ছোটগল্প: জানালার নাটক // ইলসে আইশিংগার, ভাষান্তর নন্দিনী সেনগুপ্ত

এক মহিলা জানালায় দাঁড়িয়ে বাড়ির বাইরে চারদিকে দেখছিল। নদীর দিক থেকে বয়ে আসা হালকা বাতাসে নতুন কোনো সংবাদ বা বার্তার ইঙ্গিতমাত্র নেই। মহিলার চোখের দৃষ্টিতে কৌতূহল; এমন কৌতূহল যা খুব সহজে নিবৃত্ত হয় না। মহিলার বাড়ির সামনে একটাও সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটেনি। কেউ গুলিতে আহত হয়ে উল্টে পড়ে গেছে, এমন কিচ্ছুটি হয়নি। ফলে মহিলার কৌতূহলের নিবৃত্তি বিষয়ে তেমন কোনো উপকার হয়নি। তাছাড়া ওই মহিলা থাকে বাড়িটার সবচেয়ে উপরের তলার ঠিক নিচের তলায়, রাস্তা থেকে অনেকটাই উপরে। ফলে শহরের রাস্তার কথাবার্তা, হট্টগোল কিছুই সেভাবে শোনা যায় না অত উপরে। যা ঘটার সব নিচেই ঘটে যায়। মহিলা জানালা থেকে সরেই যাচ্ছিল, এমন সময়ে লক্ষ্য করল যে তার উল্টোদিকের বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটি ঘরের আলো জ্বালিয়েছে।

এখনও দিনের আলো আছে বেশ। ফলে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না যে ঘরটার আলো জ্বলছে, যেমন দিনের আলোতে রাস্তার আলো জ্বললেও বোঝা যায় না সেভাবে। কিন্তু এত আগে আলো জ্বালাবার কারণ কি? এ যেন গির্জা থেকে শোভাযাত্রা বেরোবার অনেক আগেই জানালায় মোমবাতি জ্বালিয়ে দেবার আচার পালনের* মত কতকটা। মহিলা জানালাতেই দাঁড়িয়ে রইল। বৃদ্ধ লোকটি জানালাটা খুলে একটু মাথা নাড়ল। ‘আমার দিকে তাকিয়ে নাড়ল কি?’… ভাবতে লাগল মহিলা। মহিলার উপরের তলার ফ্ল্যাটটা ফাঁকা আর নিচের তলার ফ্ল্যাটে একটা ওয়ার্কশপ আছে, যেটা এই সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে। মহিলা নিজেও মাথাটা একটু নাড়ল। বৃদ্ধ মানুষটিও আবার মাথা নাড়ল।

বৃদ্ধ মানুষটি নিজের কপাল স্পর্শ করল একবার। সম্ভবত খেয়াল করল সে যে তার মাথায় টুপি নেই। মানুষটি ঘরের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আবার উপস্থিত হল সে জানালায়। মাথায় টুপি, গায়ে কোট। লোকটা মাথার টুপি একটু তুলে হাসল। তারপর পকেট থেকে এক টুকরো সাদা কাপড় বের করে নাড়তে লাগল। প্রথমে হালকাভাবে, তারপর প্রচণ্ড আগ্রহভরে জোরে জোরে নাড়তে শুরু করল। কাপড়ের টুকরোটা নাড়তে নাড়তে জানলা দিয়ে বিপজ্জনকভাবে বাইরে ঝুঁকে পড়ল। এতটাই ঝুঁকে পড়ল যে লোকটা পড়ে যেতে পারে উপর থেকে। যে কেউ ঘাবড়ে যাবে ওই অবস্থায় লোকটাকে দেখে। মহিলা জানালা থেকে একটু পিছিয়ে গেল। এই পিছিয়ে যাওয়াটা যেন বৃদ্ধ লোকটাকে আরও উৎসাহী করে তুলল। লোকটা কাপড়ের টুকরোটা ফেলে দিল। লোকটা নিজের গলায় পেঁচানো স্কার্ফটা খুলে ফেলল। একটা বিশাল, রঙচঙে স্কার্ফ… লোকটা স্কার্ফটা জানলার বাইরে হাওয়াতে জোরে জোরে পতাকার মত নাড়তে শুরু করল। মহিলা আরও এক পা পিছিয়ে গেল। লোকটা এবার নিজের মাথা থেকে টুপিটা খুলে ফেলল সজোরে এক ক্ষিপ্র ঝটকায়। তারপর স্কার্ফটা মাথায় পাগড়ির মত পেঁচিয়ে ফেলল। তারপর দু’ হাত কোনাকুনি এক্স অক্ষরের মত রাখল নিজের বুকে, যেন হৃদয় স্পর্শ করছে, তারপর মাথা নিচু করে অভিবাদন করল। তারপর মাথা তুলেই নিজের বাম চোখ একটু কুঁচকে বন্ধ করে তাকালো, যেন তাদের মধ্যে একটা গোপন ব্যাপার আছে।

