পাঞ্জাবী সাহিত্যের ‘কুইন’ খ্যাত অমৃতা প্রীতমকে আধুনিক পাঞ্জাবী সাহিত্যের প্রথম সার্থক কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক হিসেকে গণ্য করা হয়। জন্মনাম অমৃতা কৌর, জন্ম ৩১ আগস্ট, ১৯১৯ পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা’র মান্ডি বাহাউদ্দিন এলাকায়। বাবা কর্তার সিং হিতকরী ও মা রাজবিবির একমাত্র সন্তান অমৃতা। বাবা ছিলেন ব্রজভাষার কবি, পন্ডিত এবং পত্রিকার সম্পাদক; সেই সাথে শিখ ধর্মের প্রচারক। মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা।
লেখালেখির প্রতি ভালোবাসাটা তিনি পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। ছোটবেলা থেকেই শরীরে-ধমনীতে এক বিদ্রোহী সত্ত্বা ধারণ করেছিলেন অমৃতা। প্রথাগত নিয়ম-কানুনকে প্রশ্ন করা আর জরাজীর্ণকে ভেঙে, সরিয়ে দিয়ে নতুনকে গড়ার আকাঙ্খা ছিল তার স্বভাবজাত। এগারো বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু হলে অমৃতা বাবার সাথে লাহোর চলে আসেন। ভীষণ ব্যস্ত বাবা মেয়েকে একদম সময় ও সঙ্গ দিতে পারতেন না। এই একাকীত্ব থেকে কিশোরী অমৃতা কবিতা রচনা শুরু করেন। মাত্র ষোল বছর বয়সে, ১৯৩৬ সালে, তার প্রথম কবিতা সংকলন ‘অমৃত লেহরে’ প্রকাশিত হয়। সে বছরই তার বিয়ে হয় বাল্যকালে পরিবারের ঠিক করা বাগদত্তা প্রীতম সিংয়ের সাথে। তখন থেকে অমৃতা কৌর হয়ে ওঠেন অমৃতা প্রীতম। বিয়ের সাত বছরের মধ্যেই তিনি ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। চল্লিশের দশকে প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে তার সমালোচনা ও শ্লেষপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘লোক পীড়’ (গণরোষ) প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের বিপর্যয়ে তিনি ও তার পরিবার পাঞ্জাবী শরণার্থী হিসেবে লাহোর হয়ে দিল্লী চলে আসেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও’র পাঞ্জাবী সার্ভিসে চাকরীর সুবাদে তার উদ্বাস্তু জীবনের সংগ্রাম কিছুটা সহজ হয়। পরের বছর তিনি তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘আজ আখখা ওয়ারিস শাহ নু’ রচনা করেন, যার প্রথম কয়েকটি লাইন এমন:
“আজ তোমায় ডাকছি ওয়ারিস শাহ, কবর থেকে কথা বলো
প্রেমের গ্রন্থে’ আজ কোনো নতুন পাতা খোলো।
এক পাঞ্জাবের মেয়ে (হীর) কেঁদেছিল একদিন
তাকে নিয়ে লিখেছিলে সুবিশাল এক গাঁথা,
আজ লক্ষ মেয়ে কাঁদছে শোনো,
ওয়ারিস শাহ তুমি কোথা?”
