এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো (১৯৪০-২০১৫) উরুগুয়ের প্রখ্যাত লেখক, কবি ও সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকার এই লেখকের মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছে অফুরান ভালোবাসা ও বিস্ময়। ভালোবাসা মানুষের প্রতি আর বিস্ময় জীবনের। জীবনকেও ভালোবেসেছেন অন্তহীন কৌতূহলে, আনন্দে আর নিবেদনে। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষের জন্য মানবতার জন্য নিবেদিত হয়েছে তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম, বক্তৃতা-ভাষণ, আন্দোলন প্রতিবাদ। নির্বাসনে থেকেছেন, মৃত্যুর পরোয়ানা পেয়েছেন একাধিকবার তবু থেমে যায়নি অদম্য এই প্রাণ ।
লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নিয়ে লিখেছেন ‘ওপেন ভেইনস অব ল্যাটিন আমেরিকা’। তিনখন্ডে লিখিত মেমোরি অব ফায়ার’ আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রামের প্রাণবন্ত ইতিহাস। শিল্প-সাহিত্য ইতিহাস যুদ্ধ প্রতিরোধ স্বৈরশাসন বর্ণবাদ নারী-স্বাধীনতা প্রভৃতির অনবদ্য কাব্যিক উপস্থাপন তাঁর ‘ মিরর’ ও ‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ বই দুটি।
‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ ৩৬৫ দিনের দিনলিপি। জগতের কত অদ্ভূত ইতিহাসের কত অনন্য বিষয় নিয়েই-না তিনি লিখেছেন কিন্তু কী আশ্চর্য সবকিছুই মনে হয় আজকের – এই সময়ের – এই জীবনের আর কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদের।
– মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম
———————-
কালের সন্ততি জুন
জুন ১
সন্তর মতো মানুষ
২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডে ‘দাতব্য বৈচিত্র্য ও স্বাধীনতা‘ শিরোনামে এক রাজনৈতিক দল আইনি স্বীকৃতি চায়! নতুন এই দল মানুষের যৌনতা ও যৌন জীবনের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এবং সেই মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে বলে ঘোষণা দেয়।
তাঁরা বালমৈথুন ও শিশু পর্নোগ্রাফির বৈধতা চায়।
আট বছর আগে এরাই ইন্টারনেটে আন্তর্জাতিক ‘বালকপ্রীতি দিবস পালন করে!
আইনি বৈধতা আদায়ে এই দলটি ন্যূনতম স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারেনি, কোনো নির্বাচনে কখনো জিততে পারেনি এবং শেষে ২০১০ নীরবে আত্মহত্যা করে!
জুন ২
রেড ইন্ডিয়ানরাও মানুষ
১৫৩৭ সালে পোপ তৃতীয় পল ‘ঈশ্বরের মহিমা‘ নামে এক ফরমান জারি করেন।
এই আজ্ঞাপত্রে পোপ রেড ইন্ডিয়ানদের স্বাধীন সম্পন্ন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আদিবাসী আমেরিকানদেরকে যাঁরা শুধু নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, তাঁদের রীতিমতো ধিক্কার দেয়া হয় এই আজ্ঞাপনে। সেইসাথে যাঁরা তাঁদেরকে মাথামোটা অর্থসভ্য বলে ক্যাথলিকবিশ্বাস থেকে দূরে রেখেছে, তাঁদেরও নিন্দামন্দ করা হয় বিস্তর।
এই বিবৃতিতে পোপ আরো বলেন, ‘ স্বাধীন মানুষ হিসেবে জীবনযাপনের সম্পূর্ণ অধিকার তাঁদের আছে। তাঁরাও সম্পদের আইনি দখল নিতে পারে।তাই কোনোভাবেই তাঁদের বন্দি করা চলবে না, ক্রীতদাস বানানো যাবে না।‘
সাগর পেড়িয়ে এ-কথা সেদিন আমেরিকায় পৌঁছাতেই পারেনি!
জুন ৩
আতাহুয়ালপার প্রতিশোধ
গোটা তামবোগ্রান্ডে শহর সোনার বিছানায় ঘুমায়!
