একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (২০তম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

(৫৮)

হাফ প্যান্ট পরলে কি হবে ক্লাস ফাইভে রাহুল অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছিল।

একা ভকুয়াটেপায় যেতে পারত। পনেরো কুড়ি দিন পরে পরে রাহুলের ভকুয়াটেপায় যাওয়াটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। একটি প্রকাণ্ড ব্যাগে চিনি, ডাল, তেল বুটমুগ জাতীয় জিনিস ভরিয়ে বরুণ রাহুলকে ভকুয়াটেপায় অর্থাৎ বরুণের নতুন শ্বশুরবাড়িতে যেতে নির্দেশ দিত। রাহুল এভাবে যেতে খুব আনন্দ পেত। কারণ তখন স্কুলে যেতে পারা থেকে মুক্তি, বরুণের তীক্ষ্ণ চোখ জোড়ার শাসন থেকে মুক্তি, বাড়ির একঘেয়েমি জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি, তার বিপরীতে ভকুয়াটেপায় রয়েছে  অপে মাসি।আর অপে মাসি মানেই ভালোবাসার এক ঝাঁক বাতাস…

একই বাসে ভকুয়াটেপায় তখন যাবার মতো ব্যবস্থা ছিল না। পাঠশালা থেকে একটি বাস সার্থেবারি মাত্র যায়।তারপরে সেই বাসের যাত্রা শেষ।সার্থেবারিতে  বাস থেকে নেমে চা-সিঙ্গারা খেয়ে বরপেটা যাওয়া বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হত। চা সিঙ্গারার জন্য নির্ধারিত পঁচিশ পয়সা বরুণ বাসে আসা যাওয়ার ভাড়ার সঙ্গে রাহুলের হাতে গুঁজে দিয়ে আদর করে বলে, ‘জিনিসগুলি নামানোর সময় ভালো করে দেখে নিবি বাবা। ওজন আছে। জানালা দিয়ে হাত বের করে রাখবি না।সার্থেবারিতে নেমে চা- সিঙ্গারা খেয়ে নিবি। রাস্তা পার হওয়ার সময় এদিকে ওদিকে দেখবি। বরপেটায় যাওয়া বাসটা না আসা পর্যন্ত চায়ের দোকানের বারান্দায় অপেক্ষা করবি…’

সার্থেবারির কলিতা হোটেলে চা-সিঙ্গারা খেয়ে রাহুলের এরকম মনে হতো যেন গজেন্দ্রনাথের লবঙ্গ চায়ের চেয়ে আজকাল তার বেশি ভালো লাগে সিঙ্গারা চা। রাহুল অনুভব করল মিষ্টির চেয়ে নোনতার স্বাদ বেশি ভালো লাগছে তার। এটা হয়তো বড়ো হওয়ার লক্ষণ তার। সার্থেবারিতে বরপেটা যাওয়ার বাসটা আসার জন্য অপেক্ষা করে করে কখনও একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। সেভাবে যদি এখানে এই অপরিচিত জায়গায় সিগারেট খায় বজালীবাসী জানতেই পারবে না। কিন্তু সে মনের ইচ্ছা দমন করে রাখে। কারণ ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলের সিগারেট খাওয়ার অধিকার নেই এই দেশে। কেবল ভিখারি জাতীয়  ছেলেরাই এই বয়সে সিগারেট খেলে কেউ এই ভারতবর্ষে আপত্তি করে না ।

বরপেটা যাওয়া বাসে উঠে এসে রাউলির চকে নামে।রাউলির চক থেকে বরুণের শ্বশুর বাড়ি ভকুয়াটেপা প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ অর্থাৎ রাহুলের নতুন মামা বাড়ি।কিন্তু রাহুলের নতুন মা চন্দ্রপ্রভার কোনো ভাই ছিল না।একজন দিদি ছিল মাত্র, অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।

রাউলির চকে  নেমে ভকুয়াটেপায় যাওয়ার  প্রথম বাড়িটাই ছিল রামেশ্বর পাঠকের ঘর। অপে মাসি সেই বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিল রাহুলকে। যখনই ভকুয়াটেপায় রাহুল আসে সেই বাড়িটা না দেখে থাকে না। দেখার সঙ্গে তার ঠোঁটে  না এসে থাকেনা—অ পাখি রৈয়া যারে…পাখি রৈয়া যারে…নামের সেই বিখ্যাত লোকগীতটির দুটো পংক্তি।