১৯৫০ সালে অমৃতা লিখলেন উপন্যাস ‘পিঞ্জর’। ১৯৫৬ সালে তার দীর্ঘ কবিতা ‘সুনেহ্রে’ (সংবেদন) এর জন্য প্রথম নারী হিসেবে পাঞ্জাব সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬০ সালে এক পুত্র ও এক কন্যাসহ তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তবে, সব পিছুটান ফেলে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক ইমরোজের সাথে নিজের মতো, নিজের শর্তে নতুন জীবন শুরু করেন। জীবনের পরবর্তী চল্লিশ বছর, অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি ইমরোজের সাথেই বাস করেন। সুদীর্ঘ সাত দশকের সাহিত্যজীবনে পাঞ্জাবি সাহিত্যে নারীদের মুখপাত্র অমৃতা প্রীতম ২৮টি উপন্যাস, ২৩টি কাব্যগ্রন্থ, ১৫টি গল্প সংকলন এবং তিনটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘কালা গুলাব’, ‘রাশিদে টিকেট’, ‘আক্ষোরো কি ছায়’ আত্মজীবনীমূলক লেখা। ‘ডাঃ দেব’, ‘যাত্রী’, ‘দিল্লী কা গলিয়া’, ‘কোরে কাগজ’, ‘উনচাঁশ দিন’ এবং ‘রঙ কা পাত্তা’ তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘এক বাত’, ‘কাগজ তে ক্যানভাস’, ‘কস্তুরী’, ‘এক সি অনীতা’, ‘নাগমানি’ এবং ‘পাঞ্জাব দি আওয়াজ’ তার কবিতা সংকলন। ‘কাহানি যো কাহানিয়া নেহি’, ‘কাহানিও কি আঙ্গান মে’ তার ছোটগল্প সংকলন। ‘কাগজ তে ক্যানভাস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮২ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০০৪ সালে পদ্ম বিভূষণ এবং সাহিত্য আকাদেমি ফেলোশিপ লাভ করেন। ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর, ৮৬ বছর বয়সী অমৃতা প্রীতম ঘুমের মধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেন।
অধ্যায় ১
ধূসর, মলিন আকাশ। পায়ের নীচে বস্তা পেতে বসে, পুরো মটরশুটি ছাড়াচ্ছিল। একটার খোসা চাপ দিয়ে ফাটিয়ে, দানাগুলো আঙ্গুলে ঠেলে যখন মুঠোয় ভরে নাড়তে-চাড়তে গেল, একটা সাদা চটচটে কীট ওর তর্জনীর সাথে লেগে গেল। ময়লাভর্তি গর্তে পা পড়ে গেলে যেমন রি রি অনুভূতি হয়, ঘৃণায় পুরো’র শরীর তেমনি রি রি করতে থাকে। দাঁত কিড়মিড় করে উঠে, হাতটা ঝাড়া দিয়ে সে সাথে সাথে পোকাটা মাটিতে ফেলে দিল; আর হাত দু’টো হাঁটুর ভাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল।
পুরো ওর সামনে তিনটা ঢিবির দিকে তাকালো: একটা ছাড়ানো খোসার, একটা আস্ত মটরশুটির, আরেকটা ছোট ঢিবি ওর ছাড়ানো মটরশুটির। এবার সে হাঁটুর ভাঁজ থেকে দুই হাত বের করে এনে, হাত দু’টো বুকের ধুকপুকুনির ওপর জোরে চেপে ধরে, শূন্যদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকালো। পুরো’র মনে হতে লাগে যে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত- তার শরীরটাও ঐ মটরদানার মতো, যেখানে মটরদানার পরিবর্তে কোনো কীট, কোনো শুয়োপোকা বড় হচ্ছে। পুরো’র শরীরজুড়ে আবারো রি রি অনুভূতিটা হয়, সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। ওর শরীর এখন নোংরা, অপবিত্র। ও যদি ওর গর্ভের ভেতর থেকে পোকাটাকে টেনে বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতো! একটা কাঁটা তোলার মতো করে, নখ দিয়ে যদি ওটাকে টেনে উপড়ে ফেলতে পারতো! ফণা তুলে কামড়ে ধরা গোখরাকে যেমন করে এক হ্যাঁচকা টানে বিচ্ছিন্ন করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়; যেমন করে লেগে থাকা কেন্নোকে আলাদা করে দেয়া হয়; যেভাবে লেগে থাকা জোঁককে পেট চিপে, টেনে দূরে ছুঁড়ে মারা হয়।