শহরের প্রতিটি বাড়ি খামার রাস্তার নিচে লুকিয়ে আছে অঢেল সুবর্ণরত্ন!
শহরবাসী এই সুসংবাদ জানার সাথে সাথেই পেয়ে যায় উচ্ছেদের নির্মম নোটিশ। পেরুর সরকার এই শহর পুরোটাই বিক্রি করে দেয় ম্যানহাটন মিনারেল কর্পোরেশনের কাছে। কর্পোরেশন আশ্বাস দেয় অচিরেই সবাই বিত্তবান কোটিপতি হয়ে উঠবে। কেউ তবু শহর ছেড়ে চলে যেতে চায় না আর ২০০২ সালের এই দিনে গণভোটের মাধ্যমে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তাঁদের প্রবল অস্বীকৃতি। নিজ হাতে লাগানো আম লেবু আর এভোকাডোর সবুজ উদ্যানঘেরা আবাসেই তাঁরা আজীবন থাকতে চায়।
তাঁরা ভালো করেই জানে স্বর্ণের মতো খনিজসম্পদ শুধু অভিশাপই বয়ে আনে। ডিনামাইট ঢেউখেলানো পর্বতমালা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, বিষাক্ত বর্জ্য নদী জলাশয় দূষিত করে ফেলে!
তাঁরা আরও জানে স্বর্ণ মানুষকে লোভী করে তোলে- স্বর্ণলোভের কোনো নিবৃত্তি নেই!
পূর্বপুরুষ আতাহুয়ালপার কাহিনী তাঁদের ভালো করেই জানা – অপরিমেয় স্বর্ণ-সম্পদ মুক্তিপণ নিয়েও স্প্যানিশ দখলদার ফ্রান্সিসকো পিজারো আতাহুয়ালপাকে হত্যা করে!
একই ভুল আর নয়!
জুন ৪
ভবিষ্যতের সুখস্মৃতি
১৫৩৬ সালে সভ্যমানুষেরা ‘চিলি’ দেশটি আবিস্কার করে – স্কুল-কলেজে এই আমাদের পড়ানো হয়। পাঠ্যবইয়ের এই শিক্ষা ‘মাপুচি’ জনগোষ্ঠীকে মোটেই আকর্ষণ করে না, কেননা তিন হাজার বছর আগেই যে তাঁরা ‘চিলি’তে বসবাস শুরু করে!
১৫৬৩ সালে চিলির আদিবাসী জনতা স্পেনিয়ার্ডদের প্রধান দূর্গ অবরোধ করে রাখে।
আত্মসমর্পনের পূর্ব-মুহূর্তে ক্যাপ্টেন লরেঞ্জো দূর্গের শীর্ষ থেকে চিৎকার করে বলে, ‘ জেনে রাখো, এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আমরাই জিতব। আমাদের মাঝে কোনো স্প্যানিশ নারী নেই, আমরা একসময় তোমাদের দেশেই বিয়ে করব, সন্তান উৎপাদন করব আর সেই সন্তানেরা তোমাদের শাসন করবে।’
দোভাষী কোলোকোলো ভাষায় এর অর্থ প্রচার করে। আদিবাসীদের কাছে সে শব্দপুঞ্জ বৃষ্টির ধ্বনির মতোই দুর্বোধ্য মনে হয়।
সেনাপতির অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী সেদিন তাঁরা বুঝতে পারেনি!
জুন ৫
প্রকৃতির প্রতিশোধ
দুর্যোগ-দুর্ঘটনা বরাবরই শাস্তিদাতা প্রাকৃতিক বিচারক, তাকে স্বয়ং ভুক্তভোগী বলে আমরা ভুল করে থাকি। জলবায়ু যে আজ বেপরোয়া রুদ্ররূপ ধরেছে, তার জন্য আমরা মানুষই দায়ী।
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ইকুয়েডরের নতুন সংবিধান উদযাপনের সর্বোত্তম দিন আজ। ২০০৮ সালে এই সংবিধানই প্রথমবারের মতো ‘প্রকৃতি’কে রাষ্ট্রের অন্যতম নাগরিকের মর্যাদা দেয়। ভাবতে অবাক লাগে- প্রকৃতিরও নাগরিক মানুষের মতো কিছু অধিকার আছে এবং সে অধিকার সংবিধান স্বীকৃত!