বালিময় পথটি দিয়ে ভারী ব্যাগটা বহন করে নিতে রাহুল ঝুকে পড়তে থাকে ।মাঝখানে কয়েকবার দাঁড়িয়ে হাত বদল করে নেয়। যখন সে গিয়ে তার নতুন মায়ের বাড়িতে পৌঁছায়,বাড়ির বারান্দায়  বসে হুঁকো টানতে থাকা বরুণের নতুন শ্বশুর  দামোদর শর্মাকে দেখতে পায়। কাশতে কাশতে তিনি হুঁকো টানতে থাকেন। নিজেও খান অন্যকেও খাওয়ান অর্থাৎ তিনি তামাক বিক্রি করেন। কোনো একজন এক টাকার তামাক নেয়, কেউ আবার দু টাকার তামাক নেয়, এভাবেই চলছে দামোদর শর্মা। তার চেয়ারের কাছে থাকা গ্রাহক বসা বেঞ্চের নিচে একটি এলুমিনিয়ামের থালা থাকে। যেখানে থাকে কিছু ছাই, সেই ছাইয়ের থালাটিতে দামোদর কাশতে কাশতে কফগুলি ফেলে।কফগুলি দেখে রাহুলের ঘৃণা হয় না। সে  অনেক আগেই অনেক জিনিসকে ঘৃণা করা ছেড়ে দিয়েছে—এটাও বড়ো হওয়ার একটি লক্ষণ, সে ভাবে।সে গিয়ে সেই বেঞ্চটাতে বসে।দামোদর শর্মা একইভাবে চেয়ারে বসে হুঁকো টানতে থাকেন এবং তাকে কিছু সময় পরে বলেন, ‘যা ভেতরে যা।’

ভেতরে ঢুকে যাওয়া রাহুলকে দেখে অপে মাসি নিরুদ্বেগভাবে বলে, ‘রাহুল এসেছিস, আয় বস।’ এই বলে একটা পিড়ি পেতে দেয়। তাদের বাড়িতে অতিথিকে বসার জন্য পিড়ি দেওয়া হয়। মাত্র দুটি বিছানা আছে ওদের বাড়িতে। মানুষ তিনজন—

দামোদর, দামোদরের স্ত্রী এবং অপে মাসি। বাড়িতে একটাই চেয়ার,দামোদর বসে হুঁকো টানার জন্য এবং তামাকের গ্রাহকদের জন্য রয়েছে একটি বেঞ্চি। রাহুল রাতে থাকার জন্য প্রফুল্ল মামা অর্থাৎ চন্দ্রপ্রভার খুড়তুতো দাদার বাড়িতে যেতে হয়। প্রফুল্ল মামাকে রাহুলের ভালো লাগে। উদাত্ত কণ্ঠে প্রফুল্ল মামা রাহুলকে ভাগ্নে বলে ডাকে। প্রফুল্ল মামার কথা বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয়। জোরে জোরে কথা বলে এবং যা বলে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে।

একদিন প্রফুল্ল মামা বাড়িতে ছিল না । সেদিন রাহুলকে প্রফুল্ল মামার দাদা সদা মামার সঙ্গে ঘুমোতে হয়েছিল।অবিবাহিত সদামামা ছিলেন বৃত্তিতে একজন পুরোহিত। ধুতি এবং গেঞ্জি পরে থাকা সদা মামার কাঁধে সবসময় একটা জীর্ণ গামছা থাকত। অন্ধকারে দুলতে থাকা ভকুয়াটেপায় কেরোসিনের কুপি আর জোনাকি পোকার আলোতে রাত কাটত।রাতে দামোদর শর্মার বাড়িতে ভাত খেয়ে রাহুল সামনে থাকা প্রফুল্ল মামাদের বাড়িতে ঘুমাতে যায়। অপে মাসি সেই একটুখানি জায়গাটা রাহুলকে এগিয়ে দিয়ে যায়, প্রফুল্ল মামাদের উঠোন পর্যন্ত।

সেদিন সদামামা রাহুলকে বিছানা পেতে দিয়ে মশারিটা ঘরের চার কোণায় থাকা গজালে টেনে দিয়ে  মশা মাছি যাতে ঢুকতে না পারে  সেই জন্য  মশারিটা তোষকের নিচে গুঁজে দিয়ে বলেছিল—‘ভাগ্নে তুমি ঘুমিয়ে থাক,আমি ভাত খাইনি। আমি ভাত খেয়ে এসে ঘুমোব। আলোটা কমিয়ে দিচ্ছি এই বলে তিনি চলে গিয়েছিলেন।

