃখী মানুষগুলি সুতির কাপড় পরত। ধনী  সম্ভ্রান্ত মানুষরা পরত টেরিলিন  টেরিকটনের কাপড়। টেরিলিনের কাপড়গুলি একবার ইস্তিরি করলেই হল, চিরদিনের জন্য ভাঁজ থেকে যায়। সুতির কাপড়ে ইস্তিরি প্রায় থাকেই না। একদিন থাকলেও ধুয়ে দিলেই শেষ। বরুণ সমস্ত ধরনের কাপড়ই পরত।  বরুণের সুতির কাপড়েরও অভাব   ছিল না টেরিলিন, টেরিকটনেরও অভাব ছিল না। খদ্দেরের জেকেট ছিল, জওহর কোট‌,  ইংলিশ কোটও ছিল।জওহর কোট পরলে বরুণকে খুব সুন্দর দেখাত। বজালী অঞ্চলে জওহর কোট পরা দ্বিতীয় আর কেউ ছিলনা ।

বরুণের সুতির  পায়জামা পেন্ট ইস্তিরি   করার জন্য রাহুলকে রামলাল বিহারীর লণ্ড্রিতে যেতে হত। খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে রামলাল ওদের হাতে  একেবারে গরম কাপড় তুলে দিত। ওরা  (রাহুলের সঙ্গে একটা ভাইও  যায়,  তাকে এসব কাজে একা যেতে দেওয়া যায় না) শরীরের একপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে  বাড়িতে ফিরে আসার সময় উষ্ণতা অনুভব করে।  এতেই তাদের শান্তি।

তারপরে রাহুলরা যখন আরও একটু বড়ো হল বরুণ বাড়ির জন্য একটা ইস্তিরি কিনে আনল।ইস্তিরিটার  ভেতরে জ্বলন্ত কাঠ কয়লা ভরতে হয়।পেছনের একটা ফুটো দিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হয়। তখন কাঠ কয়লা গুলি জ্বল জ্বল  করে জ্বলতে থাকে । তখন ইস্তিরি গরম হয়ে যায়।বরুণ রাহুলকে  ডেকে ইস্তিরি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দেয়।রাহুল  তখনই বুঝে যায় এবং ইস্তিরি করতে লেগে যায়। বাবা তার কাজ দেখে  ‘বেশ বাবা’  বলে প্রেরণা দেয়। তারপর থেকে রাহুল বরুনের সমস্ত কাপড় ইস্তিরি করার দায়িত্ব গ্রহণ করল। সেও রামলালের মতো সুতির কাপড় ইস্তিরি করার আগে একটু জল ছিটিয়ে  নেয়। বরুণের কাপড় ইস্ত্রি করার ফাঁকে ফাঁকে কখনও সেও নিজের কন্ট্রোলের কাপড়ের জামাটা ইস্তিরি করে নেয়।

(৫২)

দুর্গাপূজার সময় নতুন কাপড় নেওয়াটা টিহু বজালী অঞ্চলে এক অঘোষিত প্ৰথার মতোই ছিল। পূজার কিছুদিন আগে থেকে বরুণ রাহুলকে সাইকেল মেরে মেরে খবর নিতে পাঠায়—বজালী সমবায় সমিতিতে কন্ট্রোলের কাপড় এসেছে কিনা? যদি কন্ট্রোলের কাপড় এসে থাকে তাহলে রাহুলরা একজোড়া নতুন কাপড় পাবে, অন্যথায় নতুন কাপড় পাওয়ার আশা কম! তাই রাহুল মাঝে মধ্যে বরুণ না বলা সত্বেও সমবায়ের দোকানে খবর নিতে যায়—এসেছে নাকি কন্ট্রোলের কাপড়?

কন্ট্রোলের কাপড় আসে ১.৩৫ টাকা দামের,( গতবার ১.২০ টাকা দামের ছিল— রাহুলের মনে আছে), দেখতে সুন্দর । বরুণ হরেশ্বর দর্জিকে জিজ্ঞেস করে না, কোনো একটি কাপড়ের দোকানের বারান্দায় বসা একজন অখ্যাত দর্জির কাছে রাহুল নীপা থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ে যায় এবং ওদের জামার জন্য মাপ নিতে বলে। নীপার জন্য ফ্ৰকের কাপড় কতটা লাগবে জিজ্ঞেস করে? দর্জি হিসাব দেয়। সেই হিসাব নিয়ে রাহুল সমবায় দোকান থেকে কেরিয়ারে করে কিনে আনে কয়েক মিটার নতুন কাপড়। প্রত্যেকেই নতুন কাপড় দেখার জন্য দৌড়ে আসে— নতুন কাপড়!