অন্যদিকে বড় কোম্পানিগুলো নাগরিকত্বের সুবিধা পাচ্ছে আমেরিকায়, সেই ১৮৮৬ সাল থেকে।
‘প্রকৃতি’ যদি আমেরিকায় একটা কোনো বড় ব্যাংক হতো, তাহলে সে দিব্যি টিকে যেতো!!
জুন ৬
এইখানেতে পাহাড় ছিল
গত দু’শ বছরে উত্তর আমেরিকার অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালায় চার’শ সত্তরটি পাহাড় ধ্বংস করা হয়। আমেরিকান আদিবাসীরা বিলুপ্ত সেই পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে বেদনাতুর জীবনযাপন করছে।
পাহাড় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে –
কারণ সেখানে ছড়িয়ে আছে উর্বরতম ভূমি!
পাহাড় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে –
কারণ ভেতরে লুকিয়ে আছে কৃষ্ণরত্ন কয়লা!
জুন ৭
রাজার কবিতা কবিতার রাজা
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের চব্বিশ বছর পূর্বেই ‘নাজাওয়ালকোইয়ত‘ প্রয়াত হন। তিনি মেক্সিকোর বিস্তীর্ণ উপত্যকার টেক্সকোকো রাজ্যের প্রজ্ঞাবান রাজা ছিলেন। কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বজনস্বীকৃত।
তাঁর একটি কবিতা –
“কালের পরশে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় সুকঠিন স্বর্ণনিচয়
পান্নার গাঢ় সবুজ কান্তিহীন বিবর্ণময়
গোপন পাখির মায়াবী পালক ধূলোময় তাজে
নিথরপাথর আর যুবরাজ রাজা জগতে কে নিয়ত বিরাজে
রহস্য ডাকে অপার নিবিড়ে জীবনের কোলাহল শেষে
কিছুই কি হলো না তবে এমন জীবনে এসে?
কালের সরদে আমার এ গান বাজিবে তবু অভ্র আকাশে।”
জুন ৮
রুচির কলঙ্ক
১৫০৪ সালে মিকেলেঞ্জেলো তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্য ডেভিড উন্মোচন করেন। ফ্লোরেন্সের মূল ফটকে সটান দাঁড়িয়ে আছে পৌরুষদৃপ্ত ডেভিড। আপামর জনসাধারণ সহজভাবে গ্রহণ করেনি এই উদোম শিল্পকর্ম, ভাস্কর্যের গায়ে পাথর ছুঁড়ে তাঁরা এর তীব্র নিন্দা জানায়!
মিকেলেঞ্জেলো বাধ্য হয়ে ভাস্কর্যের অতি সংবেদনশীল অংশ ম্যাপল পাতায় মুড়ে দেন। সেদিন পাথরের নিটোল শরীরে ব্রোঞ্জের কলঙ্ক লাগে!
জুন ১২
রহস্য উন্মোচন
অবশেষে ২০১০ সালে, আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণের প্রকৃত কারণ উন্মোচন করে। তাঁরা স্বীকার করে নেয় আর কিছু নয় – আফগানিস্তানের ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজসম্পদই এই আগ্রাসনের মূল কারণ।
তালেবান তাঁদের কাছে সম্পদ ও সমস্যার কোনোটাই নয়!
আমেরিকার একমাত্র লক্ষ্য দেশটির ভূগর্ভস্থ অঢেল সম্পদ যেমন- স্বর্ণ, তামা, কোবাল্ট, লৌহ সর্বোপরি ধাতব লিথিয়াম যা সেলুলার ফোন ও ল্যাপটপ কম্পিউটারের মূল উপাদান!