ক্লান্ত রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাহুলের অজান্তে সদামামা রাহুলের হাফ প্যান্টটা  ধীরে ধীরে খুলে ফেলেছিল।হঠাৎ রাহুলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।অন্ধকারের মধ্যে সে দেখল তার পিঠের ওপরে সদা মামা উঠে পড়েছেন এবং ধুতিটা ফাঁক করে টানটান হয়ে থাকা লিঙ্গটা রাহুলের পাছায় গুঁজে দিয়েছেন। রাহুল নড়াচড়া করতে পারছে না।‘কী করছ কী করছ…বলে রাহুল লক্ষ্য করল যে তার পাছাটা বিজল বিজল কোনো জিনিসে ভিজে গেছে।

রাহুল চিৎকার করে উঠল।সদা মামা  তার জীর্ণ গামছা দিয়ে রাহুলের নোংরা হয়ে পড়া পাছাটা মুছে দিল। কিন্তু রাহুল ক্ষান্ত হল না। সে তৎক্ষণাৎ হাফ প্যান্টটা পরে নিয়ে বিছানা থেকে নামল এবং কাঁদতে শুরু করল। রাহুল বলল যে সে আর এখানে ঘুমাবে না। সে অপে  মাসির ঘরে চলে যাবে। রাহুল চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল।

সাদা মামা দেখলেন ভীষণ বিপদ। পুরোহিতের এই ধরনের আচরণের কথা বাড়ির মানুষ, বাইরের মানুষ জানতে পারলে সর্বনাশ হবে। সদা মামা রাহুলকে মিনতি করতে লাগলেন। তিনি হাতজোড় করে বলতে লাগলেন—‘ভাগ্নে আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি। কাউকে কিছু বল না। আমার ভুল হয়ে গেছে ভাগ্নে—আমি তোমার পায়ে ধরছি…’

আর ভাগ্নে কান্না বন্ধ করেছিল। একটি অসহায় কিশোরকে অন্য একজন অসহায় মানুষের মিনতিকে বুঝতে হয়েছিল।

এই ঘটনার প্রায় কুড়ি বছর পরে রাহুলের বিয়ের দিন বরের সাজ  পরে থাকা সেই ভাগ্নে দেখেছিল—বিয়ের পুরোহিত সাদা মামা।রাহুলকে যখন সেই পুরোহিতকে প্রণাম করতে হয়েছিল রাহুল বড়ো কৌতুক অনুভব করেছিল।মানুষের জীবনের ঘটনাবলীকে নিয়ে তার মুখে একটা বাঁকা হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল …

(৫৯)

পাঠশালা নামের সেই জায়গাটিতে অনেক মহাজন ছিল। কী কারনে তারা মহাজন আখ্যা পেয়েছিল জানা যায় না। কারণ সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বর্তমান নিস্তব্ধ। মানুষ ভুলে যাওয়া অতীতের মধ্যে ঘুরতে থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। কিন্তু তাদের অতীত যে গৌরবময় ছিল, তার চিহ্ন বর্তমানে তাদের ঘর–দুয়ার, সম্পত্তি এবং সন্তানদের কাপড়চোপড় তথা চুলের স্টাইলে জানা যেত। গজেন্দ্রনাথের বাড়ির প্রায় সামনের দিকের কিছুটা পূর্বেই ছিল টংকে মহাজনের ঘর। তার একটা ট্রাক ছিল, অ্যাম্বাসেডর গাড়ি ছিল, প্রকাণ্ড অঞ্চল জুড়ে ঘর–দুয়ার ছিল, দুজন স্ত্রী ছিল। বড়ো বউ ছিল দুষ্ট প্রকৃতির এবং কিছু অদ্ভুত প্রকৃতির। বড়ো বউয়ের দিক থেকে উজ্জল ,মুকুন্দ এবং দিগন্ত নামের তিন ছেলে ছাড়াও একটি মেয়ে ছিল, যার নাম ছিল বিদ্যাবতী। উগ্র গন্ধের পাউডার মেখে মুখটাকে সব সময় সাদা করে রাখত সে। সেই সময় পাউডার ছাড়া আজকের মতো মুখে মাখার কোনো রং হয়তো আবিষ্কার হয়নি! আর হয়ে থাকলেও পাঠশালা নামের এই গ্রাম থেকে শহরের দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাওয়া জায়গাটিতে এসে পৌঁছায়নি!