পুরো ওর চোখের সামনের দেওয়ালটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো; অতীতের অনেক স্মৃতি ওর মনে এসে ভীড় করলো। গুজরাটের কোনো এক জেলার, ছাত্তোয়ানি নামক এক গ্রামের মহাজন পরিবারের মেয়ে পুরো। ওদের সাহা বংশের মহাজনী কারবার, অর্থাৎ সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসা কয়েক পুরুষ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও ওরা সবার কাছে ‘সাহা’ বলেই পরিচিত। সময়ের ফেরে এই সাহা বংশের অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে পড়েছিল যে, ওদের ছোট ছোট তৈষজপত্রের সাথে ওরা ওদের বড় বড় ডেগচি, কড়াইগুলো পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এসব তৈজষপত্রে ওদের পূর্বপুরুষের নাম খোদিত ছিল। এমন বেইজ্জতি, এমন অসম্মান পুরো’র বাপ-কাকারা মেনে নিতে পারেনি, সহ্য করে উঠতে পারেনি। ওরা গ্রাম ছেড়ে, এমনকি দেশ ছেড়ে সিয়াম (থাইল্যান্ড) চলে যায়। ওখানে তাদের ভাগ্যের চাকা আবারও ঘুরে যায়। তখন পুরো নয় বছরের কিশোরী মাত্র। ওর মায়ের কোলে তখন ছোট্ট একটা ভাইও ছিল। শেকড়হারা এই পরিবার আবারও ওদের পিতৃপুরুষের ছাত্তোয়ানি গ্রামে ফিরে আসে। পুরো’র বাবা পিতৃপুরুষের বন্ধক রাখা বাড়িটা ছাড়িয়ে নিয়ে, বাপ-দাদার মান রাখতে পারলো। চক্রবৃদ্ধি সুদে বন্ধকী বাড়ি ছাড়াতে যে অর্থ ব্যয় হলো, পুরোর বাবা তার চেয়ে ঢের কম খরচে নতুন একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু অর্থ বাঁচানোর চিন্তা না করে, তার বাবা পূর্বপুরুষের কলঙ্কিত নাম উদ্ধারে মনোযোগী হলো; সকল অসম্মান, কালিমা যা কিছু লেগে-লেপ্টে ছিল, তা মুছে ফেলতে পারলো।
এরপর, নিজ জমিতে পুরো’র বাবা যা-কিছু আবাদ করিয়েছিল- রকমারি শষ্য থেকে গোখাদ্য- সবকিছু বিক্রিবাট্টা করে দিয়ে পুরো’রা আবার সিয়ামে ফিরে গেল। কিন্তু এবার তার বাবা পরিবারের জন্য একটা বাড়ি রেখে গেল, যেটাকে তারা নিজেদের বাড়ি বলতে পারবে; আর সেই সাথে একটা নাম- যে নামে ওরা গর্বও করতে পারবে। পরেরবার যখন পুরো’র বাবা বিদেশ থেকে ফিরলো পুরো’র বয়স তখন চৌদ্দ। পুরোর পর ওর সেই ছোট ভাইটা; তারপর পরপর তিনটা বোন। ওর মা এখন গর্ভবতী; সাহা পরিবারে ছয় নম্বর সন্তান আসতে চলেছে।