জুন ১৩
সার্বিক পরাজয়
২০১০ সাল থেকে গণহারে আমেরিকান সৈন্যরা আত্মহত্যা শুরু করে। যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতোই ভয়ঙ্কর এই আত্মোৎসর্গ প্রবণতা।
পেন্টাগন সশস্ত্রবাহিনীতে অধিক সংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইতোমধ্যে সৈন্যবাহিনীতে এই চাকরির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।
দিনে দিনে গোটা বিশ্বটাই হয়ে উঠছে সশস্ত্র সামরিক ঘাঁটি আর দুনিয়াজুড়ে তৈরি হচ্ছে অবধারিত এক মানসিক হাসপাতাল। এই মানসিকস্বাস্থ্য নিবাসে ভারসাম্যহীন আসলে কারা? যাঁরা নিরুপায় আত্মহত্যা করে চলছে তাঁরা নাকি যাঁরা তাঁদের মারণযুদ্ধে পাঠিয়েছে, তাঁরা?
জুন ১৪
জলপাই রঙের অন্ধকার
১৯৮২ সালের এই দিনে আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক যুদ্ধে হেরে যায়। কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি ও রক্তপাত ছাড়াই স্বৈরশাসকের তাবেদারসব জেনারেল কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করে। ব্রিটিশ অধিকৃত ফকল্যান্ড আইল্যান্ড পুনরুদ্ধার করতে তাঁরা জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি ছিল। কিন্তু কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়া যুদ্ধ ছাড়াই লজ্জাস্কর পরাজয় স্বীকার করেন তাঁরা!
এইসব নির্লজ্জ জেনারেলদের পৌরুষ দেখা গেছে হাতকড়া-পড়া মেয়েদের ধর্ষণে, অসহায় নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি ও নির্যাতনে, সাধারণের থেকে নবজাতক শিশু চুরিতে আর অবৈধভাবে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ানোর উদগ্র প্রচেষ্টায়। কিন্তু দেশপ্রেমের বুলি তাঁদের ঠোঁটের আগায়, কথায় কথায় উন্নয়নের বয়ান, নিঃস্বার্থ জনসেবার ফিরিস্তি আর দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা তাঁদের কথায় ও কাজে।
কর্মসংস্থানের নামে হতদরিদ্র পরিবারের কিশোর যুবকদের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়োগের উচ্ছ্বাস-আনন্দ ঐসব পরিবাবে বেশিদিন স্থায়ী হয় না! কিছুদিনের মধ্যেই এইসব আনাড়ি সৈন্য যুদ্ধে আর দক্ষিণের প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রাণ হারায়!
জুন ১৫
নারী সাহসিকা
আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক ও তাঁর বহু জেনারেল তাঁদের কৃতকর্মের জন্য একদিন বিচারের সম্মুখীন হন।
তাঁদের অসংখ্য অজস্র কুকীর্তির একটি –
সিলভিনা পারোদি নামে একছাত্রীকে গণজাগরণে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। অন্য অনেক বন্দীর মতো তিনিও একসময় নিখোঁজ হয়ে যান!
২০০৮ সালের এই দিনে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সিসিলিয়া আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তিনি মহামান্য আদালতকে বলেন, ‘ সিলভিনার মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না, ব্যারাকে তাঁকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হতো!’
তিনি আদালতে আরো স্বীকার করেন , ‘ দিনরাত নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে আমিই তাঁকে ধরিয়ে দিই। সৈন্যরা টেনে-হিঁচরে তাঁকে ঘর থেকে বের করে আনে, বন্দুকের বাট দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। তাঁর যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম দূর থেকে ।’
আদালতের বাইরে একজন কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করে,‘ এতকিছুর পর জীবন কাটাচ্ছেন কিভাবে?‘
মৃদুস্বরে তিনি বলেন, ‘ আপনার কি মনে হয় আমি বেঁচে আছি?‘
জুন ১৬
হায় প্রেম!
অস্কার লিনিয়েরা শতসহস্র নিখোঁজ-গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের একজন। আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তা তাঁদের মার্জিত মোলায়েম ভাষায় এই গুমহত্যাকে বলে ‘ট্রান্সফার’।
বন্দীশালায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন পিয়েরো দ্য মন্তে। কমরেড মন্তে স্মৃতিচারণ করেন, ‘জেলখানায় অস্কার একদিন আমাকে জানায়- জানো, আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি, আর দেখ আজ আমাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে – এ জীবনে ভালোবাসা আর হলো না!’
