সে নিজের একটা ডাকনাম রেখেছিল- ‘বিপ্লবী।’
খুব লেখাপড়া জানা যুবক, সুদর্শন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী; চাকরীও বেশ ভালো করে। আচরণে পুরোপুরি বিদ্রোহী।
কথায় কথায় সে মার্কস, লেনিনের উদাহরণ দিত; ছিল চে গুয়েভারা’র অন্ধ ভক্ত। কফি হাউজে দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা দিত, খুব কথা বলতো; সব সময় বিপ্লবীর জোশে থাকতো- ‘সবকিছু উল্টে-পাল্টে দিতে হবে, সবকিছু বদলে দিতে হবে!’ চুল বড় বড়, দাড়িও আঙ্গুল-সমান হতে চলেছে; কথায় কথায় বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে বসে। সর্বদা কিছু একটা করার, করে দেখানোর সুযোগ খোঁজে। বলে, ‘আমার বাবার মতো মানুষকে জলদি জলদি মরে যাওয়া উচিত। আমার বাবা ঘোর বর্ণবাদী, জাতিবাদী আর প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ। ঠেঁট বুর্জোয়া! উনি যখন দেহ রাখবেন, আমি কোনো রীতি-নীতি-ধর্মের অনুসরণ করবো না। নিজের মাথাও মুন্ডন করবো না, বাবার কোনো শ্রাদ্ধও পালন করবো না। সব পরষ্পরাকে আমি নাশ করে দেবো! চে গুয়েভারা জিন্দাবাদ!’
তার কোনো এক বন্ধু তাকে বলে, ‘কিন্তু তোমার বাবা তো তোমাকে ভীষণ ভালবাসে!’
বিপ্লবী বলে ওঠে; ‘ভালোবাসা! হাঃ হাঃ… প্রত্যেক বুর্জোয়াই বিপ্লবীদের বিপ্লবকে মারতে, নস্যাৎ করতে ভালবাসে। এসব ‘পেয়ার’ হল সাক্ষাৎ ষড়যন্ত্র, তোমরা তা বুঝতেই পারো না। আমার বাবা এই মুহূর্তে একজন ব্রাক্ষণকে খুঁজে ফিরছেন। যার কাছ থেকে তিনি বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি সেটা হতে দিচ্ছি না। আমি আমার জাতির কাউকে বিয়ে করবো না। আমি অন্য জাতের, নীচু কোনো জাতের একটা মেয়েকে বিয়ে করবো। আমার বাপ মাথায় হাতে দিয়ে, মাথা নিচু করে বসে পড়বে।’
বন্ধু বললো, ‘যদি তোমার সাথে কারো প্রেম হয়ে যায়, আর মেয়েটা যদি ব্রাহ্মণ জাতের হয়, তাহলেও কি তুমি তাকে বিয়ে করবে না?’
‘না, কোনোভাবেই না। আমি ওকে ছেড়ে দেব। কোনো বিপ্লবী তার স্বজাতের সাথে প্রেমও করে না, বিয়েও না। আমার এক কায়স্থ মেয়ের সাথে প্রেম আছে। আমি তাকেই বিয়ে করবো।’
একদিন সে তার সেই কায়স্থ প্রেমিকাকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেললো। তারপর নববধূকে সাথে নিয়ে, নিজ শহরে এসে এক বন্ধুর বাড়িতে থাকতে শুরু করলো। তখন তার ভাব বড় তুঙ্গে ছিল। বললো, ‘আই ব্রোক দেয়ার নেক! আমার বাপ এখন মনে হয় তন্ন তন্ন করে আমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। মা নিশ্চয়ই পড়ে পড়ে কাঁদছে; পাড়ার, মহল্লার লোকজন জড়ো করে আমার বাপ মনে হয় ভাষণ দিচ্ছে: ‘আমার জন্য এই ছেলে এখন মৃত! আমি ওকে ত্যাজ্য করলাম।’
‘বাবা আমাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে। আই ডোন্ট কেয়ার! যে কোনো বলিদান, যে কোনো আত্মত্যাগে আমি প্রস্তুত। ঐ ঘর এখন আমার জন্য শত্রুর ঘর, দুশমনের ঘর হয়ে গেছে। বাট, আই উইল ফাইট টু দি এন্ড… টু দি এন্ড!’ বিপ্লবী এখন বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে, বসে পড়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে, ‘ব্যাস! সংঘর্ষ এসে পড়লো বলে!’