সাহা পরিবার এবার গ্রামে আসার পর, পুরো’র বাবা-মা প্রথম যে কাজটি করলো, তা হলো- প্রতিবেশি রাত্তোয়াল গ্রামের অবস্থাপন্ন এক পরিবারের ছেলের সাথে তাদের বড় মেয়ের বিয়ে স্থির করে ফেললো। পুরো’র মা শুধু তার গর্ভস্থ সন্তানের জন্মের অপেক্ষায় ছিল। সন্তান-প্রসবপূর্বক রীতি অনুযায়ী যখন তার ‘স্নান’ সম্পন্ন হলো, পুরো’র মা তার সোমত্থ মেয়ের বিয়ে-অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় লেগে গেল। পুরো’র বাবা-মা এবার একটা মেয়ের বোঝা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল, দৃঢ় পণ করেছিল। পুরোর বাগদত্ত যুবকটি সুপুরুষ, সেইসাথে বুদ্ধিমানও। লোকটার বাপের বাড়িটা রাত্তোয়াল গ্রামের একমাত্র পাকা দালানবাড়ি; ইট-পাথর-সুড়কির, কাঠের কড়ি-বর্গার পাক্কা দালান। এই বাড়ির বারান্দার উঁচু খিলানে ‘ওম’ শব্দটি খোদাই করে লেখা আছে। ওদের তিনটা মোষও আছে। পুরো’র বাবা পাত্রের বাবা-মা’কে প্রথানুযায়ী পাঁচটা রুপোর মুদ্রার সাথে মিষ্টি ও এক তাল গুড় উপহার হিসেবে প্রদান করেছে। এই প্রথার মধ্যে দিয়ে ওনাদের ছেলের হাতকে পুরো’র বাবা-মা তাদের মেয়ের জন্য পাকা করে ফেলেছে। সেসব দিনে ঐ অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে একটি বৈবাহিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বিনিময় বিবাহ প্রথার প্রচলন ছিল। তাই পুরো’র ভাইয়ের বয়স মাত্র বারো বছর হওয়া সত্ত্বেও, ছেলেটার সাথে পুরোর হবু বরের ছোট বোন- একেবারে শিশু বোনের বিয়েও পাকা হয়ে যায়।
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে পুরো’র মায়ের তিনটে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। কন্যার সংখ্যা যথেষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া ভাগ্যদেবীও এখন তাদের প্রতি সুপ্রসন্ন; খাওয়া-পরার জন্য তাদের যথেষ্টই আছে। তাই পুরো’র মা এবার বিধিমাতা’র কাছে আরেকটি পুত্রসন্তানের কামনা করে। গ্রামের হিন্দু মহিলারা সবাই পুরোদের উঠোনে এসে জড়ো হয়ে, গোবর আর মাটি দিয়ে বিধিমাতা’র একটা মূর্তি গড়ে দিলো। এরপর মূর্তির মাথায় সোনার কারুকাজ করা একটা লাল, উজ্জ্বল কাপড় জড়িয়ে দিলো; আর মায়ের নাকে একটা ছোট্ট, সোনার নাকফুল পরিয়ে দিলো। তারপর সবাই একস্বর হয়ে বন্দনা করলো:
বিধি মাতা, বিধি মাতা, তুমি এসো মন খারাপ করে,
বিধি মাতা, বিধি মাতা, বিদায় নিয়ো তুমি আনন্দ-ভেলায় ভেসে।
গ্রামের মানুষের বিশ্বাস যে, প্রত্যেক নবজাতকের জন্মের সময় বিধিমাতা স্বয়ং হাজির হন এবং তিনিই নবজাতকের লিঙ্গ নির্ধারণ করে থাকেন। শ্রী মাতা যদি চঞ্চলা আর হাসিখুশি থাকেন, তাহলে মনে করা হয় যে, স্বামীর সাথে তার মধুর সম্পর্ক বজায় আছে। আর তাহলে মা তড়িঘড়ি করে একটা কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে স্বামীর কাছে দৌড় লাগাবেন। অন্যদিকে মা যদি একটু গোমড়া মুখে, মন খারাপ করে থাকেন, তার অর্থ এই যে, স্বামীর সাথে তার ঝগড়া-বিবাদ চলছে;তাই স্বামীর ঘরে ফিরে যাবার জন্য তার কোনো তাড়াহুড়া নেই। ফলে মা ধৈর্য্য সহকারে একটা পুত্রসন্তান প্রসব করবেন। মহিলারা আবারো গেয়ে ওঠে:
বিধি মাতা, বিধি মাতা, তুমি এসো মন খারাপ করে
বিধি মাতা, বিধি মাতা, বিদায় নিয়ো তুমি আনন্দ-ভেলায় ভেসে।