জুন ১৭
আমি কেন ট্যাক্স দেব?
কিতো শহরে শুধু পুরুষেরাই আইনত ক্রয়বিক্রয় ব্যবসাবাণিজ্য করার সুবিধা পেতো। তাই ট্যাক্স-ভ্যাট শুধু তাঁদেরকেই পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু ১৭৮২ সালে কিতো মিউনিসিপ্যাল কোর্ট রুল জারি করে, এখন থেকে সামোসা সুরিতা তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয়ের জন্য ট্যাক্স দিতে বাধ্য থাকবে।
সামোসা নির্বিকার বলে পাঠায়, ‘ তাঁদের আইন অনুযায়ী কাজ করা উচিৎ, ট্যাক্স আমার স্বামীর থেকেই আদায় করা বিধেয়। আইন তো মনে করে আমরা নারীরা অপদার্থ অযোগ্য, তো তাই যদি হয় তাহলে আমাদের থেকে ট্যাক্স দরকার কেন? আমরা যদি আইনত উপার্জনের অযোগ্য হই, তাহলে সেই আইন মতে ট্যাক্স প্রদানেও অযোগ্য।’
জুন ১৮
আর সুসান কেন জরিমানা দেবে?
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বনাম সুসান বি. এন্থনি মামলা, উত্তর নিউইয়র্ক জেলা আদালত, ১৮ জুন ১৮৭৩।
এটর্নি রিচার্ড ক্রাউলিঃ ‘ধর্মবতার, অভিযুক্ত সুসান বি. এন্থনি একজন গৃহবাসিনী নারী। নারী হয়েও তিনি কংগ্রেস নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। গুরুতর অপরাধ করেছেন। আমাদের সুপ্রতিষ্ঠিত আর ঐতিহ্যবাহী আইনের ঘোরতর বিরোধী এই উদ্ধত সাহস, অবিনীত অপরাধ।
হুজুরের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এই নারীর কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।’
বিচারক ওয়ার্ড হান্টঃ ‘অভিযুক্তকে প্রচলিত আইনের কাঠামো মেনেই বিচার করা হয়েছে।’
সুসান বি. এন্থনিঃ ‘হুজুর, যথার্থই বলেছেন প্রচলিত আইনের কাঠামো মেনেই বিচার করা হয়েছে! আর আইনের এই কাঠামো বানিয়েছেন পুরুষ, ব্যাখ্যা করেছেন পুরুষ, কার্যকর করেছেন পুরুষ এবং এসব কিছুই করা হয়েছে পুরুষের জন্য, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে।’
বিচারক ওয়ার্ড হান্ট: ‘অভিযুক্ত আসামি উঠে দাঁড়ান। এই আদালত রায় দিচ্ছে যে, আপনি অতিসত্বর একশ ডলার জরিমানা দেবেন আর এই বিচারকার্যের খরচটাও বহন করবেন।’
সুসান বি. এন্থনি: ‘আল্লাহর কসম! আমি একটা পয়সাও দেব না!’