   মহিলার বেশ মজা লাগে বিষয়টা দেখে। এমনকি একটু একটু ভালো লাগতে থাকে ব্যাপারটা; কিন্তু পরক্ষণেই সে লক্ষ্য করে লোকটা হঠাৎ মাথা উল্টে শীর্ষাসনের ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। তালি দেওয়া ভেলভেটের প্যান্ট পরা শীর্ণ পা দুটো দেখা যায় জানালাতে। লোকটা আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বপূর্ণ মুখটায় লেগে আছে উষ্ণতা; লাল হয়ে গেছে মুখটা পরিশ্রমে। কিন্তু এত কিছু দেখবার আগেই মহিলা তাড়াতাড়ি পুলিশকে ফোন করে। বৃদ্ধ লোকটির আচরণ একেবারেই স্বাভাবিক মনে হয় না তার। লোকটা আবার পাশের জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তার নানা শব্দ, ট্রামের শব্দ ইত্যাদির মাঝেই তিনটে গলির পরে বেরিয়ে আসা ডাকাত ধরবার স্কোয়াডের পুলিশের গাড়ির তীব্র হর্নের শব্দ পায় ওই মহিলা। ফোনে মহিলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেনি; তার কণ্ঠস্বর খুব উত্তেজিত ছিল। ফলে থানা থেকে ডাকাত ধরবার গাড়ি পাঠানো হয়েছে।

    বৃদ্ধ লোকটা এখন হাসছে। মুখের বলিরেখাগুলো ভীষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পর মুহূর্তে লোকটা মুখটা দু’ হাত দিয়ে মুখটা মুছে নেয়। মুখটা এখন গম্ভীর; সামনে দুটো হাতের পাতা এভাবে ধরে রেখেছে, যেন হাতে একটা কাপ আছে; যেন আগের মুহূর্তের হাসিটুকু মুছে নিয়ে লোকটা দু’ হাতের পাতা দিয়ে তৈরি করা একটা কাপের মত আকৃতির আধারের মধ্যে ঢেলে রেখেছে। লোকটা হাতে ধরা কাল্পনিক আধার উল্টে ছুঁড়ে ফেলে দেবার ভঙ্গি করে।

বাড়ির নিচেই পুলিশের গাড়ি এসে গেছে। জানালার সামনে ওই বৃদ্ধ লোকটির নাটুকেপনা থেকে কোনওমতে নিজেকে প্রায় ছিন্ন করে নিয়ে মহিলা নিচে দৌড়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে। নিচে পৌঁছে সে দেখে যে পুলিশের গাড়ি ঘিরে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। পুলিশ গাড়ি থেকে নামার পরে ওই মহিলার এবং পুলিশের পেছন পেছন প্রচুর লোকজন ভিড় করে সঙ্গে আসতে থাকে। পুলিশ ভয় দেখিয়ে ভিড় সরাবার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের লোকজন বলতে শুরু করে যে তারা নাকি সবাই ওই বাড়ির বাসিন্দা। সবাই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে পুলিশের সঙ্গে। কেউ কেউ  বৃদ্ধ লোকটির দরজা অবধি গিয়ে ভিতরে যেতে চায়। কেউ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নজর রাখে পরিস্থিতির দিকে।

অনেক বার দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অবশেষে পুলিশের লোক তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। তাছাড়া সম্ভবত দরজার বেলটাও খারাপ হয়ে গেছে, কারণ সেটাও বাজছিল না। পুলিশ যেরকম দ্রুততার সঙ্গে, সাবধানে এবং নিশ্চুপে কাজ সারল, সেরকম পরিষ্কার কাজ যে কোনো চোরডাকাত কিম্বা অনুপ্রবেশকারীর জন্য ঈর্ষণীয়। সামনের ঘরে ঢুকে দু’ জন সাবধানে পায়ের বুট খুলে ধীরে ধীরে চুপচাপ এগোতে লাগল।

এখন বাইরে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। তারা এগোতে এগোতে সামনে একটা কাপড়চোপড় রাখবার আলমারি পেরিয়ে করিডোরের শেষে আলোর রেখা দেখতে পায় ফ্ল্যাটের মধ্যে। সেদিকে এগোতে থাকে পুলিশের দুই রক্ষী। মহিলাও তাদের পেছন পেছন যেতে থাকে পা টিপে টিপে। দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে যায়।