নীপা জিন্টিরা  কাপড়টা নেড়েচেড়ে  বলে—এঃ মা সুতির কাপড়!

রাহুল উত্তর দেয়— সেলাই হয়ে গেলে দেখতে ভালোই লাগবে!

সমবায়ের দোকানে হাফপ্যান্টের কাপড় আসে না। হাফপ্যান্টের জন্য বরুণকে ওদের মাড়োয়ারির কাপড়ের দোকানে নিয়ে যেতে হয় । হাফপ্যান্ট মানে বরুণ এক গুলিতে দুই শিকার করে। তিনি অর্ডার দেন বজালী হাইস্কুলের ইউনিফর্মে পরা  খাকি রঙের পুলিশে পরা খসখসে কাপড়ের মতো— ইউনিফর্ম ও হবে, এমনিতেও পরতে পারবে! রাহুলদের ইচ্ছা–অনিচ্ছা পছন্দ-অপছন্দের কোনো মূল্য তখন থাকে না।

কখনও সমবায়ের দোকানে সময়মতো কোনো কন্ট্রোলের কাপড়  এসে না পৌঁছালে বরুণ ওদেরকে মারোয়ারি দোকানে নিয়ে যায়। দোকানে গিয়ে বরুণ দোকানিকে বলে—- সবচেয়ে কম দামি কী কাপড় আছে দেখান। দোকানি দুই তিন রকমের কাপড় বের করে। বরুণ বলে—না পাতলা নীল রঙের কাপড় দেখান তো, বজালী হাইস্কুলের ইউনিফর্মে পরা। নতুন পুজোর কাপড় হবে, ইউনিফর্ম ও হবে!

রাহুল নীপারা অন্য কোনো কাপড়ের দিকে দেখিয়ে বলে—ওই কাপড়টা ভালো ছিল। কিন্তু দোকানি ইতিমধ্যে কাপড় কেটে ফেলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দর্জির কাছে শার্ট এবং হাফপ্যান্টের মাপ দিয়ে থাকার সময় বরুণ দর্জিকে লক্ষ্য করে বলে—দুই ইঞ্চির মতো লম্বা রাখবে,ওরা দ্রুত বেড়ে চলেছে।

ছেলে-মেয়েদের কাপড় কেনা এবং মাপ দেওয়ার পর্ব শেষ হলে বরুণ এবার ভূড়িওলা মূল কাপড়ের দোকানিকে বলে–এখন সবচেয়ে দামি কাপড় কী আছে দেখান…।দোকানি বলেন–মফৎলাল আছে,বিন্নী আছে,এছ কুমার আছে…

বরুণ হাতে নেয় মফৎলাল -বিন্নীর মিলের টেরিকটন-টেরিলিন কাপড়।পেন্টের জন্য টেরিকটন আর শার্টের জন্য ফুরফুরে মিহি মসৃণ সুন্দর টেরিলেনের কাপড়।নিজের শার্ট-পেন্টের কাপড় পছন্দ করে বরুণ রাহুল-নীপাকে জিজ্ঞেস করে—কোন কাপড়টা ভালো লাগবে বল!

ওরা দুজনেই বরুণ পছন্দ করা কাপড় দুটি দেখিয়ে বলে—এই দুটিই আপনাকে মানাবে!দোকানি ঘচ করে কাপড় দুটি কেটে ফেলে।রাহুল-নীপার হিংসা হয় না।ওরা জানে পিতৃ আর সন্তানের মর্যাদার পার্থক্য।ওরা জানে ওদের প্রাপ্তির সীমা।

দুই পীস কাপড় বরুণ সঙ্গে করে নিয়ে আসে।বারান্দায় বসা দর্জি বরুণের কাপড় সেলাই করতে পারবে না।সে নিজে মণিপুরি টেইলারিঙে যায়।মাপ দেয়।সেই সময় মণিপুরি টেইলারিঙের যুবক দর্জিরা বজালী অঞ্চলের ভেতরে সবচেয়ে ভালো ডিজাইনের কাপড় পরত।তারই একটার নাম ছিল জিপ্পী।কোনো এক সূত্রে রাহুল তার সঙ্গে বন্ধুত্বও গড়ে তুলেছিল। জিপ্পী মাঝে মধ্যে তাকে কাশীয়ার চা দোকানের কালাকাঁদ ও খাইয়েছিল।

(৫৩)