জুন ১৯
বাইসাইকেল শঙ্কা
‘আমার মতে দুনিয়াজুড়ে নারীর ক্ষমতায়নে সবচাইতে বেশি ভূমিকা রেখেছে বাইসাইকেল।‘, বলেছেন সুসান বি এন্থনি। আর তাঁর বন্ধু এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন বলেছেন, ‘ বাইসাইকেল চালিয়েই নারী তাঁর ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে যায়।‘
মর্মার্থে ও আক্ষরিক অর্থে বাক্যটি সমান সত্য।
অন্যদিকে কোনো কোনো ডাক্তার – যেমন ফিলিপ তিসি – সাবধান করে দেন, ‘ সাইকেল চালানোয় নারীর অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত ঘটে, বন্ধ্যাত্বের সম্ভাবনাও বাড়ে।‘ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘ অশ্লীল এই বাহন নারীর নীতি নৈতিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে। সাইকেলের আসনে গোপন ইন্দ্রিয়ের স্পর্শে নারীর কামোদ্দীপক শিহরণ জাগে। নারী বেপথু হয়ে যায়।’
কিন্তু সত্য হলো – বাইসাইকেল নারীর জীবনে গতি এনে দিয়েছে। তাঁকে ঘর থেকে বের করে আনন্দময় স্বাধীন জীবন উপহার দিয়েছে। আর এই সাইকেল নারীর মধ্যযুগীয় নারীসুলভ উত্তেজক পোশাককে জানিয়েছে বাই বাই।
জুন ২০
কালো? তা সে যতই কালো হোক
গানের প্রতিটি শব্দকে বহুবর্ণিল রঙিন করে তোলে তাঁর উচ্চগ্রামের নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠস্বর। রিও ডি জেনেরিও‘র হাজার হাজার মুগ্ধ স্রোতার করতালিতে প্রাঙ্গণ ময়দান জলসাঘর মুখরিত হয়ে ওঠে জকিনা লাপিনিয়া‘র অত্যাশ্চর্য সঙ্গীতে।
জনৈক সুইডিশ অপেরাভক্ত কার্ল রুডার্স ১৮০০
সালে লিসবনে তাঁর সঙ্গীত শোনেন। বিমুগ্ধ এই শ্রোতা সঙ্গীতের ভূয়সী প্রশংসা করেন, ‘ অসাধারণ কণ্ঠ, নিপুন তাঁর সঙ্গীতের তালে মোহময় অঙ্গভঙ্গি, কিন্তু দুঃখজনক হলো তাঁর গায়ের রং বড্ড কালো! গাঢ় রঙচঙে প্রসাধনী ব্যবহার করে তাঁকে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে।‘
জুন ২১
আমরা সবাই আজ ‘আকিম‘
ইতালিতে ২০০১ সালে এই দিনের ট্রেভিসো বনাম জেনোয়ার প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
ট্রেভিসোর অন্যতম খেলোয়াড় নাইজেরিয়ার ‘আকিম ওমোলাদে‘ ইতালির মাঠে স্টেডিয়ামে বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেন। দর্শক তাঁকে দেখলেই অযাচিত হুইসেল বাজায়, অশ্লীল বর্ণবাদী কটূক্তি করে, আর অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে তাঁকে বিব্রত নাজেহাল করে ছাড়ে।
কিন্তু আজকের খেলায় স্টেডিয়াম জুড়ে নীরবতা – কোথাও কোনো কটুক্তি বা তাচ্ছিল্যের উলুধ্বনি নেই!
ট্রেভিসোর অন্য দশজন খেলোয়াড়ের সবাই আজ কালো কালিতে মুখ রাঙিয়ে খেলতে নেমেছেন!
জুন ২২
পৃথিবীর পৃথুল কোমর
খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪ সালে, ইরাতোস্থিনিস নামে একবিজ্ঞ ব্যক্তি আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে একটি লোহার দণ্ড পুঁতে দিয়ে এর ছায়ার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন।
ঠিক এক বছর পর একই সময় একই দিনে একই লৌহদণ্ড আসওয়ান শহরে পুঁতে দিয়ে দেখেন লৌহদণ্ডের কোনো ছায়া পড়েনি। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, দন্ডের এই ছায়াহীনতা প্রমাণ করে পৃথিবী সমতল নয়, বর্তুলাকার।
তিনি দুই শহরে প্রাপ্ত ছায়ার দৈর্ঘ্যের অন্তরফল নির্ণয় করেন। সেইসাথে শহর দুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব পায়ে হেঁটে পরিমাপও করেন।
ছায়ার ব্যবধান আর শহর দুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব হিসাবকিতাব করে পৃথিবীর কোমরের মাপ নিতে চান এই প্রাজ্ঞ ‘বিশ্ব’ প্রেমিক!
মাপে তিনি মাত্র পঞ্চাশ মাইল এদিকসেদিক করেছিলেন!