শ্রী বিধিমাতা মনে হলো খুব কাছাকাছিই ছিলেন, আর মহিলাদের এই বন্দনাও তার কানে পৌঁছালো। এর এক পক্ষকাল পর, পুরো’র মা একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো। খুবই আবেগ ও আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হলো, অনেক অনেক আনন্দ-উল্লাস হল। পুরোদের পরিবারের দূর দূর-সম্পর্কের আত্মীয়রা পর্যন্ত তাদের বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশিদের কাছ থেকে অভিনন্দন পেতে লাগলো। অবশ্য একটা বড় দুশ্চিন্তা পুরো’র মাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। তার এই ছেলে ‘ত্রিখাল’ হয়ে জন্মেছে, অর্থাৎ তিন-তিনটা কন্যার পর ছেলেটার জন্ম হয়েছে। গ্রহ-নক্ষত্রের ফেরে পুরোদের পরিবার তাই দেব-দেবীদের কোপানলে পড়তে পারে। এই ধরনের পুত্রসন্তান হয় নিজেই অল্প বয়সে মারা যায়, না হয় ওরা ওদের বাপ-মা অথবা ভাইদের আয়ু কমিয়ে দেয়। সুতরাং শ্রী বিধিমাতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য গ্রামের মহিলারা আবারো পুরোদের উঠোনে জড়ো হয়। বড় একটা কাঁসার থালায় বড়সড় একটা ফুটো তৈরি করে, নবজাতক পুত্রকে এই ফুটোর মধ্য দিয়ে দুইবার গলিয়ে নেওয়া হলো আর বন্দনা করা হলো: ‘এই যে, একপাল ত্রিখাল আসছে- এক পাল ত্রিখাল!’ এসব আচার-রীতি পালনের পর মা একটু আশ্বস্ত হয় যে, তার পুত্র ত্রিখাল হলেও দীর্ঘজীবী হবে।
পুরো’র বয়স এখন পনের। ওর অঙ্গে-প্রতঙ্গে, শরীরময় সর্বত্র- রক্তের এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস ঢেউ দোলাচ্ছে। ওর স্তনমুকুল বেড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে, ওর কামিজ শরীরের সাথে একেবারে আঁটোসাঁটো হয়ে আছে। কাছের একটা হাট থেকে পুরো ফুলে ফুলে ছাপা কাপড় কিনে নতুন কামিজ বানিয়ে নিয়েছে। সেই সাথে মানানসই একটা ওড়না। কামিজ আর ওড়নায় সে অভ্রের ভারী কাজও করিয়ে নিয়েছে।
পুরো’র সখীরা ওর কাছে ওর বাগদত্ত রামচন্দ্রের বর্ণনা করেছে; হবু স্বামীর সেই শারীরিক বর্ণনা পুরোর মনে গভীরভাবে ছাপা হয়ে আছে। একান্তে, নিভৃতে যখনই বর্ণনা করা সেই মুখটা সে মনের চোখে দেখতে পায়, ওর দুই গাল লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে।
পুরো’র এখন বাড়ির বাইরে একা একা বের হওয়া নিষেধ। দুই গ্রামের মধ্যে অনেক মানুষের নিয়মিত যাতায়াত আছে; তাই পুরোর মা’র শঙ্কা যে, রামচন্দ্রের গ্রামের কেউ হয়তো পুরোকে পথে পথে, ঘুরে-ফিরে বেড়াতে দেখে ফেলবে। সতর্ক হওয়ার অবশ্য আরো একটা কারণ আছে- মুসলমানেরা এখন বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। দিন-দুপুরের প্রকাশ্য দিবালোক ছাড়া হিন্দু মেয়েরা সাধারণত ঘরের বাইরে বের হয় না।
পুরো প্রায়ই তার বাবার ক্ষেত-মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে পার হয়ে, দুই গ্রামের মধ্যকার পায়ে হাঁটা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। সখীদের সাথে, প্রতিবেশি মেয়েদের সাথে ঘোরাফেরা করে, পালংশাক তুলতে যায়।