বিদ্যাবতী  বেশ শক্তপোক্ত ছিল। সেই সময়ে শক্ত ছেলেমেয়েদের সুন্দর এবং ভালো স্বাস্থ্যের বলে মনে করা হত। শক্তপোক্ত ছেলেমেয়েরাই ছিল বর্ধিষ্ণু পরিবারের লক্ষণ। সেই সূত্রে উজ্জ্বল মুকুন্দরাও ছিল শক্তপোক্ত। উজ্জলের দুই চোখ ছিল লাল, সবাই মদ খায় বলে জানত। উজ্জলের নিজস্ব একটা গাড়ি স্কুটার ভালো করার গ্যারেজ ছিল। মুকুন্দ ঠিকার কাজ করত। দিগন্ত লং প্যান্টের পকেটে রুমাল নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো ছেলে ছিল ।

প্রথম স্ত্রী যার কথা বলতে হলে প্রত্যেকেই ‘উজ্জলের মা’ বলত, রুক্ষ এবং অদ্ভুত প্রকৃতির হওয়ার জন্য লংকে মহাজন তাকে ছেড়ে তার বোনকে বিয়ে করে এনেছিল। এই মানুষটা ছিল শান্ত,ধীর–স্থির। উজ্জলের মাকে থাকার জন্য টংকে মহাজন যেখানে ঘর–মাটি দিয়েছিল, সেটা গজেন্দ্রনাথের সীমা সংলগ্ন মাটিটুকু। তাই গজেন্দ্রনাথের ঘরের সীমার এপারে গজেন্দ্রনাথ, ওপারে উজ্জলের মা।’ উজ্জলের মা’ এই শব্দটিকে গজেন্দ্রনাথের বাড়ির প্রত্যেক সদস্য মাত্ৰই নয়, বাগানের কলাগাছ, বাঁশ গাছ, শাকসব্জি ইত্যাদিও ভয় করে চলত।

কেননা গজেন্দ্রনাথ সেই সীমার মস্ত দীর্ঘ বাঁশের বেড়াটা যেদিনই দিতে গিয়েছিল, উগ্রমূর্তি ধরে উজ্জ্বলের মা বাধা আরোপ করেছিল। উজ্জ্বলের মা তজো থেকে শুরু করে কাজ করতে আসা হাজিরা মানুষগুলিকে গালিগালাজ করে প্রথমে ঝগড়ার সূত্রপাত করে নিত। সীমা ঠেলা বলে মানুষটা মিথ্যা অভিযোগ করে গজেন্দ্রনাথের ঘরটাকে সব সময় জ্বালাত। এই বীভৎস গালিগালাজের সামনে গজেন্দ্রনাথের গায়ত্রী মন্ত্র গাওয়া ঠোঁট দুটি নিস্পন্দ হয়ে পড়েছিল। বরুণও এসেছিল উজ্জলের মায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে। গজেন্দ্রনাথের সমগ্র পরিবার সেই অন্যায় যুদ্ধটা দেখেছিল। ঝগড়া করার সময় উজ্জলের মায়ের হাতে একটা দা থাকে। কিন্তু তার চেয়েও শক্তিশালী ছিল তার মুখের অশ্লীল গালিগালাজ। চিৎকার চেঁচামেচি করে কখনও উজ্জলের মা মেখেলাটা কোমর পর্যন্ত তুলে নিয়ে বলত—’ হু! আমার বুছ'( বুছ শব্দটির দ্বারা যোনিকে বোঝানো হত।) তারপরে যুদ্ধ আপনা-আপনি সমাপ্ত হয়ে যেত)প্রত্যেকে চোখ নিচু করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসত। রাহুল দেখেছিল এই যুদ্ধে সব সময় গজেন্দ্রনাথ অসহায় ছিল। সব সময় অন্যায়ের জয় হত।

এই অন্যায় চলবে না বলে বরুণ একবার পুলিশে এজাহার দিয়েছিল। কিন্তু অন্যায় কীভাবে নেয় কে পরাজিত করতে হয় সে কৌশল জানত।

উজ্জ্বলের মায়ের গজেন্দ্রনাথের সঙ্গে এই অন্যায় যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমর্থক ছিল টংকে মহাজন। যদিও তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতেন না। এদিকে মায়ের গালিগালাজের সঙ্গে যোগ দিত উজ্জ্বল মুকুন্দের তর্জন গর্জন আর কখনও বা বিদ্যাবতীর টিঙটিঙে  কণ্ঠস্বর!

এর বিপরীতে টংকে মহাজনের দ্বিতীয় স্ত্রী উত্তরা এবং চার ছেলে শান্ত স্বভাবের ছিল। কৈলাশ নামের ছোটো ছেলেটি রাহুলের সঙ্গে একসঙ্গে একই শ্রেণিতে পড়ত। রাহুলের চেয়েও পড়াশোনায় ভালো ছিল । সে ইস্ত্ৰি করা শার্ট পরত। অ্যাম্বাসেডের গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বের করে বেড়াতে যাওয়া কৈলাসকে  রাহুলরা দেখত। এই দেখাদেখিতে কৈলাসের মতই রাহুলরা আনন্দিত হত। কারণ সে ওদের দেখে একটা হাত নাড়ত।