জুন ২৩
অগ্নি স্নানে শুচি হোক সব
অনেক অনেক আগে এইদিন মধ্যরাতে আগুনের বিশাল কুণ্ড জ্বলে ওঠে। ভক্তিভরে চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায় উৎসুক নিবেদিত জনতা।
তাঁদের বিশ্বাস, এই রাতের প্রজ্জ্বলিত আগুন আত্মা ও আবাস শুদ্ধ কলঙ্কমুক্ত করে। সময়ের গ্লানি আর পুরাতন জঞ্জালসব অগ্নি স্নানে শুচি হয়ে ওঠে। রাতভর নতুনের আবাহন চলে অগ্নিকে সামনে রেখে – এসো হে নতুন জীবন, এসো হে!
অগ্নিহোত্রের এই রীতি উত্তর থেকে সারা পৃথিবী ছড়িয়ে পড়ে। অনাদিকাল থেকে এইদিন প্যাগানদের উৎসবের দিন, সার্বজনীন মঙ্গলের দিবস।
কিন্তু রোমান ক্যাথলিক চার্চ এসব নাফরমানি মানতে চায় না, তাঁরা এই দিনটিকে ‘সেইন্ট জন’ দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে।
জুন ২৪
সূর্যো যথা সর্বলোকস্য চক্ষু –
আজ ভোর থেকেই আন্দিজের উপত্যকায় শৃঙ্গে সূর্য উৎসব ‘ ইন্তি রেমি’ মহাসমারোহে উৎযাপন শুরু হয়।
সৃষ্টির আদিতে আকাশ আর পৃথিবীতে ছিল অন্তহীন অন্ধকার – শুধু রাত আর রাত।
টিটিকাকা লেক থেকে প্রথম যেদিন আদি নারী ও পুরুষ আবির্ভূত হয়, সেদিনই পূর্ব দিগন্তে প্রথম উঁকি দেয় মহামহিম অরূণদেব।
দেবতা ‘ভিরাকোচা’ সূর্য সৃষ্টি করেন যাতে নারী পুরুষ এক অদ্ভূত মায়াবী আলোতে একে অপরের সৌন্দর্য দেখতে পারে!
জুন ২৫
ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার?
৭৬২ সালের আজ রাতে চিনা কবি ‘লী পো’ জলে ডুবে মারা যান।
ইয়াংসি নদীতে পূর্ণিমার থরো থরো রূপ জড়িয়ে ধরতে চেয়েছেন তিনি। চাঁদও তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় মায়াবী সেই রাতে।
ক’দিন আগেই চাঁদকে নিয়ে তিনি লিখেছেন-
মদির রাতে মদিরা হাতে আমি একা
পরাণ সখা বন্ধু কারো নাহি দেখা
পেয়ালা খানি উর্ধ্বে তুলে দিয়েছি আজি
প্রেয়সী শশী অধর ছোঁয়াও, হও রাজি
হায়রে রাকা! সুদূরে থাকা ফুরাবে না?
আমার ছায়া আমারি পাশে আনমনা।
জুন ২৬
স্বৈর-রাজ্যে পৃথিবী শঙ্কাময়
আজ আন্তর্জাতিক নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস।
কিন্তু নির্মম পরিহাস হলো – ১৯৭৩ সালে এইদিনের পরের দিন, উরুগুয়ের স্বৈরশাসক ক্ষমতায় আসে।
এবং পরবর্তীতে দেশটাকে একটা বৃহৎ নির্যাতন ক্যাম্পে পরিণত করে
গোপন তথ্য আদায়ে তাঁরা পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে যেত দিনের পর দিন।
কিন্তু খুব বেশী তথ্য তাঁরা বের করতে পারেনি নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক মানুষের থেকে।
তবে তাঁরা যেটা খুব ভালোভাবেই পেরেছে তা হলো – ‘ভীতিসঞ্চার’;
আপামর মানুষের মধ্যে এক হৃদয়কাঁপানো ভয় সঞ্চারিত করেছিল তাঁরা।
নির্বাসনে থাকা কালে আমি এক বেনামা পত্র পাই, যাতে সভ্য-শিক্ষিত মানুষের বেদনার্ত আর্তনাদ শোনা যায় –
‘কত আর মিথ্যা বলা যায়! আমি মিথ্যা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, শুধু বেঁচে থাকার জন্য এই জঘন্য আত্মপ্রবঞ্চনা আর কত!