রাহুলের আজও মনে আছে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন দিদি নীপার বান্ধবীর বাড়িতে দিদি তাকে কোনো একটা খাতা দেবার জন্য পাঠিয়েছিল।গরিবদের বাড়ি। রাহুলকে বাইরের ঘরে বসতে দিয়ে বান্ধবীর বোন বিজুলি ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে  ঢুকে যাওয়াটা সাধারণত চা আনতে যাওয়া। রাহুল লক্ষ্য করল তাকে যেখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে সেই মাটির মেঝেতে এবং মাটি দিয়ে লেপা চার দেওয়ালের ঘরটার দরজার সামনে আর জানালায় ঝুলে রয়েছে আর টেবিলেও পেতে রাখা আছে বজালী সমাবায় সমিতির কন্ট্রোলের সেই একই কাপড় যে কাপড়ের শার্ট পরে সে এসেছে। তার নিজেকে বড়ো অসহায়  মনে হল। তার নিজেকে আদর করতে ইচ্ছা করল। সে নেড়েচেড়ে দেখল সেই পর্দা দরিদ্র মাখা।

বিজুলী দিয়ে যাওয়া চা  সে খেতে পারল না। চা না খাওয়াটা এক ধরনের অভদ্রামি হবে বলে ভেবে সে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখল মেঝেতে একটা ইঁদুরের গর্ত। সে চা টা সেখানে ঢেলে দিল। গরম চা গর্তে পড়ায় ভেতর থেকে একটা ইঁদুর বেরিয়ে এসে হেলতে দুলতে দৌড় মারল।

ঠিক সেই সময় বিজুলী  ঘরটাতে ঢুকছিল । তারও  চোখে পড়ল পালিয়ে যাওয়া ইঁদুরটা। কিছু একটা না করা কাজ করে ফেলে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো একটা ভাব রাহুলের মনে এলেও প্রকৃতপক্ষে বিজলী কিছুই বুঝতে পারল না।

রাহুল বলল— একটা ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে গেল… বিজুলীর চোখ দুটি এমনিতে উজ্জ্বল ছিল আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল না!

এই বিজুলীই ভবিষ্যতে রাহুলের জন্য প্রতিদিন বাড়ির বাগান থেকে একটা করে আমলকি পেড়ে নিয়ে তার হাতে দেবে। আর একদিন রাহুলের হাতে অর্ধেকটা আমলকি তুলে দিয়ে বলবে— আজ অর্ধেকটা!

রাহুল জিজ্ঞেস করবে— অর্ধেকটা কেন?

বিজুলী বলবে—আমি কামড়ে কামড়ে একটা দিক খেয়েছি… সে কথা এখন থাক, ভবিষ্যতে ইচ্ছা হলে রাহুল সেই কথা বলবে।

মফতলালের টেরিকটনের সেলাই করা লং পেন্ট এবং বিন্নির টেরিলিনের শার্ট রাহুল ইস্তিরি করেছিল। এত মিহি মসৃণ গালে লাগিয়ে দেখে সে।

এবার দুর্গা পুজোর আগে রাহুলের নেতৃত্বে ওরা বাবার কাছে আবদার করল যে আমাদের সবাইকে দিতে হবে না, আমাদের মধ্যে যে কোনো একজনকে একটা টেরিলিনের শার্ট দিন বা দিদিকে দিন একটা টেরিলিনের ফ্রক…।

বরুণ মুখ ভেঙ্গিয়ে উঠল—বাহ লাট সাহেব এসেছে,  টেরিলিনের শার্ট পরবে।বরুণ ওদেরকে টেরিলিনের যোগ্য বলে ভাবত না।

(৫৪)

বর্ষার দিনগুলিতে একনাগারে বৃষ্টি হয়ে থাকার ফলে রাহুলদের উঠোনটা এবং চাপাকলের পাকা গোলাকার জায়গাটায় শেওলা জমে সবুজ এবং পিছল হয়ে পড়ে। তজো সেখানে ঘন ঘন আছাড় খায়। এরকমই দিনের একটি রবিবারে বরুণ রাহুলদের সবাইকে ডেকে নির্দেশ দেয়—’ আজ তোদের উঠোন এবং চাপাকলের জায়গাটা পরিষ্কার করার দিন। আর রাহুল, তোকে বাথরুম আর লেট্রিনটা পরিষ্কার করতে হবে।

রাহুলের বুকটা গর্বে ফুলে উঠে, কারণ তাকে বেশি দায়িত্বপূৰ্ণ কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে হারপিক জাতীয় টয়লেট ক্লিনার ছিল না, কাপড় ধোঁয়া পাউডার সাৰ্ফ ছিটিয়ে নিয়ে খড়ের মুঠি দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হত। জলের আয়রনের হলদে দাগ গুলি উঠিয়ে দেবার জন্য রাহুল শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল— যাতে বাবা বরুণ পায়খানা করে এসে বলতে বাধ্য হয়—’ বাহ রাহুল একদম লেট্রিনের বেসিনটাতে ভাত খেতে পারার মতো ধবধবের সাদা করে ফেলেছে!’