বৃদ্ধ লোকটা ওদের দিক থেকে পেছন ফিরে এখনও জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা মাথায় একটা বড় সাদা বালিশ ধরে আছে। তারপর বালিশটা একটু নিচে রাখবার ভঙ্গি করছে। কাউকে যেন ইঙ্গিত করছে ঘুমোতে যাবার জন্য। মেঝে থেকে কার্পেটটা তুলে একদিকের প্রান্ত কাঁধের উপরে জড়িয়ে রেখেছে। লোকটা একবারও পিছনে ফিরে তাকায়নি পুলিশের রক্ষীরা ঘরে ঢোকা সত্ত্বেও। লোকটা কানে শোনে না একেবারেই। শুনতেই পায়নি কোনো শব্দ। রক্ষীরা একদম লোকটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটার কাঁধের উপর দিয়ে মহিলা বাইরের দিকে তাকায়। নিজের ঘরের অন্ধকার জানালাটা দেখতে পায় সে। তার ফ্ল্যাটের নিচের ওয়ার্কশপ, সে যেমন ভেবেছিল, সত্যিই এখন বন্ধ। কিন্তু তার ঠিক উপরের তলার ফ্ল্যাটে নতুন কারা যেন এসেছে। তার নিজের ফ্ল্যাটের জানালার ঠিক উপরের তলার জানালাটিতে আলো জ্বলছে। বাচ্চাদের খাট দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। একটা বাচ্চা ছেলে খাটে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটার কাঁধেও একটা বালিশ, কাঁধে জড়ানো কম্বল। বাচ্চাটা লাফাচ্ছে, হাত নাড়ছে, মনের খুশিতে মুখে নানা রকম শব্দ করছে। বাচ্চাটা হেসে উঠল। মুখের উপর দিয়ে বুলিয়ে নিল নিজের দুই হাতের পাতা। তারপর সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। নিজের হাতের পাতাদুটো কাপের মত আকারে ধরে রেখেছে সে। নিজের হাসিটুকু যেন ধরে রেখেছে সেই কাপে। পরমুহূর্তে বাচ্চাটা সেই কাল্পনিক কাপ থেকে সর্বশক্তি দিয়ে যেন হাসিটুকু ছুঁড়ে দিল পুলিশের রক্ষীদের মুখের দিকে।

[ Das Fenstertheater গল্পের অনুবাদ]

*মধ্য ইউরোপে প্রাক-বড়দিন সময়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের সময় গির্জা থেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে ও নানা সাজসজ্জা সহযোগে শোভাযাত্রা বের হয়। সেই শোভাযাত্রাকে সম্মান জানানোর জন্য পথের ধারের জানালায় ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হয়।

লেখক পরিচিতি: (Ilse Aichinger) ইলসে আইশিংগারের জন্ম ১৯২১ সালের ১লা নভেম্বর ভিয়েনাতে। আরেক যমজ বোনের নাম হেলগা। বাবা লুডভিগ আইশিংগার ছিলেন শিক্ষক। মা বার্থা ক্র্যামার শিশুচিকিৎসক। মায়ের দিক থেকে তাদের মধ্যে ইহুদী বংশধারা থাকলেও তারা বেড়ে উঠেছিলেন ক্যাথলিক পরিমণ্ডলে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩৮ সাল নাগাদ  ইহুদীদের উপর যখন দমন পীড়ন নেমে আসে, আধা-ইহুদী হিসেবে ইলসেকে নানা সামাজিক বয়কটের মুখে পড়তে হয়। এমনকি পড়াশুনো বন্ধ করে ক্রীতদাসীর মত বোতামের কারখানায় শ্রমদান করতে হয়। যুদ্ধ শেষ হবার পরে ১৯৪৫ সালে আবার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন। লেখালেখির শুরু এই সময় থেকেই। ১৯৫১ সালে ‘গ্রুপে ৪৭’ নামে সাহিত্যিকদের সমিতিতে তিনি আমন্ত্রণ পান। এই সমিতি যুদ্ধ পরবর্তী অস্ট্রিয়াতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ে কাজ করছিল। সেখানেই ইলসের সঙ্গে আলাপ হয় জার্মান কবি গুন্থার আইশ-এর এবং ১৯৫৩ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ইলসের ছোটগল্প জার্মান পাঠকদের মনে এক পাকা আসন করে নেয়। বক্তব্যের তীব্রতার জন্য ইলসেকে ‘কাফকার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ’ বলে বর্ণনা করা হত। যদিও অনেক সমালোচকের মতে ইলসের লেখনী মানুষের দুঃখকষ্ট তুলে ধরবার ক্ষেত্রে বহুবার কাফকাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। পঁচাত্তর বছর বয়সে ইলসে বার্লিনের লিটারারি কলোকুইয়ামের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। ২০১৬ সালের ১১ই নভেম্বর ভিয়েনাতে তার দেহাবসান ঘটে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top