মাঝেমধ্যে ও জামগাছটার কাছে চলে যায়, ওটার ডালপালা ধরে ঝাঁকিয়ে, গাছের তলায় অনেকক্ষণ ধরে জাম কুড়ায়। বান্ধবীদের সাথে গল্পে মশগুল থাকলেও ওর চোখজোড়া রামচন্দ্রের গ্রামের দিকে চলে যাওয়া, পায়ে-হাঁটা পথটার ওপর আটকে থাকে। মনে মনে পুরো প্রার্থনা করে, আজ যেন রামচন্দ্র এই পথ ধরে যায়, যাতে করে সে তার হবু স্বামীকে একবার একটু ভালো করে দেখে নিতে পারে। শুধু এই চিন্তাটুকুতেই তার বুকের ধুকপুকানি অনেকখানি বেড়ে যায়, হৃৎপিণ্ড দৌড়াতে শুরু করে। এরপর, তার বর হতে চলা যুবকটিকে স্বপ্নে দেখে দেখে পুরো’র রাতগুলো পার হতে থাকে।
একদিন পুরো সখীদের সাথে বাইরে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছিল। নতুন স্যান্ডেলজোড়া পায়ে পরায় খানিকক্ষণ পর ওর গোঁড়ালি কেটে বসে যায়। পায়ে ব্যথা নিয়ে পুরো সখীদের থেকে খানিকটা পিছনে পড়ে, আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। ওর সখীরা ফিরতি রাস্তা ধরে গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। গলিত সীসার মতো গোধূলীচ্ছটা পশ্চিমাকাশে গাঢ় হতে শুরু করেছে। পায়ে-হাঁটা, আঁকাবাকা পথটা নীচ দিয়ে চলে গেছে; ঝাঁকড়া, বুনো ঝোপে পথের একটা অংশ অদৃশ্য হয়ে আছে। পুরো দেখতে পেলো, তার সখীরা অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে। ওর ডান পায়ের গোড়ালীতে বড় একটা ফোস্কা পড়ে গেছে। জুতোজোড়া হাতে নিয়ে, পুরো ত্রস্ত-ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করে।
সখীরা পুরোর সাথে ঠাট্টা-মজা করে, আর এই বলে খোঁচায় যে, ফোস্কাটা ওর ডান পায়ে পড়েছে কেননা, ওর শরীরের ডানপাশটা নাকি বামপাশের তুলনায় বেশী ভারী। ওরা বলে, ওর ডান হাতটা নাকি ওর বাম হাতের তুলনায় একটু বড়। দুষ্টুমী করে সখীরা আরো বলে: ‘তা, তোর বিয়ের সময় চুড়িগুলো হাতে ঢোকানোর সময় মজাটা টের পাবি।’ সাথেসাথে মনের চোখে পুরো সেই দৃশ্যটা দেখতে পায়- হাতির দাঁতে তৈরি লাল শাখা-চুড়ি ওকে পরানোর জন্য মেয়েরা জোর-জবরদস্তি করছে। বড় চুড়িটা সহজে হাতে ঢুকে গেলো, ভালো কথা। এরপর ছোটগুলো কোনমতে বামহাতে পরানো গেলেও, ডানহাতে চুড়িগুলো কিছুতেই গললো না। যে নাপিতানি’র ওপর চুড়ি পরানোর দায়িত্ব পড়েছিল, সে পুরোর হাতে তেল মালিশ করে, শাখাকে জোরসে তার ডানহাতে ভরে দেবার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেল। জোরাজুরিতে আবার শাখা-চুড়ি ভেঙ্গে যাবে না তো? এতো চাপ চুড়িটা সহ্য করতে পারবে তো? বুকের মধ্যে ওর ধুকপুক করে ওঠে। দাম্পত্য জীবনের শুভ প্রতীক, ঐশ্বরিক আশীর্বাদ এই শাখাচুড়ি। একটাও যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলেই সর্বনাশ! তখন বুঝে নিতে হবে, বড় কোনো বিপদ আসছে- অকাল বৈধব্যের সম্ভাবনাই বেশি। পুরো রাগত দৃষ্টি হেনে ওর ডান হাতটার দিকে তাকালো। ওর হাতের চুড়ি কেন ভেঙ্গে যাবে? না, মোটেই তা হবে না। মনে মনে সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলো, ওর হবু স্বামী রামচন্দ্র যেন অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকে- একশো হাজার বছর, কি তারও বেশি, লাখো লাখো বছর। ‘হে ভগবান, আমার হবু স্বামী যেন যুগ যুগ বেঁচে থাকে- হাজারো, লাখো বছর যেন বেঁচে থাকে!’