দিদি নীপাকে বাদ দিয়ে রাহুলের বাকি ভাইদের উঠোন এবং চাপাকলের পাড়ের শেওলা( যাকে বাদামল বলে বলা হত) পরিষ্কার করতে হয়েছিল। সেই কাজ আরম্ভ করার আগে ওরা শেওলা পড়ে  পিছল হয়ে পড়া উঠোনটাতে পাছা পেতে বসে নিয়ে এক আমোদজনক খেলা খেলছিল। একে অপরকে উঠোনের এক প্রান্ত থেকে ঠেলা দেয় এবং তখন অপরজন উঠোনের অন্য প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায় পিছলাতে পিছলাতে। ওদের খালি গা বিজল বিজল হয়ে পড়ে। খেলাধুলা সহ্য না করা বরুণও সেই খেলা দূর থেকে দেখে মুখ টিপে  হাসে!

গজেন্দ্রনাথের বড়ো ছেলে বরুণ কেন খেলাধুলা পছন্দ করত না জানা যায় না। একবার রাহুলরা দুপুরবেলা বাগানে বল খেলার অপরাধে বরুণ তাদের যে শাস্তি দিয়েছিল, সে কথা রাহুল সারা জীবন ভুলতে পারেনি।

নিজের সন্তান না হয়ে নিরোদের সন্তান হওয়ার জন্য অনুপ বিকিদের শাস্তি কম হয়েছিল। কারণ ভানু প্রায়ই এই বলে আপত্তি করত—’ আমার ওদের দোষ নেই। রাহুল ওদের ডেকে নিয়েছিল!’ আর বরুণের নিজের সন্তান হওয়ার জন্য রাহুলদের শাস্তি ছিল কঠোর। রাহুলদের হয়ে কথা বলার কেউ ছিলনা। গজেন্দ্রনাথ এই সমস্ত কথার কোনো আভাস পেত না। তিনি থাকেন তার আয়ুর্বেদিক ঔষধের দোকানে। ঠাকুরমা অমৃতপ্রভা এই ধরনের শাস্তি দেখতে না পেরে গোয়ালের দিকে চলে যেত।

দুপুর বেলা বাগানে বল খেলার শাস্তি সেদিন ওদের এভাবে দেওয়া হয়েছিল— তজোর মাধ্যমে একটা খসখসে বড়ো পাথর এনে উঠোনের মাঝখানে রাখা হয়েছিল। তারপর রাহুলকে ধরে তার যে কয়েকজন ভাই দুপুরবেলা বাগানে বল খেলেছিল, সবাইকে উঠোনে ডেকে আনা হয়েছিল। তারপরে বরুণ নির্দেশ দিয়েছিল— খেল এই পাথরের বলটা দিয়ে খেল…।’ রাহুল উঠনের এক কোণে দাঁত কামড়ে ছিল। বাকিরা ভয়ে কাঁদছিল। কেউ নড়াচড়া করছিল না। বরুণ তর্জন গর্জন করছিল— বল খেলতে এসেছে—আয়— এই বলে রাহুলকে টেনে এনেছিল পাথরটার কাছে বলেছিল —খেল—এই বলটা  দিয়ে খেলতে হবে আজ।’ পাথরটার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাহুল। বরুণ রাহুলের একটা পা তুলে নিয়ে পাথরটায় আঘাত করে বিড়বিড় করে বলছিল—’ বল খেলতে এসেছে…’ রাহুলের পা থেকে রক্ত না বের হওয়া পর্যন্ত বরুণ শান্ত হয়নি। তবু রাহুল কাঁদেনি। তার বুকের ভেতরে সেদিন চোখের জল জমাাট বেঁধে গিয়েছিল!

কেবল রাহুলের জন্য নয়, ভাইদের কাছেও সেটা ছিল এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। রাহুলের মা শশীর কথা মনে পড়ছিল। শশীর সেই চ্যাপ্টা বুকের ভেতরে থাকা হাড়গুলির মধ্যে কত ভালোবাসা ঢুকে ছিল, ভালোবাসা হয়তো এই ধরনের নিষ্ঠুর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারত। নতুন মায়ের উপচে থাকা বুকের ভেতরের ভালোবাসা কেন প্রকাশ হয়নি এই দিনগুলোতে— সে কথা ভেবে মর্মাহত হয়ে পড়েছিল রাহুল। এরকম সময়ে নতুন মা ও হয়ে পড়ত কেমন যেন সংকুচিত!