এরপর, এক বন্ধু ওর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে বললো, ‘তোমার ফাদার বলছিলেন যে, তুমি বউ নিয়ে সোজা বাড়ি গেলে না কেন? তোমার বাবাকে তো খুবই শান্ত দেখলাম। উনি বলছিলেন,‘ছেলে আর ছেলে বউকে বাসায় নিয়ে আসো।’
বিপ্লবী রীতিমতো রেগেমেগে হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘ওফ… যত্তোসব বুর্জোয়া হিপোক্রেসি! এসব, সব ষড়যন্ত্র। ঘরে আমাকে আগে ডেকে নেবে, এরপর অপমান করে, হৈ-চৈ-হল্লা করে ক্ষেদিয়ে দেবে। উনি আমাকে ত্যাজ্য করেছেন, তাহলে আমি কেন সমঝোতা করবো? আমি দুই রুমের বাসা ভাড়া করে থাকবো।’
বন্ধু তাকে বললো, ‘তোমার বাবা আবার কখন তোমাকে ত্যাজ্য করলো?!’
বিপ্লবী বললো, ‘আমি সবকিছু জানি। আই উইল ফাইট!’
বন্ধু বললো, ‘যখন লড়াইয়ের কিছু নেই, তখন ফাইট করে কি করবে?’
বিপ্লবী পুরোপুরি তার কল্পনায় বুঁদ হয়ে ছিল। হাতিয়ার গুজিয়ে রাখছে, বারুদ শুকিয়ে রাখছে। বিপ্লবী হিসেবে তার পরীক্ষা দেবার সময় সমাগত। ‘আমি বীরের মতো লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো, লড়ে যাবো; নিজেকে বলিদান করবো!’
তিনদিনের দিন বিপ্লবীর এক বিশেষ বন্ধু এসে বললো, ‘তোর বাবা-মা ট্যাক্সি চড়ে তোকে নিতে এখানেই আসছে। বুধবার তোদের বিয়ে উপলক্ষ্যে ভোজ-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতিথিদের দাওয়াতপত্র বিলি চলছে।’
বিপ্লবী মাথা খুঁটতে থাকে, ওর ঘাম ছুটে যায়। মুখমন্ডল, ত্বক ফ্যাকাশে, হলুদাভ হয়ে ওঠে। বলে, ‘হায়! সবকিছু খতম হয়ে গেল! জীবনভর সাধনা, সংঘর্ষ সবকিছু শেষ হয়ে গেল। নো স্ট্রাগল, নো রেভল্যুশান! আমি হেরে গেলাম। ওরা আমাকে নিতে আসছে। আমি লড়তে চেয়েছিলাম। আমার বিপ্লব! আমার বিপ্লবী চেতনা! দেবী, তুমি আমার বাপকে দিয়ে আমাকে তিরস্কার করাও। চে গুয়েভারা! ডিয়ার চে! চে!’
বিপ্লবীর বউটা কিন্তু চালাক-চতুর ছিল। সে দুই-তিনদিন ধরে তার বিপ্লবী স্বামীর ‘বিপ্লব’ দেখে আসছিল, আর মনে মনে হেসেই আকুল হচ্ছিল। বউ তাকে বললো, ‘ডিয়ার, একটা কথা বলি- তুমি কিন্তু কোনো বিপ্লবী নও।’
‘আমি বিপ্লবী নই? তাহলে আমি কি?’
বউ বললো, ‘তুমি হলে গিয়ে একটা বুর্জোয়া ভাঁড়! তারপরও, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি!’
========
হরিশংকর পরসাই
আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গ ও রম্যলেখক হরিশংকর পরসাই ১৯২৪ সালের ২২ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের মধ্যপ্রদেশের হশান্গাবাদ জেলার জামানি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ করার পর তিনি অল্পকিছুকাল চাকরিতে যুক্ত হন। এরপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ভারতের জাবালপুর শহরে থিতু হবার পর তিনি ‘বসুধা’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ‘বসুধা’ দারুণভাবে পাঠকনন্দিত হবার পরও অর্থাভাবে তাকে এর প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়। জীবিকার জন্য এরপর তিনি ‘দৈনিক দেশবন্ধু’ পত্রিকার সাথে যুক্ত হলেও সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান এবং তার সহজাত, হাস্যরসাত্মক ও তীক্ষ্ণভেদী লেখার জন্য হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যঙ্গকার, রম্যলেখক এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো বিষয়গুলোও তার সহজ ভাষার ব্যবহার, সোজাসাপ্টা প্রকাশভঙ্গিমা, বিচারগুণ ও হাস্যরসে অনন্য হয়ে উঠেছে। ‘বিকলাঙ্গ্ শ্রদ্ধা কা দৌড়’ ব্যঙ্গরচনার জন্য তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘য্যায়সে উনকে দিন ফিরে’, ‘ভোলারাম কি জীভ’ এবং ‘হাসতে হ্যায় রোতে হ্যায়’ তার জনপ্রিয় ছোটগল্প সংকলন। ‘রানী নাগফনি কী কাহানী’, ‘জাউলা অউর জাল’ এবং ‘তাঁত কী খোঁজ’ তার পাঠকপ্রিয় উপন্যাস। তিনি ১৯৯৫ সালের ১০ আগস্ট, জাবালপুরে লোকান্তরিত হন।