এরপর আচমকা পুরো’র তার গ্রামের সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়, যাকে চুড়ি পরানোর সময় শাখাচুড়িটা সতিসত্যি ভেঙ্গে গিয়েছিল। আশেপাশে জড়ো হওয়া মহিলারা সাথে সাথে ‘রাম রাম’ ধ্বনি তুলে, মেয়েটার হবু স্বামীর কুশল কামনা করতে শুরু করেছিল। এরপর, সোনার চিকন তারে সেই চুড়িজোড়া লাগিয়ে, মেয়েটাকে ঐ চুড়িটাই পরিয়ে দেয়া হলো। যেন এভাবে তার হবু স্বামীর খন্ডিত জীবনকে জুড়ে দেওয়া হলো। এরকম অদ্ভুতসব চিন্তাভাবনা আর কল্পনার মধ্যে মশগুল ছিলো পুরো। ঠিক সেই মুহুর্তে বামপাশের পিপুল গাছের আড়াল থেকে সহসা এক যুবক বের হয়ে আসলো, এসে একবারে রাস্তার মধ্যেখানে পথরোধ করে দাঁড়ালো। পুরো দেখলো, ছোড়া এই গ্রামেরই মুসলমান যুবক রশিদ, অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী বাইশ-চব্বিশের এক যুবক। শয়তানি-ভরা একটা বাঁকা হাসি তার ঠোঁটে। আর তার চোখজোড়া পুরো’র সদ্য অঙ্কুরিত স্তনযুগলের ওপর নিবদ্ধ।
ভূত দেখার মতো কেঁপে উঠে, ভয়ার্ত একটা চিৎকার দিয়ে উঠে পুরো, রশিদকে পাশ কাটিয়ে ঝাড়া দৌড় লাগালো। গ্রামের প্রান্তসীমায় যখন সে তার সখীদের নাগাল পেলো, ততক্ষণে সে হাঁপিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, আতঙ্কে চোখ-মুখ রীতিমতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ভাগ্যিস রশিদ ওর গায়ে হাত লাগায়নি, ওকে কিছু বলেনি! ‘তা, ওটা কি একটা ছোকরা ছিল, নাকি আস্ত একটা বাঘ?’ সখীরা সুযোগ পেয়ে আবারো পুরোকে খোঁচাতে শুরু করে।
ভয়ে, আতঙ্কে পুরো’র তখন জানে জান ছিল না। ‘তুই তো দেখছি আস্ত একটা হাঁদা’, বান্ধবীদের একজন হুল ফোটালো, ‘তোর তো ভাগ্যে ভালো যে, ওটা কোনো ভালুুক নয়! বাঘ তো শিকার পেলে খুবলে খুবলে খায়। আর ভালুক কিন্তু মেয়েদের ধরে ওর গুহায় নিয়ে গিয়ে, এমন আচরণটা করে, যেন মেয়েটা তার বিয়ে করা বউ!’
বান্ধবীরা সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
দৃশ্যটা কল্পনা করে পুরোর গা রি রি, ঘিন ঘিন করে কেঁপে ওঠে। কোন্ সে হতভাগী যার একটা ভালুকের সাথে বিছানায় যেতে হবে! এটা নিয়ে যত বেশি সে ভাবলো, তত সে ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। পুরো তার মনের চোখে রশিদের সুঠাম, লোমশ শরীর আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দেখতে পায়। এরপর সম্বিৎ ফিরে পেতেই, গ্রামের গলিপথে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সখীদের রিনরিন হাসির আওয়াজ ওর কানে আসে।
এ ঘটনার দু’দিন পর, পুরো শিম তুলতে ক্ষেতে-মাঠে ঘুরে বেড়ালো। দু’মুঠো শিম তুলে সে কাছের কুয়োতলায় গেল। শিমগুলো ভালো করে ধুয়ে নিয়ে, একটা কচি শিম মুখে দিতেই একটা শব্দ শুনতে পেয়ে সে সামনের দিকে তাকালো। একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রশিদ সোজাসুজি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো’র মনে হলো, ওর পা দুটো থেকে কেউ যেন সব রক্ত টেনে-শুষে নিয়েছে।
‘ভয় কিসের, সুন্দরী? আমি তো তোমার দাস!’ রশিদের মুখে আগের মতো শয়তানীপূর্ণ বাঁকা হাসিটা লেগে আছে; ওর কথা বলার মধ্যে দুষ্টামির ভাব।
রশিদকে দেখে পুরো’র বিশালকায় ছাইরঙা ভালুকের মতো মনে হলো। ভালুকটা কি তার হাত দু’টো সামনে বাড়িয়ে দেবে, আর বড় বড় নখরযুক্ত হাতে পুরোকে টেনে লোমশ বুকে জড়াবে? ও কি ধারালো ঐ নখ দিয়েই পুরো’র গলায় আদর করতে চাইবে? ও কি তাকে টেনে-হিঁচড়ে ওর গুহায় নিয়ে যাবে…. আর তারপর….?