সেই নিষ্ঠুর শাস্তি কেবল সেদিনই শেষ হয়নি। কারণ রাহুল সমগ্র জীবন যেখানে গিয়েছিল, সেই পাথরের বলটাকে মগজের এক কোণে নিয়ে বেড়াতে হত। যদি রাহুল হাসত, যদি রাহুল কোথাও আনন্দ পেত, যদি রাহুল নেচে উঠত কখন ও, তারপরেই তাকে খেলতে হত সেই খসখসে পাথরের বলটা…

(৫৫)

বরুণ বাড়িতে থাকলে খেলাধুলো, হাসি-ফুর্তি ,আনন্দ, গান-বাজনার কোনো ফাঁক-ফোঁকর থাকত না বাড়িতে। কোনো অজ্ঞাত কারণে বাড়ির সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু কাজে নিয়োজিত হয়ে থাকার দৃশ্য দেখে বরুণ খুশি হত। তাই বরুণ বাড়িতে থাকলে রাহুলরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। আর যখন বরুণ বাড়িতে থাকে না, প্রতিটি প্রাণী নিজেদের স্বাভাবিকত্ব খুঁজে পায়। আর মনের আনন্দে গান জুড়ে দেয়…

বরুণের বাড়িতে থাকা না থাকার সময়টুকু প্রত্যেকেই জানে। তবু যদি বাইরে থেকে কখনও এসে পড়ে তখন বাড়ির হাত গুলি যে যা পায় হাতে নিয়ে নেয়। যেমন কেউ একজন হাতে ঝাড়ুটা নিয়ে মাকড়সার জাল পরিষ্কার করতে গলাটা উপরের দিকে তুলে, কেউ উঠোনে তৎক্ষণাৎ বসে পড়ে বড়ো কষ্টে গজিয়ে উঠতে চাওয়া দুব্বো ঘাস একটা একটা করে উপড়ে ফেলে। কেউ উঠোনের তারে মেলে দেওয়া গামছাটা টেনে নিয়ে চট করে চলে যায় বাথরুমের দিকে। কেউ চাপা কল মারতে শুরু করে…

বরুণ আসবে এবং বারান্দার লম্বা বেঞ্চে বা ঘরের ভেতরের খাটটাতে বসে   নীপা-রিন্টুরা রেডিওতে গীতিমালিকা বা কল্পতরুর গান শুনতে থাকবে,সেরকম ঘটনা  বাড়িটাতে ঘটতেই পারে না। এই বাড়িতে আনন্দকে অপব্যয় বলে গণ্য করা হয়েছিল।

বজালী হাইস্কুলের হিন্দি শিক্ষক, বজালী রাষ্ট্রভাষা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষতো ছিলেনই, তাছাড়া অসম রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির একজন সদস্যও হওয়ার জন্য বরুণকে মাসে পনেরো দিনে গুয়াহাটির হেদায়েতপুরের মিটিঙে যেতে হত। গুয়াহাটি তখন পাঠশালা থেকে ছিল অনেক দূরে। তাই পরিবহন নিগমের লালবাসগুলি অর্ধেক পথে অর্থাৎ নলবাড়িতে বিশ্রাম নিতে হত। যাত্রীরা ও বাসস্ট্যান্ডে নেমে প্রস্রাব করে চা জল খাবার খেয়ে নিত।গজেন্দ্রনাথের চায়ের দোকানের মতো একটা লবঙ্গ এই পৃথিবীতে আর ছিল না!বরুণ গুয়াহাটি গেলে তিনদিনের মাথায় ফিরে্ আসত। সেই তিন দিন সারা মাসের জন্য যেন রাহুল- নীপা- জিন্টুরা আনন্দ-যাপন করে নিত।

বরুণ গুহাটিতে সেদিন গিয়েছিল। নীপা  চাপা কলের পারে উর্বর মাটি পেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা মেহেন্দির  কিছু পাতা ছিঁড়ে এনে চাপা কলের পাকা পারে লেপটে বসে নিয়ে একটা পাথর দিয়ে পিষে পিষে মেহেন্দিৰ রঙ বের করে দু হাতে মেখে নিয়েছিল। জীবনে প্রথম মেহেন্দির রং মেখে কত যে ফুর্তি লেগেছিল তার। হাত দুটি সবার চোখে পড়ার মতো করে সে বারবার বের করছিল। তার ফুর্তিতে রাহুলদের সবার বুক  শান্ত হয়ে পড়েছিল ।নীপা প্ৰায়ই কোলে করে রাখা দীপু তার হাতের দিকে তাকিয়ে এখন ও কথা না ফোটা ঠোঁট দুটি দিয়ে কী সব বলে তার আনন্দ প্রকাশ করছিল। অমৃতপ্রভার ও  সায় ছিল সেই মেহেদির রঙে। একটু সরষের তেল মেখে নিলে রংটা আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বলে অমৃতপ্ৰভা নীপার দুই হাতে একটু সরষের তেল ঢেলে দিয়েছিল।

তিনদিন পরে বরুণ যখন গুয়াহাটি থেকে ফিরে এল, তখন বিকেল হয়ে এসেছিল। নীপা তার হাত দুটি বরুণের চোখে না পড়ে সে বিষয়ে যত্নবান হলেও বরুণের চোখে কিন্তু ঠিকই পড়েছিল। বরুণ কোনো কিছুই বলেনি। নীপা ভেবেছিল সে বড়ো কোনো অপরাধ করেনি!