একদিন উপরিউক্ত যুদ্ধের ন্যায় সমাধানের খোঁজে গজেন্দ্রনাথ টংকে মহাজনের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু টংকে মহাজন তাকে তিরস্কার করেছিল।

একদিন সেই পরাক্রমী টংকে মহাজনের শরীরের একটা অংশ প্যারালাইসিস হয়ে পড়েছিল, তখন লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে একদিন গজেন্দ্রনাথের কাছে এসেছিল। কোমরে জড়িয়ে থাকা ধুতির কোঁচ থেকে কয়েকটি টাকা বের করে বলেছিল—’ আমাকে মাফ করবেন। অনুগ্রহ করে শালগ্রামকে প্রসাদ ভোগ দেবেন।’

রাহুল দেখেছিল— গজেন্দ্রনাথের আয়ুর্বেদিক ফার্মেসীর গ্রাহক বসা বেঞ্চটিতে হাতের লাঠিটা কাছে রেখে বসে থাকা টংকে মহাজনের চোখ থেকে ঝরঝর করে চোখের জল বের হয়ে আসছে। টংকে মহাজন বলেছিল—’ আপনি আমার জন্য কিছু একটা করবেন ঠাকুর। আমাকে এখন আর কেউ চেনে না।’

সেই পরাক্রমী টংকে মহাজন, যে তার সামনের চেয়ারে বা বেঞ্চে কাউকে বসতে দিত না— এমনকি ছোটো স্ত্রীরও সামনে বসার অধিকার ছিল না— সেই পরাক্রমী অহংকারী টংকে মহাজন যে প্যারালাইসিসে নিজের শরীরের অর্ধেক অংশের শক্তি হারিয়েছিল তাই নয়। মানসিকভাবেও সে তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। শত্রুপক্ষের হাতে রাজার মুকুট গড়িয়ে পড়ার মতো টংকে মহাজনেরও সমস্ত পরাক্রম ভুলুন্ঠিত হয়ে পড়েছিল। তারপরে রাজার সেই অবস্থা দেখে শত্রুরা যেভাবে হাসে, টংকে মহাজন ও যেন  দেখলেন— তিনি যখন দাঁড়াতে গিয়ে বারবার পড়ে যান, নিজে নিজে ভাত– জল মুখে নিতে পারেন না, তখন যেন ছেলেরা হাসে। বড়ো সরল এবং এতদিন ভালো বলে ভাবা ছোটো স্ত্রী হাসে, অ্যাম্বাসেডর  ড্রাইভারটা হাসে, ঘর ঝাড়ু দেওয়া পরিষ্কার করা কাজের মেয়েটি হাসে! প্রথম স্ত্ৰী তো তার কোনো খবরই নেয় না, উজ্জ্বল মুকুন্দ এবং দিগন্তও একদিন একসঙ্গে এসে খোঁড়া বাপের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল—’ বেশ ভালো হয়েছে বুড়ো।’

টংকে মহাজন দেখে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে…। সবাই তার শত্রু। একদিন তিনি বারান্দার চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় দেখলেন সামনের ঘরের চালে একটা কাক পড়ে কা কা করছে। তিনি ভাবলেন কাকটা ও তার দিকে তাকিয়ে হাসছে!

টংকে মহাজন বিড়াল পছন্দ করত না। কুকুর তার প্রিয় ছিল। বাড়িতে কয়েকটি কুকুর ছিল। অ্যাম্বাসেডরে করে তারই মধ্যে দু-একটিকে  নিয়ে তিনি বেড়াতেও গিয়েছেন! বাইরের কোথাও থেকে এলেই কুকুরগুলি তার পা চাটতে শুরু করত। এখন তার হাতে লাঠি থাকার জন্য কুকুরগুলি আর কাছে আসে না। টংকে মহাজন ভাবেন— এতদিন তিনি তাহলে শত্রুর মধ্যে বসবাস করতেন। কুকুরগুলি কাছে আসে না বলে টংকে মহাজনের পেছন দিকের বাড়িতে থাকা বিড়ালটা মাঝেমধ্যে এখন এসে তিনি বসে থাকা চেয়ারের নিচে থেকে আওয়াজ দেয়—’মিউ’! টংকে মহাজন ভাবেন তাকেই ডাকছে—’টংকে’!