সত্য লুকানো যদিও সহ্য করা যায়, মিথ্যা শেখানো, মিথ্যা পড়ানো কিভাবে মানি?
কিন্তু আমার যে তিন তিনটা শিশু সন্তান আছে, আমি কি এড়াতে পারি?’
জুন ২৭
নির্যাতনের সংবিধান
চতুর্দশ শতাব্দীতে হলি ইনকুইজিশনের সময় লিখিত হয় নির্যাতনের সংবিধান ‘ডিরেক্টোরিয়াম ইনকুইজিটোরিয়াম’।
বিভীষিকাময় এই সংবিধানের শাস্তিবিধান নীতির মৃদুতম একটি নীতি –
‘প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে কেউ গড়িমসি করলে তাঁকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।’
জুন ২৮
উত্তাপের আশীর্বাদ
৯৬০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিষ্টান মিশনারীরা স্ক্যান্ডিনেভিয়া আক্রমণ করে। প্যাগান ভাইকিংসদের তাঁরা ভয় দেখায় – ‘ তোমরা যদি সত্য ধর্মে বিশ্বাস না-আনো, তবে তোমাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা – প্রজ্জ্বলিত আগুনের অন্তহীন নরক!’
ভাইকিংসরা এই ভয়ভীতি স্বর্গীয় সুসংবাদ হিসেবেই দেখেছে। তীব্র ঠান্ডার দেশে আগুন তাঁদের কাছে দেবতার আশীর্বাদ।
জুন ২৯
স্বর্গ ও নরক
আজ সেইন্ট পিটার্স দিবস।
বলা হয়, পিটার্সের হাতেই আছে স্বর্গের কাঙ্খিত চাবি।
কিন্তু সেই অপার্থিব স্বর্গের নিশ্চয়তা কে দেবে?
প্রজ্ঞাবান জ্ঞানীরা বলেন, ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!‘
জুন ৩০
দুর্বিনীত নারী
১৮১৯ সালের এইদিনে বুয়েনেস আয়ার্সের একটি চার্চে হুয়ানা ম্যানসোর ব্যাপ্টিজম সম্পন্ন হয়।
পবিত্র জলের স্পর্শে কন্যাশিশু নম্র ভদ্র ও মার্জিত হয়ে উঠবে- ব্যাপ্টিজমের এই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু হুয়ানা নম্র মার্জিত হয়নি!
সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হুয়ানা উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনায় প্রগতিশীলসব বিদ্যাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। সহশিক্ষার সেসব বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে একসাথে পড়ালেখা করে আর ধর্মশিক্ষা সেখানে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। নূন্যতম শারীরিক শাস্তির বিধানও সেখানে নিষিদ্ধ।
শুধু তাই নয়, হুয়ানা সত্যসন্ধানীদের জন্য আর্জেন্টিনার নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করেন। তিনি এমনসব বইপত্র লেখেন, যা তখন কেউ ভাবতেই পারেনি।যেমন – বৈবাহিক জীবনের কপটতা ভণ্ডামি নিয়ে তিনি আস্ত একটা উপন্যাস লিখে ফেলেন।
আর দেশের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরীটি তিনিই গড়ে তোলেন নিরলস প্রচেষ্টায়।
ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাচেতনাও রীতিমতো ঈর্ষনীয়। বিবাহবিচ্ছেদের অস্তিত্বই যখন আর্জেন্টিনায় ছিল না, তখন তিনি সগর্বে ডিভোর্স প্রস্তাব করেন।
আর্জেন্টিনার পত্রপত্রিকায় রথি-মহারথি সম্পাদক সাংবাদিক তাঁকে নিয়ে নিয়মিত রঙ্গতামাশা করতো।
মৃত্যুতেও তাঁর রেহাই নেই, পবিত্র চার্চ তাঁর শেষ আশ্রয় কবরের জায়গাটুকুও তাঁকে দেয়নি!