পরের দিন স্নান করতে যাবার আগে(দা টা কোথায় থাকে জানে না বলে) বরুণ তজোর মাধ্যমে দা টা আনিয়েছিল। কোনোদিনই হাতে দা না নেওয়া বরুণ কয়েক কোপ মেরে মেরে চাপা কলের পারে নীরবে দ্রুত বেড়ে উঠা মেহেন্দি গাছটাকে কেটে ফেলেছিল। যেন সমস্ত দোষ ছিল মেহেন্দি গাছটার। বরুণ কাউকে কিছু বলেনি। বরুণের মৌনতা সেদিন ছিল অনেক তর্জন গর্জনের চেয়ে কঠোর নির্দয়!

এত কম আয়ু ছিল সেই মেহেন্দি গাছটার! চাপা কলের পাশে ভিজে মাটিতে তজো কোথা থেকে এনে রোপণ করা সেই মেহেন্দি গাছটাকে একজন কিশোরীর হাত দুটি মাত্র একবার হিঙ্গুল বর্ণ করে দিয়েই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।

জীবনে আর কখনও মেহেন্দির রং লাগাব না বলে সেদিন নীপা প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেই প্রতিজ্ঞা ভাঙতে তার একান্ত বান্ধবী, মালা পিসির মেয়ে হিমানী নীপার বিয়ের আগের দিন আপ্ৰাণ চেষ্টা করে ও পারেনি। নীপার বুকের কোনো এক জায়গায় সেই মেহেন্দি গাছটার চোখের জল হয়তো লেগেছিল!

(৫৬)

তখন শান্তি নার্স ছিল না। তজো পাঠশালার স্টেট ডিসপেন্সারি থেকে অন্য একজন নার্সকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। যন্ত্রণা নিয়ে রাহুলের নতুন মা আতুরঘরে প্রবেশ করেছিল। অমৃতপ্রভা ছিল বারান্দায়। সমস্ত কিছু জানতে পেরে মালা পিসি দুদিন আগে থেকে এসে উপস্থিত হয়েছিল। বাকি অন্য মানুষগুলি যে যেভাবে থাকে, সেভাবেই ছিল।যেমন বরুণ বজালী উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মৈথিলীশরণ গুপ্তার হিন্দি কবিতা পড়ায়, গজেন্দ্রনাথ তার ফার্মেসিতে প্রসূতির তেল মালিশ বিক্রি করে, রাহুল নীপারা স্কুল ছুটির পরে বাড়িতে এসেছিল। তাই ঘরটাতে উত্তেজনা ছিল কম। ওরা আসার সঙ্গে সঙ্গে অমৃত প্রভা এবং মালা পিসি চিৎকার চেঁচামেচি না করার জন্য ইঙ্গিতে সাবধান করে দিয়ে বলল যে আতুরঘরে নার্স আছে!

আতুরঘরে কিছুক্ষণ পরে নবজাত শিশুর কান্না ভেসে উঠল। এই কান্না পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সঙ্গীত। রাহুল নীপাদের আনন্দের আর সীমা রইল না ! নার্সটি তজো বাগানে খুঁড়ে রাখা একটা গর্তে এক গামলা রক্ত জল এবং নাড়ি ফুল ইত্যাদি ফেলে রেখে আসল। তজো সঙ্গে সঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে গর্তটি বুজিয়ে ফেলল। বরুণ গজনেন্দ্রনাথ সহ বাড়ির প্রত্যেকেরই মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। সেই হাসি বাড়ির কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল।হাসিটা সেদিন সারাদিন থাকল বাড়িতে। অমৃতপ্রভা ও হেসেছিলেন, কিন্তু রাহুলের এরকম মনে হচ্ছিল— অমৃতপ্রভা যেন জোর করে হাসছে।