কেবল একজন মানুষের ওপরেই আস্থা ছিল টংকে মহাজনের, সেই মানুষটি হল গজেন্দ্রনাথ। টংকে মহাজন জানতেন এই পৃথিবীতে গজেন্দ্রনাথের হয়তো অনেক শত্রু আছে(প্রধান শত্রু ছিলেন উজ্জ্বলের মা), কিন্তু গজেন্দ্রনাথ কারও শত্রু ছিল না।

টংকে মহাজন এই কথাও জানতেন যে গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে থাকা শালগ্রামটির অপার শক্তি। গজেন্দ্র নাথের শত্রুতা করা ব্যক্তিকে সেই  শালগ্রাম নিশ্চিতভাবে শাস্তি দিয়েছিল। টংকে মহাজন নিজের চোখে দেখেছেন যে উজ্জলের লিভার নষ্ট হয়ে মারা গেছে। মুকুন্দও একদিন স্ট্ৰোক হয়ে মারা গেল। দিগন্তরেও একটি পা ছোটো হয়ে গিয়ে এখন খোঁড়া হয়ে গেছে। মেয়ে বিদ্যাবতীও বিহারী রাজমিস্ত্রির সঙ্গে পালিয়ে গেছে!

এখন দেখা গেল স্বয়ং উজ্জলের মা,যে কোনোদিন গায়ে চাদর নিত না, মেখেলাটা  বুকে গিঁট দিয়ে যৌবন কাটিয়েছে — সেই মানুষটা এখন ব্লাউজ পরে, চাদর গায়ে দিয়ে গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে এসে অমৃতপ্রভার সঙ্গে পান–সুপুরি চিবুচ্ছে। গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে কোনো নাম প্রসঙ্গ, সত্যনারায়ণ পূজা হলে ঘরের এক কোণে সুপুরি কাটা হত ….

গজেন্দ্রনাথ সব সময় দুধ দিয়ে স্নান করানো শালগ্রাম সমস্ত অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে থাকেনি। সেগুলি যে শাস্তি তার কোনো প্রমাণ না থাকলেও পাঠশালাবাসী সেগুলোকে প্রমাণ বলে গণ্য করেছিল। আর আমাদের রাহুল, সেও তার ছোটো মগজ দিয়ে এই কথাগুলিকে শাস্তি বলে ভেবে আনন্দ পেয়েছিল। কিন্তু রাহুলের চিন্তায় জট পাকিয়েছিল এই কথা ভেবে যে— তাহলে তরুনী পিসি কি? গজেন্দ্রনাথের শাস্তি? প্রথম মেয়ে অল্প বয়সে বিধবা হওয়াটা?

কিন্তু পরের মুহূর্তে রাহুল নিজেকে উত্তর দিয়েছিল— এগুলো শাস্তি নয়। গজেন্দ্রনাথের ওপরে ভগবান নেওয়া পরীক্ষা! যেমন রামের বনবাস!

(৬০)

 

আরও একজন মহাজন ছিলেন, সনন্ত মহাজন। টংকে মহাজনের মতো সনন্ত মহাজনের ওপরে ভগবানের কোনো শাস্তি ছিল না। বরং ছিল আশীর্বাদ। বা বলা যেতে পারে গজেন্দ্রনাথের ওপরে পরীক্ষা। কেননা একদিন গজেন্দ্রনাথের গরুর গাড়ির গাড়োয়ান ছিল সনন্ত মহাজন। একদিন গজেন্দ্রনাথ নিজের গরুর গাড়িতে সনন্তকে গাড়োয়ান করে বামন কুছি থেকে পাঠশালায় আসছিলেন।চার কিলোমিটার পথ। তখন পর্যন্ত বামুনকুছি  থেকে এসে পাঠশালায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেননি  গজেন্দ্রনাথ। সেদিনই ছিল জমি কিনে টাকা পয়সা দিয়ে কাগজপত্র সমঝে নেবার দিন। গজেন্দ্রনাথের মাথায় নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন। নতুন পৃথিবী মানে একটার পর একটা সমস্যার সমাধান করে যাবার কথা। সমস্যার ফাঁকে ফাঁকে আবছা দেখা যায় নতুন পৃথিবীটা। সেই নতুন পৃথিবীটার আবছা ছবি দেখতে দেখতে আসছিলেন গজেন্দ্রনাথ।

কিছুক্ষণ পরে গজেন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন যে তার এই আবছা স্বপ্ন গুলি গাড়োয়ানটার জন্য ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। কারণ সে বিনা কারণে গাড়ির বলদ দুটিকে মারধর করছে। গজেন্দ্রনাথ এবার গাড়োয়ান সনন্তকে বললেন—-‘ কেন গরুদুটিকে এভাবে মারধর করছ?’

