সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই: পর্ব ১২ (ও যে মানে না মানা) I I চয়ন মল্লিক

ও যে মানে না মানা।
আঁখি ফিরাইলে বলে, ‘না, না, না।’
যত বলি ‘নাই রাতি– মলিন হয়েছে বাতি’
মুখপানে চেয়ে বলে, ‘না, না, না।’
বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে
ফাগুন করিছে হা হা ফুলের বনে।
আমি যত বলি ‘তবে—এবার যে যেতে হবে’
দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, ‘না, না, না।’

রাগ: ভৈরবী; তাল: দাদরা; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৩১৬; (খৃষ্টাব্দ): ১৯০৯; স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

পিনু সাত্তারের কণ্ঠে গানটি: https://www.youtube.com/watch?v=aX_cf9Hyup4

হিন্দী ঠুংরী “বনাকে বঁতিয়া” ভেঙে তৈরী রবীন্দ্রনাথের এই ভাঙা গানটি ভৈরবী সুরে দাদরা তালের উপর। এই গানটি যে প্রেমের গান, তাতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। প্রিয় চলে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে যেতে দিতে মন সরে না—এই চিরন্তন সহজ ভাবটি রবিঠাকুর তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটি বজায় রেখে পুরাতনী বাংলা গানের আদলের এই বহুশ্রুত গানটিতে প্রকাশ করেছেন। পুরাতন বাংলা গানের সরলতা এবং অল্প কথার ঐতিহ্য মেনেও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য অটুট রেখে রবীন্দ্রনাথ এই যে কিছু গান রেখে গেছেন, তারা যেন প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছে ‘বিশেষভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত’। আর ভৈরবীর ব্যবহার এ গানটিকে করেছে আরও বিশেষ। তাঁর নিজের কথায়, “ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চিরবিরহবেদনা”। সেই চিরবিরহটুকুই যেন বারে বারে তীব্র হয়ে ওঠে এই গানখানির সুরের মোচড়ে মোচড়ে।

যে চলেই যাবে, তাকে ধরে রাখবার যে ব্যাকুলতা, তা প্রতিবার “না, না, না” বলবার সময় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর প্রতিটি “না”-ই  সুরের ভিন্ন মোচড়ে অনুভূতির প্রকাশ ঘটায় তীব্রভাবে। যদিও তিনটি আলাদা ছত্রে “না” এসেছে, আর তিনবারই মূল সুর একই, কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায় যে, প্রথম “না” যতটা দৃঢ়, দ্বিতীয়টিতে তা কমে অনুরোধের সুর হয়েছে প্রকট, আর শেষ “না” সেই অনুরোধটিকেই আরও ব্যাপ্তি ঘটিয়ে তুলে এনেছে আকুলতায়—যেন দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে বাঁধতে চেয়েও না-পারার ব্যর্থতায় প্রিয়হৃদয়টি ভেঙে পড়ছে হতাশায়।

এই গানটিকে কবি’র অন্য অনেক গানের চেয়ে খানিকটা আলাদা মনে হয় আমার। কারণ এর ভেতরের কথোপকথন। যদিও যে চলে যাবে, তারই জবানিতে আমরা পুরো গল্পটি দেখছি; সে কিন্তু দুইজনের বক্তব্যই গানের ভিতর দিয়ে বলে চলেছে। আর এই দু’টি সত্তাকে প্রকাশ করবার সময়ও তাই গাইতে হবে উপযুক্ত জায়গায় খানিকটা থেমে, দম নিয়ে। এ গানের সহজিয়া সুরটি সে কাজটিকেও সহজ করে দিয়েছে। যেমন,

“যত বলি ‘নাই রাতি– মলিন হয়েছে বাতি’
মুখপানে চেয়ে বলে, ‘না, না, না।’

উপরের ছত্রে যদি ‘যত বলি’, ‘নাই রাতি’, ‘মলিন হয়েছে বাতি’, আর ‘মুখপানে চেয়ে বলে’—এই অংশগুলোর পরে দম নিয়ে গাওয়া হয়, তাহলে গানটির অর্থ আপনিই ফুটে উঠে, তার জন্য আলাদা যত্নের প্রয়োজন নেই। একইভাবে আভোগের অংশটি গাইবার সময়ে যদি ‘আমি যত বলি’, ‘তবে’, ‘এবার যে যেতে হবে’, ‘দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে’, আর এরপর ‘না, না, না’ এভাবে দম নিয়ে বলে যায়, গানের ভাব প্রকাশ সহজ হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের ৪৮ বছর বয়সে লেখা ‘প্রেম’ পর্যায়ের এই গানটিতে আমি কেমন যেন কৃষ্ণপ্রেমের ছোঁয়া পাই। যেন রাধা তার শ্যামকিশোরকে নিশিভোরে যেতে দিতে চায় না, আর কৃষ্ণ যেন রাধার সেই আকুলতা নিজের মনেই ভেবে নিজে আরও উন্মনা হয়ে পড়ছে। যদিও এটি ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের গান, আর রাজা রামচন্দ্র রায়ের প্রমোদসভায় নটীর কন্ঠে গীত, আমার সামান্য বোধে সবসময়েই মনে হয় যে কবি এটি পুরুষকন্ঠের জন্যই লিখে গেছেন।

সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই: পর্ব ১১ (বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল) I I চয়ন মল্লিক

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top