বজালী উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাংস্কৃত শিক্ষক ভগবান গোস্বামী পঞ্জিকা দেখে মানুষের যাত্রা শুভ কী অশুভ,  যাত্রা আছে কি নেই ,বিয়ের জোড়া আসবে কি আসবে না ইত্যাদি দেখার সঙ্গে সঙ্গে রাশি-লগ্ন -গণ ইত্যাদিও দেখেন। বরুণ তার বাড়িতে গিয়ে কনিষ্ঠ সন্তানের জন্মের সময়টি বলায় রাশি কী হবে এবং নামের আদ্যাক্ষরটি জানাল। সেই অনুসারে রাহুলদের এই ভাইটির নাম রাখা হল—- দীপুল ! এই ভগবান গোস্বামীর বিষয়ে কিছু কথা না বলা অন্যায় হবে । মানুষটা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর, স্বাস্থ্যবান চেহারার। পরনে সব সময় সাদা ধুতি এবং মাখন রঙের পাঞ্জাবি শার্ট। শার্টের বুক পকেটে থাকে একটা সোনালি রঙের কলম। পুরুষ মানুষ এত সুন্দর না হলেও চলে ! সেই ভগবান গোস্বামী যখন পেডেলে পা দিয়ে লাফিয়ে সাইকেলে উঠেন, তখন ধুতিটা উঁচু হয়ে যায় এবং বিচিত্র রঙের আঁচ থাকা আন্ডারপ্যান্টটা চোখে পড়ে যায় । তখন তার সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। রাহুল ভাবে—তিনি সাদা আন্ডারপ্যান্ট কেন পড়েন না?

মায়ের বুকের দুধ খেয়ে ঝলমল করে বেড়ে উঠল সেই শিশু। কিন্তু মায়ের কোলে শিশু আর কত বড়ো হয়? শিশুরা বড়ো হয় অন্যের কোলে! এখন সেই প্রতিটি শিশুর হাসি কান্নার অর্থ রাহুল– জিন্টুরা জানে। ওরা প্রতিটি হাসির ফোটো তুলে রাখে—ওদের হৃদয়ের ক্যামেরায়। সেই শিশুর হাসিই এখন ওদের আনন্দ উদযাপন!

মায়ের কোলে সে আর কতটুকু থাকল? রাহুল-জিন্টু নীপাদের স্নেহের কোলে, রাহুলদের হাত বেয়ে বেয়ে সে দ্রুত নেমে এল কোল থেকে আর রাহুলদের দুষ্টুমিতে যোগ দিল। বাড়িতে এই শিশুর উপস্থিতি তার হাসির ফুর্তি এবং আচরণ গুলি রাহুলদের মনগুলিকে অনবরত ভরিয়ে রাখতে লাগল। এখন নড়বড়ে পায়ে ওদের সঙ্গে এসে খেলতে চায়। মাঝে মধ্যে অমৃতপ্রভা রাহুলকে সাবধান করে দেয়—- দেখবি ,দীপুলকে কিন্তু ফেলে দিস না। সাংঘাতিক কথা হবে!’

এই সাংঘতিক কথার মধ্যে যে সমস্ত কথা ঢুকে থাকে, যে সমস্ত ইঙ্গিত ঢুকে থাকে সেসব কথা রাহুল এখন বুঝতে সক্ষম হল। কিন্তু রাহুল সেই সব কথা অস্বীকার করার শক্তিও ইতিমধ্যে অর্জন করেছিল!

এই দীপুল কাঁদার জন্য খুব বেশি সুযোগই পেল না। ওদের আদর মাখানো দুষ্টুমির মধ্যে তার মুখে অনবরত একটা হাসি লেগে থাকতে দেখা গেল। পরবর্তীকালে ও সমগ্র ঘরের মানুষগুলির ভেতরে তার হাসিটাই সবচেয়ে সুন্দর হয়ে রইল। কেন না সে হাসলে তার চোখ দুটিও হেসে উঠে।

(৫৭)

বরুণ মাঝেমধ্যে ভাবে— এই দুষ্টুদের দলটিতে দীপুলের যোগ দেওয়াটা ঠিক হয়নি। তাকে একটু দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হল। তবলা এবং খোল শিখবে বলে তাকে খোল-তবলা এনে দেওয়া হল। শেখানোর জন্য এলেন পরীক্ষিত মাস্টার। তার আগ্রহ ছিল না তা‐ ধিনা- ধিন এবং তাদের থেকে দূরে সরিয়েও রাখা গেল না। কেননা নতুন মায়ের মাথায় কোনো প্রদূষণের ধোঁয়া প্রবেশ করতে পারছিল না!