কয়েক মিনিটের জন্য গাড়োয়ান থেমেছিল মাত্র। তারপর আবার সে একই কাজ আরম্ভ করল। ধৈর্য ধরে ধরে গজেন্দ্রনাথের ধৈর্যের বাঁধ খসে পড়ল— তিনি গাাড়োয়ানের পেছনে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং তৎক্ষণাৎ লাথি মেরে গাড়োয়ান সনন্তকে মাটিতে ফেলে দিলেন এবং নিজে গরুর গাড়ি নিয়ে পাঠশালায় চলে গেলেন।

গজেন্দ্রনাথের লাথি খেয়ে ছিটকে মাটিতে পড়া সেই গাড়োয়ানটি কীভাবে একদিন সনন্ত মহাজন হয়ে পড়ল জানা যায় না। সেই গাড়োয়ানটি  পাঠশালায় এতটা মাটি কীভাবে কিনে নিল—তার কাহিনি পাঠশালাবাসী জানেনা। এমনকি একদিন গজেন্দ্রনাথেরই তিন বিঘা মাটি সনন্ত মহাজন কিনে নিয়েছিল। আর সেখানে বড়ো ছেলে দীনেশকে সিনেমা হল বানাতে দিয়েছিল। পাঠশালার সবচেয়ে বড়ো কাপড়ের দোকানটাও ছিল সনন্ত মহাজনেৰ। একটা ইটের ভাটাও ছিল, দীনেশ চালাত। অন্য এক ছেলে একটা থিয়েটারের দল খুলেছিল।

পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবি এবং চোখে সোনালি ফ্ৰেমের চশমা পৰে কাপড়ের দোকানের বারান্দায় বসে থাকে সনন্ত মহাজন। একজন ধীর স্থির ধীরে ধীরে কথা বলা মানুষ। তার রাগ নেই। সবাই তাকে সমীহ করে। তিনি আভিজাত্যের সংস্কৃতি নিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকেন।

কখনও কখনও তিনি একটা রিক্সায় উঠে গজেন্দ্রনাথের কাছে আসেন। তার স্মৃতি তাকে ব্যথিত করে না বোধ হয়। গজেন্দ্রনাথের কাছে আসা মানে গজেন্দ্রনাথের ফার্মেসিতে আসা। গজেন্দ্রনাথের ফার্মেসি মানে আয়ুর্বেদিক ঔষধ থাকা দুটো আলমারি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা ঔষধ দুটি হল অশোকারিষ্ট এবং পত্রাঙ্গসব থাকে কোনোদিন খালি না হওয়া পর্যন্ত। বজালী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ঔষধ এই দুটি। মহিলাদের ঋতুস্রাব অনিয়মিত হলে গজেন্দ্রনাথ দেয় অশোকারিষ্ট। একনাগাড়ে তিন বোতল খেতে বলেন। আর সাদাস্রাব বন্ধ হওয়ার ঔষধ চাইতে এলে দেন পত্রাঙ্গসব ।

গজেন্দ্রনাথের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই এই দুই ধরনের রোগের চিকিৎসা করতে পারে। কখনও গজেন্দ্রনাথ না থাকলে রাহুল জিন্টুরা দোকানে বসে। তখন যদি কোনো গ্রাহক আসে এবং গজেন্দ্রনাথের খোঁজ করে, রাহুল জিন্টুরা  জিজ্ঞেস করে— সাদা স্রাব বন্ধ হওয়ার ঔষধ লাগে নাকি? নাকি মাসিক ঠিকমতো হওয়ার ঔষধ? গ্রাহক ইতস্তত করলেও অবিশ্বাস করে না— গজেন্দ্রনাথের নাতি, ওরা ভুল করতে পারেনা। আর বলে—-‘ সাদা স্রাব বন্ধ করার ঔষধ দাও।’ সাদাস্রাব কাকে বলে রাহুলরা জানে না, কিন্তু ঔষধ এবং ঔষধ খাওয়ার নিয়ম জানে। ওরা পত্রাঙ্গসবের একটা বোতল বের করে দিয়ে বলে—’ চার চামচ ঔষধ এবং চার চামচ জল, ভাত খাবার পরে দিনে দুইবার! তিন বোতল খেলে সাদাস্রাব বন্ধ হয়ে যাবে!’

গ্রাহক জিজ্ঞাসা করে—- কত দাম?

