ফিলিস্তিন: হত্যার জীবন্ত প্রদর্শনী II রোমেল রহমান

ফিলিস্তিনি কৈশোরের কবিতা

শহরটাকে হত্যাপুরী নামেই চেনে সবাই যখন
তুমি তখন স্বপ্ন কেন দেখাও কবি?
কাব্যে তুমি এতো দারুণ স্বপ্ন আঁকো
ইচ্ছা করে যদি আমার অমন দারুণ জীবন হতো?
কিন্তু দেখ, সকাল বিকাল বোমা বারুদ বুলেট এসে
আমার উঠোন ফুলের বাগান পড়ার টেবিল ছাই কোরে যায়।
এখানে ফুল ফোটেও ভীষণ সতর্কতায়
যদি ওরা বিব্রত হয়
আকাশ থেকে বারুদ ফেলে ঝলসে দেবে,
জন্ম থেকে দেখছি শুধু,
এখানে রোদ তারকাটাকে ডিঙিয়ে তবে আছড়ে পড়ে।
মৃত্যু শুধু মৃত্যু নামে সকাল বিকাল এই মাটিতে
তুমি না হয় ফুল ফসলের স্বপ্ন আঁকা বন্ধ কোরে
আমার করুণ কিশোর বেলার কাব্য লিখো?
দোহাই কবি!
যখন আমি মৃত্যু শুধু মৃত্যু দেখি
রাস্তাঘাটে হেটে বেড়ায়, ডানায় ভেসে উড়ে আসে
তখন আমার পায়ের তলার মাটিকেও পর মনে হয়।
রক্তখেকো মাটি আমার
জন্ম আমার রক্ত দিতে।
আমার শহর ফুলের বাগান নয় তো কবি
হত্যাপুরী বলেই তাকে স্বীকার কোরো?

জন্মে দেখি তারকাটাতে বন্দী আমি, খুনিরা সব নজরবন্দী করে আমায়
হাততালি দেয় যখন তখন আমার জীবন খেলনা নিয়ে ওরা খেলে!
আমার কোন প্রাপ্য অধিকারের খাতা নেই এখানে
আমার তো নেই কিশোর বেলার ছুটে চলার স্বাধীনতা
মৃত্যু শুধু মৃত্যু আমার কানের পাশে, দৃষ্টি জুড়ে
পায়ে পায়ে গুপ্তচরের মতো চুপি হেটে বেড়ায়।

যখন আমি দেখি আমার এক বয়সী
ওদের কোন শিশু কিশোর আকাশ ভরে স্বপ্ন ওড়ায়
পার্কে মাঠে ছড়িয়ে গিয়ে কাটায় বিকেল।
তখন আমি তারকাঁটাতে বন্দী কোন পশুর মতো তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকি।
আমি তো চাই আমরা দুজন একই মাঠে খেলবো একই খেলনা নিয়ে।
কিন্তু আমি আঁতকে উঠি যখন তখন
কখন জানি খুনিরা সব আসবে উড়ে চাকায় চড়ে।

— মৃত্যু শুধু মৃত্যু আমার ভাগ্যলেখা

আমার যারা বন্ধু তারা পঙ্গু এবং অর্ধমৃত
কিংবা যারা গতবছর খুন হয়েছে,
আমি জানি আমারও ঐ একই মালায় ভাগ্যলেখা।
তাই কি আমি মায়ের কানে বলেছিলাম —
অন্ধ খোদা দেখে না এই নৃশংসতা…?
তার আরসে কাঁপে না কি একটি পাতা…?
নাকি তিনি সিংহাসনের ঠুঁটো রাজা…?’

— মৃত্যু শুধু মৃত্যু আমার ভাগ্যলেখা

জন্ম নেওয়ার অপরাধে এখন আমি কুণ্ঠিত হই
যখন দেখি এই পৃথিবী অন্ধ খোদার রাজ্য শুধু।
তুমি কবি আমায় নিয়ে স্বপ্ন আঁকা বন্ধ কোরে
ব্যর্থ আমার… ভীতু আমার…কিশোর বেলার
কিংবা আমার বন্ধু যারা পঙ্গু হয়ে মরছে রোদে
তাদের কথা লিখে যেও?
জন্ম থেকে দেখছি শুধু আমার শহর হত্যাপুরী
জন্ম আমার চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘের
আমার জন্য বরাদ্দ নেই বেঁচে থাকার অবাধ আকাশ
শেকল পায়ে স্বাধীন আমার মাতৃভূমি।
-*-
১৪ জুলাই ২০১৪