রাহুলদের নতুন মা যে দিনই এই বাড়িতে প্রবেশ করেছিল, অৰ্থাৎ বিয়ের পরদিন —সেদিনই বিয়ে বাড়ির অনেক মহিলার মধ্যে কোনো একজন মহিলা তার কানে ফিসফিস করে বলেছিল—’ এটি তোর সৎ মা।’

বিয়ে বাড়িতে সেদিন সেই মহিলাটি যেন সৎ মা মানে তেজীমালা গল্পটির কথাই মনে করিয়ে দিয়ে মনের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু গজেন্দ্রনাথের  সৎ এবং শক্তিশালী হৃদয়ের ছায়ায় বেড়ে উঠা রাহুলের মনে সেই বিষবাষ্প প্রবেশ করতে পারল না। বাবার বিয়ের পরে গজেন্দ্রনাথের সঙ্গে যখন রাহুল মাকে আনার জন্য ভকুয়াটেপায় গিয়েছিল, সেদিন ফিরে আসার সময় সারাটা পথ সে ভেবেছিল—লক্ষ্মীনাথ ‘তেজীমালা’ গল্পটা লেখা উচিত হয়নি।

রাহুল ভেবেছিল—এই নতুন মাকে আনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই বেশি। কারণ সেই  নতুন মাকে আনার প্রস্তাবটা রেখেছিল। নাহলে তো অমৃতপ্রভা ,মালা পিসি, চামতার পিসি সহ কারও সম্মতি ছিল না। বরুণতো এই মানুষটিকে এনেছিল ঘরটা চালানোর জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন বলে!

কিন্তু রাহুল?

রাহুল চেয়েছিল মা শশী মৃত্যুর আগে তাকে বলে যাওয়া সেই কথাগুলি রাখতে—-‘… আমি মরলে বাবাকে আরও একটি মা নিয়ে আসতে বলবি। বলবি—একজন ফর্সা  মাকে যেন নিয়ে আসে! বলবি তো?…’

রাহুল মাথা নেড়ে মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—’ বলব।’

সেই প্রতিশ্রুতি রাহুল রেখেছিল। তাই সে ভাবে—এই নতুন মাকে আনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি!

সেই প্রতিশ্রুতি রাহুল রেখেছিল। তাই সে ভাবে—এই নতুন মাকে আনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি! তাছাড়া রাহুল  ভেবেছিল মা শশি তার  বুকে রেখে যাওয়া খালি জায়গাটা নতুন মা খালি হয়ে থাকতে দেবে না।….

‘বুড়িমার গল্প’ বইটি প্রতিটি মানুষের বাড়িতে থাকার মতো রাহুলদের বাড়িতেও ছিল। একদিন রাহুল সেই বইটি থেকে তেজীমালা গল্পটির পৃষ্ঠাগুলি চুপিচুপি ছিঁড়ে রেখে দিয়েছিল যাতে তার ভাই জিন্টু-রিকিরা সেটা পড়তে না পারে। সে ভেবেছিল গল্পটি ওদের অনিষ্ট করবে।

সে ভাইদের বলে—লটকন পড়, কাঞ্চন প্‌ড়, চম্পাবতী পড়…।সে ভেবেছিল পৃথিবীর কেউ  এই তেজীমালা নামের করুন গল্পটি না পড়াই ভালো।

শান্তশিষ্ট কোনোদিন একটা কঠিন কথা বলতে না পারা রাহুলদের মা ভালোভাবে মনের আবেগ প্রকাশ করতে জানত না। তার অন্তরে সুপ্ত হয়ে থাকে ভালোবাসাগুলি! সরল অন্তরের সেই মা কখনও একটি কঠিন কথা রাহুলদের বলত না। তার মনে নেই তিলমাত্র হিংসা। তিনি সংকীর্ণমনা নন। কোমল অন্তরের সেই মা ছোটো মেয়ের মতো টিভির সিরিয়াল দেখে চাদরের আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছেন, কণ্ঠস্বর আবেগ রুদ্ধ হয়ে যায়। সেরকম মুহূর্তে রাহুলের নতুন মাকে আদর করতে ইচ্ছা করে।

এই মাকে সে আর গজেন্দ্রনাথ যেদিন ভকুয়াটেপায়  আনতে গিয়েছিল সেদিন মা ছিলেন কত ছোটো। জটিল পৃথিবীর রীতিনীতি বুঝতে না পারা সেই মা এখনও যেন বড়ো হননি এরকম মনে হয় তার। কিন্তু সে তো প্রকাশ করতে পারে না এই সমস্ত মনের কথা।

কেননা কোথাও একটি অদৃশ্য প্রাচীর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই মসৃণ স্নেহ ভালোবাসা সম্পর্কের মধ্যে বরুণ একটি দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।বরুণেরও দোষ নেই। সে জানে না সম্পর্ক গুলির সম্ভাবনার বিষয়ে!

একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (১৮ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top