কখনও গ্রাহক পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো চিকিৎসকের চিকিৎসা জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য জিজ্ঞেস করে—আর যদি মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হয় তাহলে কী ঔষধ? ওরা পরীক্ষায় পাশ করে, বলে— অশোকারিষ্ট । গ্রাহক সবিশ্বাস এবং সন্তুষ্টির সঙ্গে সাদাস্রাবের ঔষধ নিয়ে ফিরে আসে।

একটা বিচিত্র ফার্মেসি।গজেন্দ্রনাথের বিনা পয়সার চিকিৎসার খোঁজে তার কাছে আসে বিচিত্র মানুষ,বিচিত্র রোগি।সাপে দংশন করা মানুষ থেকে শুরু করে বসন্ত রোগের ঝাঁড়ফুক পর্যন্ত,বাচ্চার কান্না থেকে শুরু করে কারও নজর লাগা,রাতে খারাপ স্বপ্ন দখে ভয় খাওয়া থেকে শুরু করে স্বপ্নদোষ এবং ক্ষীণ ধাতুর চিকিৎসা পর্যন্ত।প্রায় বিনা পয়সার চিকিৎসা।কেবল মাড়োয়ারিরা তাদের পরিবার এবং শিশুদের এই ধরনের চিকিৎসার জন্য গজেন্দ্রনাথের ফার্মেসিতে আসে না।তারা গজেন্দ্রনাথকে তাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়—একটা রিক্সা পাঠিয়ে দেয়।গজেন্দ্রনাথ রিক্সায় উঠে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে একই রিক্সায় ফিরে আসেন।তারা গজেন্দ্রনাথকে উপযুক্ত সাম্মানিক দেয় এবং একটা ফিল্টার সিগারেট খাওয়ায়।

রাহুল ভাবে গজেন্দ্রনাথ একজন নিঃসঙ্গ চিকিৎসক।সে দূর থেকে গজেন্দ্রনাথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।গজেন্দ্রনাথের একেবারে কাছে যেতে ইচ্ছা করে তার।সে চায় দাদুর পবিত্র হাতের একটুখানি স্পর্শ।সে গজেন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বলে –‘দাদু,আমার পেট ব্যথা করছে।’

গজেন্দ্রনাথ রাহুলের গেঞ্জিটা তুলে পেটটা টিপে টিপে দেখে  এবং তিনবার ফুঁ মেরে দেয়।আর জিজ্ঞেস করেন–‘কমেছে কি?’তার মিথ্যা পেটের ব্যথা গজেন্দ্রনাথের মিথ্যা চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়।সে বলে ব্যথা নাই হয়ে গেছে দাদু!’

এই বিনা  পয়সার ফার্মেসির একটা চেয়ারে কখনও সনন্ত মহাজন এসে বসেন। সনন্ত মহাজন কারও বাড়িতে আসাটা গৌরবের কথা। গজেন্দ্রনাথ সাদরে উঠে দাঁড়ান,—‘ বসুন কর্তা!’

সনন্ত মহাজন গজেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করে— ‘ভালো আছেন তো কর্তা?’

গজেন্দ্রনাথ বলেন—’ আছি আর কি।’

গজেন্দ্রনাথ এক ফাঁকে দোকানের পেছন দিকের ঘরে গিয়ে অমৃতপ্রভাকে বলেন—’ কর্তা এসেছেন। ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে দেবে।’

বাড়ির সবাই জানতে পারে কর্তা এসেছেন। বরুণও একবার গিয়ে আওয়াজ দেয়, পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। সনন্ত মহাজন যেহেতু ব্রাহ্মণ, তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করায় কোনো বাধা নেই। রাহুলকে নিয়ে প্রতিটি ছেলে-মেয়ে একের পর এক এসে কর্তার সুন্দর চকচকে জুতো জোড়া স্পর্শ করে প্রণাম করে এবং কিছুটা দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এরকম একজন বয়স্ক সুন্দর মানুষ ওরা পাঠশালায় কখনও দেখেনি।

গজেন্দ্রনাথ এবং সনন্ত মহাজন দুজন দুজনকে ‘কর্তা’ বলে ডাকে। এই ‘কর্তা’ শব্দটি কী বোঝায় রাহুলরা জানে না।

চা খেয়ে উঠে কর্তা পকেট থেকে ফিল্টার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে গজেন্দ্রনাথকে একটা দেয় এবং অন্য একটি নিজের ঠোঁটে চেপে ধরে সোনালি রঙের একটা লাইটার জ্বালায়।

নাতি নাতনিরা বিড়ি খাওয়া গজেন্দ্রনাথকে সিগারেট খেতে দেখে ফিসফাস করে।

একদিন গজেন্দ্রনাথ লাথি মেরে গরুর গাড়ি থেকে ছিটকে মাটিতে ফেলে দেওয়া গাড়োয়ান সনন্তকে’ কর্তা’ বলে ডাকাটা গজেন্দ্রনাথের কাছে ভগবান নেওয়া এক পরীক্ষা নিশ্চয়! কেননা ‘কর্তা’ মানে হল মালিক ,স্রষ্টা!

এই ধরনের জটিলতার, কঠিনতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে গজেন্দ্রনাথ যেতে থাকে।

একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (১৯তম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top