গ্রামের দুইজন লোক ঐ পথে বাড়ি ফিরছিল। তাতেও রশিদ ভয় পেল না, ক্ষান্ত দিল না; চোখে-মুখে একটা শক্ত, বাঁকা কামুক হাসি নিয়ে, সে যেখানে ছিল- সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। পুরো লাল লাল টমেটোর ঝুড়ির ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে, ওখান থেকে দৌড়ে পালালো। এরপর বড় বড় পা ফেলে সখীদের কাছে চলে গেল।
সমস্ত দিনটা পুরো খুব ভয়ে ভয়ে কাটালো, সারাটা রাস্তা সখীদের হাত আঁকড়ে ধরে থাকলো। মাঝেমাঝে নিজেদের ছায়া দেখেও কেঁপে কেঁপে উঠলো। সামান্য কোনো শব্দেই চমকে চমকে উঠলো। তবে এই নিয়ে পুরো ওর বাবা-মা’কে কিছু বললো না। ওর সখীরা বলেছিল, এগুলো এমন কোনো বিষয় নয় যে বাবা-মাকে জানাতে হবে, অভিভাবকের কানে তুলতে হবে। সখীরা বলেছিল যে, সব ব্যাটা মানুষই যুবতী মেয়ে-মহিলাদের আড়ে-টারে দেখে, কিংবা সোজাসাপ্টা চোখে চোখ রাখে, আর নিজেদেরকে ওদের গোলাম, ওদের দাস বলে বর্ণনা করে। ও ধরনের আবোলতাবোল কথা, বালখিল্যতাকে গুরুত্বের সাথে নিতে নেই। ব্যাটা মানুষকে বকরবকর করতে দাও! রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে কি কেউ রাস্তায় হাঁটা বন্ধ করে দেবে?
ঐ দিন পুরোদের গ্রামের ছয়-সাত বছরের একটা ছেলেকে পাগলা কুকুরে কামড়ে দিল। গলি-মহল্লার মহিলারা মিলে ছেলেটার ঘাঁয়ের ওপর লাল মরিচ বেঁধে দিল। মরিচের তেজে পাগলা কুকুরের দাঁতের বিষ কেটে যায়। পুরো যখন খবরটা শুনলো, তখন ওর মনে হলো- শুকনোঝাল গুড়ো করে রশিদের চোখের মধ্যে ছুঁড়ে মারে। যতবার রশিদের ঐ লোলুপ দৃষ্টি, কামুক চেহারা তার মনে পড়লো, ততবার রাগ তার একেবারে মাথায় উঠে গেল। এদিকে সখীরা পুরো’র হাত ধরে টানাটানি করলো, কিন্তু তার আর ক্ষেতের দিকে যাবার সাহস হলো না।
পুুরো’র বিবাহের দিন ঘনিয়ে আসছিল। ওর বাবা মেহমানদারী করার জন্য ঘি-ভর্তি অনেকগুলো টিনের বাক্স, আর বস্তা বস্তা ময়দা মজুদ করে রেখেছে। ওর মা নতুন নতুন জামাকাপড় দিয়ে, আর সিয়াম থেকে আনা খাঁটি রেশমের লাল ফুল তোলা পোশাক দিয়ে, বিভিন্নরকম হলুদ পোষাক দিয়ে মেয়ের জন্য কাঠের বড় সাদা সিন্দুকটা ভরে রেখেছে। ওড়নার কাপড় কুঁচি দিতে দিতে, পুরো’র মায়ের আঙ্গুলের অগ্রভাগ রীতিমতো ব্যথা হয়ে উঠেছে।
বাড়ির পেছনের দিকে, ভেতর-কামরায়, পুরো’র বিয়ের পণ হিসেবে সবমিলিয়ে পিতলের একান্নটা বাসন-কোসন চকচক করছে। এগুলো বিয়ের দিন ছেলেপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সেসব দিনে ক্রুশে ফুল তুলে, বিভিন্ন নকশা করার খুব চল ছিল। পুরো ক্রুশে তোলা ফুল জুড়ে জুড়ে, একটা বড় বিছানার চাদর বানিয়ে ফেললো। নিজ হাতে সে গুনো-তার পেঁচিয়ে ফুল বানাতে শিখেছিল। পণের জন্য সে নিজ হাতে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঝুড়ি, ডালি আর বসার ছোট মোড়াও বানিয়েছিল।