রাতের শব্দরা

জল পড়ার শব্দে রাত্রি নির্ঘুম,
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গত জানিয়ে দিচ্ছে চৌদিকের নিস্তব্ধতা ;
এরই মধ্যে আমরা লুকিয়ে আছি ঘুমহীন উপত্যকায় ।
হন্তারকদের নজরবন্দি এ জনপদে কুকুরেরাও নির্বাক!
কে মটকে দেবে ঐ জলের কলের ঘাড় স্তব্ধতা আনতে?
আমাদের সাহস আত্মরক্ষার কিস্তিতে গৃহবন্দী।
 
মৃত্যুর জন্যে উপযুক্ত এ যুদ্ধ কী কারবালা কিংবা কুরুক্ষেত্র?
মানুষ মানুষের ভাই এ কথা মিথ্যে প্রমাণিত (আজ),
বরং মানুষ মানুষের জন্য আততায়ী।
 
জলপাই ফুলের কুঁড়িরা শঙ্কিত পাপড়ি মেলতে।
 
তোমাকে বলতে পারছি না আগামীকাল সব ঠিক হয়ে যাবে,
নিশ্চিন্ত ঘুমের চাদরে :
আমাদের সন্তান তার জন্মভূমি ফিরে পাবে।
-*-
২০ অক্টোবর ২৩

ফিলিস্তিন

এখানে হত্যার জীবন্ত প্রদর্শনী হয়।
আহা, কী নান্দনিকভাবে নরহত্যা দেখার সুযোগ।
সভ্যতার অদ্ভুত  নিরবতা থেকে টের পাই —
এ এক সম্মিলিত নরমেধযজ্ঞ।
 
(তবু এরই মধ্যে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর কিশোরীরা জেনে গেছে, মৃত্যুর বদলে মাতৃভূমিই এক টুকরো রুটির নিশ্চিত তৃপ্ত সম্ভাবনা।)
 
জলপাই গাছেরা এখানে কবরে ছায়া দেবার জন্য জন্মায়।
প্রতিটা মায়ের স্তন থেকে নেমে যায় একেকজন শহীদ।
-*-
১৪ অক্টোবর ২৩

 
জেরুজালেম

সন্ধ্যার আকাশ উজ্জ্বল করে বিস্ফোরণ!
একে একে চুরমার হচ্ছে সংসার।
তোমারা সবাই হাত্তালি দিতে দিতে ইহুদি বা মুসলিম হয়ে যাচ্ছ!
কেউ কেউ শোকে মুহ্যমান।
কেউ কেউ উল্লাসে খানখান।
 
একবার ভাবলে না কিশোরীর পড়ে থাকা বাইসাইকেলটা কে চালাবে আর? বিধ্বস্ত বাড়ি গুলোর দোমড়ানো  ফ্রিজে থাকা খাবার গুলোর কী হবে? রান্নাঘরে জ্বাল দিতে থাকা দুধের হাড়িটা এখনো জ্বলছে, রুটি গুলো ছন্নছাড়া হয়ে আছে; চাপা পড়া বৃদ্ধ মানুষটা যাকে খায়িয়ে না দিলে খেতে অক্ষম তার কী হবে? যে স্বপ্নের  খোয়াবে নিজেকে আদর করতো নিজ হাতে নিজে সেইসব তরুণ তরুণী যারা আজ নিহত বিক্ষত ; জীবন যাদের গোরেস্তান হয়ে গেলো মূহুর্তে।  কী হবে এরপর…তারপর… প্রতিপরপর..?

একই আকাশে উড়বে পায়রা আর মিসাইল?
 
ভ্রাতৃঘাতী এ নগরীর রক্তস্রোত দেখে নিজেকে উন্মূল লাগে।

মাহমুদ দারবিশ কোথায় আপনি? পেয়েছেন নিজের আইডেন্টিটি কার্ড? উপত্যকা চুরমার হচ্ছে তুমুল। বাগান গুলোতে রক্তের ফোয়ারা। কে কার বুট পরে কাকে যে মাড়িয়ে যাচ্ছে ভীষণ। আমি তো দেখছি,….মানুষ মানুষ।

এই ঘৃণা ফুরাবে না।

এ বিজয়ের কোন শেষ নেই।

কাফন মোড়ানো শত শত নিহতের লাশ দেখে আমার জবান, কলেমা শাহাদাত ফেলে বলে ওঠে, ‘মানুষ মরছে মানুষের হাতে। মানুষই দেবে না মানুষের স্বাধীনতা।’
 
তাকিয়ে দেখুন —
মানুষ হচ্ছে খুন আর খোদা নিরুত্তাপ।
নাকি দেওয়ালের রাজনীতি আমাদের শান্তনা পুরষ্কার?
আপনি দাঁড়ান একবার এসে আমার সঙ্গে, বলে যান :
গ্যালারির সবাই ইহুদি অথবা মুসলিম হয়ে হাততালি দিচ্ছে, আমি তো যুগের পর যুগ কয়েকজন মানুষকে খুঁজছিলাম।
-*-
১০ অক্টোবর ২৩

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top